ঢাকায় ইন্টারভিউ
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 2,085 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

গল্প লেখকঃ
Sujan Morgan
(এপ্রিল – ২০১৮)
……………

হঠাৎ ফোনে একটা টিএন্ডটি নাম্বার দেখে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠলো বিষাদ। নম্বরটা দেখে মনে হলো ঢাকার, এ নিশ্চয়ই কোনো চাকরির ফোন। ফোন ধরেই কাপাকাপা গলায় ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে বেশ কাঠখোট্টা গলায় বললো– মিঃ বিষাদ বলছেন? আগামীকাল দুপুর ৩টায় আপনার ইন্টারভিউ,বাংলাদেশ ব্যাংক, মতিঝিল প্রধান কার্যালয়। বলেই ফোন কেটে দিলেন।বিষাদের খুশীতে মন চঞ্চল হয়ে উঠলো। যাক, ভাইভাতে ভালো করতে পারলেই তো চাকরি এখানে দূর্নীতি হয়না বললেই চলে।
থাক, কল্পনাটা এখানেই থামিয়ে দিয়ে বাস্তবে ফেরত এলো সে। তখনই মনে পরলো পকেট পুরোই ফাঁকা! জোহরার কথা মনে পরলো। ওর থেকেই টাকা ধার করতে হবে। জোহরা বিষাদের একমাত্র বান্ধবী। অনেক কষ্টেসৃষ্টে কিছু টাকা জোগাড় করে পরদিন খুব ভোরে রওয়ানা হয়ে গেলো বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
সারা রাস্তা সে ইন্টারভিউর পোশাক নিয়ে ভাবলো! এমন কালোরঙ এর সাথে সাদা ফরমাল শার্ট কেমন লাগবে? টাই কি পড়বো নাকি পড়বো না? নাকি পকেটে করে নিয়ে যাবো,ইন্টারভিউ রুমে ঢোকার আগে পরে নেবো? পকেটেই থাক। এসব ভাবতে ভাবতেই লঞ্চঘাটে এসে পৌছালো বাস। নেমে লঞ্চে ওঠার পরেই তার মাথা থেকে পোশাক, চাকরির ইন্টারভিউ সব পালালো। এসে ঢুকলো ডেকের রান্না করা ইলিশ ভাজি আর ভাত! পকেটের স্বল্প টাকা ভাঙবে কি ভাংবেনা, এই করে সারা রাস্তা নিজেকে বোঝালো, “আরে বিষাদ; জিব্বাকে পোষ মানা বেটা, চাকরিটা হয়ে গেলে, কত মাছ খাবি? আবার বোঝালো, ইশ,যদি আরো কিছু টাকা ধারে আনতাম! উফফ। আবার নিজেকেই বোঝালো, ইন্টারভিউতে যখন জিজ্ঞেস করবে– মিস্টার বিষাদ, আপনি কবে জয়েন করতে পারবেন আমাদের অফিসে? তখন না হয় ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বন্ধুদের ফোন করতে করতে কোনো বড় হোটেলে ইলিশ ভাজি খাবো আর বলবো, শোন আমি আর ব্যাচেলর নেই, বুঝলি? আবার ভেবে নিজেই হাসলো, প্রথম ফোনটা জোহরাকেই করবো, সাথে গানটাও শুনিয়ে দেবো ওরে,
‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি জোহরা শুনছো,
এখন থেকে আর ধার করতে হবেনা,
পায়ের ওপর পা দিয়ে, এখন আমার টাকায় চলবে
বাসাকে বলে দাও, আমি আর বেকার না’ ”
হায় হায় কত কিছু ভেবে ফেললাম, কিন্তু মাথা থেকে ইলিশ গেলো না। আর কিছু না ভেবেই লঞ্চের নোংরা খাবার টেবিলে বসে, এক টুকরো ইলিশ চাক দিয়ে গপাগপ ২ প্লেট ভাত মেরে দিলাম। আহ শান্তি!
হঠাৎ দুলুনি অনুভব ছোট্ট লঞ্চে। কিন্তু বিষাদের মাথায় শুধুই চাকরি আর জোহরা। দুলুনি বাড়ল, বিষাদের ভাবনা দুলছে না। নিচ থেকে চিৎকার আসছে! বিষাদ দৌড়ে নিচে যেয়ে দেখলো একদিকে কাত হয়ে জল উঠছে। সবাই চিৎকার করে কাঁদছে,কেউ সূরা পরছে!! জানালায় তাকিয়ে দেখলো লঞ্চ মাঝ পদ্মায়! পকেটে হাতরে দেখলো টাই খানা ঠিক পকেটেই আছে। মোবাইল এ তাকিয়ে দেখলো সকাল ১১টা২০। আরে, আর ৪ ঘন্টায় কিভাবে পৌছাবে সে মতিঝিল? তখন মানুষজন লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পরছে। আর কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান মৃত্যুর সাথে। কিন্তু বিষাদের মাথায় অন্যকিছু চলছে, সে ভাবছে নাহ জামা ভেজানো যাবেনা। ইন্টার্ভিউ দিয়েই চাকরি সুখবর জানাবো সবাইকে। অফিস নিশ্চয়ই কিছু এডভান্স দেবে!!বাবার জন্য একটা ভালো দামি পাঞ্জাবী, মায়ের জন্য শাড়ি আর জোহরার জন্য একটা নীল শাড়ী। মেয়েটা ফর্শা, নীল রঙ মানাবে। দেবেতো এডভান্স?? পদ্মার বুকে বিষাদ, তার মাথায় তখনও চলছে সেই জোহরা, ইলিশ, ২প্লেট গরম ভাত, এডভান্স, ইন্টারভিউ, মোবাইল কই ভেসে গিয়েছে ঠিক নেই, কিন্তু একহাতে টাই খানা আঁকড়ে আছে। টাই ছাড়া কি ইন্টারভিউতে যাওয়া যায়?

জ্ঞান হারানোর পূর্বে এটাই শেষ চিন্তা ছিলো বিষাদের। অন্ধকার পৃথিবীতে ভোর হলে নাকে একটা নল, ভুরভুর করে বাতাস ঢুকছে,অক্সিজেন। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া অনাদি, অপরিমেয় কিন্তু অশেষ নয় মোটেও। একেকটা অনু দাম দিয়ে কিনতে হয়। ফুসফুসটা ক্লান্ত, চলে কি চলে না। হৃদয়টা তার পুরোদস্তর হৃৎপিন্ড হয়ে পাটিগনিত কষছে, খুব কষ্ট করেও পঞ্চাশ পার হতে পারছে না। বিষাদ ভাবে সে এখনো বেঁচে আছে তাহলে। আচ্ছা বিষাদ কে?
কেউ তাকে নিয়ে কিছু বলছে না। কেউ বলছে না ওকে বরিশাল থেকে ঢাকা ইন্টারভিউ দিতে যাবার পথে এক লঞ্চডুবিতে অগনিত প্রানহীন দেহদের ভিড়ে যে কয়েকটা জীবন্ত দেহ ছিলো তার মধ্যে বিষাদ ও ছিলো। এটাকে সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য বলবে সে তা চিন্তার। একটা দুইটা লোক, একটা জটলা, কখন যেন একজন স্রোত থেকে দেহটাকে তুলে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে কেউ একজন মানিব্যাগটা হাপিস করে দিয়েছে। মানিব্যাগটাতে একটা ছবি ছিলো একটা মেয়ের, জোহরার। সেই মেয়েটার নাম যে আর কোনদিন উচ্চারন করতে পারবে না সে।
নিজের অজান্তে বিষাদ চলে এসেছে পরিষ্কার জীবানু মুক্ত নতুন এক পৃথিবীতে। এই পৃথিবীতে সাদা পোশাক পরে কিছু মানুষ ঘুরে বেড়ায়। হাতে সূচ নিয়ে শিরা ফুঁড়ে দেয় অপ্সরী, কেউ কেউ নার্স বলে তাদের। সেই পৃথিবীটাতে হাসি নেই, কান্না নেই, ভালোবাসা নেই। আছে শুধু যুদ্ধ, মৃত্যুর সাথে জীবনের। এই পৃথিবীতে আসার আগে বিষাদের জামা-কাপড়, রক্ত পানিতে ভেজা আবর্জনা সব পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বিষাদ বেঁচে আছি কি নেই জানা নেই, হৃৎপিন্ডটা মিনিটে কয়বার লাফাচ্ছে জানার প্রয়োজন নেই, শুধু জোহরাকে একবার যদি দেখতে পারতো সে!
প্রতি মিনিটে বিল বাড়ছে এই পৃথিবীটার। একটা ধুকধুকানি টিকিয়ে রাখার জন্য না জানি কি কি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বিষাদের পরিবারের। জমি, জায়গা, কিছু স্বপ্ন, কয়েকটা জীবন। একটা দৈনন্দিন খিটিমিটি আগলে রেখে দিন রাত্রি বয়ে যাচ্ছিলো সহসা সে আবিষ্কার করলো সেই শহরে ঘুমের ওষুধ আছে, ব্লেড আছে খানিকটা রক্তমাখা, আছে অব্যবহৃত ধবধবে সাদা ব্যান্ডেজ শুধু নেই ভালোবাসা। সেই শহরটায় দম বন্ধ হয়ে আসে। কৃত্রিম প্লাস্টিকের নল দিয়ে নিশ্বাস নামের হাওয়াই মিঠাই দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয় একেকটা সম্পর্ক। অভিনয় নামের ভেন্টিলেশন লাগে। চারপাশে অসহ্য উৎসুক দৃষ্টি পালস মাপতে চায় সবকিছুর।বিষাদ মুক্ত হচ্ছে এ বাজার থেকে।
বিষাদ আবার ডুবে যাচ্ছে,
বিষাদের প্রিয় কিছু মুহুর্ত চোখের সামনে ভেসে আসে। তার মনে পরে যায় জোহরার সাথে প্রথম পরিচয়ের মুহুর্ত, তার সাথে রিকশাতে ঘোরার বাসনা, একটু হাত ছুঁয়ে দেবার বাসনা, একটু ভালোবাসার বাসনা।
একটা সংসারের লোভে ঘর ছাড়ার সে বাসনা।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৩ Comments

  1. ফয়সাল মাহমুদ

    গল্পটা হাসি দিয়ে শুরু করছিলাম,
    কান্না দিয়ে শেষ করলাম।

    Reply
    • sujan

      প্রাপ্তি।

      Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *