লেখক: Akram Hussain Tahosin
(মার্চ – ২০১৮)
………………
গাজীপুর চৌরাস্তায় রাস্তা পার হওয়াটা একটু বিপদজনক। চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে। কিন্তু আজকে আমি বেপরোয়াভাবে রাস্তা পার হচ্ছি। যেকোনো সময় একটা গাড়ি এসে আমাকে পিসে দিয়ে চলে যাবে। রাত তখন ৮টা। সাইড থেকে একটা পিচ্চি আমাকে ডাকছে, – এই যে ভাইয়া….. ভাইয়া।
আমি গুরুত্ব না দিয়ে হেঁটেই যাচ্ছি। ছেলেটা আমার পিছন পিছন আসছে। কিছুক্ষন পর জিজ্ঞেস করলাম। – কিরে কি হয়েছে তোর?
ছেলেটা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমাকে একটু সাহায্য করবেন?
প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম টোকাই হবে। এখন মনে হচ্ছে আমার ধারণা ভুল। টোকাইরা চঞ্চল প্রকৃতির হয়! ওদের মনে দ্বিধা, ভয় ভীতি কম থাকে। কিন্তু এই ছেলেটার মধ্যে সংকোচ স্পষ্ট। দেখতে যথেষ্ট অমায়িক। চোখদুটো খুব মায়া মায়া। আমি চোখ থেকে চশমা খুলে ছেলেটিকে কিছুক্ষন দেখলাম। তারপর বললাম, – কি হয়েছে বলো….
ছেলেটা আঞ্চলিক ভাষায় যা বললো তা অনেকটা এরকম, “আমার বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট। দুইদিন আগে গাজীপুর বড় ভাইয়ের কাছে আসবো বলে ভুল করে সিলেটের ট্রেনে উঠে পড়ছিলাম। দুইদিন পর (আজ) অনেক কষ্টে সিলেট থেকে গাজীপুর আসছি। এখন আমার ভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না। কেঁদে কেঁদে বললো, আমি আমার ভাইয়ের কাছে যাব।”
ছেলেটার নাম সুমন। বয়স আনুমানিক আট কিংবা নয়। পরিবার খুব গরিব বলে ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে কাজের জন্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম, – সুমন কিছু খাইবা? ছেলেটা হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললো না। কিন্তু আমার খুব খিদে পেয়েছে তাই ওকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি মাত্র ৬২টাকা আছে। রুটি আর ভাজির অর্ডার করলাম। দুইজনে এতেই চলে যাবে।
এখন আমার প্রথম কাজ এই ছেলেটিকে কিভাবে তার বাড়িতে কিংবা ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এর আগে একবার এরকম হয়েছিলো। আনুমানিক ৪মাস আগের কথা। একটি লোক অজ্ঞান হওয়ার আগে তার ইউনিয়নের নাম বলেছিলো। তারপর গুগলে সার্চ দিয়ে অনেক কষ্টে লোকেশন পেয়েছিলাম। সেই লোকেশনে অসুস্থ লোকটিকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম। আজকেও হয়তো এমন কিছুই করতে হবে। খাওয়া শেষ করে ছেলেটিকে বললাম, আচ্ছা তোমার বাড়ির কারোর নাম্বার মুখস্ত আছে?
ছেলেটি জবাব দিলো, – আব্বার নাম্বার একটু একটু মনে আছে।
– তাইলে বলো দেখি…..
ছেলেটি নাম্বার বললো সেই নাম্বারে কল দিতেই এক সুকন্ঠি বালিকা কল রিসিভ করলো। আমি খুব বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার ভাই কিংবা অন্য কেউ দুইদিন আগে হারিয়ে গেছে?”
মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগলো। এই হাসি শুনে যে কারো টেনশন গলে পানি হয়ে যাবে। আমারও তাই হলো। আমি মেয়েটির কথা শুনার জন্য অপেক্ষা করলাম। সে হাসি থামিয়ে বললো, – ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন ভাইয়া।
সুমনের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিরে নাম্বার তো ভুল! সুমন কিছু বলছে না। খানিক সময় পর বলে উঠলো, ভাইয়া ১৫০এর জায়গায় ১০৫ হবে। আমি আবার কল দিলাম। এবার এক মধ্যবয়সী লোক কল রিসিভ করে অসহায় ভঙ্গিতে ‘হ্যালো’ বললো। আমি বললাম, সুমন নামে আপনার কোনো ছেলে আছে?
লোকটা হাহাকার করে বলে উঠলো, “হ্যা। আমার ছেলে কই?” বুঝতে পারলাম ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু এতো অল্পবয়সী একটা ছেলেকে বাড়ি থেকে কিভাবে একা ছাড়লো এটা আমার বোধোদয় হয় না।
যাইহোক সুমনের আব্বুর থেকে গাজীপুরে অবস্থানরত তার ভাইয়ের নাম্বার নিয়ে ফোন করে এনে দেখা করলাম। এখন সুমন খুব খুশি। মানুষের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ কয়েকভাবে হয়, কেউ ফিক করে হেসে দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে আবার কেউ মুখে মৃদু হাসির সাথে চোখে জল এনে প্রকাশ করে। সুমনের মুখে মৃদু হাসি চোখে কিছু একটা চকচক করছে। তার ভাই পুরো কেঁদে দিয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরলো, এই জড়িয়ে ধরার মধ্যে এক পৃথিবী ভালোবাসা আছে। যা কোনো বালিকার পাজরে নেই।
০ Comments