লেখা:অনামিকা দাস রিমঝিম।
দশম শ্রেণির ছাত্র রোহানকে বেশ চিন্তিত লাগছে আজ। বিষয়টি খেয়াল করলো তার বাবা রফিক সাহেব।
একসময় রফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
-রোহান, কী হয়েছে তোমার? কিছু নিয়ে ভাবছো মনে হচ্ছে।ব্যাপারটা কী আমার সাথে শেয়ার করা যায়? আমায় বলো, দেখি সাহায্য করতে পারি কিনা তোমায়।
-হ্যাঁ বাবা।আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। আসলে ম্যাম বলেছে কাল ক্লাসে সবাইকে কুরবানি নিয়ে কিছু বলতে হবে।সেটা কোনো ঘটনা, গল্প বা স্মৃতি যা কিছু হতে পারে। কারণ ইদের ছুটির আগে কাল লাস্ট ক্লাস। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না কী বলব।
-আচ্ছা বুঝলাম। তাই এতক্ষণ ধরে এই সমস্যার সমাধান খুঁজছিলে কী ওই বিরক্তিকর জায়গায়,মানে ফেসবুকে?
-হ্যাঁ। ভাবছিলাম কিছু পেয়ে যাব হয়ত। কিন্তু এই বিষয়ে তেমন কিছু দেখছি না ফেসবুকে। ফ্রেন্ডরা অনেকেই নিজেদের কুরবানির গরু,ছাগলের সাথে সেল্ফি আপলোড করেছে। আর কারটার দাম কত বেশি
এসব নিয়ে লিখেছে। আমিও কি এই ধরণের কিছু বলব ক্লাসে ?আমাদের গরুর বিবরণ?
-ছিঃ ছিঃ! এসব কি বলছিস? আমার ছেলে হয়ে এসব কিভাবে বলতে পারলি বলতো?
– সরি বাবা।ভুল হয়ে গেছে। তুমিই বরং আইডিয়া দাও।আসলে কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না তাই ভুল করে করে বলে ফেলেছি।
-আচ্ছা, তাহলে একটা গল্পই বলি শোন,
গ্রামের একজন গরিব চাষী তার বউ ছেলে নিয়ে বেশ কষ্টেই দিন চালাতো। মানুষের জমিতে কাজ করত চাষী। কিন্তু এত কষ্টের মাঝেও নিজের একমাত্র ছেলেকে পড়াশুনা করাত। তাকে বলতো,”বাবা,একদিন তুই অনেক বড় হবি,বড় চাকরি করবি, ভাল মানুষ হবি।আমার স্বপ্ন এইডা বাবা। তুই পূরণ করিস। ”
ছেলেও পড়াশুনাতে বেশ ভালই ছিল।খেলার সময় খেলত, পড়ার সময় পড়ত।
চাষীর নিজের সম্বল বলতে দুইটি গরু আর একটা ছাগল ছিল। ছোট্ট ছেলেটি গ্রামের বন্ধু বান্ধবের সাথে যতটা সময় কাটাতো, তার চেয়ে বেশি সময় কাটাতো এই তিনটি প্রাণীর সাথে। মাঝে মাঝে বই নিয়ে পড়াতে যেত তাদের।চাষীর বউ তখন রেগে বলতো,”ওতবড় গরুরে তুই মানুষের পড়া পড়াবার যাস ক্যা বাপ। ওরা কি তোর কথা বুঝব?ওরা যেভাবে বড় হইসে তেমনই থাকব!আজাইরা পাগলামো করিসনা সোনা বাপ আমার।”
তখন ছেলেটা তার মাকে বলত,”আইচ্ছা মা,এরা এমনে বড় হইসে তাই এগরে আর পড়ালেখা শিখাতে পারুম না তাইতো? তাইলে এগরে যখন বাচ্চা হইবো, তারে আমি ছোট থেকেই পড়ালেখা করামু। ”
ছেলের কথা শুনে মা খিল-খিল করে হেসে উঠত।
এভাবে বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল দিন। দেখতে দেখতে চাষীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে গেল।
বাবা মায়ের চোখের মণি ছিল সে। সারা মাসে যে দুই দিন মাছ খেত,তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পিসটা থাকত ছেলের জন্য।ছেলেকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নিত না তার বাবা।বলত, “যা কষ্ট করা লাগে আমি করমু বাপ,তুই ভাল করে পড় খালি।”
তবে বাবার এত কষ্ট দেখে চুপ করে থাকতে পারতনা ছেলে। তাই গরু ছাগলকে মাঝে মাঝে মাঠে নিয়ে যাওয়া,খেতে দেওয়া,দেখাশুনা করা এই কাজগুলো করত।আসলে ছেলেটি পশু খুব ভালবাসত। খুব মায়া ছিল পশুদের উপর।
একদিন বাড়ির গাভীর এক বাছুর হলো। সেদিন চাষীর ছেলের আনন্দ দেখে কে!
সবাইকে ধরে ধরে বলছে গরুর বাচ্চা হওয়ার কথা। যেন তার নিজের ভাই হয়েছে। ছেলের আনন্দ দেখে চাষীর চোখে জল চলে এলো।
দিন যেতে থাকলো, ছেলেটির মায়াও বাড়তে থাকলো বাছুরের উপর।মাকে বলত , “মা, হেয় তো বাচ্চা। ওহন এরে আমি পড়ামু। আমার মত করে মানুষ করমু।” মা আবার ছেলের কথা শুনে হাসে।
সারাদিন গরু ছাগল নিয়ে মেতে থাকত ছেলেটা।শুধু ছেলে না, চাষী আর চাষীর বউও পালিত পশুগলোকে খুব ভালবাসত। গরুর যা দুধ হতো অর্ধেক হাটে বেচতো আর অর্ধেক রাখতো ছেলের জন্য।ছেলে এখন বড় হয়েছে। তাই বেশি পুষ্টির দরকার।
বাছুরটি বড় হতে থাকলো।ছেলেটি তাকে এমন ভাবে পালন করত যেন সে নিজের ছোট ভাই। বাছুরটিও যেন ছেলেটির কথায় উঠত বসতো।আসলে সব প্রাণীই ভালবাসা পেলে মিশে যায়। ঠিক তেমনই।যখন রাতে হারিকেনের আলো নিয়ে বাছুরকে পড়াতে বসত, বাছুরও যেন মাথা নেড়ে নেড়ে পড়া করত। সেই দৃশ্য দেখে চাষী তার বউকে বলত,”দ্যাখ বউ,কি মায়া ..!”
এরপর কিছুদিন পরেই বাছুরের মা গরুটি মারা গেল হঠাৎ। চাষী, তার বউ,আর ছেলেটি খুব কষ্ট পেল। রাতে সেদিন খেলোনা পর্যন্ত ছেলেটি। কাঁদতে কাঁদতে বাছুরের কাছে গিয়ে বলল,”তুই কষ্ট পাবি না। একদম কষ্ট পাবি না। আমি তোরে দেখমু। তোরে খাওয়ামু আমি। একি! তুই কানতাছোস ক্যান।তুই থাম …থাম কইতাছি।
তারপর দৌড়ে নিজের বাবাকে ডেকে এনে বলল,”বাবা,ওরে তুমি থামাও। ওর চোখ দিয়া কালো জল পড়তেছে ক্যান বাবা,,ওই অনেক কষ্ট পাইতাছে না বাবা?”
চাষী বলল,”হ রে বাপ! ওর কষ্ট হইতাসে। তাই কানতাসে। তুই আর কান্দিসনা রে বাপ।আমি যে সহ্য করবার পারি না।”
এই বলে চাষীও সেদিন খুব কাঁদলো।
দিন যেতে থাকলো । বাছুরটিকে আদর দিয়ে মায়া দিয়ে বড় করছিল ছেলেটা। বেশ বড়ও হয়ে গেছিল। গরুটার উপর ছেলেটির এত মায়া ছিল যে নিজের হাতে খাইয়ে দিত,গল্প করত,মাঠে নিয়ে যেত। কারণ সে বুঝেছিল মা মরা একটা মানুষের যত কষ্ট হয়,একটা গরুরও ততই কষ্ট হয় ।
এরই মধ্যে ছেলেটি বুকে বেশ কয়েকদিন থেকে ব্যাথ্যা শুরু হতে থাকলো। ধরা পড়লো কঠিন অসুখ।চিকিৎসার জন্য অনেক খরচ।অপারেশন করাতে হবে।তাই ছেলেটির অনিচ্ছা স্বত্বেও তার চিকিৎসার জন্য ছাগল আর একটি গরুকে কুরবানির হাটে বেচে দিলো চাষী ।
এত টাকা দিয়েও সব টাকা যোগার হলো না। ডাক্তার বলল বিদেশে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করাতে হবে। তারজন্য আরও কিছু টাকার দরকার। এরপর শেষ সম্বল বলতে ছিল শুধু সেই মা মরা গরুটা। যাকে চাষীর ছেলে জান দিয়ে ভালবাসতো আর চাষী নিজেও তাকে ছেলের মত ভালবাসতো। কিন্তু এই মুহূর্তে চাষী নিরুপায়। সে মনে মনে ভাবলো,তার ছেলের জীবন বাঁচাতে হলে আরেক ছেলেকে যে কুরবানি দিতেই হবে।
ছেলেটি কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। সে কেঁদে বলছিল,”বাবা,আমি মইরা যাই তাও তুমি ওরে নিয়া যাইও না। আমার জানের চেয়েও বেশি ভালবাসি ওরে আমি। দয়া করে বাবা,তোমার পায়ে ধরতাসি ….।”
চাষী তখন নিজের কসম দিয়ে বলল,গরুটা কুরবানির হাটে বেচতেই হবে। কারণ, নয়তো তার ছেলেকে বাঁচাতে পারবে না।একথা বলা ছাড়া উপায় ছিল না চাষীর। কসম না দিলে কিছুতেই তার ছেলে রাজী হচ্ছিল না।
তারপর আর ছেলেটি কিচ্ছু বলতে পারলো না।বাপের সাথে হাটে গিয়ে টাকার বিনিময়ে তার প্রানপ্রিয় গরুকে তুলে দিতে হলো অন্য লোকের হাতে। তারপর শেষ বারের মতো আদর করে,চোখ মুছতে মুছতে পেছন ঘুরে খালি পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো…..
এই পর্যন্ত গল্প বলে রফিক সাহেব খেয়াল করলেন যে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আর সাথে রোহানের চোখ দিয়েও।চোখ মুখে রোহান বলল,
“ভালবাসার এত জোর বাবা? সত্যি আজ একটা জিনিস বুঝলাম। সবচেয়ে বড় কুরবানি দেয় তো তারা,যারা এত মায়া দিয়ে বড় করা জীবগুলোকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে।
আর এসব অসহায় জীবের সাথে সেল্ফি তুলে যারা মজার,হাসির ক্যাপশনের সাথে আপলোড করছে ফেসবুকে, তারা কী আসলেই মানুষ?
ছিঃ!
আচ্ছা একটা মানুষ যদি জানতে বুঝতে পারত যে কয়দিন পর তাকে কুরবানি দেওয়া হবে তাহলে তার কেমন লাগত? সৃষ্টিকর্তাতো তার সৃষ্ট সকল জীবকে কিছুনা কিছু বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। তাহলে সেই প্রাণী গুলোও হয়ত বুঝতে পারে যে তাদের সময় শেষ। তাহলে তারা তখন কত কষ্ট পায়,আর মানুষ তাদের সাথে এমন জঘন্য আচরণ করে। গায়ের উপর শুয়ে, মাথার উপর পা দিয়ে ছবি তোলে।ভাবতেই কেমন লাগছে।তোমার গল্প থেকে অনেক কিছু শিখলাম বাবা।
তবে একটা প্রশ্ন ছিল, আচ্ছা বাবা সেই সময় গরুটাও কী বুঝে গিয়েছিল যে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ মানে সেই ছেলেটার জন্য তার জীবন দিতে হচ্ছে? সে কিছু অনুভূতি প্রকাশ করেছিল না শেষ সময়ে….?”
ঠিক তখন হঠাৎ বেশ আনমনে ভাবে কাঁদতে কাঁদতেই রফিক সাহেব বললেন, ” হ্যাঁ পেছন ফিরে আমি ওর চোখে জল দেখেছিলাম। ঠিক যেমন ওর মা মরার দিন ওর চোখ বেয়ে কালো জল পড়ছিল ……”
অসাধারণ সুন্দর একটি গল্প।আজ কুরবানির ইদ আর এমন দিনে গল্পটা পড়ে সত্যিই খুব ভালো লাগছে। অনামিকা আপু অন্য ধর্মের হয়েও খুব সুন্দর করে মুসলিম ধর্মের এই কুরবানির ইদ নিয়ে একটি গল্প লিখেছেন,খুব ভালো লাগলো। রোহানের বাবা বুঝতে পারছে যে তিনি কতবড় কুরবানি দিয়েছেন,কারণ,কুরবানির মূল কথা এটাই যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে হবে।শুধু গরু টাকা দিয়ে কিনে কুরবানি দিলেই হয়ে যায় না। তার প্রতি মায়া থাকতে হয়। আর এখনকার যুবসমাজ ফেসবুকে সেল্ফি আপলোড দিয়ে নিজেকে যেভাবে নিচু করছে সে কথা আর নাই বলি। বানানে কোন ভুল নেই। যত্ন নিয়ে লেখা।
তবে” চোখ মুখে রোহান বলল” এই লাইনটি অপরিষ্কার লাগল।
অনেক ধন্যবাদ আপু ♥
ওইটা “মুছে” হতো 🙁
হ্যাঁ যত্ন নিয়েই লিখার চেষ্টা করেছি। 🙂
দোয়া করবেন।
দারুণ।
প্রাণীর প্রতি এতোটা মায়ামাখা একটি গল্প।
একটি লাইন হৃদয় ছুঁয়ে গেছে,
“সবচেয়ে বড় কুরবানি দেয় তো
তারা,যারা এত মায়া দিয়ে বড় করা জীবগুলোকে
অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে।”
আসলেই সত্যি।
খুব খারাপ লাগে, যখন দেখি আধুনিক তরুণ তরুণী অন্যকে দেখানোর জন্য সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেয়।
কোরবানি তো এক আল্লাহর জন্য।এটি একান্তচিত্তে মন থেকে করতে হয়।তাহলে অন্যকে দেখাতে হবে কেনো?
ধন্যবাদ
অনেক ধন্যবাদ ♥
বাস্তবধর্মী গল্প।ভালো লাগলো।
আজকাল মানুষ কুরবানি দেয় লোক দেখানোর জন্য।
কার গরু কতো বড়, কতো টাকা এসব দেখে।গরুর সাথে
সেল্ফি তুলে ফেইসবুকে দেয়।এসবকেই প্রাধান্য দেয়।
তারা এটা বুঝে না কুরবানি মানে এটা না।
কুরবানী হচ্ছে ত্যাগ।
গরু বড় কোন ফ্যাক্ট না।আসল হচ্ছে আল্লাহকে সন্তুষ্টি করা।
গল্পটি পড়ে কিছুটা খারাপ লাগলো।
যারা গরু লালন পালন করে তারা কতো কষ্ট করে।তাদেরও মায়া হয়ে যায় গরুর প্রতি।
অবশেষে ভালোবাসা ত্যাগ করতে হয়।
ব্যাথ্যা–ব্যথা
শুভ কামনা রইলো।
ধন্যবাদ আপু ♥
এরকম একটা গল্প অনেকদিন থেকে লিখব ভাবছিলাম।
তাছাড়া আমি পশু পাখি খুব ভালবাসি। মায়াও বেশি।
তাদের কারও কিছু হলে খুব কষ্ট লাগে।
সেটাই স্বাভাবিক।
যাই হোক,আপনাদের অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সময় নিয়ে পড়ার জন্য।খুব যত্নে লেখার চেষ্টা করেছি কিন্তু তবুও ২/১ টা ভুল হয়েছে। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। 🙂
দারুণ গল্প। মায়া দিয়ে ঘেরা ছিল। কিছু ম্যাজিক লাইনের কারণে গল্পটা আরও ভাল হয়েছে। কিছু ভুলত্রুটি ছিল, তবে সেটা বড় কিছু না।
অনেক অনেক ধন্যবাদ 🙂