ভাগশেষ
প্রকাশিত: জানুয়ারী ১১, ২০১৯
লেখকঃ augustmault0163

 2,543 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

জিন্নাত রিমা

আমাদের একান্নবর্তী পরিবারটা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আমরা ছোটরা সবাই আড়াল থেকে সব শুনে যাচ্ছি। কাল থেকে এই পরিবারের সবাই আর এক হাড়ির ভাত খাবে না। এক হাড়ির ভাত না খাওয়ার ব্যাপারটা আমি কিছুটা বুঝলেও বাকিদের বুঝার মতো বয়স হয়নি। তবুও যে যার মতো গম্ভীর হয়ে আড়াল থেকে বড়দের কথা শুনে যাচ্ছি। ছোট চাচার মেয়ে মিতু আমার শার্ট পিছন থেকে টেনে ধরে বলল,’ ভাইজান, বাবারা কী বলছে? আমরা কি একসাথে থাকব না?’
আমি বললাম,’ একসাথেই থাকব,খাব না। মিতু চুপ করে থাক। কী বলে শুনি। মিতু সুবোধ বালিকার মতো চুপ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।
জায়গা-জমি দুপুরে ভাগ হয়ে গেছে। বাবা চাচারা এখন বৈঠকে বসেছে, দাদা দাদিকে ভাগ করতে। দুপুরের কথা মনে পড়তেই মনে পড়ে গেল পেয়ারা গাছটার কথা। বাড়ির পশ্চিম কোণটায় ছাল বেয়ে বেড়ে উঠা সেই পেয়ারা গাছটার কথা। যেটাতে প্রতিবছর ঠাসা ঠাসা পেয়ারা ধরে। আমি ছাড়া গাছটাতে কেউ উঠতে পারে না।
গাছটা এখন আর সবার নেই। ছোট চাচার ভাগে পড়েছে গাছটা। আচ্ছা,চাচিমা কি আমায় উঠতে দিবে গাছটাতে? সম্ভবত দিবে না। এই ভাগাভাগির ব্যাপারটা প্রথমে ছোট চাচিই তো বলেছেন।
বসার রুম থেকে ছোট চাচার আওয়াজ শুনলাম, ‘ বড়,( বাবাকে সবাই বড় বলে) সেজ আর আমি ছোট মায়ের ভাগটা আমাদেরই। মেজ আর তুই দুজনে বাবাকে নে। মাসের পনেরো দিন মা আমার সাথে খাবে আর পনেরো দিন সেজ’র সাথে। তোরা দুজনও বাবাকে সেভাবে খাওয়া।’
বাবা বললেন,’ ঠিক আছে তাই হোক।’
মেজ চাচা বললেন,’ তবে বাবা মার কোনো অসুখ হলে সেটার চার ভাইয়েরই সমান খরচাপাতি দিতে হবে।’
সেজ চাচার কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না।আমার পিছনে চাচাতো ভাই বোনেরা দাঁড়িয়ে সব শুনছে। মেজ চাচার দুই ছেলে সুমন আর রুমন। রুমন হঠাৎ-ই শব্দ করল, সুমনকে বলল,’ বুঝলি দাদা, বড় হয়ে আমি মাকে খাওয়াবো, তুই বাবাকে।’
আমার বাবার প্রতি কেমন একটা ঘৃণা জমে যাচ্ছে।
বসার ঘর থেকে আবার সেজ চাচার আওয়াজ আসছে,’ বাবা, মা তোমাদের কোনো আপত্তি আছে? থাকলে বলতে পার।’
দাদা উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন,’ নারে, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তোরা যা ভালো মনে করিস তাই কর।’
দাদা লাঠিতে ভর করে রুমের দিকে অগ্রসর হলেন। দাদার পিছুপিছু দাদিও।
যে যার রুমে ঢুকে গেলেন। আমি, সুমন,রুমনও শুয়ে পড়লাম বিছানায়। শোয়ার সাথে সাথেই সুমন,রুমন ঘুম। আমার ঘুম আসছে না। আমার কেবল কাল দাদা দাদি আলাদা খাবে সে কথায় মনে পড়ছে। আমার বুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকে কখনো দাদা, দাদীর একে অপরকে ছেড়ে কিছু খেতেই দেখিনি। তারাই নাকি কাল থেকে আলাদা খাবে। কে কী খাচ্ছে তা দেখবে না। পারবে তো দুজন মানিয়ে নিতে? কত দিনই বা বাঁচবে এরা? কেন বৃদ্ধ বয়সে মা বাবারা বোঝা হয়ে যায়? কই বাবারা চার ভাইকে তো দাদা দাদি কখনো ভাগ করে খাওয়ায়নি।
ভোরের আলো ফোঁটে গেছে। দাদা রোজ সকালে মসজিদে যাওয়ার জন্য আমাকে ডাকেন। অথচ আজ ডাকলো না। আমি সেই কবে জেগে বসে আছি। বাধ্য হয়ে নিজেই গেলাম দাদাকে ডাকতে। আরেকটু পরে ফজরের নামাজ কাযা হয়ে যাবে।
দাদা প্রায় সময় আমাকে সকালে ডাকতে গিয়ে বলতেন,’ বুঝলি আমার ঘুম হচ্ছে পাতলা। একটু শব্দ হলেই ঘুম
ভেঙে যাই। আর তোকে ডেকে ডেকে হয়রান হলেও তোর ঘুম ভাঙে না। অথচ দাদাকে পনেরো মিনিট ধরে ডেকেও কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। সেজ চাচার রুমটা দাদা দাদির রুমের পাশে। আমার ডাকাডাকিতে চাচা উঠে আসলেন। উনিও চেষ্টা করলেন। কাজ হলো না। পরে মেজ চাচা আর ছোট চাচা এসে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুললেন।
দাদা দাদির রুমে বড়দের কান্নার রোল পড়ে গেল। আমার এটুকু বুঝতে কষ্ট হলো না যে আমার ঘুম পাতলা দাদা দাদি আজ চিরতরের জন্য গভীর ঘুমে মগ্ন। কোনো কঠিন শব্দই আর এদের কানে পৌঁছাবে না। জাগাবে না। আমার কান্না আসছে না। আমি বড়দের কান্না দেখে রাতের অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠছি।
গত রাতে সুমন রুমন ঘুমিয়ে যাওয়ার পরও আমার যখন ঘুম আসছে না, তখন আমি বিছানা ছেড়ে উঠি। ধীর পায়ে হেঁটে দাদাদের রুমের দরজায় এসে দাঁড়াই। তখনো তাদের রুমের দরজা খোলা। আমি আড়াল থেকে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করি।
দাদা:- জাহানারা, আমাদের অতীতের কথা মনে আছে তোমার?
দাদি:- কোন কথা?
দাদা:- খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল তোমার,আমার সাথে। অল্প বয়সের বউ বলে অভিমানটাও বেশি ছিল তোমার। মনে আছে বিয়ের কয়দিন পর এক বন্ধুর জোরাজুরিতে রাতের খাবারটা তার বাসায় খেয়ে আসতে হলো। এসে দেখি, তুমি না খেয়ে বসে আছো। আমি খেয়ে এসেছি শুনে সে কি রাগ না উঠলো তোমার। কত কিছুই না করলাম তবুও সেই রাতে তোমাকে আর খাওয়াতে পারিনি ভাত। পরদিন তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম তোমাকে রেখে কিছুই খাব না। যা খাওয়ার একসাথেই খাব।
দাদি:- হুমম, মনে আছে আমার। আর সেই অভ্যাসটা এই বয়সে এসেও ছাড়তে পারিনি।
দাদা:- কিন্তু কাল থেকে তো অভ্যাসটা পাল্টাতে হবে। পারবে তুমি?
দাদি:- না, তুমি পারবে?
দাদা:- জানি না।
দাদি:- জানি পারবে না। তাই তো আমাদের শেষ খাওয়াটা আমি জোগাড় করে রাখলাম।’
তাদের কথা শেষ হতে না হতেই আমি রুমে ঢুকে পড়ি।
,’হাসান এখনো ঘুমাসনি তুই?
না,দাদা ভাই ঘুম আসছে না। আজ রাতটা তোমাদের সাথে থাকি। কি রাখবে?
দাদা বললেন,’ থাক, সমস্যা নেই।’
কিন্তু দাদি রাজি হলেন না। উনি বললেন:- না, আজ নয় কাল থাকিস। যা এখন ঘুমোতে যা।’
বুঝলাম দুজনের মন খারাপ। তাই আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দাদাকে বললাম,’ দেখবেন দাদা, বড় হয়ে আমি এর প্রতিশোধ নিব। আমি আর আমার ভাই শিফন মিলে মা বাবাকে ভাগ করব।’
দাদা ধমক দিয়ে বললেন, ‘ ছিঃ ছিঃ দাদু ভাই মা বাবাকে নিয়ে এসব কথা বলতে নেই। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
গত রাতের ভেঙে যাওয়া পরিবারের সকলে আজ দু’টো লাশের পাশে জড়ো হয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
আমি দরজায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে। বিছানায় শুয়ে আছে দুটো লাশ। পাশে পড়ে থাকা খালি বিষের শিশি। যা ছিল দাদা দাদির শেষ খাওয়া।আমি দু’টো লাশের মাঝে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভালোবাসার একজোড়া পাখি। যারা একে অপর থেকে বিচ্ছেদ হবে না বলেই একসাথে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে।
(বি:দ্র: আমরা সকলে জানি আত্মহত্যা মহাপাপ। আমার গল্পের বৃদ্ধ দম্পতির আত্মহত্যাকে আমি মোটেও সমর্থন করছি না। এই গল্পের মাধ্যমেই একটা ম্যাসেজ দিতে চাই। আর তা হলো, অন্তত মা বাবা বেঁচে থাকতে যেন কোনো পরিবার ভাগ না হয়। কোনো ভাইরা যাতে না বলে, মা আমার সাথে খাবে বাবা তোর সাথে।)

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৪ Comments

  1. halima tus sadia

    সত্যিই খুব খারাপ লাগলো।

    বাবা মা কতো কষ্ট করে সন্তান্দের বড় করে,আর সেই সন্তান বড় হয়ে বৃদ্ধ বয়সে যখন বলে বাবা আমার ঘরে খাবে আর মা অন্য ভাইয়ের ঘরে খাবে।

    কথাগুলো সবাই মেনে নিতে পারে না।
    তেমনি গল্পের দাদা দাদীও হয়তো মেনে নিতে পারেনি।
    তাই শেষ মুহূর্তে এই পথ বেছে নিতে হয়েছে।

    শুভ কামনা রইলো।

    Reply
  2. halima tus sadia

    সত্যিই খুব খারাপ লাগলো।

    বাবা মা কতো কষ্ট করে সন্তান্দের বড় করে,আর সেই সন্তান বড় হয়ে বৃদ্ধ বয়সে যখন বলে বাবা আমার ঘরে খাবে আর মা অন্য ভাইয়ের ঘরে খাবে।

    কথাগুলো সবাই মেনে নিতে পারে না।
    তেমনি গল্পের দাদা দাদীও হয়তো মেনে নিতে পারেনি।
    তাই শেষ মুহূর্তে এই পথ বেছে নিতে হয়েছে।

    শুভ কামনা রইলো।

    Reply
  3. Md Rahim Miah

    থাকব-থাকবো
    খাব-খাবো
    পার-পারো
    রোল-ঠেলা(রোল দিয়ে আসলে ক্লাসের রোল নাম্বার বুঝায়)
    খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল তোমার, আমার সাথে -খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার সাথে তোমার (এইভাবে দিলে লাইনটা মিলতো)
    খাব-খাবো(যেহেতু তুমি বলা হয়েছে)
    পারবে তুমি? -পারবে কি তুমি? (যেহেতু প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেওয়া হয়েছে কি দেওয়ার উচিত ছিল)
    তুমি পারবে? -তুমি কি পারবে?

    বাহ্ চমৎকার লিখেছেন, পড়ে অনেক অনেক ভালো লেগেছে। গল্পের মাঝে বাস্তবতা ফুটে তুলেছেন বলা যায়। যদিও জানি না এইসব বিষয়ের জন্য কখনোও
    কোনো পিতা-মাথা আত্মহত্যা করেছে কি না। যাইহোক আসলে আজকাল বেশিরভাগ সন্তানই তাদের বাবা-মাকে এইভাবে ভাগ করে নেয়। বানানে তেমন ভুল নেই মাত্র কয়েকটা আর কিছু ভুল যা উল্লেখ করেছি। আগামীতে এইসব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন আশা করি, অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।

    Reply
  4. আফরোজা আক্তার ইতি

    গল্পটা পুরোপুরি বাস্তবকে ঘিরে লেখা। পড়ে চোখে পানি এসে গেল, মনটাও খারাপ হয়ে গেল।
    আমাদের সমাজে এখনও কিছু পরিবার আছে যারা তাদের বাবা-মাকে বোঝা মনে করে। বাবা মায়ের প্রতি খরচকে আলগা এবং অযথা খরচ বলে মনে করে। অবশেষে কেউ তাদের পাঠিয়ে দেয় বৃদ্ধাশ্রমে নয়ত আবার কেউ ভাইবোনের মাঝে পিতামাতার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয় যেটা খুবই হীনম্মন্য কাজ। তাদের এসব কীর্তি দেখে শিখে বাচ্চারাও। পরবর্তীতে তারাও মায়ের সাথে এমনটাই করে।
    তবে বৃদ্ধ বৃদ্ধার আত্মহত্যাকে গল্পের শেষাংশ না দিয়ে অন্যভাবে রূপ দেয়া যেত। তাহলে গল্পটা সুন্দর হতো।
    আর হ্যাঁ গল্পের বার্তাটা অবশ্যই সঠিক ও শিক্ষণীয়।
    অনেক সুন্দর হয়েছে। বানান কিছু ভুল আছে।
    হাড়ি- হাঁড়ি।
    সে কথায়- সে কথাই।
    ভেঙ্গে যাই- যায়।
    শুভ কামনা অজস্র।

    Reply

Leave a Reply to আফরোজা আক্তার ইতি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *