জীবনচক্রের উত্থান
প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,761 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

গল্প: জীবনচক্রের উত্থান
লেখিকা: আফরোজা আক্তার ইতি

“চিকচিক করে বালি, কোথা নাই কাদায়ায়ায়া,
একধারে কাশবন, ফুলে ফুলে সাদায়ায়ায়া।”
মতিগঞ্জ প্রাইমারি স্কুল থেকে ভেসে আসছে কিছু ছোট বাচ্চাদের সমবেত কচিকণ্ঠের এই কবিতার সুর। খুকি ঘাটপাড়ে বসে কানখাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে এই অস্পষ্ট ধ্বনি। তার পাশেই পড়ে আছে ছোট্ট একটা কলস। তার মা যে তাকে সেই কখন পাঠিয়েছে ঘাট থেকে পানি তুলে আনতে তাসে বেমালুম ভুলে গিয়েছে। গালে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে সে স্কুল থেকে ভেসে আসা কবিতার ভাষা উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
-“কে গো ওইখানে?”
সম্বিৎ ফিরল খুকির। পাশ ফিরে তাকালো। বুড়িমা হাত কপালের উপর তেরছাভাবে তুলে তার সামনের ছোট্ট মেয়েটিকে চেনার চেষ্টা করছে। ক্ষণিক পরেই কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, “এইখানে বইসা কি করস গো বুড়ি?”
খুকি এবার ভীষণ খেপে গেল। চেঁচিয়ে বলল, “ছাই! আমি বুড়ি না, তুমি বুড়ি।”
বুড়িমা তার হাড় জিরজিরে আঙুল দিয়ে খুকির নরম চিবুক আলতো নেড়ে বলল, “ওরে পাগলি দেখ, আমারও দাঁত পইড়া গেসে, তোরও তো দুইখান দাঁত পইড়া গেসে।”
বুড়িমার কথা শুনে ফোকলা দাঁতে খিলখিল করে হেসে উঠল খুকি। কালই তার আরও একটা দাঁত পড়েছে। কি রক্ত বের হলো! দাঁতটাকে সে চুলার পাশে ইঁদুরের গর্তে ফেলে বিড়বিড় করে বলেছে, “ইঁদুরভাই, তোমার দাঁত আমাকে দাও, আমার দাঁত তুমি নাও।”
এখন সে কথা বললেই তার মুখে শোঁ শোঁ শব্দ হয়। মুখে পানি নিয়ে দু’দাঁতের মাঝ দিয়ে পানি ফেলে খুকি দারুণ একটা খেলা বের করেছে।
-“এইখানে বইসা বইসা কি করোস গো খুকি?”
-“মা পানি আনতে পাঠালো—-” কথা শেষ করার আগেই খুকি জিহ্বায় কামড় দিল। তড়িঘড়ি করে কলস নিয়ে ঘাটের পানি তুলে নিল সে।
বুড়িমা দেখে আফসোস করে বলে উঠল, “আহারে, এইটুকুন একটা ফুটফুটা মাইয়্যা, এতো ছোট বয়সেই এতো কাম। ওরে, তুই এতো ভারী কলসি নিতে পারবি রে?”
খুকি কোনোরকমে কাঁখে কলস তুলে কঁকিয়ে বলল, “বেশ পারব বুড়িমা।”
বুড়িমা বিড়বিড় করে উঠল। তাড়াতাড়ি রওনা দিল খুকি। মায়ের বকুনির ভয়ে বুড়ির বিড়বিড় তার কানে গেল না। সেই কখন পানি তুলতে পাঠিয়েছে মা, আর ও কিনা ঘায়ে এসে বসেই আছে! বুড়িমার কথা অবশ্য ঠিক। ক’মাস ধরেই খুকিকে সংসারের কাজ করতে হচ্ছে। মায়ের শরীর বেশ খারাপ। পাশের বাড়ির কাকীমা বলেছে, আর কটাদিন পরেই নাকি তাদের ঘরে একটা ছোট্ট বাবু আসবে। খুকি যেনো মায়ের সাথে সবসময় থাকে, মায়ের কাজে সাহায্য করে। খুকির এতে কষ্ট হলেও সে ভীষণ খুশি। কারণ, আর কিছুদিন পরেই তার খেলার সাথী আসবে। খুকি ঠিক করেছে তার বোন এলে পুরনো চাবি দেয়া পুতুল, আর লাল রঙের চুড়িগুলো দিয়ে দিবে বোনকে। আর ভাই হলে তাকে গতবার মেলায় বাবার কিনে দেয়া খেলনা গাড়িটা দিয়ে দিবে। কয়েকদিন ধরেই খুকি কড়ি খেলার জন্য একবাক্স শক্ত নুড়ি জমাবে ভাবছে, ভাই এলে তাকে নিয়েই বেশখানিক নুড়ি কুড়াতে পারবে বলে খুশিতে মন নেচে উঠল তার।
বাড়ির উঠানে পা দিতেই তার মা চামেলী চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাঁরে? তোর এখন আসার সময় হলো বুঝি?” খুকি তার মায়ের এমন প্রতিক্রিয়ার জন্য তৈরি হয়েই ছিল, মায়ের মন গলানোর ফন্দি সে রাস্তার মাঝেই এঁটে এসেছে। কলসটা কোনোমতে উঠানে রেখেই তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল, “ওমা, আমাদের ছোটবাবু কবে আসবে গো?”
তার মা লাজুক হেসে বলল, “ক’দিন পরেই আসবে রে খুকি।” পরক্ষণেই মুখের হাসি মুছে কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল, “তোর খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই নারে খুকি? ঘরের কাজ করতে হচ্ছে, ইশকুলটাও ছাড়তে হলো, খেলাধুলাও করতে পারছিস না।”
খুকি আবারো আদুরে গলায় বলল, “ও কিছু না মা। খুব ক্ষিদে পেয়েছে মা।”
“আহারে, আমার খুকির বুঝি ক্ষিদে পেয়েছে? নে বোস, গরম গরম মুড়ি ভেজেছি। গুড় মাখিয়ে খেয়ে নে।”
গুড়-মুড়ি মাখিয়ে খানিকটা মুখে পুরে খুকি বলল, “মা, গলায় যে আটকে যাচ্ছে। শুকনো মুড়ি খেতে পারছি না।” তার মা কিছু বলার আগেই সে আবার বলে উঠল, “মা, রাজুদের বাড়ি থেকে এক বাটি তরকারি নিয়ে আসি?”
মেয়ের এমন কথা শুনে চামেলীর চোখ ভিজে এলো। কতদিন ধরে মেয়েটা ভাত খেতে পাচ্ছে না, মুড়ি, চিড়া, শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করছে। ঘরে নেই একমুঠো চাল, যা দিয়ে নিজে খাবে, মেয়েটাকে খাওয়াবে। মেয়ের মলিন মুখে হাত বুলিয়ে বলল, “এই একবাটি মুড়ি নিয়ে যা, মুড়ি দিয়ে ওদের থেকে বাটিতে তরকারি নিয়ে আসিস।
খুকি মুড়ির বাটি আঁচল দিয়ে ঢেকে রাজুদের বাড়ির জন্য রওনা দিল। পথিমধ্যে বাবুলের সাথে দেখা। খুকি হাত নেড়ে তাকে থামাল।
-“বাবুলভাই, স্কুল ছুটি দিয়েছে?”
-“হুঁ, দেখছিস না হাতে বই-খাতা নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।”
-“আজ কি শিখালো ভাই?”
-“নামতা শিখিয়েছে।”
-“আমাকে শিখাবি?”
বাবুল মুখ ভেংচে বলল, “হুউউ, তোকে শিখাবো কেন? তুই আমাকে কি দিবি?”
খুকি বাবুলের এ স্বভাব জানে। বাবুলের ভারী চাই চাই অভ্যাস, বিমিময় ছাড়া সে কিছুই করে না। অথচ স্কুলে বাবুলই ভালো ছাত্র, তাই ওকেই জিজ্ঞেস করে অনেক কিছু শিখে নেয়। খুকি তার আঁচল সরিয়ে বলল, “মুড়ি খাবি বাবুলভাই?”
বাবুল বলল, “ওমন মুড়ি আমি খাই না।”
খুকি তার আঁচলের গিট দেওয়া নুড়িগুলো বের করে বলল, “অনেক খুঁজে এমন নুড়ি পেয়েছি, তোকে দিলাম। কড়ি খেলিস।” বাবুল ভীষণ খুশি হয়ে তাকে ১এর ঘরের নামতা শিখিয়ে দিল।
রাজুর মা খুকিকে দেখেই বলল, “আয়রে খুকি। কতদিন পর এলি!” খুকিকে দেখলে তার ভীষণ মায়া হয়। কি ফুটফুটে মিষ্টি একটা মুখ, আগে এদিকটা আসতো, পাকা পাকা কথা বলত খুকি আর সে শুনে হাহা করে হেসে উঠত। রাস্তার এক্সিডেন্টে বাবা মরে যাওয়ার পর মেয়েটা কেমন যেনো হয়ে গেল, পোয়াতি বউটাও তিনটা মুখ নিয়ে একার সংসারে হিমশিম খাচ্ছে।
-“ও কাকীমা, মা বলল মুড়িগুলো রেখে কিছু তরকারি দিতে।”
-“কাল রাতে কি খেয়েছিস?”
-“সিদ্ধ শাক আর আলু।”
চোখের কোণে পানি চলে এল রাজুর মায়ের। একটা প্লেট নিয়ে সকালের গরম ভাত আর একটু গোশতের ঝোল মেখে খুকিকে নিজ হাতে খাওয়ে দিল। খুকি পেটের ক্ষুধায় যেন পুরো হাঁড়িই সাফ করে দেয়। খাওয়া শেষে বাটিভর্তি ভাত আর তরকারি দিয়ে বলল, “খুকি রে, তোর মা’কে খেতে বলিস। এই শরীরে কিছু না খেয়ে থাকলে দুইজনেই মরবে।”
খুকি পথে যেতে যেতে চিন্তায় পড়ে গেল, এগুলো দেখলে তার মা ভীষণ বকুনি দিবে। মা কারো থেকে কিছু নিয়ে গেলেই রেগে যায়। আচ্ছা, মা কি পেটভরে খেতে পছন্দ করে না?
.
সকালে মানুষের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো খুকির। চোখ মুছে সে ঘরের দুয়ারে পা দিতেই একজন বলল, “ওরে খুকি! তোর যে ভাই এলো রে। আমাদের মিঠাই খাওয়াবি না?” খুকি খানিকটা বিষম খেল যেন। তারপর রেগে ছুটে বেরিয়ে পেছনের ঘরে চলে গেল মায়ের কাছে। মা কেনো এমনটা করল? মা’কে সে কতবার বলেছে সেও মায়ের সাথে গিয়ে হাট থেকে ভাইকে নিয়ে আসবে। তবে মা তাকে ফেলেই হুট করে অতো রাতে হাট থেকে ভাইকে নিয়ে এলো কেন? না, সে মায়ের সাথে একটুও কথা বলবে না সে শুধু তার ভাইকেই দেখবে।
খুকি কিন্তু ঘরে ঢুকে তার মা’কেই আগে দেখতে পেল। সারাঘর নজর ঘুরিয়েও তার ভাইয়ের দেখা পেল না। খুকির চিন্তা বুঝতে পেরে তার মা মুচকি হেসে আঁচল সরাল। ওমা! এতো দেখছি একহাত একটা বাচ্চা। কেমন দূর্বলভাবে গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। অথচ খুকি কিনা ভাবল, তার ভাইকে নিয়ে ঘাটের ধারে একবাক্স নুড়ি কুড়াবে, আমপাতার বাঁশি বানাবে। আশাহতভাবে ভাইয়ের তুলতুলে শরীর, ছোট্ট হাত-পা ধরে দেখতে গেলো সে। অমনি ভাইটা তার ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে বিড়ালছানার মতো ওয়ায়া করে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। খুকির ভারী মজা লাগল। তার মনে হলো, এ যেনো এক জীবন্ত পুতুল, যেটা চাবি ছাড়াই নড়ে উঠে।
.
চামেলীর চিন্তার অন্ত নেই। তার পাঁচদিনের খোকা কেমন যেনো দুর্বল, কিছুক্ষণ পরপর কেমন করুণ, চিকন সুরে কেঁদে উঠে। তাতে তার চিন্তা যেনো আরও বেড়ে যায়। খুকি তার ভাইকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। তার মাকে বলল, “মা খোকার শরীর এতো গরম কেন? তার মা রান্নাঘর থেকে চিন্তিতমুখে পট্টি নিয়ে আসে। কি করবে সে বুঝতে পারছে না। খোকার ডাক্তার আনারও পয়সা নেই। আজ মানুষটা বেঁচে থাকলে কি ভরপুর সংসারই না থাকতো তাদের! চোখের পানি মুছে সে বলল, “খুকি, তুই খোকার কাছে থাক। আমি মোয়াগুলো বেচে একটু পরেই আসব।”
মোড়লের বউয়ের কাছে একঝাঁকা মোয়া বেচে সে বেশকিছু টাকা পেল। তা দিয়ে বদ্যির থেকে জ্বরের বড়ি আর পথ্য জেনে নিয়েছে সে। বাকি টাকা দিয়ে কিছু চাল কিনে বাড়ি ফিরল।
দুয়ারে পা দিতেই খুকি ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “মা, ভাই যেনো কেমন করছে।”
ছুটে গিয়ে খোকাকে কোলে নিল চামেলী। কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে, গা এতো গরম যে কোলেই রাখা যাচ্ছে না। হৃদপিণ্ডটাও যেন ধুকপুক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আবার খুকির কোলে তাকে রেখে সে ছুটে গেল বাবুলদের বাড়িতে। গিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “ও বাবুলের মা। আমার ছেলেটা কেমন যেনো করছে। তাড়াতাড়ি চলো আমার সাথে।”
বাবুলের বাবা ঘরে ছিলেন। তিনি বের হয়ে বললেন, “কিগো, কি হলো? বাবুলের মা বাসায় নেই। ঘাটে কাপড় কাঁচতে গেছে।”
-“ভাই, আমার সাথে চলেন, খোকা কেমন যেনো করছে।”
-“খোকা কেমন করছে তা বাইরে দাঁড়িয়ে বললে বুঝব কি করে? ঘরে এসে স্থির হয়ে বলো।”
চামেলী ঘরে ঢুকে বলল, “ছেলেটার ক’দিন ধরেই জ্বর, আজ এতো বেড়েছে, খুব চিন্তা হচ্ছে।” বাবুলের বাবা তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। ইশ! বউটা এখনো কত সুন্দর! কতবারই না তাকে কাছে পাওয়ার কামনা করেছে সে। কখনো সুযোগ মিলে নি। আজ বাবুল স্কুলে, ওর মা-ও ঘাটে। সে চামেলীর হাত ধরে বলল, “একটা খোকার জন্য এতো চিন্তা? চাইলে আমি তোমাকে আরও খোকা এনে দিতে পারি।”
চামেলী আঁতকে উঠে তার দিকে তাকালো। কি বিশ্রি হাসি লোকটার মুখে। ছিহ! যেই লোকটাকে সে এতোদিন বড়ভাইয়ের চোখে দেখেছে আজ সে কিনা বিপদের সুযোগ নিয়ে—–। ছিহ! হাত ছাড়িয়ে মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে কাঁদতে একছুটে বাড়ি এলো সে।
খুকি আগের মতোই ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, “মা, ভাইয়ের শরীর এতো ঠাণ্ডা কেন?” তার মা তার কোল থেকে খোকাকে তুলে নিয়েই চুপচাপ বসে পড়ল। তার চোখের পানি আটকে আছে কারণ, এই ছোট্ট ক্লান্ত হৃদপিণ্ডটা ধুকপুকানি একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। খুকি এতো কিছু বুঝলো না, শুধু এটুকু বুঝলো, তার ভাইয়ের আগুনের মতো গরম শরীর হঠাৎ করেই বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া ভালো কিছু না। খোকা আর নড়ছে না। চুপটি করে ঘুমাচ্ছে যেমনটা বাবাকে সে শেষবার দেখেছিল। তার ভাই কি মারা গেছে? তাহলে মা কাঁদে না কেন? সে তার মা-কে হাত দিয়ে ঝাঁকালো, “ওমা, ভাইয়ের কি হলো?” তার মা পাথরের মুর্তির মতো খোকাকে শক্ত করে জড়িয়ে স্থিরভাবে বসে রইল।
.
খুকিদের ভাঙা বাড়ির উঠান মানুষে গমগম করছে, সবাই পাঁচদিনের মৃত নবজাতককে দেখতে ভিড় করেছে। দাওয়ায় ছেলেকে কোলে জড়িয়ে আগের মতোই স্থির হয়ে বসে আছে চামেলী। তার পাশেই তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে তার মেয়ে খুকি। ভিড়ের মধ্যে থেকে নানারকম গুঞ্জন উঠছে। সবাই মা-কে দোষ দিচ্ছে। খুকি বুঝতে পারছে না এতে মায়ের দোষ কী।
-“আহারে, জামাইডারেও খাইলি, ছোড পোলাডারেও খাইলি। তুই কি রাক্ষসী নাকি অপয়া?”
-“আমি ক’দিন আগেও কইলাম, বিয়া-শাদি কর। আমার কাছে ভালা পোলা আছে, তোগো তিনজনারেই দেখবো। আমার কতা হুনলে এইদিন দ্যাখতে হইতো?”
-“নিজে খাইতে পাস না বইলা পোলাডারে গলা টিপ্পা মারোস নাইতো?”
-“আরেহ জানেন ও কি করছে? আমি যহন বাসায় ছিলাম না, বাবুলের বাপের কাছে গেছিল। কি খারাপ মাইয়া। বাবুলের বাপ আমারে নিজের মুখে কইছে।”
এবার তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল চামেলী। চেঁচিয়ে দু’হাতে কাক তাড়ানোর মতো সবাইকে তাড়িয়ে দিল। “বউটা বুঝি পাগল হয়া গ্যাছে।” এই কথা বিড়বিড় করে বলতে বলতে সবাই উঠান ছাড়ল।
হ্যাঁ, চামেলী আসলেই পাগল হয়ে গিয়েছিল। দেখা গেল, পরদিন সকালে সে সন্তানের শোকে কাঁদার পরিবর্তে উঠানে বসে মহাসমারোহে চুলায় খই ভাজছে, চিড়া ভাজছে, মোয়া বানাচ্ছে, হাঁস-মুরগির ডিম, একঝাঁকা মুড়ি এসব নিয়ে হাটে বিক্রি করে আসছে। প্রতিদিনই তার পাগলামি চলতে লাগল। এক সপ্তাহ পরেই সে মেয়েকে আবার স্কুলে ভর্তি করালো। পাড়াপড়শি সারারাতই তার ঘরে হ্যারিক্যানে আলো জ্বলতে দেখে, কারণ সে রাত জেগে কাঁথা সেলাই করে। সকালে মেয়ে স্কুলে গেলে সে যায় হাটে চিড়া, মুড়ি, ডিম বেচতে। আবার বিকালে সে খই, চিড়া, মুড়ি ভাজতে বসে। রাত জেগে কাঁথা সেলাই করে ভালো দামে হাটে বিক্রি করে আসে।
খুকি এখন অনেক বড় হয়েছে। চামেলী প্রায়ই তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে, তার ছোট্ট খুকিটি আর খুকি নেই। খুকির হাসি আছে, তবে ফোকলা দাঁত নেই। খুকির ছোট্ট বেনুনিতে সাদা ফিতা বেঁধে দেয় তার মা। মুড়ি ভাজার সময় খুকি চুলোর পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, “মা, বলো তো, লিলি মানে কি?” চামেলী উত্তর না দিতে পেরে মুচকি হাসে। খুকি হেসে বলে, “এটা জানো না? লিলি মানে শাপলা। শাপলা আমাদের দেশের জাতীয় ফুল।” চামেলী বুঝতে পারে না জাতীয় ফুল মানে কি, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারে মেয়ে তার আল্লাহর রহমতে অনেক কিছু শিখেছে। সেও টুকটাক শিখে নিচ্ছে মেয়ের থেকে, এপর্যন্ত চামেলী দু’টো শব্দ শিখেছে খুকির কাছ থেকে, “অ্যাপল” মানে আপেল। “বল” অর্থ বল। এইদুইটা সহজ তো তাই!
.
দেখতে দেখতে পনেরোটি বছর কেটে গেছে। এই পনেরোটি বছর আগেও যারা চামেলীকে পাগল বলে বিদ্রুপ করেছিল, এখন তারাও খুকিদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের জন্য দু’হাত তুলে দোয়া করে যায়। খুকি এখন তাদের মতিগঞ্জ গ্রামের মস্তবড় ডাক্তার যে!

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

১৩ Comments

  1. রেবা

    ভালো লাগল গল্পটা

    Reply
  2. Md Rahim Miah

    কাদায়ায়ায়া-কাদা
    সাদায়ায়ায়া-সাদা
    তাসে-তা সে
    হুঁ-হ্যাঁ
    শুনে-শোনে
    অসাধারণ একটা গল্প পড়লাম, অনেক অনেক ভালো লেগেছে। শিক্ষণীয়ও বটে, মানুষ চেষ্টা করলে কি না করা যায়। গল্পের মাঝে সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। তবে সারারাত না জেগে অধেক রাত জেগে লিখে উল্লেখ করলে ভালো হতো। কারণ সারারাত জেগে কাঁথা সেলাই, সকালে আবার হাটে চিড়া, মুড়ি, ডিম বিক্রি করতে যায় আর বিকালে আবার খই, চিড়া, মুড়ি ভাজতে বসে, তাহলে উনি ঘুমান কখন? সঠিকভাবে না ঘুমিয়ে কি একটা মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারি নাকি? একজন বয়স্ক মানুষকে কমপক্ষে ৬ঘন্টা ঘুমানোর প্রয়োজন। লেখিকা উচিত ছিল সব দিকে ঠিক রেখে লেখা। যাইহোক আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইল

    Reply
    • আফরোজা আক্তার ইতি

      অসংখ্য ধন্যবাদ রাহিম ভাই আপনার গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য। সাদায়ায়ায়ায়া, কাদায়ায়ায়া আমি সেগুলো লিখেছি মূলত সুর করে আবৃত্তি বুঝাতে।
      আর হ্যাঁ, আপনি গল্পের মর্মার্থের দিকে খেয়াল না করে বেচারীর ঘুমের দিকে এতো নজর দিচ্ছেন কেনো ভাই? এতোটাও বিশ্লেষণ করলে তো সে কখন খায়, কখন ঘুমায় এগুলোও উল্লেখ করতে হবে! সে তার কাজের মাঝেই সময় করে ঘুমিয়ে নেয়। সাধারণত মানুষ যখন কোনো বিপর্যয়ে পড়ে, তখন দৈনন্দিন কাজ এবং নাওয়া-খাওয়ার প্রতি অসচেতন হয়ে পড়ে।
      আবারও অশেষ ধন্যবাদ পাঠককে আমার গল্পটি এতোটা মনযোগ এবং নিঁখুতভাবে পড়ার জন্য। ভালোবাসা নিবেন।♥

      Reply
      • Md Rahim Miah

        আমি জানি আপনে সুর করে বলেছিলেন, কিন্তু কবিতা তো সুর শেষে লাগিয়ে বলে না, সুর দিয়ে বলে গান। আর ঘুমের দিকে নজর না দিলে কি চলবে নাকি? কারণ অসুস্থতা হলে মানুষ নিয়মিত ঠিকভাবে কাজকর্ম করতে পারে না। অথচ উনি রাতদিন কাজ করে সুস্থ থেকে মেয়ে বড় করছেন, যা বাস্তবের সাথে মিলে না। আধা রাত লিখতে ভালো হত। তবে যতগুলো গল্প পড়েছি তাঁর মাঝে আপনারটা অনেক বেশি ভালো লেগেছে , অনেক শুভ কামনা রইল।

        Reply
  3. Tanjina Tania

    কাদায়ায়ায়া, সাদায়ায়া সুর করে পড়ার এই লাইনগুলো পড়তে গিয়ে ছোটবেলার কথা মনে পড়লো। প্রাইমারিতে আমরাও এভাবে পড়তাম। গল্পটা ভালো ছিলো। শুনে বানানটা শোনে হবে মে বি। শুভকামনা লেখিকা ।

    Reply
    • আফরোজা আক্তার ইতি

      তানিয়াপু অসংখ্য ধন্যবাদ। আসলেই এভাবে সুর করে কবিতাটি পড়ার মাঝে তৃপ্তি আছে। ভালোবাসা নিও।

      Reply
  4. Halima tus sadia

    অসাধারণ লিখছো।শব্দচয়নও ভালো
    গল্পের মাঝে নতুনত্ব পেলাম।
    স্বামী হারা সংসার করা চামেলীর জন্য বড় কষ্টের।কতো
    মানুষের কতো কথা শুনতে হয়েছে।
    বাস্তবেও এমন ঘটনা কম নয়।
    তবে শেষটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে দিয়েছে।
    আরও বিশ্লেষণ করতে পারতা।
    হুট করেই ডাক্তার হয়ে গেল খুকি।
    কিভাবে হলো এটা বলা দরকার ছিল।
    তবুও শুভ কামনা রইলো।
    এগিয়ে যাও,লেখার হাত ভালো।
    বড় লেখিকা হবা একদিন।

    বানানে কয়েকটা ভুল আছে

    বোস–বস
    আবারো–আবারও

    Reply
    • আফরোজা আক্তার ইতি

      এত্তগুলা শুকরিয়া হালিমাপু। হ্যাঁ, সীমিত শব্দসংখ্যার জন্য আর গল্পটি বাড়াতে পারি নি। তোমার গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু। আর ভুলগুলো শুধরে নিব।

      Reply
  5. অচেনা আমি

    আসসালামু আলাইকুম। গল্প প্রসঙ্গে কিছু কথা:
    সত্যি কথা বলতে গল্পটা তেমন একটা মুগ্ধ আমাকে করতে পারেনি। বেশ কিছু ভুল রয়েছে গল্পে। কিছু বিষয় গড়মিল লেগেছে। আচ্ছা একটা মানুষ পাগল হয়ে যাওয়ার পর কি তার দায়িত্ব – কর্তব্য কোনো বোধ থাকে? চামেলী পাগল হয়ে এতো দায়িত্ববতী কীভাবে হলো? তাছাড়া সারা রাত কাঁথা সেলাই, সারাদিন মুড়ি, চিড়া ভাজা আর বিক্রি করা। চামেলী তাহলে ঘুমায়টা কখন? বাস্তবতার সাথে মিল রেখে লেখা উচিত ছিল। চিহ্ন ব্যবহারেও কিছু কিছু ভুল রয়েছে। তাছাড়া কি/ কী এর ব্যবহার ঠিক নেই। নিচে ভুলগুলো লক্ষণীয় :
    কচিকণ্ঠে – কচি কণ্ঠে
    তাসে – তা সে
    সম্বিৎ – সম্বিত
    বলল – বললো
    গেসে – গেছে
    ঘায়ে – ঘাটে
    কটাদিন – ক’টা দিন
    একবাক্স – এক বাক্স
    হ্যাঁরে – হ্যাঁ রে
    বাবুলভাই – বাবুল ভাই
    বলত – বলতো
    খাওয়ে – খাইয়ে
    বাটিভর্তি – বাটি ভর্তি
    দুইজনেই – দু’জনেই/দুই জনেই
    সারাঘর – সারা ঘর
    একহাত – এক হাত
    আমপাতার – আম পাতার
    বিড়ালছানার – বিড়াল ছানার
    পাঁচদিনের – পাঁচ দিনের
    চিন্তিতমুখে – চিন্তিত মুখে
    একঝাঁকা – এক ঝাঁকা
    বেশকিছু – বেশ কিছু
    মিলে নি – মিলেনি
    কি বিশ্রি – কী বিশ্রী
    মুর্তির – মূর্তির
    হয়া – হইয়া
    এপর্যন্ত – এ পর্যন্ত
    এইদুইটা – এইই দুইটা
    মস্তবড় – মস্ত বড়

    আগামীতে আশা করি আরও ভালো হবে। শুভ কামনা।

    Reply
  6. Nafis Intehab Nazmul

    বর্ণনাভঙ্গি অসাধারণ। গল্পের মাঝখান টায় এসে আমার বড্ড হাসি পেয়েছিলো, যখন খুকি দেখল ছোট খোকা কে। ভেবেছিলো বড় হবে।
    বাট, গল্প টা কে একটা নিষ্ঠুর সমাজের রুপ দেওয়া হয়েছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা সম্ভব হয়নি। এতে আবার কেউ সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করেছে।
    খোকা মারা গেলে অপয়া ডাকও শুনতে হয়েছে।
    বাট, একটা বড় ভুল। খুকির ডাক্তার হওয়ার গল্প টা আরেকটু বড় করতে হত। হুট করে…… মানায় নি এটা। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি, সেখানে ডাক্তার হয়ে গেলো?
    মাঝখানে খুকির মায়ের পরিশ্রম টা কে বেশী বর্ণনা করার দরকার ছিলো। এখানেই মার্ক হারাবেন।

    Reply

Leave a Reply to আফরোজা আক্তার ইতি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *