লেখকঃ
জেসমিন আফরিন স্মৃতি
(মে – ২০১৮)
………………
ছোটবেলায় তেলাপোকাকে খুব ভয় পেতাম। এখন অবশ্য পাইনা। তবে তেলাপোকার প্রতি ঘেন্না ভাবটা আছে। গায়ের ওপর পড়লে চিৎকার দেওয়া ওটা ব্যতিক্রম কিছুইনা। মা এ নিয়ে অনেক বকতেন। তবে এখন আর বকেন না। টিকটিকির ব্যাপারে আমার অন্য রকম আগ্রহ ছিল। একবার একটা টিকটিকির লেজ ছুঁয়ে দিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে লেজটা ছিড়ে মাটিতে পড়ে গেল। খুব মজা পেয়েছিলাম।
এ মুহুর্তে আমি টিকটিকি দেখছি। সেই ছোটবেলার সেই টিকটিকির কথা মনে পড়ছে, অবশ্য একটু কষ্টও হচ্ছে তার জন্য। অবশ্য আমি ওর চেয়েও বেশি কষ্টে আছি। হৃদয় ছিড়ে রক্ত ঝরছে, চোখ শুকনো, সিলিংয়ে ঝুলে থাকা টিকটিকিগুলোকে দেখছি। তিনটা টিকটিকি দুইটা একসাথে, আরেকটা অনেকটা দূরে। দৃশ্যটা অন্য সময় দেখলে হয়ত একা একা হলেও হাসতাম, সামান্য লজ্জাও পেতাম, অথচ এখন খুব আগ্রহ ভরে এদের দেখছি।
আমি শুয়ে আছি হসপিটালের নরম সুন্দর বিছানায়। অন্যান্য রোগীদের তুলনায় আমার যত্ন একটু বেশি করেন নার্সরা, কেননা আমার শশুর মশাই আমাকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবেন, অনেক ভালোও বাসেন আমাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় মেয়ে আমি।ছোট আরো দুই বোন। যথেষ্ট সুন্দরী আমরা তিন বোন। কিন্তু পর্যাপ্ত বয়স হওয়া সত্ত্বেও যৌতুক এর ব্যাধিতে আক্রান্ত, তাই বিয়ের পিরিতে বসা হয়নি কোনো বোনেরই। সে বছর মামা এক ধনাঢ্য পরিবারের ছেলের সাথে আমার বিয়ের সমন্ধ আনেন, বাবা- মা তো মহা খুশি। তাও আবার কোন প্রকার যৌতুক ছাড়াই নাকি আমার শশুর মশাই আমাকে তার পুত্রবধু করতে রাজি।ছেলে নাকি দেখতে হ্যাংলা পাতলা, বাউ হালে বাতাসে ঢুলে এমন আরকি। যাকে এক কথায় বলে রোগা পটকা। যাই হোক এমন কথা শোনার পরও বাবা মা তাদের মেয়েকে সেই ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি। বাবা মার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। বসে গেলাম বিয়ের পিরিতে। অনেক আনন্দ আর হৈ চৈ করে বিয়ে সম্পন্ন হলো।
স্বভাবতই স্বামীকে অনায়সে গ্রহন করা বাঙালি নারীর বৈশিষ্ট্য। আমিও তার ব্যাতিক্রম না। ওনাকে দেখলে মনে হয় যেন কত বছর থেকে ওনি কোন প্রকার অসুস্থতায় ভুগছেন। ওনাকে প্রায় খেয়াল করতাম জ্বরে বিছানায় গুটি মেরে শুয়ে থাকতেন, আস্তে আস্তে যেন তার দেহের ওজন কমতে কমতে জীর্ণ শীর্ণ অবস্থা। আমি ডাক্তার দেখানোর কথা বললেই তিনি আমাকে এড়িয়ে যেতেন। কেমন জানি মনে হত যে মানুষটা কি কিছু লুকোতে চায়। বিয়ের ছয় মাস পর তাকে জোর করেই ডাক্তার দেখালাম, আর যা রিপোর্ট আসলো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। অবশেষে রিপোর্ট বলে দিলো তার সমস্যা। এইচ আই ভি। যা তিনি বিদেশে কর্মরত থাকা অবস্থায় বাঁধিয়ে ছিলেন। আর তার এই কথা তার বাবা মা জানতেন না, বলেই তিনারা এখন আমার এই পরিনতির জন্য নিজেদের দোষারোপ করেন। কিন্তু আর কি করা সে ও আছে চিকিৎসারত যদিও প্রতিকার নেই।
খুব সুখী হতে চেয়েছিলাম তো তাই সুখ আমার কপালে রইলো না। রক্তের অনুচক্রিকার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে, কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরন বন্ধে সাহায্য করে। হৃদয়ের রক্তক্ষরন বন্ধে সাহায্য করে এমনকি কোন কণিকা আছে কি………….?আমিও এখন ঐ একলা টিকটিকির মতো, টিকটিকির মন, অন্তর আছে কি না আমি জানিনা। তবে আমার আছে। আর সেখানে শুধুই রক্তক্ষরন চলছে। কবে থামবে জানিনা।
০ Comments