মাহমুদা তাহিরা
‘রায়পুর রায়পুর, এই উঠেন উঠেন, ও আফা কই যাবেন?’
বাজার করতে উল্লাপুর এসেছে শিউলি, আট বছরের ছেলে আবুকে নিয়ে। নিজের গ্রাম রায়পুর থেকে মাইল সাতেক দূরে।
ছোট ছেলেটা দেড় বছরের, বাড়িতেই রেখে এসেছে, আবুর দাদীর কাছে।
অতটুকুন বাচ্চা নিয়ে বাজার-ঘাট তো সহজ কিছু না, তাও যা জ্বালায় পিচ্চিটা! সুযোগ পেলেই কাঁদে, হাতে কিছু দিয়ে ঠান্ডা করতে হয়। সেটা আবার ধপাস করে হাত থেকে ফেলে দিবে, দিয়েই আবার কান্না, উঠিয়ে হাতে দিলেও কান্না, এই এক মহাজ্বালা! আবুটা শান্ত, সাধারণ বাচ্চা তো আর না, তাই বলেই হয়তো এমন শান্ত।
সিএনজি ড্রাইভারের হাঁকডাকে রাস্তার বাম পাশে ফিরে শিউলি, হাতে দু’দুটো চটের বস্তা। টমেটো, লাউ থেকে শুরু করে আলু, পেয়াজ সবই ভর্তি করা। সাপ্তাহিক বাজারটা তাকেই সারতে হয়। স্বামী মাহফুজ মিয়া কাজ করে ঢাকাতে। বাজার করতে আসলে আবুকে নিয়ে আসা কেমনতর বোকামি তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। ব্যাগ দুটা সামলাবে নাকি আবুকে!
রাস্তা পার হতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে শিউলি, ‘এত গাড়িঘোড়া কি করি এহন!’ কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে শিউলি।
‘আবু এ আবু! বাপ তুই দাঁড়াই থাক এইহানে, আমি ব্যাগগুলা থুইয়া আইতাছি, দাঁড়াইস কিন্তু, কোনোদিক যাইস না আবার!’
আবুর সামনের দুইটা দাঁত নাই, ফিঁক করে হেসে মায়ের কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয় আবু। সেই কবে দাঁতগুলা ফালাইছে, এখনো দাঁত উঠার কোনো নামগন্ধ নাই। আবুকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে তড়িঘড়ি করে রাস্তা পার হতে হতে আবুর দাঁত নিয়ে ভাবে শিউলি। তিনদিন ধরে দাঁতের ব্যথায় ঠিকমতো খাচ্ছিলো না আবু, দাঁত নড়ে, ফেলতে হবে। কিন্তু বজ্জাৎ ছেলে দাঁত ধরতেই দেয়না। শিউলির মনে পড়ে সারা বাড়ি কেমন করে দৌড়িয়ে আরব চাচারে দিয়ে জোর করে দাঁত ফেলতে হয়েছিলো আবুর।
কয়মাস হইতে চললো, এখনো দাঁত উঠে না পোলার। কপাল কুঞ্চিত হয় শিউলির।
সিএনজির পেছনে চটের বস্তা দুটা রেখে তাড়াহুড়ো করে আবুর দিকে যায় শিউলি। না, আবুকে তো দেখছে না সে, কই গেলো আবার পোলাডা!
‘আবু ও আবু, কই গেলি আবার তুই!’ তারস্বরে রাস্তার ঐপাশে চিল্লায় শিউলি, কয়েকজন বিরক্ত হয়। কয়েকজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে কে হারাইছে? দেখতে কেমন?
সিএনজিওয়ালা তাড়া দেয়, তাড়াতাড়ি করার জন্য। লোক ভর্তি হইলেই সিএনজি ছাইড়া দেবে সে। মহিলা জাহান্নামে যাক তার পোলারে নিয়া।
শিউলি ভড়কে যায় আবুকে না পেয়ে, ভেতরটা দুরুদুরু করে। আবু কই গেলো, এই পোলাডারে নিয়া সে আর কত জ্বলবো। ‘নে! হারাইছোস এবার মইরা থাক কোনোহানে পইড়া, তোরে নিয়া আমি আর পারি না রে আবু ও আবু? তুই মরসও তো না, মইরা গেলেও শান্তি হইতাম খোদার কাছে তো গেছে’ বিলাপের সুরে কাঁদতে থাকে শিউলি।
‘ও ভাই একটু দেখেন না কই গেলো আমার পোলাডা, ব্যাক্কলরে ভাই ব্যাক্কল, কথা কইতারে না, একটা কমলারঙের গেঞ্জি পরনে আছিলো’ কয়েকজন লোককে ধরে এভাবেই আহাজারি করে শিউলি।
একটা হুলস্থুল পড়ে যায় রীতিমতো বাজারের এইদিকটাতে। কয়েকজন আগ্রহভরে খুঁজতেও থাকে কমলারঙের গেঞ্জি পরনের ছেলেটাকে।
দূর থেকে শিউলির চোখেই প্রথম পড়ে। একটা সিডির দোকানে গেমস খেলছে দশ বছরের মতন একটা ছেলে। আবু হা করে মনোযোগ সহকারে সেটাই দেখছে, ধুমধাম ফাইট হচ্ছে কম্পিউটারের স্ক্রিনে।
শিউলি দৌড়ে যায়, গিয়ে ঠাস করে একটা চড় লাগায় আবুর গাল আর কান বরাবর।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আবু, মায়ের মুখের দিকে টলমল চোখ নিয়ে তাকায়। না, আবুর চোখ দেখার মত মেজাজ নাই এখন শিউলির। কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় সিএনজিগুলোর কাছে। মাঝখানে ধুমধাম কয়েকটা কিল বসিয়েও দেয় আবুর পিঠে।
‘কেমন ছেলে জন্ম দিছি গো খোদা, এত মাইর খাইয়া একটু কান্দেও না’ শিউলির ইচ্ছে করে নিজের কপালেই কয়েকটা জুতার ঘা বসিয়ে দিতে।
সিএনজির কাছে গিয়ে দেখে পেছনের দুই সিটে মহিলা বসে গেছে। সামনেও আর একটা সিটই খালি। হয় আবুকে সামনে বসাতে হবে নাহয় এরপরের সিএঞ্জিতে যেতে হবে। শিউলির মেজাজ খারাপ, ধাক্কা দিয়ে আবুকে সামনের সিটের দিকে পাঠায়, ‘যা আইজ অইখানেই বসবি তুই, যা বয়!’ ধমক লাগায় শিউলি। আবুর চোখ এখনো টলমল করছে। ‘আ’ ‘ও’ শব্দটাও করছে না পর্যন্ত!
ড্রাইভারের পাশে বসা বয়স্ক লোকটি বলে উঠে ‘আগো মা কি করো, তোমার পোলাডা তো সামনে বইতে পারবো না মনে অয়, পইড়া তো যাইবো’
‘যাক পইড়া, মইরা যাক চাচা, আর ভাল্লাগেনা জ্বালা। আর কত সইমু আমি! এমন দামড়া হইয়া গেছে তাও মুখে খাওনডা তুইল্লা দেওন লাগে। মুখ দিয়া তো জবানও নাই! এমন হাবাগোবা সন্তান আল্লাহ দিছে যখন, সে তুইল্লা নিলেই তো পারে।
ড্রাইভার আপনে যান, পড়বো না, পড়লে মরবোও না!’
ড্রাইভার স্টার্ট দেয়, গাড়ি চলতে থাকে। বয়স্ক লোকটি বারবার তাকায় আবুর দিকে। কেমন নিষ্পাপ চেহারা ছেলেটার, চোখ দুটা কেমন টলমল করছে জলে, সবসময় কি এমন টলমলই থাকে ছেলেটার চোখদুটো? এই চারটা হাত-পা নিয়ে, একটা সুস্থ মাথা নিয়ে কত ভালো আছি আল্লাহর এই দুনিয়ায়। আর এদের জীবনটা? কিছু বুঝাতে পারে এরা কাউকে? কেউ বুঝে কখনো ওদের? নিজেদের মনেই ছোট্ট একটা জগত সাজিয়ে চুপ করে থাকে বোধহয়।
বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
রাস্তা ফাঁকা পেয়ে স্পীড বাড়ে সিএনজির। আবু জড়সড়ভাবে বসে থাকে শক্ত করে স্টীলটা ধরে। একবারের জন্য পেছন ফেরে মায়ের দিকে তাকায়। ইশারায় বুঝায় সে পেছনে বসতে চাচ্ছে, সামনে ভালো লাগছে না।
‘চুপ কইরা বইসা থাক, নড়বি না! পিছনে কই আসবি? জায়গা আছে?’ রাগ দেখিয়ে উত্তর দেয় শিউলি।
আবু ভয়ে আর কিছু বলে না। তার বারবার মনে হয় এই বুঝি সে পিছলে গেলো, হাতে শক্তি লাগে না।
রাস্তার ডান পাশে তাকিয়ে থাকে সে, কতকিছু দেখা যায় কিন্তু বুঝে না সে এতকিছু। শুধু বুঝে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে।
গরু ছাগল চড়ে বেড়ায় বিস্তীর্ণ সবুজ জমিতে। দুটা ইটখোলাও দেখা যায় দূরে। আবু তাকিয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে তার। খুব বাতাস, বাতাসের তোড়ে বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে।
‘এই ব্যাটা আরো চাইপ্পা বয়’ সিএনজি মামা ধমকে উঠে। আবু শুনে না, কি জানি কানে কিছু যাচ্ছে না কেন তার! সে জোরে জোড়ে নিশ্বাস নেয়, তার মাথার ভেতরে কি যেন ঘুরে, এত বাতাস, সবুজ জমি, গরু-ছাগল, ইটখোলা, এত বাতাস, সবুজ জমি…।
আবু হুট করেই মাথাটা বের করে দেয় সিএঞ্জির ভেতর থেকেই। কেন বের করলো হঠাৎ? আরো জোরে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য? এই দূষিত পৃথিবীর বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য?
শিউলি পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে, ‘আবু-উ-উ-উ-উ’
আর কিছু শোনা যায় না!
সিএনজিটা এক পাশে ধাক্কা লেগে বামদিকের বড় গাছটাতে লেপ্টে আছে। গাছটা না থাকলে কি হতো? এখানেই সিএঞ্জিটার লীলা শেষ হয়ে যেত, ভেতরের সবকটা মানুষ দুমড়ে মুচড়ে পুকুরটাতে পড়তো।
সিএনজির ভেতর পাঁচজন আছে ড্রাইভারসহ, জঘন্যভাবে ক্ষত বিক্ষত, তবে বেঁচে আছে। ভেতরে শুধু আবু নেই, আবু রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে। ট্রাকটা আটকে রাখা হয়েছে রাস্তার ডানপাশে। এত মানুষের হট্টগোল, চেঁচামেচি তবুও কেমন নিস্তব্ধ নিরব সব।
আবু বেঁচে নেই, থেঁতলা মাথা আর নিথর দেহ নিয়ে সে পড়ে আছে রাস্তার মাঝখানটায়। রক্তের বন্যা হচ্ছে, জমাটবদ্ধ কচিকাঁচা রক্ত।
_
দু’মাস হয়ে গেলেও শিউলি এখনো কথা বলে না। সব মিলিয়ে বোধহয় মোটমাট দশবার হা হু করেছে সে আবু মরার পর।
ছোট ছেলেটা মায়ের আঁচল ধরে টানলে ব্লাউজ খুলে দেয়। ছেলেটা পেট ভরিয়ে চলে যায়, একটু দূরে বসে আপনমনে খেলে। এতটুকুন ছেলে, কিছু বুঝার কথাও না তবুও কান্নাকাটি করে না আর আগের মতো।
পাড়াপড়শিরা প্রথম একমাসে দুনিয়ার সকল সান্ত্বনাই দিয়ে ফেলেছে শিউলিকে।
এখন আর দেয় না, নিজেরাই বিরক্ত হয়।
‘ছেলে মইরা গেছে এক্সিডেন্ট কইরা, আল্লারটা আল্লা নিয়া গেছে। এখনো এমন করলে ক্যামনে হইবো! কোলে তো আরেকটা ছেলে আছে নাকি! তারে তো পালতে হইবো। এমনে আর কয়দিন?’
শিউলি শ্রী ছাড়া হয়ে বসে থাকে দুয়ারের কাঠটাতে মাথা হেলিয়েই।
সে রাতে ঘুমাতে পারে না কতদিন, কাকে বলবে? কেন পারে না কাকে বুঝাবে? তার আবু তো তার সাথেই অভিমান করে চলে গেলো। যে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে সন্তান বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে শিউলি কিনা মা হয়ে সন্তানকে নিজ হাতে মরণের দিকে ঠেলে দিলো?
আবু যদি শিউলিকে ক্ষমা না করে? সন্তান যদি মাকে ক্ষমা না করে?
চোখ বন্ধ করলেই শিউলি আবুকে দেখে। আবু টলমল চোখে তাকিয়ে আছে, শিউলি আবুকে শাসিয়ে বলে যাচ্ছে ‘মরস না ক্যান তুই, খোদা তরে নেয় না ক্যান!’
চোখ বন্ধ করলে সিএনজির সেই বয়স্ক লোকটিকেও দেখে শিউলি। মিটিমিটি হেসে তাকে বলে যায় ‘অবহেলা কইরো না গো মা, সন্তান কানা ল্যাংড়া হইলেও তো সন্তানই। আল্লাহ তাগোরে পাঠায় মমিন কইরা, নিয়াও যায় মমিন হইয়াই।’
শিউলির মাথায় ঝিম ধরে, তার চিৎকার করে দুনিয়ার সব কিছু তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু না, তার গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হয়না।
শিউলির নিজের মাকেও দেখে চোখের সামনে, ‘কিগো মা তোর ছেলের গলায় কথা নাই দেইখা না অবহেলা করতি?’
শিউলি দৌড়ে উঠে যায় ছোটো ছেলেটার দিকে, কোলে তুলে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমু খায় গালে কপালে, হাহাকার করে কেঁদে বলে উঠে ‘আবু রে আমার আবু!’
সুন্দর লিখেছেন।
লেখার গভীরতা বোঝানোর চেষ্টা সফল হয়েছে।
শব্দ চয়ন মুগ্ধকর।
শেষাংসে হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো।
অনেক শুভ কামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ধন্যবাদ সুন্দর মতামতের জন্য।
ভালো লিখেছেন আপু।
শব্দচয়ন, গল্পের বিষয়বস্তু দুটোই মনোমুগ্ধকর।
গল্পের ভেতরে কিছু একটা ছিল যেটা পুরো গল্পটাকেই পড়তে বাধ্য করেছে।
শুভকামনা রইলো, অনেক দূর এগিয়ে যান। ????
ভালোবাসা অফুরান। ????
সত্যিই এত্ত সুন্দর একটা গল্প পড়লাম। শেষটুকু পড়েই কলিজায় মোচড় দিল। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। কি ব্লব আর এই গল্প সম্পর্কে। যত বলব ততই কম হবে।
লেখিকা তার গল্পে খুবই পারদর্শী। লেখার মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন আর পাঠককে আগ্রহী করার কৌশলও জানেন। গল্পের বিষয়বস্তুও খুবই সুন্দর।
আমি মুগ্ধ। বেশ যত্নে লেখা। তাই বানানও নির্ভুল।
অনেক বেশি ধন্যবাদ আপু। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমিও খুব খুশি হলাম।
এই প্রথম ওয়েবসাইটের কোনো গল্প পড়ে কান্না আসলো আপু।
এই আবুর মধ্যে যেন আমি আমার ২০ বছরের প্রতিবন্ধী আলী ভাইয়াকে দেখতে পেলাম!
আপুরে,ভাই টা আমার ৩ বছর আগেই জান্নাতে চলে গেছে।।শিউলির যন্ত্রণাটা আমি বুঝি গো!
এখনো মনে হয়,আমি যদি ভবিষ্যৎ জানতাম তবে কখনোই তাকে হীনমন্য করতাম না,তার প্রতি নাক কুঁচকাতাম না।
বড়ো আফসোস হয় এখন!
যাক সেসব কথা,পাঠক হৃদয়ে আলোড়ন তুলতে পেরেছেন,এটাই আপনার প্রাপ্তি।
অনেক সুন্দর বাস্তবধর্মী গল্প, অসাধারণ উপস্থাপনভঙ্গি, যত্নের লেখনী!
সত্যিই, অপূর্ব!
শুভকামনা রইল
এইরেহ আপু! আপনার আলী ভাইয়ার কথা জেনেও আমার কেমন কষ্ট হচ্ছে। 🙂
আল্লাহ নিষ্পাপ মানুষগুলোকে জান্নাতবাসী করুন আর আমাদেরকেও হেদায়েত দান করুন সেই প্রার্থনা।
অনেক ধন্যবাদ আপু। অনেক ভালো থাকবেন।