গল্প লেখকঃ
আপসারা নূর তিথি
(এপ্রিল – ২০১৮)
……………………
শাপলা আর রাজুর বয়সে খুব বেশি পার্থক্য নেই। শাপলার বয়স এগারো আর রাজুর আট। রাজু একটা ব্রাক স্কুলে পড়াশোনা করলেও শাপলার সুযোগ হয়ে উঠেনি শিক্ষার আলোতে আসার। সারাদিন ঘরের কাজ করতে করতেই দিন কেটে যায়। প্রতিদিন রাজু স্কুল থেকে ফেরার পর শাপলা ওকে নিয়ে পুকুর পাড়ে বসে স্কুলের গল্প শুনে। শাপলার খুব ইচ্ছে হয় স্কুলে ছুটে যেতে কিন্তু ওর হাত পা বাধা। মা তো ওর দুই বছর বয়সের পিচ্চি ভাইটাকে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকে। আর কোনো কাজ এদিক-সেদিক হলেই ওর সাথে বকাবকি করে এমনকি গায়েও হাত তুলে। ওর খুব কষ্ট হয়। কিন্তু রাজুর জন্য সব মেনে নেয়। বড় ভালোবাসে যে ভাইকে। মা এর সাথে অনেক অনুনয় বিনয় করে ভাইকে স্কুলে পড়াতে পারছে।
“বুবু জানোস আইজকা আমাগোর বড় মিডাম কি কইছে?”
– কি কইছে?
– কাইল নাকি পয়লা বৈশাখ?
– এইদিনে সবাই সকালবেলা পান্তা ভাতের লগে ইলিশ মাছ ভাজা খায়। মাইয়ারা বাসন্তি রং এর শাড়ি পইড়া মেলায় যায়। মেলাতে চুড়ি, আলতা কত্তকিছু কিনে। আর পোলারা ঢাকঢোল এর ছবিওয়ালা জামা পইড়া মেলায় গিয়া খেলনা কিনে।
– হেরা ম্যালা আনন্দ করে। নারে ভাই?
– হ তা করে। কাইল তো গঞ্জে মেলা বইবো। তুই আমারে লইয়্যা যাইবি? বাপরে তো কইলে লইয়া যাইবো না।
– আইচ্ছা যামু নি। মায় যহন দুপুরে খোকনরে লইয়্যা ঘুমাইবো তহন যামুনি।
– বুবু একটা কথা কই?
– ক।
– কাইল আমারে ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়াইবি?
শাপলা কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এ নিষ্পাপ চাহনীর দিকে তাকিয়ে ওর না করার সাহস হয়ে উঠে নি। . . মা একটা কথা কমু?
-তো ক না পোড়ামুখি। অমন করার কি আছে?
– বাপেরে কইবা কাইল একটা ইলিশ মাছ আনতে? ইলিশ খাইবার মন চাইতাছে।
– তোর বাপের মাথা চাবাইয়া খা। কত্তকিছু খাইবার শখ জাগে তোর? পোড়ামুখি, রাক্ষুসি। সর আমার সামনেত্তে। রাইতের বেলা তর বাপ আইলে তারে আবার এইডা কইয়া মানুষডার পেরেশানি বাড়াইস না।
শাপলা মুখ কালো করে বের হয়ে আসে। ও খুব ভালো করে জানে যেহেতু মা রাজি হয় নি সেহেতু বাবাকে বলে আর কোনো লাভ নেই। কিন্তু ভাইকে কি জবাব দিবে ও? এতো শখ করে খেতে চাইলো! শাপলা এইসব ভাবতে ভাবতে আনমনে গ্রামের কাঁচাপথ ধরে হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর যেতেই দেখলো জব্বার জেলে মাছ ধরতেছে। শাপলার চোখমুখ উজ্জ্ল হয়ে উঠলো। শাপলা ক্ষীন আশা নিয়ে বললো, জবুর চাচা আমারে একটা ইলিশ মাছ দিবা গো?
– জব্বার মিয়া চোখ কপালে তুলে বললো, “তুই ইলিশ মাছ দিয়া কি করবি?
– রাজুএ খাইতে চাইছে। দাও না গো একটা মাছ।
– জব্বার মিয়া গাল চুলকে বললো, আইচ্ছা তয় বিকালে বাড়িত আইস।
– অহন দিয়া দাও না।
– আরে মাইয়া এই পানিতে ইলিশ পাওয়া যায় নাকি? কাইল নদীতে গেছিলাম। ইলিশ ধরছি। বাড়িত আছে। বিকালে আইলে তোরে একটা দিমুনি।
– আইচ্ছা আমুনি।
শাপলা খুশিমনে বাড়ি ছুটে গেলো। ভাই এর আবদার সে পূরণ করতে পারবে। . . বিকালে ঘরের সব কাজ করে উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ছুটে চলে গেলো জব্বার মিয়ার বাড়িতে।
– জবুর চাচা ও জবুর চাচা। আমি আইছি।
– কিডা! শাপলা আইছোস? আয় ঘরে আয়।
– শাপলা ঘরে ঢুকে বলে, “চাচিএ কই? দাও মাছ দাও। যাইগা। মায় আবার চিল্লাইবো।
– জব্বার মিয়া ঘরের দরজা আটকে দিলো। শাপলা স্বাভাবিকভাবেই বললো, “চাচা দরজার খিল দাও ক্যা? আমি যামুগা তো।
– মাছ নিবি আর মাছের দাম দিবি না?
– আমার কাছে তো দাম নাই। কেমনে দিমু?
– সেইটা আমি দেহাইতাছি।
– চাচা ও চাচা। কি করো তুমি? আমার গায়ে হাত দাও ক্যা? আমারে ছাইড়া দাও। আমি যাইগা। চাচা ছাড়ো আমার লাগছে। ও চাচা তোমার পায় পড়ি।
– শাপলার কোনো অনুনয় বিনয় জব্বারের মনে রেখাপাত করে না। একসময় ছোট দেখে একটা ইলিশ মাছ হাতে ধরিয়ে দিয়ে শাসিয়ে দেয় এই ঘটনা যেনো ও কাউকে না বলে। তাহলে খুব খারাপ হবে। শাপলা বুঝতে পারে না ওর সাথে কি ঘটেছে। ও শুধু বুঝে ওর সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। ও ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। চোখের সামনে সব ঘোলা হয়ে আসে। হঠাৎ করে সব অন্ধকার হয়ে যায় ওর কাছে।
. . জ্ঞান ফেরার পর শাপলা নিজেকে ওদের গ্রামের সরকারি হাসপাতালের একটা বেডে আবিষ্কার করে। ও ভয়ার্ত কন্ঠে বলে, নার্স আফা। ও নার্স আফা আমি এনে কেমনে আইলাম?
– শোনো মাইয়ার কথা! কাল যে তোমারে ধর্ষণ করা হইলো ঐগুলো কি কিছুই মনে নাই? আবার জিজ্ঞাসা করো এখানে কিভাবে আসলা?
রেহানা!” একটা গম্ভীর পুরুষালি গলার ধমক শুনে চুপসে যায় নার্সটি। পুরুষালি গলাটি এই হাসপাতালের বড় ডাক্তারের। তোমার কি কমনসেন্স বলতে কিছু নেই? তুমি এতোটুকু বাচ্চারে এইসব বলছো। ডাক্তার সাব ধর্ষণ কি জিনিস? হাসিহাসি মুখে অল্পবয়সী এক তরুণী রুমে ঢুকে বলে, তেমন কিছু না খুকি। তুমি আমার সাথে আসো তো। তোমার সাথে আমি গল্প করবো। কৌশলে তরুণী ডাক্তার শাপলার কাছে পুরোটা শুনে শিউরে উঠে। মানুষ এতোটা নিচ কি করে হতে পারে!
আফা আমি বাড়িত যামু। মাছটা কই? আমার ভাই খাইবো। গিয়া রানতে হইবো তো। কাল রাতে শঙ্খ যখন বাসায় ফিরছিলো তখন এই মেয়েটাকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো। মাছ কোথায় পাবে এখন? শঙ্খ তাই বুদ্ধি করে বললো, তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে তাই আমি মাছটা রান্না করে রেখেছি। তারপর বাসায় ফোন দিয়ে একজনকে বললো হাসপাতালে কিছু ইলিশের টুকরো ভাজা নিয়ে আসতে।
ডা. তৌহিদ শঙ্খকে ডেকে পাঠালো। মেয়েটার ব্যাপারে কিছু জানলে? যা জেনেছি তা খুবই মর্মাহত। ওর ধর্ষণের খবরটা ধামাচাপা থাকাই বোধহয় ভালো। গ্রাম এলাকা। মেয়েটাকে ওরা বাঁচতে দিবে না। তার উপর ঘরে ওর সৎ মা। শাপলার কথা শুনে মনে হলো সেই মহিলার আচরণও খুব ভালো না। আই সি। তুমি বরং এক কাজ করো। মেয়েটাকে ওর বাসায় নিয়ে যাও। আর কাল রাতের জন্য বিশ্বাসযোগ্য কোনো ঘটনা তাদের বলে এসো। মেয়েটা বড় মিষ্টি। ওর উপর আর কোনো কালো ছায়া না পড়ুক।
শাপলা ঘরের আঙিনায় পা রাখতেই ওর মা অজগরের মতো ফোসফোস করতে করতে বললো, নবাবাজাদি কইত্তে আইছেন? কোন নাগরের লগে আকাম করতে গেছিলেন? এমন সময় ডা. শঙ্খ হাসিমুখে ঢুকে বললো, “আসসালামু আলাইকুম। ওকে ভুল বুঝবেন না। ওর ভাগ্য ভালো আমি ঠিকসময়ে ব্রেক কষতে পেরেছিলাম। তাই শুধু মাথায় আঘাত লেগেছে। সেইজন্যই কাল সারারাত হাসপাতালে ছিলো। এতোক্ষণে মহিলা লক্ষ্য করলো শাপলার কপালে ব্যান্ডেজ করা। রাজু দৌড়ে এসে শাপলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। মহিলা ঘরে ঢুকে যায়। শাপলা রাজুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “দেখ ভাই তোর জন্য আমি পান্তা আর ইলিশ আনছি।” রাজু দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে, “আমার লাইগা আনতে কই নাই। মজজিদে কিছু ভিক্ষুক আছে। আইজকা মার মৃত্যুবার্ষিকী না? গত বৈশাখের ঝড়ে যে মায় মরলো! তাই ওগোরে খাওয়ামু। মার লাইগা দোয়া করবো” শাপলা ঢুকরে কেঁদে উঠে। এই ব্যাপারটা ওর মাথাতেই আসে নি। ওর ভাইটা যেনো আজ খুব বড় হয়ে উঠেছে। দুই ভাইবোনের এরকম অশ্রুসজল দৃশ্য দেখে কখন যেনো ডা. শঙ্খেরও চোখ ভিজে উঠেছে। মেয়েটা এক কালবৈশাখীর আক্রমণে মাকে হারিয়েছে। নিজের উপর অজান্তেই যে কিছু বুঝে উঠার আগেই এরচেয়ে বড় কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে গেলো!
খুব সুন্দর লাগছে গল্পটা
ধন্যবাদ