___মুহাম্মদ ত্বারেক
ফুফির একা মানুষ। ঠিক মত গরুটার যত্ন নিতে পারেনা বলে শুকনাই রয়ে গেল। সকালবেলা বিলে বেঁধে দেয় আর বিকেলবেলা নিয়ে আসে। ফুফি আর উনার স্বামী গ্রামেই থাকেন। ফুফাত ভাইরা সব শহরে থাকেন। পয়সা ওয়ালা হয়ে গেছেন উনারা। ফুফা দোকানে বসে চা খায় আর আড্ডা মারে। আগে কৃষি কাজ করে অন্ন যোগালেও এখন এসব করতে সম্মানে বাঁধে। আর ফুফিরও গরু-টরু নিয়ে মাঠে যাওয়া,খাবার খাওয়ানো এসব করতে ইচ্ছে করে না। বড় লোক হলে কি আর কষ্ট করতে মন চায়? সোনার পালঙ্কে বসে বসে খেয়ে বাকী জীবন কাটাতে পারলেই বেশ হয়। তো গত বছর বাবাকে বললেন,”ভাই! তুই এই গরুটা নিয়ে গিয়ে পাল। সামনের বছর কোরবানের আগে বিক্রি করতে পারবি মনে হয়।” আমি ঘরে বসে বসে খাই। তাই আমাকে কাজ দিতে গরুটা নিয়ে আসলেন আমার প্রিয় বাবা।
আমি ওরে নাম দিলাম বুলু। বুলু তখন কত পিচ্ছি ছিল! লালচে রঙের কেশ, লম্বা শিং, শুকনো গায়ের গঠন। চিকন হতে হতে হাঁড় গুলো শুকনো কাঠের মত ভেসে উঠছিল। গোসল করায়নি কতদিন তা ফুফিই ভাল জানেন। গায়ে ময়লা লেগে কিরকম বিশ্রী একটা অবয়ব ধারণ করেছে। আমি বুলুরে আস্তে আস্তে টেনে পুকুরে নামালাম। বাবাকে বললাম দোকান থেকে সার্ফএক্সেল নিয়ে আসতে। তারপর খড়ে এক মুষ্টি পাওডার মেখে বুলুর শরীর ঘষতে শুরু করলাম। গোবরগাদা গুলো এমন ভাবে লেগে আছে যে,মনে হচ্ছে যেন কেউ সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। মগ দিয়ে পানি ঢালি আর ঘষি। আবার পানি ঢালি, আবার ঘষি। সব কাদা পরিষ্কার করে খোলা মাঠের রৌদ্রতাপে শুকালাম। বাড়ি এসে এক বালতি পানিতে তুষে সাথে লবণ মিশিয়ে মাঠে নিয়ে খাওয়ালাম। তারপর বাগানের পাশে একটা তৃণ ভূমি আছে,ওখানে বেঁধে দিয়ে আমি গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। দক্ষিণ দিক থেকে নির্মল বায়ু বয়ে যাচ্ছে আমার উলঙ্গ শরীরে। মনে হচ্ছে কোন এক রুপবতী প্রেমিকা তার কোমল হস্তদ্বয় আমার গায়ের উপর আলতো করে বুলিয়ে নিচ্ছে। সবুজের নিচে বসে থাকতে থাকতে কখন যে তন্দ্রা এসে আমাকে স্পর্শ করলো টেরই পাইনি। তন্দ্রার পর ঝিমিয়ে গাছের গোড়ায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার বুলু তাজাঘাস খেয়ে পেট ভরিয়ে আনন্দ চিত্তে বসে রয়েছে। মাত্রা একদিন হয়েছে আমার কাছে এসেছে। এরই মাঝে এত যত্ন! সে হয়তো কখনো চিন্তাও করেনি। বুলুরে দেখে বুঝতে পারলাম পশুদেরও ফিলিংস আছে,তাদেরও কষ্ট অনুভূত হয়। তাই তো জবেহ করার সময় পশু যেন কষ্ট না পায় সেদিকে নজর দিতে বলেছেন ইসলাম। তারাও কাঁদে, চোঁখে দিয়ে অশ্রু তাদেরও গড়ায়। একদিন বুলুর চোঁখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু গড়াচ্ছিল। আমি দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম। হায়! কি হল! আমার বুলু কাঁদে কেন! তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন দিলাম। বাচ্চা অসুস্থ হলে তার মা-বাবা যেরকম কষ্ট পায় ঠিক সেরকম কষ্ট হচ্ছিল আমার। ওর কান্না দেখে আমিও চোঁখের জল ধরে রাখতে পারলাম না,কেঁদে দিলাম। বাবা দেখে হুহু করে হাসা শুরু করে দিলেন। তারপর বললেন,
-আরে বোকা! গরুর কিছু হয়নি। তুই খামাকা টেনশন করতেছস।
কাঁন্না থামিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম,
-না বাবা, কিছু একটা তো হইছে। নইলে সে এরকম কাঁদতো না। কখনো তো কাঁদেনি।
একটুপর ডাক্তার সাহেব আসলেন। তিনি অনেক্ষণ খোঁজার পর কান্নাট কোন কারণ পেলেন না। এদিকে আমার টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। হাটছি এদিক ওদিক। হঠাৎ নজর পড়লো বুলুর পায়ের দিকে। মাছি বসতেছে। বুলু সেগুলোকে লেজ দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনভাবে যাচ্ছে না। আমি পায়ের কাছে গিয়ে স্তব্ধ। এত্ত বড় কাটা দাগ! ডাক্তার আমার শব্দ শুনে এসে দেখলেন গোড়ালি থেকে পানি ঝরছে। বোতল ভাঙা কিংবা টিনের কাটা হবে হয়তো। আমার কুদ্দুস চাচা আলের পাশে বাড়ির যতসব ভাঙা জিনিস পত্র সব ওখানে ফেলে। এত করে বলছিলাম ওখানে না ফেলতে। কিন্তু উনি ফেলবেনই। কারণ উনর জমি এটা। উনার যেমন ইচ্ছা তেমন করেন। উনার এমন কাজকর্মে আমরা অতিষ্ঠ। যাকগে উনার কথা। ডাক্তার স্যাবলন দিয়ে ধুয়ে মলম লাগিয়ে দিলেন আর কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন। ওষুধ এনে খাওয়ালাম। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে গেল আমার বুলু।
এরপর থেকে বুলুর যত্ন আরও বাড়িয়ে দিলাম। পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। বুলুর প্রতি আমার এত যত্ন দেখে অনেকেই বলতো, “বুলু গরু হয়ে এত যত্ন করছিস, নাজানি তোর বাচ্চা হলে কি করতি!” আমি তাদের এসব কথায় কান না দিয়ে উল্টো হেসে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতাম। আসলেই আমি বুলুরে নিজের বাচ্চার মতই যত্ন করি। ও হয়তো কথা বলতে পারেনা। কিন্তু আমি ওর দুঃখ-কষ্ট সব বুঝি। বাবা বলেছিলেন,”কাউকে বুঝতে হলে তার সাথে কথা বলার দরকার নাই; তার মুখে চেয়ে থেকে চোঁখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করলেই তার মনে কি আছে,সে কি বলতে চায় তা সহজে উপলব্ধি করা যায়।” আমিও ঠিক সেভাবেই বুলুকে বুঝি।
একদিন ঢাকা গিয়েছিলাম একটা জরুরী কাজে। আসতে আসতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছিল। বাড়ি ফিরে দেখি বাবার হাতে ব্যান্ডেজ। জিজ্ঞেস করলাম,
-কি বাবা? কি করে হল এটা?
আছাড় খাইছেন কোথাও?
-আরে আছাড় খাইনি। তুই ঢাকা যাওয়ার পর তোর বুলুরে গোয়ালঘর থেকে বের করতে গেছিলাম। কিন্তু বের হচ্ছিল না। জোর করে বের করাতে গিয়ে এই অবস্থা।
আমি হাসতে হাসতে তখন পেট ব্যাথা হয়ে গেছিলো। হু, বুলুর কিন্তু সেই রকম রাগ। আমি ছাড়া কারো কথা শুনেই না। জোরাজোরি করলে বাবার চেয়েও জঘন্য দশা করে ছাড়ে। আমাকে দেখলে কেন জানি তার রাগ পানি হয়ে যায়। অবোধ বালকের মত বসে থাকে সরলমনা হয়ে।
কোরবানের হাট জমে উঠছে দিনদিন। বুলুর গঠন বেশ বড় হয়েছে এই এক বছরে, আমার অবিশ্রান্ত যত্নে। তিনদিন বাজারে তুলেছি। কেউ কেনার সাহস করেনি। এত বড় গরু কি সবাই কিনতে পারে? তিনোটাতেই বুলু সবার সেরা ছিল। আজ নিয়ে গিয়েছিলাম দিঘীর হাটে। এটা অন্য তিন বাজারের চেয়ে বড় বাজর। এখানেও বরাবরের মগ আমার বুলুই সবচেয়ে বড়। সবার চোঁখ বুলুর দিকেই। যদিও কিনার মত সামর্থ্য তাদের নাই। ভাবছিলাম আজও বুলুকে বিক্রি করতে পারব না। কিন্তু না, আমার ভাবনাকে মিথ্যা করে দিয়ে হঠাৎ একজন ভদ্র লোক কার গাড়ি নিয়ে আসলেন। নেমে সোজা আনার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
-দাম কত বুলুর?
আমি অবাক। বুলুর নাম উনি জানেন কি করে? আমি তো উনারে চিনিই না। দাম বললাম,
-চার লাখ
গাড়ি থেকে গিয়ে চারটা হাজার টাকার বান্ডেল নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিলেন। পিছনের ট্রাক থেকে দু’জন লোক নেমে এসে তুলে নিয়ে চলে গেলেন। এসবকিছু মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই ঘটেছে। পাশের বিক্রেতারা অবাক দৃষ্টিতে চেয়েছিল আমাদের দিকপ। তিনদিন ধরে তিন বাজারে ঘুরে বিক্রি করতে পারলাম না। আর উনি দশ মিনিটেই অচমকা ধামাকা ঘটিয়ে কিনে নিয়ে চলে গেলেন! পরে জানতে পারলাম, উনি অনেক বড় একজন ব্যবসায়ী। কোরবানি দেওয়ার মত বড়সড় গরু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। খবরে আমার বুলুকে দেখে সেই সুদূর কুমিল্লা থেকে চলে আসছিলেন চট্টগ্রামে।
বাড়িতে এসে মন খারাপ করছিল ভীষণ। বুলুরে বিক্রি করে হয়তো টাকা চার লাখ পেয়েছি। সত্যি বলছি আমি কোন গরু বিক্রি করিনি; করিছি তো নিজের সন্তানের মত লালিত বুলুকে। আমার বুলুকে কোরবান করে দিবে,গলায় তীক্ষ্ণ ছুরি চালিয়ে জবেহ করে দিবে,ছাল ছেড়ে দিবে,খানখান করে দিবে তার দেহ- এসব ভাবতেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ছটফট করছে মনটা। চোঁখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তেছে বুলুকে হারানোর বিরহতাপে। এত যত্নে লালিত-পালিত, এত আদরে বড় করা বুলু আর মাত্র দুইদিন পর কোরবানির গোসত হয়ে অনেক মুসলিমের জিহ্বায় রুটির সাথে মিশে যাবে। এমনি হয়তো গরু বিক্রেতাদের জীবন।
দারুণ
পশুর প্রতি মায়া জড়ানো একটি গল্প।কিছুটা শিক্ষাও লুকিয়ে আছে।
শেষের লাইনটা অনেক ভালো লেগেছে,
এমনি হয়তো গরু বিক্রেতাদের জীবন
ধন্যবাদ
ু
গরু পশু হলেও তার জন্য মায়া জন্মে।মা যেমন তার সন্তানকে লালন পালন করে, সন্তানের কিছু হলে মা কাঁদে।তেমনি গরুকেও সন্তানের মতো মনে হয়।
তাদের জীবন বিসর্জন দেয়।
ত্যাগতো তারা করে যারা গরুকে লালন করে।
বানানে ভুল আছে প্রচুর।বানানের প্রতি যত্নশীল হবেন।
ফুফির একা মানুষ—ফুফি একা মানুষ
তুষে সাথে–তুষের সাথে
মাত্রা–মাত্র
কান্নাট–কান্নার
কাঁন্না–কান্না
ব্যাথা-ব্যথা
উনর–উনার
বাজর–বাজার
দিকপ–দিকে
গোসত –গোস্ত।
শুভ কামনা রইলো।