বৃদ্ধাশ্রম
প্রকাশিত: অগাস্ট ২১, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 1,858 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখা:মাইশা জান্নাত রিমা
.
.
কড়া রোদে হাঁটতে হাঁটতে রীতিমতো হাপাচ্ছে লোকটা।
গায়ের শার্টটা ঘামে ভিজে একদম শরীরের সাথে লেগে গেছে।নিজের শরীরটাকে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলেই মনে হচ্ছে না।তার উপর দুহাতে দুটো বাজারের ব্যাগ।হাত দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে তার।
ধুলোবালিতে চশমার গ্লাসটাও অস্বচ্ছ হয়ে গেছে।হাত দুটোতে বোঝা বলে চশমাটা মুছতেও পারছেন না ভদ্রলোক।
যখনই ভাবলেন যে কোথাও ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে সাথে চশমাটাও পরিষ্কার করে নেবেন,ঠিক তখনই গাড়ির হর্ন আর সাথে সাথে এক প্রচন্ড ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেলেন বৃদ্ধ।
হাঁটুতে ভীষণ আঘাত লেগেছে।পুরো শরীর ধুলোবালিতে ভরপুর।কোনোমতে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই পুনরায় পড়ে যাচ্ছিলেন,ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা ছেলে এসে ধরে ফেলল।
ততোক্ষণে গাড়িটার ভেতর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসেছে।
.
–কী ব্যাপার? অন্ধ নাকি? চোখে দেখেন না?
সব মুছিবত এসে জুটেছে আমার কপালে। যত্তসব। .
.
আরোও কতোকিছু বলে চলেছে লোকটি।কিন্তু বৃদ্ধের কানে এই শব্দগুলো বিশেষ প্রভাব ফেলছে বলে মনে হলো না।
শুধু একটা কথাই মনে পড়ল তার,অনেক্ষণ হয়েছে সে বাইরে বেরিয়েছে।আর বেশি দেরি করলে বাড়িতে অশান্তি শুরু হয়ে যাবে।
তাই সে এবার উঠে পা টেনে টেনে হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির দিকে l
.
বাড়িতে পৌঁছেই একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন।
.
–বৌমা এক গ্লাস জল দাও তো?
–আমি এখন কাজ করছি দেখছেন না? সারাক্ষণ শুধু একের পর এক আদেশ তো করেই চলেছেন।
.
এক গ্লাস পানি চেয়ে কী এমন ভুল করে ফেলেছেন সেটাই ভাবতে লাগলেন রাহাত সাহেব।
উঁঠে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাসে পানি নিতে গিয়ে গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেল।
.
–এটা কী করলেন আপনি? গ্লাসটা ইচ্ছে করে ভেঙ্গে ফেললেন? আজ আসুক আপনার ছেলে।
.
রাহাত সাহেব হাজারো চেষ্টা করেও ছেলের বৌকে বোঝাতে পারলেন না যে তিনি ইচ্ছে করে এমনটা করেননি।অগত্যা নিজের ঘরে চলে গেলেন।
.
ঘরের ফ্যানটা একমাস হলো নষ্ট হয়েছে,কিন্তু এখনও তার ছেলের একটু সময় হয়নি একটা মিস্ত্রী ডেকে এনে ফ্যানটা ঠিক করিয়ে দেওয়ার।
বারান্দায় এসে রকিং চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিলেন তিনি।ক্লান্তিতে কখন যে চোখে ঘুম নেমে এলো সেটা টেরও পেলেন না।
ঘুম ভাঙ্গলো ছেলের ডাকাডাকিতে।ছেলে তাকে কোথায় যেন যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিতে বলছে।রাহাত সাহেব আন্দাজ করতে পেরেছেন তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে।তিনি নাতির ঘরে চলে গেলেন,দেখলেন নাতি ঘুমাচ্ছে।ঘুমন্ত নাতির কপালে একটা চুমো দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
বারবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছেন,মনে হচ্ছে কেউ যেন তার কলিজাটা ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলছে l
কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলেন তিনি।
গাড়িটা চলতে শুরু করলো।বেশ কিছুক্ষণ পর নিরিবিলি একটা জায়গায় এসে থামল গাড়িটা।রাহাত সাহেব ধীর পায়ে নেমে দাঁড়ালেন গাড়ি থেকে।তারপর চোখের চশমাটা মুছে নিয়ে তাকালেন মাথার উপরের সাইনবোর্ডটার দিকে।
“শান্তিনীড় বৃদ্ধাশ্রম”।
নামটা বড় চেনা চেনা লাগছে।কোথায় যেন শুনেছে এই নামটা।
হ্যাঁ,মনে পড়েছে।ত্রিশ বছর আগে এই বৃদ্ধাশ্রমটাতেই সে তার বাবাকে রেখে গিয়েছিল।আজও দৃশ্যটা যেন ঠিক একই।শুধু আজ অসহায় বৃদ্ধ বাবার জায়গায় সে নিজে দাঁড়িয়ে আছে।আর নিষ্ঠুর ছেলের জায়গাটাতে তার নিজেরই ছেলে।
.
–বাবা,আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে।মাঝে মাঝে আমি এসে তোমার সাথে দেখা করে যাবো।
.
সবটা বুঝতে পেরেও ছেলের এমন কথায় চমকে উঠলেন রাহাত সাহেব।ত্রিশ বছর আগের তার করা সেই ভুলটাই আজ তার ছেলেও করছে।সে জানে মুখে বললেও তার ছেলে আর তার কাছে আসবে না।হয়তো সামান্য খোঁজখবরটুকুও নেবে না।তার খুব করে ইচ্ছে করল ছেলেকে বোঝাতে,যাতে সে তার মতো এতো বড় ভুল না করে।কিন্তু সে জানে তার ছেলে তার কথা আর শুনবে না।
অশ্রুসজল চোখে পরম আদরে ছেলের মাথায় শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি।তারপর এগিয়ে চললেন সামনের দিকে।
.
.
আজ ঈদের দিন।
এখানে সে এসেছে প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে।এর মধ্যে ছেলে দুইবার কল দিয়েছিল।
আজ এই বিশেষ দিনে রাহাত সাহেবের খুব ইচ্ছে করলো ছেলেকে দেখতে।নাতিটার কথা ভাবতেই চোখে জল চলে এল তার।
সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে যে ছেলেকে বড় করেছে আজ সেই ছেলেই কি না তাকে অনিশ্চয়তার জীবনের দিকে ঠেলে দিল!
.
ঘরের চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে তিনি চেয়ে রইলেন গোধূলীর রক্তরঙা সূর্যের দিকে।শেষ বেলার ডুবন্ত প্রায় সূর্যটার মতো তার জীবনটাও এখন প্রায় শেষের দিকে।
বহুবছর আগে তার বাবা এভাবেই এই আশ্রমের কোথাও বসে তার বিষাদভরা জীবনটা কাটিয়েছেন।আর আজ তার নিজের সেই মহাপাপের শাস্তি সেও পাচ্ছে একইভাবে।
সত্যিই প্রকৃতি ভীষণ নিষ্ঠুর।এই জীবনে করা পাপের শাস্তি এই জীবনেই পেতে হয়।এখন খুব আফসোস হয় রাহাত সাহেবের। নিজের ভুলটাকে শোধরানোর ইচ্ছে হয় খুব।কিন্তু চলে যাওয়া সময় তো কখনও ফিরে পাওয়া যায় না।
প্রতিটি মুহূর্তই এখন সে অনুশোচনা করে।তবে তার খুব কষ্ট হয় ছেলের কথা ভেবে।তার ছেলেটাও হয়তো একদিন এখানে আসবে।কিন্তু ততোদিন সে বেঁচে থাকবে কিনা সেটাই ক্রমশ চিন্তিত করে তোলে এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকে।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৪ Comments

  1. HM TareQue

    উত্তম শিক্ষণীয় একটা গল্প। যে মা-বাবা আমাদের লালনপালন করতে এটুকু বিরক্ত বোধ করেনি,তারা যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন তাদের সেবাযত্ন করা সন্তানের কর্তব্য। কিন্তু আমরা তা না করে উল্টো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি। একটিবার খবরও নিই না। তবে আল্লাহ কিন্তু সব পাপের শাস্তি দুনিয়াতে না দিলেও কিছু কিছু মানুষের শিক্ষার জন্য দিয়ে দেয়। এই গল্পে তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

    Reply
  2. Mahbub Alom

    কথায় আছে,সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।রাহাত সাহেবের করা ভুলটাও শোধরানো সম্ভব না।তবুও বাবারা নিঃস্বার্থ হন।
    এই জীবনের পাপের শাস্তি এই জীবনেই পেতে হয়।বাবা মাকে দুঃখ দিলে আল্লাহ কাউকে ক্ষমা করেন না।দোয়া করি আর যাতে কখনো এরকম কারো সাথে না ঘটে।

    গল্পটা অনেক ভালো লেগেছে।

    Reply
  3. Halima tus sadia

    সময় বড্ড অসহায়।কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।যে যেমন করে তার ফল কিছু হলেও এই জীবনে ভোগ করে যেতে হয়।
    বৃদ্ধ বয়সে নাতি -নাতনি,পুত্র বধুরাই হয় একমাত্র সঙ্গী।তারাও তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে।এর চাইতে আর বড় কষ্ট নেই।সকল সন্তানদের বাবা মার সেবা করার তৌফিক দান করুক।

    ভালো লিখেছেন বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে।কারো বাবা মার যেনো বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা না হয়।

    হাপাচ্ছে–হাঁপাচ্ছে
    পুনরায়-পূনরায়
    শুভ কামনা রইলো।

    Reply
  4. আফরোজা আক্তার ইতি

    কথায় আছে, “পাপ বাপকেও ছাড়ে না।” প্রত্যেকেই তার শাস্তি দুনিয়াতেই অর্ধেক ভোগ করে যায়। রাহাত সাহেব তার বৃদ্ধ বাবাকে রেখে এসেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে,আজ ভাগ্যের পাক-চক্রে তাকেও থাকতে হচ্ছে সেই বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে। যেই বয়সে তার প্রয়োজন সন্তানের সঙ্গ,তাদের সময় ও ভালোবাসা, সসেই ববয়সে আজ তাকে থাকতে হচ্ছে অন্য কোথাও সবার থেকে দূরে।বাবা মা অমূল্য জিনিস। ওঁনাদের কখনো দূরে ঠেলে দেওয়ার কথা ভাবাও উচিত না।সুন্দর একটা গল্প লিখেছেন। রাহাত সাহেব তার ভুল বুঝতে পারছেন। একসময় তার ছেলেও বুঝবে।
    বানানে তেমন কোন ভুল নেই।যত্ন নিয়ে লেখা।
    হাপাচ্ছে- হাঁপাচ্ছে।
    দুহাতে- দু’হাতে।
    উঁঠে- উঠে।

    Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *