গল্প লেখিকাঃ
আফরোজা আক্তার ইতি
(এপ্রিল – ২০১৮)
………………
নীলার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। কারণটা খুবই সামান্য, তবে সেটা তার জন্য যে কতটা মারাত্মক হতে পারে সে তা জানে। ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে আবিরের খুব শখের একটা ফুলদানি নীলার হাত থেকে ফসকে পড়ে গেছে। ভাঙা কাঁচগুলো পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে পরেছে। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল নীলা। গতসপ্তাহে আবিরের অফিসের শার্ট ইস্ত্রি করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিল ও। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল নীলা। আবির বিয়ের আগে ওকে বলতো, “তুমি ঘরের কাজ করতে না পারলে কি হয়েছে? আমি আছি না? আমি তোমাকে শিখিয়ে দিবো। তুমি চিন্তা করছো কেনো?” হ্যাঁ, আবির সেদিন সত্যিই নীলাকে ইস্ত্রি করতে শিখিয়ে দিয়েছিল তবে সেটা শার্টে নয়, নীলার ডান হাতে। কাঁপা কাঁপা হাতে মেঝে থেকে ভাঙা কাঁচগুলো তুলতে গিয়ে ডানহাতের দগদগে পোড়া ঘা এর উপর চোখ পড়ল নীলার। আবারো ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তার। তাড়াতাড়ি কাঁচ তুলতে গিয়ে কখন যে হাত কেটে ফেলেছে সেদিকে সে খেয়ালও করতো না, যদি না মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটা রক্তগুলো নজরে না পড়ত। বামহাতের তালু টা অনেকখানি কেটে গেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। নীলা তার হাত চেপে ধরে মরিয়া হয়ে কাপড় খুঁজতে লাগলো রক্ত বন্ধ করার জন্য।
ব্যালকনিতে যেতেই সানসেটে চড়ুই-দম্পতির দিকে নজর পড়ল নীলার। একমাস হয়েছে এই দম্পতির বসবাস এখানে। নীলা আর আবির বিয়ের পর এ ফ্ল্যাটে এসেছে একমাস হয়েছে। তখন থেকেই এই বদ্ধ রুমে নীলার একমাত্র সঙ্গী এই চড়ুই দম্পতি। অবশ্য এই চড়ুই পাখিরা শুধু দম্পতি নয়, খুব সুন্দর একটা সংসার হয়েছে ওদের। মা চড়ুই গতকাল দু’টো ডিম দিয়েছে আর সেগুলোতে বসে এখন তা’ দিচ্ছে। আর বাবা চড়ুইটা সজনে গাছের ডালে বসে পাহাড়া দিচ্ছে তার পরিবারকে। কত সুখের সংসারই না ওদের। অথচ নীলা আর আবিরেরও এমন সুখের সংসার হতে পারতো। কিন্তু বিয়ের দু’দিন পর থেকেই আবির আস্তে আস্তে কেমন যেন পালটে যেতে লাগলো। প্রেমের বিয়ে ওদের। ওদের নিয়ের যখন ছ’মাস চলছে, দুই পরিবারে জানাজানি হয়ে যায়, অবশেষে দুই পরিবার সিদ্বান্ত নেয় যে তারা দু’জন দু’জনের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারবে না, বিয়ের আগে প্রেম হারাম, এই সম্পর্ক তাদের শেষ করতে হবে। কিন্তু তারা তো তখন অথৈ প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবে না। শেষে সিদ্ধান্ত নিল তারা পালিয়ে বিয়ে করবে। যেই ভাবা সেই কাজ, বিন্দুমাত্র না ভেবে না চিনতে পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করে নীলা আর আবির এই ফ্ল্যাটে উঠল। এরপর থেকেই যেন আবির বদলে যেতে শুরু করল। আবির ছিল একজন বেকার যুবক, বয়স ও নিতান্তই কম। বিয়ের পর তাকে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে হল, সাংসারিক চাপ মাথায় পড়ল, সেই সাথে ভাড়া, ধার দেনা, খাবার, পোশাক সবকিছুর চাপ নিয়ে আবির ধীরে ধীরে অতিষ্ঠ হয়ে যেতে লাগলো। আর সেই চাপ ফলশ্রুতিতে নীলার উপর অত্যাচার হয়ে পড়তে লাগলো।
ব্যালকনির ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে নীলা ভাবতে লাগলো। কতদিন আকাশ দেখা হয় না। এই বদ্ধ রুমে থাকতে থাকতে নীলার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবির বিয়ের আগে বলতো, বিয়ের পর আমরা হানিমুনে কক্সবাজারে যাবো। আর প্রতি সপ্তাহে তো আমরা ঘুরতে যাবোই। আবিরকে খুব বলতে ইচ্ছে করে, “আমাকে একটু বাইরে ঘুরতে নিয়ে চলো না, এখানে থেকে আমি হাঁপিয়ে যাচ্ছি।”
কিন্তু কিছু বলার আগেই নীলার মনে পড়ে যায়, কিভাবে সেদিন আবির হিংস্র হয়ে তার গলা টিলে ধরেছিল শুধুমাত্র খাবারে একটু লবণ বেশি হয়েছিল বলে। তাই বলার আগেই গলার স্বর বন্ধ হয়ে যায় ওর।
আচ্ছা, একথা নাহয় নাইই বলা যায়। কিন্তু গত তিনদিন ধরে যে নীলা তার দেহের ভেতর আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করছে তা নিশ্চয়ই ওকে বলা যায়? তার হৃদস্পন্দনের সাথে সাথে যে আরেকটি ছোট্ট হৃদপিন্ডও স্পন্দিত হচ্ছে তা শুনলে নিশ্চয়ইই আবির আনন্দে আটখানা না হয়ে পারবে না?
নীলা মুরুব্বিদের বলতে শুনতো, “বাবা হলে নিষ্ঠুর পুরুষরাও গলে মোম হয়ে যায়।” হয়ত আবিরও সেরকম আগের মত হয়ে যাবে। আর হবেই বা না কেন? ওতো ওদের কলিজারর টুকরা। নাহ! আজকেই আবিরকে সব বলে আগের মত সুন্দর সংসার শুরু করবে নীলা। স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলল ও।
নীলা খুব সুন্দর করে সেজেছে আজ। একটা নীল শাড়ির সাথে নীল টিপ পড়েছে ও। ডানহাতে পোড়া ঘা আর বামহাতে কেটে যাওয়ায় কোন হাতেই নীল চুড়ি পড়তে পারছে না ও। অথচ আবির চুড়ি অনেক পছন্দ করে। আবিরের অফিস থেকে আসার সময় হয়ে গেছে। ভীষণ রাত করে ফেরে ও সবসময়।
তাই নীলা আজ ওর পছন্দের খাবার রেঁধে আগেই টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। আবিরের কলিংবেল শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুলল নীলা। যা ভেবেছিল তাই। আজও আবির ড্রিংক্স করে এসেছে। থাক! এখন মন খারাপ করলে চলবে না। আজই আবিরকে সব বলে সবকিছুর সমাধান করতে হবে।
আবির ওকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকে গেলো। এরপর চলে গেলো ফ্রেশ হতে। নীলার দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। খাবার টেবিলে বসে নীলা ভাবতে লাগলো কিভাবে ওকে কথাটা বলবে। কিছুক্ষণ পর আবিরকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল নীলা। আবিরের হাতে একটা বড় সি.জি.আর. পাইপ, যেটা কিনা পরশু দিন ও কিনে এনেছিল পানির কল ঠিক করবে বলে।
নীলা কিছু বুঝে উঠার আগেই আবির পাইপ দিয়ে নীলার পিঠে নিজের স্বর্বস্ব শক্তি দিয়ে জোরে একটা আঘাত করে বললো, ফুলদানিটা কেন ভাঙলে? জানো ওটা কত কষ্ট করে কত টাকা দিয়ে কিনেছি?” নীলা কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই আরো দু’তিনটা আঘাত পড়ল তার বাহুর উপর।
এলোপাথাড়ি আঘাতে হঠাৎ একটা আঘাত পড়ল নীলার পেটে। চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও। তার পেটে প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। এ যন্ত্রণা যেন হিংস্র, মাতাল আবিরের অনবরত পাইপের আঘাতকেও হার মানাচ্ছে। নীলার চোখ ব্যাথায় বন্ধ হয়ে এলো। পেট আঁকড়ে ধরে শেষবারের মত আর্তনাদ করে উঠল। কাঁপুনি দিয়ে তার নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে রইল। তার আর আবিরকে বলা হল না, “আবির, ওই চড়ুই দম্পতিটার মত আমরাও বাবা মা হতে চলেছি।”
০ Comments