লেখক- মোঃ নাঈম হাসান
(জুন – ২০১৮)
……………
বৃষ্টিটা হই হই করেও হল না। দমকা বাতাস আর বড় বড় দুই চার ফোঁটা টপ টপ করে একটা মাঝারি ঝড়ের সম্ভাবনার ডাক দিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তের অবস্থাদৃষ্টে এমনটা মনে হচ্ছে না। তবে ইদানীংকার আবহাওয়া খুবই রসিক টাইপের হয়ে গেছে। মেয়েদের মত যখন তখন রং বদলায়। এই বৃষ্টি তো এই রোদ। এসব ভেবে এখন কাজ নেই। আকবর মিয়ার এখন কাজের সন্ধান পাওয়া দরকার। গত ৭ দিন ধরে হাওড়া স্টেশনের এদিক সেদিক কুলির কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে আকবর মিয়া। বয়স ষাটোর্ধ। কিন্তু কাজ না করে উপায় নেই। কাজ না করলে পেট চলবে কি করে। আসানসোল থেকে আসার পর কবে দুবেলা পেট ভরে খেতে পেয়েছে সে হাতে গুণে বলে দিতে পারবে।
“পুলাডা গেল কনে? এইহানেই ত বইতে কইছিলাম।” আকবর মিয়া খুঁজতে থাকে তার ১৪ বছরের নাতি শামসুলকে। স্টেশন ঘেঁষে থাকা বস্তি, আর যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা ছোট বড় অনেকগুলো দোকান। প্রতিদিন কয়েক লক্ষ লোক আসা যাওয়া করে এই স্টেশন ধরে। কলকাতা থেকে দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, পুনে, জয়পুর। একগাদা লোক এসে হাজির হয়, আর স্টেশনের কোন এক ট্রেন তাদেরকে নিজের উদরে ভর্তি করে নিয়ে যায়। আবার উদর খালি করে দিয়েও যায়। বিশাল স্টেশনের কোণায় কোণায় নজর দেয় আকবর মিয়া, লক্ষ্য তার নাতি শামসুলকে খুঁজে পাওয়া। বস্তির পাশে একদল মেয়ে ঘাসের উপর ভেজা শাড়ি শুকোতে দেয়। আকবর মিয়ার তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়।
-“বজ্জাত মাইয়া পুলাপান। কাম-কাজ নাই, সারাডাদিন ঘুমাইব, আর রাত্রে সাইজ্জা গুইজ্জা বাইর অইব।” নিজে নিজে বিড়বিড় করতে থাকে আকবর মিয়া।
-“দাদা, এইহানে কি খুঁজ, কইথন আইলা, কাজ পাইছ কিছু?”
শামসুলের গলা শুনে পেছনে তাকায় আকবর মিয়া।
-“কিরে, কোনহানো গেসিলি? ম্যাঘের জন্যি ত কাজ পাইলাম না, অহন রোদ উঠব। অহন খুঁইজ্জা দেহি, যদি পাই। তুই গেছস কোনহানো?” চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ।
-“দুই একটা প্যাসিঞ্জার পাই কিনা খুঁজতাছিলাম। দুইডা পাইছিলাম কাম। মোটে চইদ্দ টাকা আয় অইছে। একজনে ৪ টেকা আর এক ব্যাডায় ১০ টেয়া দিছে।” পকেট থেকে বের করে দেখায় শামসুল।
-“তরে না কইছি এই কাম না করতে। অইদিনও কুলিগো লগে ঝামেলা অইছে, আবার ঝামেলা অইলে এইহানে থাকন যাইব না।” খেঁকিয়ে উঠে আকবর মিয়া।
-“হ, তুমি এই শইল লইয়া কাম করবা, আর আমি চাইয়া দেখুম, এইডা কি অয় দাদা?”
অভিযোগ এর সুরে বলে শামসুলযে
আকবর মিয়া ভাল করে চেয়ে দেখে। বাপ-মা মরা ছেলে শামসুল। পড়ালেখা করালে এতদিনে অন্তত ৭ ক্লাস শেষ করতে পারত। কিন্তু কেমনে কি? বইখাতার খরচ, স্কুলের খরচ সে কিভাবে দেবে? দুবেলা খেতে পায়না। রন্ধবপুরে তার একফোঁটা বাড়ি। সেটাও সহুল মিয়ার কাছে বন্ধক আছে। সহুল মিয়ার টাকাই দেওয়া হয়নাই, শামসুলকে মানুষ করবে কি দিয়ে! এখন দুজনকে এই স্টেশনে পড়ে থাকতে হয়।
-“তুই যা, আমি আইতাছি। প্যাসিঞ্জার খুঁইজ্জা কাম নাই তর।”
ইদানীং পুলিশ ঝামেলা করে স্টেশনে থাকতে দেয়না। মারধর করে তুলে দেয়। তবু পুলিশের চোখ বাঁচিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয় আকবর মিয়াদের। শেষমেশ আকবর মিয়া মাসিক ২০ টাকা ভাড়ায় নকুল এর কাছ থেকে স্টেশনের পাশেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। নকুল স্টেশনের অলিখিত সর্দার। তার একটা দল আছে। তারই সমবয়সী ছেলে-ছোকরাদের দল। বিড়ি, সিগারেট আর গাঁজার পুরিয়ার ধোঁয়ায় মাতিয়ে রাখে স্টেশন চত্বর। জানালা দিয়ে আকবর মিয়া দেখতে পায়, গোল হয়ে দল পাকিয়ে বসে আছে নকুল এর দল আর অবিরাম ধোঁয়া ছাড়ছে । ঐ জায়গা থেকে বাতাসে আসছে বিড়ি, সিগারেটের ভ্যাপসা গন্ধ। একটু পর তাদের সাথে যোগ দেয় সেই মেয়েদের দল। পানের আশীর্বাদে লাল হয়ে যাওয়া দাঁতগুলো দেখিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে মেয়েগুলো। আকবর মিয়া আর দেখতে চায়না। জানালা বন্ধ করে দেয়। পাশে ঘুমন্ত শামসুল। তার একটাই ভয়, কোনদিন নকুলের দল আর সেই মেয়েগুলো শামসুলকে দলে ভিড়িয়ে ফেলে! দুদিন আগেও আমেনাকে শামসুল এর সাথে কথা বলতে দেখেছে আকবর মিয়া। সাবধান করে দেয় শামসুলকে। মেয়েগুলির মতলব ঠিক নেই। কখন কিসে জড়িয়ে ফাঁসিয়ে দেয়!
বৃষ্টির রাত। প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ছে। আকবর মিয়ার ছাত ফুটো হয়ে টপ টপ পানি পড়ছে। কাদা হয়ে যাচ্ছে মাটির মেঝে। কাদা মাটিতে ঘুমানো যায়না। জানালাটাও বন্ধ করা হয়নি। বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে পাল্লা দুটো টেনে দিতে হচ্ছে আকবর মিয়াকে। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে শামসুল। সারাদিন খাটনি হয়েছে ছেলেটার। জানালা বন্ধ করতে গিয়া অস্ফুটে ডাক শুনতে পায় আকবর মিয়া। ভুল শুনছে না ত? না, এটা নকুলের ডাক। বাইরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ডাকছে। দরজা খুলেই দেখতে পায় নকুল দাঁড়িয়ে আছে। মাঝরাতে হঠাৎ তার আগমনে একটু অবাক হয় আকবর মিয়া।
-“কিরে নকুইলা নাকি? ভিত্রে আয়। এত রাইতে কনথে আইলি? কিছু অইছে?” একটু ভীত শোনায় আকবর মিয়ার কন্ঠ।
-“কি খবর মিয়া? না কিছু অইব ক্যা? নকুইলারে কিছু করব হেই সাধ্য আছে নি কারো? তয় তমাগো কাম কাজ চলতাছে কেমন? ইনকাম আছে নি?” হঠাৎ নকুলের গলা ছোট হয়ে আসে।
-“হ চলতাছে, অত ভালা না। তয় তর টেকা বাকি রাখুম না।”
আকবর মিয়া আশ্বাস দেয়।
একটু কেশে দম নেয় নকুল। তার মুখ থেকে বিড়ির গন্ধ আসছে। তারপর প্যান্টের পকেট হতে পলিথিনে মোড়ানো দুটো পুরিয়ার প্যাকেট বের করে নকুল।
-“এইডা রাখো। স্টেশনে লোক বুইজ্জা বিক্রি দিবা। লাভের অর্ধেক ভাগ নিমু।”
-“এইডার ভিত্রে কি?”
-“কি জাইনা তোমার কাম নাই। তয় কেউ যেন না জানে। পুলিশে জানলে ধইরা লইয়া যাইব।” বলেই অন্ধকারে হারিয়ে যায় নকুল।
আকবর মিয়া দরজা লাগিয়ে প্যাকেট দুটো তার পুঁটলিতে গুঁজে রাখে।
-“দাদাজান নকুইলা আইছিল ক্যান? হেয় কি দিয়া গেল?” হঠাৎ শামসুল এর আওয়াজ শুনে পিলে চমকে ওঠে বুড়োর।
-“চুপ কইরা ঘুমা। কি জাইনা কাম নাই তর।” বলেই ঘুমিয়ে যায় আকবর মিয়া।
স্টেশনের থামের সামনে বসে সেদিনের আয়ের টাকা গুণতে থাকে শামসুল। তার গা ঘেঁষে বসে পড়ে আমেনা। শামসুল দু’হাত পিছিয়ে বসে।
-“অই তুমার কি আমারে শরম লাগে? পিছাইয়া বইলা ক্যান? কত সাইজ্জা গুইজ্জা আইলাম একটু চাইয়া দেখবা না?” কালো দাঁতগুলি বের করে টেনে টেনে হাসে আমেনা।
-“আমারে বিরক্ত কইরো না। তোমরা খারাপ মাইয়ালোক। পোলালোকের লগে তোমরা খারাপ জিনিস বেচো। দাদায় দেখলে ভাল হইব না। চইলা যাও।” শামসুল চাপাস্বরে বলতে থাকে।
-“হ, তোমার দাদায় বিশাল ভদ্রলোক। হেয় আজকাল গাঁজা, হিরোইন এর পুরিয়া বেঁচে।”
-“খবরদার দাদার নামে বাজে বকবি না কইলাম!”
-“যাইয়া জিজ্ঞাসা কইরা লও না ক্যান? আরে কই যাও, একটা বিড়ি খাইয়া যাও!” পেছন থেকে ডাকে আমেনা। শামসুল ফিরেও তাকায় না। গটগট করে হাঁটতে থাকে।
-“দাদা এইসব কি শুনতাছি? ওই বজ্জাত মাইয়াডা কয় তুমি নাকি নকুইলার লগে হেরোইন বেচো?” বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে শামসুল।
-“এত জাইনা কাম নাই তর। ইনকাম ত ভালই হইতাছে। দুইবেলা খাইতে পাইতাছি। সহুল মিয়ার ট্যাকাও দেওন লাগব। কামাই থাকলে ব্যবসা করুম না ক্যান? তোর কাম করার দরকার নাই। তুই এইসবে কান দিস না।” আকবর মিয়ার জবাব দেয়। শামসুল আর দাঁড়ায় না। বাইরে স্টেশনের বেঞ্চিতে চলে আসে।
বাঁশি আর হুইসেলের শব্দে ঘুম ভাঙে শামসুলের। সেই বেঞ্চির উপরই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। চারপাশে শুধু তাদের মত দিন মজুরদের ছুটাছুটি। হাপাতে হাপাতে আমেনা এসে হাজির হয়।
-“চল, উঠ। পুলিশ আইসা পড়ছে। দৌড়া।”
কিছু বুঝে উঠার আগেই আমেনা হাত ধরে টেনে নিয়ে দৌড়াতে থাকে। চারপাশে পুলিশের ছড়াছড়ি। সাদা পোশাকের এই লোকগুলি লাঠিচার্জ করছে আর স্টেশন থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে এই দিনমজুরদের। ঘরে এসে আকবর মিয়ার ঘুম ভাঙায় শামসুল। তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেয়ার তাগাদা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। পুলিশ এসে তাগাদা দেয়,
-“অই বাইর হ, এক্ষণ বাইরে আয় হারামজাদা।”
-” হ স্যার, এক্ষুণি যাইতাছি।”
-“অই বুড়া, পুটলির ভিতরে কি?”
-“কিছু না সাব,” কাঁপা গলায় বলে আকবর মিয়া। গতরাতে নকুল এসে দিয়ে গিয়েছিল দুটো প্যাকেট। সাথে কয়েকশো টাকা। কয়েক সপ্তাহের জন্য বাইরে যাবে সে।
-“বাইর কর কি আছে।”
সাদা রঙের দুটো মাঝারি আকারের প্যাকেট বেরিয়ে আসে পুঁটলির ভেতর থেকে।
-“স্যার, এগুলা হিরোইন। অই বুড়ারে ধর।”
শামসুল এক পুলিশ কর্মকর্তার পায়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
-“স্যার, উনারে ছাইড়া দেন, স্যার।”
ততক্ষণে তাদের ঘিরে চারপাশে জটলা তৈরি হচ্ছে। আকবর মিয়া নির্বাক। এত লোকের মাঝে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় আর পুরনো স্টেশন হাওড়া তার দৃষ্টিসীমায় ছোট হয়ে আসে। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে। এতসবের মাঝে হঠাৎ শামসুল হাতে হ্যাঁচকা টান অনুভব। তাকে জটলার মধ্য হতে বের করে নিয়ে কেষ্টপুর এর বাসে উঠে পড়ে আমেনা। শামসুল কিছু বলে না। পেছনে পড়ে থাকে আকবর মিয়া আর তাকে ঘিরে থাকা পুলিশ। অন্ধকারের সাথে দৃষ্টির অন্তরাল হয়ে পড়ে আকবর মিয়া আর পুরো হাওড়া স্টেশন।
০ Comments