লেখকঃ সামিও রাহমান
(জুন – ২০১৮)
……………
উৎসর্গঃ রিজভী স্যার এবং আপুকে। প্রিয় স্যার এবং আপু! আপনাদের জীবন হোক কালো মেঘহীন রিমঝিম বৃষ্টিময়……..
এক
২৯ এ রমজান। সকাল ৯টা বেজে ২৭ মিনিট। রোদে ঝলমল করা একটি দিন। জানালা দিয়ে পর্দার ফাক গলে রোদ এসে হিমেলের চোখেমুখে পড়ে। রোদের আলোয় ঘুমের মাঝেই হিমেলের চোখ মুখ কুচকে উঠে। শেষ অবধি থাকতে না পেরে জেগে উঠে একমনে জানালার ফাক গলে আসা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে। জানালার পাশের জাম গাছটি বাতাস পেয়ে কেমন সরসর শব্দে দুলে উঠে।
কতদিন পর এমন নিশ্চিন্ত একটা ঘুম দিলো হিমেল। দালালি (মার্চেন্ডাইজিং) পেশায় নিয়োজিত থাকার বিনিময়ে রাতের নিশ্চিন্ত ঘুম বুহুদিন আগেই বিকিয়ে দিয়েছে। ঘুম যে হয় না, তা না, তবে সেটা ছাড়া ছাড়া এবং পেশাগত দুঃস্বপ্নে ভরপুর। আর তাই একদিন আগে ঈদের ছুটি হওয়ার পরও সময়টাকে উপভোগ করতে একদিন পর বাড়ীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তা ছাড়া সারা বছর এতোটাই দৌঁড়ের উপর থাকে যে ছুটি পাওয়ার সাথে সাথে অন্যদের সাথে বাড়ীতে যাওয়ার ইঁদুর দৌঁড়ে সামিল হতে ইচ্ছে করলো না। তবে তার মানে এই না যে, বাড়ীর জন্য তার মন টানছে না। বরং অন্যদের থেকে একটু বেশিই টানছে। কতদিন বন্ধুদের সাথে প্রাণ খুলে আড্ডা দেওয়া হয় না। মা’র হাতের রান্না খাওয়া হয় না। পুকুরের পানিতে গোসল করা হয় না। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শোনা হয় না……
দুই
‘নারে মামা, লাইফে কোন টেস্ট পাইতাছি না।’ হাতির ঝিলের রাস্তায় সাইলেন্সার বিহীন বাইক দুটো দাঁড় করিয়ে পাশের ফুটপাথে বসে থাকা কানে দুল আর হাত ভর্তি চুড়ি পড়া দুই ধনীর দুলালের একজন বলে উঠে কথাটা।
‘ক্যান, কি হইছে?’
‘আরে একমাস ধইরা ড্যাডরে কইতাছি একটা অ্যাপাচি আর টি আর কিনা দিতে, ড্যাড খালি আজকে কালকে কইয়া ঘুরাইতেছে।’
‘জিক্সার কি হইছে?’
‘এইসব জিক্সার মিক্সার আর কতদিন চালামু!’
‘আমিও ড্যাডরে কইছি, ইয়ামাহার যেই তিন চাক্কার বাইকটা আসছে, সেইটা বিডিতে আসা মাত্রই আমারে কিনা দিতে হবে।otherwise I will fuck his property .’
‘বাদ দে। ল একটা গেইম খেলি। সেইদিন আমি আর জিসানে খেলছিলাম, সেই মজা পাইছি।’
‘কী গেইম?’
‘মনে কর এইখান থাইকা দুইজনে বাইক নিয়া টান দিমু। এক টানে হোটেল সোনারগা পর্যন্ত যামু। এর মাঝে কে কত দ্রুত পাশের বাইকগুলার গা ঘেইষা যাইতে পারে। যে যত বেশি বাইকের গা ঘেইষা যাইতে পারবো,সেই জিতবো।’
‘জিতলে লাভ কী?’
‘যে জিতবো, তারে নানদুসের গ্রীল খাওয়ানো হবে।’
‘এই খেলায় মজা কই?’
‘যখন কোন মালওয়ালা বাইকের পাশ ঘেইষা যাবি, তখন দেখবি মালগুলা কেমন চিল্লান দিয়া উঠে!!!’
তিন
হিমেল বিছানা থেকে উঠে প্রথমে নিজের বাইকটাকে ভালো করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নেয়। তারপর গোসল সেরে কাপড় চোপড় পড়ে বাড়ীতে যাওয়ার জন্য রেডী হয়। ব্যাগ ব্যাগেজের কোন ঝামেলা নেই ভাবতেই মনটা বেশ হালকা লাগছে। জগন্নাথ ভার্সিটিতে পড়া ছোট ভাইকে ব্যাগ ব্যাগেজ দিয়ে আগেই বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছে। যদিও ব্যাগ দু’টো বেজায় ভারী ছিলো তবে তাতে নিজের জন্য খুব একটা কিছু ছিলো না। নিজের কিছু কাপড় চোপড়, ছোট ভাইবোন দু’টোর ঈদের জামা জুতো, মা’র জন্য একটা ব্লেন্ডার মেশিন আর পাড়া প্রতিবেশীর জন্য ব্যাগ ভর্তি গার্মেন্টসের শিপিং স্যাম্পল। গার্মেন্টসের সিপিং স্যাম্পলেই ব্যাগদুটো টই টুম্বুর হয়ে গিয়েছে। মা’র জন্য কেনা শাড়ীটা আর ব্যাগে জায়গা হয়নি বলে নিজের ল্যাপটপ ব্যাগে নিয়ে নিয়েছে।
হিমেলরা দু’ ভাই এক বোন। হিমেল বড়। তার পড়ের ভাইটা জগন্নাথে ইংলিশে অনার্স করছে। ছোট বোনটা এবার মেট্রিক পরীক্ষা দিবে। বাবা সুগার মিলের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। বছর আটেক আগে হঠাতই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তারপর বছর তিনেক জগতের অন্য একটি রূপের সাথে পরিচয় ঘটে হিমেলের। নির্দয় নিষ্ঠুর এক রূপ। বাবা মারা যাওয়ার আগে আত্মীয় স্বজনদের যে দরজাগুলো তাদের জন্য ২৪ ঘন্টা খোলা ছিলো, বাবার মৃত্যুর পর সে দরজাগুলোই একটির পর একটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। অতঃপর তিনটি বছর অবর্ননীয় কষ্ট করার পর বছর পাঁচেক আগে অনার্স শেষ করে এলাকার এক বড় ভাইয়ের কল্যানে মার্চেন্ডাইজিং-এর এই চাকরীটি যোগাড় হয়। তারপর থেকে সংসারটিকে মূলত সে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে অবশ্য মায়ের ওষুধের খরচটা হয়ে যায়। বাকি সবকিছু সেই দেখভাল করে। করেও যাবে বাকি জীবন। এতে তার কোন খেদ নেই, বরং এক গভীর আনন্দ রয়েছে। মা’র জন্য, ছোট ভাইবোনের জন্য কিছু করার আনন্দ।
চার
হিমেল মা’র শাড়ী সমেত ল্যাপটপ ব্যাগটি বুকে ঝুলিয়ে বেশ ধীরে সুস্থে আয়েশি ভঙ্গিতে বাইক চালাতে থাকে। এমনিতেও অবশ্য এই বিষয়ে সে বেশ সাবধানী। হেলমেট ছাড়া কখনো বাইক চালায় না। ঘন্টায় ৬০/৭০ কিলোমিটারের উপর স্পিড উঠায় খুব কমই। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মাকে ফোন দিয়েছিলো। মা বারবার বলে দিয়েছেন যেন খুব সাবধানে বাইক চালায়। সে যতই বলে ধীরে বাইক চালাবে মা ততই শঙ্কা বোধ করেন। অতঃপর ছেলের উপর আস্থা রাখতে না পেরে ফোনের ভেতর থেকেই আয়তুল কুরসি পরে ছেলের বুকে ফু দিয়ে দেন। মা’র এমন পাগলামি দেখে হিমেল মনে মনে হাসে। ইফতারে কি খাবে মা জানতে চাইতেই পাতাকপির বড়া আর গুড়ের শরবত করতে বলে। কতদিন হলো এই দুই জিনিস খাওয়া হয় না।
এইবার বাড়ীতে গিয়ে হিমেলের একটি পরিকল্পনা রয়েছে। পুরোনো বুন্ধুবান্ধবদের নিয়ে একটি রি-ইউনিউন করবে। স্কুল লাইফের বন্ধুদের কে কোথায় আছে খুব জানতে ইচ্ছে করে। যদিও আজকালকার বেশিরভাগ রি-ইউনিউনই নিজেকে জাহির করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গণ্য হয়, তবে হিমেলদের রি-ইউনিউনটি তা হবে না। হিমেল আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে তাদের রি-ইউনিউনে বর্তমানে কে কত বড়ে পদে আছে, কার স্যালারি কত বেশি- এইসব বিষয় নিয়ে কোন কথা হবে না। তাদের রি-ইউনিউনে শুধুমাত্র ছোটবেলার কথা হবে। কে ক্লাস ফাকি দিতে গিয়ে স্যারের হাতে ধরা পড়েছিল। কে টাক হয়ে আসার পর সবাই তার মাথায় চাটি মেরেছিল। কে স্কুল বাথরুমের পেছনে গিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলো……
এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাতই হিমেল লক্ষ্য করে তার বামপাশ দিয়ে এক সাইলেন্সার বিহীন বাইক বিকট শব্দে একেবারে গা ঘেষে তাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। হিমেল আকস্মিক এই আক্রমনে ডান্ দিকে কাটতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে চলন্ত বাইক সমেত পিছলে পড়ে। আর তখনই পেছন থেকে এক বাস এসে খুব স্বাভাবিকভাবে তাকে চাঁপা দিয়ে চলে যায়। বাইকটি একদিকে ছিটকে যায়। হিমেলের নিথর দেহটি রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকে। বুকের উপর ল্যাপটপ ব্যাগে থাকা মায়ের জন্য কেনা শাড়ীটি সেভাবেই রয়ে যায়।
পাঁচ
তিন মাস ঊনিশ দিন পর….
চলন্ত বাসের জানালার পাশে বসে থাকা ফরিদ উদ্দিন হঠাতই দেখতে পান তার পাশ দিয়ে সাইলেন্সার বিহীন এক বাইক বিকট শব্দ করতে করতে তীরের বেগে ছুটতে গিয়ে হঠাতই নিয়ন্ত্রন হারিয়ে হলিউড অ্যাকশন মুভির দৃশ্যের ন্যায় সাত আটটি পল্টি খেয়ে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে পড়ে। সাথে সাথে আশেপাশের মানুষজন দৌঁড়ে যান বাইকওয়ালাকে দেখতে। ফরিদ সাহেবের বাসটিও বাইকওয়ালাকে অতিক্রম করার সময় কিছু সময়ের জন্য থামান কি অবস্থা দেখতে। মাথার একপাশ পুরো উড়ে গিয়েছে।মগজ থেতলে গিয়ে রাস্তার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ফরিদ সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন এমন বীভৎস একটি দৃশ্য দেখার পরো কারো মাঝে কোন বিকার নেই। বরং সকলের চেহারায় একটি ঘৃণার অবয়ব ফুটে উঠে। একজন তো বলেই উঠেন-‘ঠিকই আছে, এগুলা মরুক। পুরা সমাজটারে ধ্বংস কইরা দিতাছে। এগুলা যত কমবো, সমাজের জন্য ততই ভালো।’
০ Comments