লেখা:তানজিনা তানিয়া
(জুন – ২০১৮)
……………
উঠোনের কোণে ডালিম গাছ। চিরল চিরল সবুজ পাতা। গাঢ় সবুজ অার পুরু পাতায় গাছ ভর্তি। হাত চারেক লম্বা গাছ। চিকন চিকন লতার মত ডাল পালায় গাছ ভর্তি। গাছের বয়স পাঁচ বছর ছুঁই ছুঁই। গাছের অাশ পাশ বেশ পরিষ্কার, ফকফকা। পুরু উঠোন কখনো ময়লাতে ভরে গেলেও, ময়লা জমেনা ডালিম গাছের গোঁড়ায়। জমেনা বলতে, জমতে দেয়া হয় না। অার জমতে দেন না অামার বাবা। ডালিম উনার প্রিয় ফল। তাই উঠোনের কোণে উনি ডালিমের চাড়া লাগিয়েছিলেন বছর পাঁচ হয়। এতদিনে গাছে ডালিম হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ডালিমতো দূরের কথা, অাজ অব্দি গাছে ডালিমের ফুলও অাসে নি কোনদিন। কিন্তু, বাবা হাল ছাড়েন নি। নিয়মিত ডালিম গাছটির নীচের ছোট ছোট ডাল পালা ছেঁটে দেয়া, গাছের গোঁড়ার অাগাছা পরিষ্কার করা, গরমের মৌসুমে গাছের গোঁড়ায় সকাল বিকেল পানি দেয়া; এই কাজগুলো তিনি নিরলস ভাবে অবিরাম করে যাচ্ছে গত পাঁচটি বছর। এই ডালিম গাছটির পেছনে বাবার এত যত্ন দেয়ার অারো একটি বিশেষ কারণ অাছে। এই গাছটি বাবা অামাদের এলাকার মাধ্যমিক স্কুলে বৃক্ষরোপন সপ্তাহ উপলক্ষ্যে অায়োজিত অালোচনা সভার অতিথি হিসেবে পুরস্কার স্বরুপ পেয়েছিলেন। প্রথম প্রথম ডালিম গাছটির সৌন্দর্য অামাদের পরিবারের সবার মন কাড়লেও, যখন নির্ধারিত সময় পাড় হবার পরও গাছটি ফল দিচ্ছিল না, তখন গাছটি সবার চোখের দুশমন হয়ে গেলো। অাগে যারা গাছটিকে দেখে, বাহ! কি সুন্দর দেখতে বলতো, তারাই এখন গাছটিকে উঠোনের কোণের জঞ্জাল উপাধি দিয়েছে। অাসলে অামরা মানুষ জাতটাই স্বার্থপর। অামরা যার থেকে কিছু পাই, তাকেই ভালবাসি অার যার থেকে পাইনা, তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি। ডালিম গাছটির অবস্থাও বর্তমানে তাই। সবাই অবহেলা করলেও, বাবা গাছটিকে অাগেও যেমন যত্ন করে বড় করেছে, এখনো তেমনি যত্ন করে। বাবারা অনেক ধৈর্যশীল হয়। অামার বাবাও তার ব্যাতিক্রম নয়। গাছটি যেদিন বাবা লাগিয়েছিলেন, সেদিন অামাদের তিন ভাইকে ডেকে বাবা বলেছিলেন, অাজ থেকে অামার চার ছেলে। সুমন, শাওন, সাদেক অার ডালিম। কথাটা বলেই বাবা হা হা করে হাসিতে ভেঙে পড়েছিলেন। অামিও অামার বয়স্ক কিন্তু বাচ্চা বাচ্চা মনের বাবার কথা শুনে ফিক করে হাসি দিয়েছিলাম। কিন্তু অামার বড় দুই ভাই বাবার কথায় বিরক্ত হয়ে একজন বলেছিল
-বাবা, কাজ ফেলে এটা দেখার জন্য ডেকেছ তুমি? একটা চাড়া গাছ অাবার সন্তান হয় কি করে? যত্তসব।
অারেকজন বলেছিল
-তোমারতো কাজ কর্ম নেই। তাই কত ঢং করতে মন চায়। এসব ঢং দেখার সময় অামার নেই।
বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলা ভাইয়াদের কথাগুলো অামার বুকে তীরের মত বিঁধেছিল সেদিন। অামি বোকার মত বাবার দিকে তাকালাম। দেখি, বাবার মুখে কোন পরিবর্তন নেই। যেন কিছুই হয় নি। সেদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম যে, বাবাদের অনেক ধৈর্য থাকে। অামার বয়স ছিল তখন বারো। অামার মন খারাপ হতে দেখে বাবা অামাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল
-বুড়ো কালে মানুষ অাবার শিশু হয়ে যায়রে বাপ। যে যেমন খুশি ব্যবহার করে। এ নিয়ে যদি অামাদের মত বুড়োরা মন খারাপ করি, তাহলে যে ঝামেলা বেড়েই চলবে। এ নিয়ে মনে দুঃখ নিবি না। তুই বিয়ে করে ফেললে, অামিও তোর কাছে বাচ্চা হয়ে যাব। অার তখন তুইও অামার সাথে……….
যদিও অামার বয়স তখন কম ছিল, তবুও অামি বাবার মুখে হাত চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলাম, না বাবা, অামি কখনো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। প্রয়োজনে কোনদিন বিয়ে করব না, তবুও তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে দিব না বাবা। বাবা অামাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল সেদিন। শিশুকালে যেমন মানুষ বাবা মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে, তেমনি বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন অার গায়ে যৌবনের মত শক্তি থাকে না। গায়ে খাটার ক্ষমতা থাকে না। ছেলেদের উপর নির্ভর করতে হয় ভরণ পোষনের জন্য। অার এই সুযোগে বেশির ভাগ ছেলেই বাবা মায়ের উপর খবর দারিত্ব করে। বাবা মাকে কামাই করে খাওয়ায়, এ জন্য তারা নিজে নিজে গর্ব বোধ করে অার বাবা মাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। এই সময় বোধ হয় তারা ভুলে যায় যে, এক সময় এই বাবা মায়েদের উপর নির্ভর ছিল তাদের জীবন। বাবা কিংবা মা কিন্তু তখন তাদেরকে এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে নি।
বৃদ্ধ বয়সে অামার বাবা অন্যদের থেকেও অারো বেশী খারাপ সময়ের মধ্যে পড়েছিল, কারণ অামার জন্মের সময়ই অামার মা মাড়া গিয়েছিলেন। বাবার কোন কষ্টের সময়ে বাবাকে শান্ত্বনা দেবার মত কেউ ছিল না। বাবা ছেলে মানুষি কিছু কাজ করে দিন পার করতেন। এই কখনো ঘরের দরজাটা রং করছেন, কখনো বা বিছানা পরিষ্কার করছেন অাবার কখনো বা জানালার গ্রিলগুলো ন্যাকড়া দিয়ে মুছে মুছে পরিষ্কার করছেন। অাবার এই কাজগুলোর মধ্যে কোন কিছু ভুল হলে ভাবীরা বাবাকে নানান কথা শুনাতেন। একবার বাবা অালনার ঘুণে খাওয়া এক পাশ রং করছিলেন। ভুল করে সামান্য রং ভাবীর শাড়ীতে লেগেছিল, অার তাতেই
বড় ভাবী বাবাকে যা তা বলে অপমান করে। অামি রেগে গিয়ে ভাবীকে বলেছিলাম
-সাবধান ভাবী। বাবাকে, বকবে না একদম।
ও কথা বলে সেদিন এত বড় ভুল করেছিলাম যে, দাদাভাই অামাকে ঠাস করে এসে গালে একটা চড় মেরেছিল। অামি অায়নায় গিয়ে যখন নিজের মুখটা দেখছিলাম, দেখি পাঁচ অাঙ্গুলের ছাপ বসে গেছে অামার ফর্সা গালে। সেদিন রাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম। অামার বাবা খুব ধৈর্যশীল মানুষ। তবু সেদিন অামি অামাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখা অামার বাবার ফোঁপানোর অাওয়াজ পেয়েছিলাম। অামি কান্নার জন্য ঠিক করে কথাও বলতে পারছিলাম না। বাবা অামাকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিলেন
-শিশুদের কারো কথার জবাব দিতে নেই সাদেক। তুই ও শিশু, অামিও শিশু। অামরা সব সময় চুপ থাকব, কেমন?
অামি বাবার সাথে বাবার অনুগত ছেলের মত মাথা নাড়িয়েছিলাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা বাড়ির পাশের জমিতে হাল ধরেছেন। অামার ৬৫ বছর বয়সের বাবাকে লাঙল ঠেলতে দেখে অামার বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। দাদাভাইয়ের উপর অামার চাপা রাগ, তাই ছোট ভাইয়ার ঘরে গিয়ে বললাম
-ছোট ভাইয়া, বাবা হাল চাষ করে। তুমি দেখ না?
ভাইয়া অামার কথা শুনে ভূত দেখার মত করে চোখ করে বললো
– এটা কি অষ্টমাশ্চর্য নাকি যে দেখার জন্য দাওয়াত দিচ্ছিস?
ছোট ভাইয়ার কথা শুনে অামি যারপরনাই অবাক হলাম। অামার মনের অজান্তেই অামার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম
-ছোট ভাইয়া, তোমার বুকে লাগেনা?
-কি লাগবে?
-ভাই, তোমার পরাণ পুড়ে না? অামাদের বাবা এই বয়সে কাজ করবে কেন?
ছোট ভাইয়া অামার দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বললো
-মাত্রতো ক্লাস সেভেনে পড়িস। অামরা এমন কোন জমিদার না যে, দুটো মানুষ বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াব। বাবার যে শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে, এটাই অনেক। একটু অাধটু কাজ করলে শরীর ক্ষয়ে পড়বে না। বরং অারো ভাল থাকবে বাবা। কাজ করলে শরীর ভাল থাকে। অসুখ-বিসুখ কম হয়।
অামি হতাশ হয়ে বড় দাদা ভাইয়ের ঘরে গেলাম। ভাবী অামাকে দেখে মুখের এমন একটা ভাব করলো যেন উনি পঁচা কোন দুর্গন্ধময় জিনিস দেখছে। দাদাভাইকে অবশ্য খুব স্বাভাবিক লাগলো। কোন কারণে তার মনটা বেশ ফুরফুরা। অামাকে দেখেই বললো
-সাদেক, কিছু বলবি?
অামার তখন ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। অামি হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে দাদাভাইয়ের পায়ে পড়ে গেলাম অার বলতে থাকলাম
-দাদাভাই, অামি বড় হয়ে চাকুরী করে তোমাদের সব ঋন শোধ করে দেব। তোমার দোহাই লাগে দাদাভাই। বাবাকে কাজ করতে দিও না। বাবার কষ্ট হয় তো……
কথাগুলো বলেও অামি কাঁদতেই থাকলাম।
দাদাভাই অামার কথা রাখলেন। বাবাকে জোর করে জমি থেকে তোলে দিয়ে বললেন যে, বাবার কোন কাজ করতে হবে না। সেই মুহুর্তে অামার কি যে ভাল লাগলো! অামি দাদাভাইয়ের কাছে গিয়ে নিজের গালটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম
-ভাই, অারেকটা থাপ্পর দিবা? তোমার থাপ্পর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুমি এখন একটা থাপ্পর দিলে অামি কিছুই মনে করব না।
বড় ভাই অামাকে টেনে কাছে বসালো। তারপর বললো
-সাদেক, বাবাতো তোর সব কথা শুনে। তুই বাবাকে একটু বুঝাবি?
-কি বুঝাব দাদা ভাই?
-বাবাকে বল, সব জমি অামার নামে লেখে দিতে। অামি তোদের সাড়া জীবন দেখবো। তোকে পড়াশুনে করিয়ে চাকুরীর ব্যবস্থাও করে দেব।
এবার অামি দাদাভাইয়ের এত ভাল ব্যবহারের রহস্য বুঝতে পারলাম। হয়তো অনেকদিন ধরে অাবদার টা মনে মনে নিয়ে ঘুরছে কিন্তু সুযোগের অভাবে বলতে পারছে না। অাজ সুযোগ পেয়ে সেটা অার হাতছাড়া করলো না অামার সচতুর দাদাভাই।
অামার তখন অল্প বয়স, তবু এটুকু বুঝি যে, বাবার জমি অামরা তিন ভাই সমান ভাগে পাব। অামি দাদা ভাইয়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম যে, বাবাকে বলব।
রাতে বাবার পাশে শুয়ে অাছি অামি। অামার বাবার গায়ের ঘ্রাণ সুধার মত। বিশুদ্ধতা অার পবিত্রতার অালাদা কোন ঘ্রাণ থাকে কিনা, সেটা অামি জানি না। তবে অামার বাবার গায়ের ঘ্রাণ অামার কাছে বিশুদ্ধতা অার পবিত্রতার ঘ্রাণের প্রতীক। অামার যখন কোন কারণে মন খারাপ হয়, তখন অামি বিড়ালের মত বাবার গায়ের সাথে ঘেঁষে বসি। বাবার গায়ের পবিত্র গন্ধ নেই বুক ভরে। অার তখনই অামার মন ভাল হয়ে যায়। অামি কোনদিন মায়ের অাদর পাইনি, তাই অামার কাছে অামার বাবাই অামার বাবা অাবার এই বাবা অামার মাও। অামার বাবা অামাকে ছোটবেলা থেকে কখনো অযত্ন করে নি। ভাইয়েরাও অামাকে বেশ অাদর করতো, কিন্তু তিন বছর অন্তর অামার দুই ভাই বিয়ে করার পর থেকেই সবকিছু কেমন বদলে গেলো। অামি অার বাবা কেমন যেন তাদের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম। দাদাভাই অাগে খাওয়ার সময় অামাকে কাছে বসিয়ে লোমকা বানিয়ে মুখে তোলে খাওয়াতো। বিয়ের পর অার সে অামাকে তেমন কাছে ডাকে না। সেদিনতো একটা থাপ্পরও দিল। দাদাভাইয়ের মেয়ে হওয়ার পর থেকে তো অার বাবার শরীরের খোঁজ খবরও রাখে না তেমন একটা। বাবার অ্যাজমার সমস্যা। ছোট ভাইয়া অামাকে অাগে দোকান থেকে কত মজা কিনে খাওয়াতো। এখন যদি মাঝে মাঝে পাঁচ-দশ টাকা চাই তাহলে কখনো ধমক দেয়, অার কখনো বা মুখে প্রচুর বিরক্তির রেখা টেনে পাঁচ বা দশ টাকার একটা নোট পকেট থেকে বের করে দেয়।
দাদাভাইয়ের অাবদারের কথা অামি বাবাকে বলতেই বাবা কেমন যেন একটু কেঁপে উঠলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। বাবার মুখটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল। অামি বাবাকে বললাম
-বাবা, অামার জমি লাগবে না। তুমি তোমার সব জমি দাদাভাই অার ছোট ভাইয়াকে লেখে দাও। তাতে করে, ওরা অামাদের অাবারও অাগের মত ভালোবাসবে বাবা।
বাবা অনেকটা অাবেগ নিয়ে অামাকে কাছে টেনে অামার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো
-বাবারে, ভালবাসা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ওদের যদি জমি লেখে দেই, তাহলে ওরা অামাদের অার খেয়ালই রাখবে না। এখনতো তবু জমির লোভে একটু অাধটু দেখে। দু মুঠো ডাল ভাত খেতে দেয়।
অামি বোকার মত বাবাকে প্রশ্ন করে বসি
-বাবা, অামাদের ভালোবাসার মত কেউ নেই, না? মা থাকলে অামাদের কত ভালোবাসতো, তাই না?
মায়ের কথা মনে করলেই বাবা কেমন যেন তপড়ায়। অামি স্পষ্টই বুঝতে পারি যে, তখন বাবার ভেতর মহা মূল্যবান কিছু হারানোর শোক প্রবল হয়ে উঠে। এখনও সেটাই হল। বাবা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো
-কে বললো অামাদের ভালোবাসার কেউ নেই?
এই যে তোকে অামি, অার অামাকে তুই ভালোবাসিস, সেটা কি ভালোবাসা নয় রে পাগল?
অামি বোকার মত অাবারো বাবাকে প্রশ্ন করে বসি,
-বাবা, তুমি মাকে খুব ভালোবাসতে, না?
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন
-তোর মা ছিল ধনী ঘরের শিক্ষিত এতিম মেয়ে। অামার মত সামান্য এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে ভালবেসে সে ঘর ছেড়েছিল। তোর মামারা কোনদিন অামাদের মেনে নেয় নি। অামি তোর মায়ের সব চাহিদা ঠিকমত পূরণ করতে পারতাম না। তবুও তার অামার উপর কোন অভিযোগ ছিল না। নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছে অামাকে অার অামার সংসারকে।
কথার এ পর্যায়ে বাবা একটু হাসেন। তারপর বলেন
-জানিস সাদেক, অামাকে বিয়ের পর তোর মায়ের প্রথম দাবী ছিল অামাকে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। প্রথম প্রথম পাড়তাম না অামি। পরে অাস্তে অাস্তে ঠিক হয়ে যায়। সুমন অার শাওনকেও সে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শেখায়। তোর জন্মের সময় তো তোর মা একেবারেই চলে গেলেন। তখন অামার মূল উদ্দেশ্য হয়, এই গ্রামে থেকেও তোকে শুদ্ধ ভাষায় কথা শেখানো। নইলে হয়তো দেখা যাবে, কোনদিন স্বপ্নে এসে তোর মা অভিমানের স্বরে বলবে
“তুমি অামার ছেলেটাকে গেঁয়ো ভাষা শিখিয়েছ”?
অামি কৌতুহল ভরা চোখ নিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম
-বাবা, মাকে স্বপ্ন দেখ তুমি?
বাবা অাবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে
-যে অামার জাগরণে অামার পুরুটা জুড়ে বিচরণ করে, তাকে কি স্বপ্ন দেখতে হয়রে বাবা?
দিন যায়। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ নামক একটি জেলার ছোট একটা গ্রামে অামি অার অামার বাবা কোনমতে দিনাতিপাত করি। বাবা পেনশনের অল্প যে কয়টা টাকা পায়, তাতে অামার পড়ালেখার খরচ হয়ে ভরণ পোষণ ঠিকমত হয় না। বাবার অ্যাজমার সমস্যার পাশাপাশি অল্প হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। জমি লেখে দিবে না শুনে দাদা ভাই চেতে যায়। অামাদের সম্পূর্ন ভাবে টাকা পয়সা দেয়া বন্ধ করে দেয়। ছোট ভাই মাঝে মাঝে কিছু দেয়, তবুও খুশি মনে না।
বাড়িতে যেই অাসে তারই অাগে নজর পড়ে ডালিম গাছটার দিকে। এতদিন হয়ে যাওয়ার পরও গাছে ডালিম হয় না দেখে সবাই বলে গাছটা কেটে ফেলে সেই জায়গায় অন্য চাড়া লাগাতে। বাবা গাছটার গায়ে হাত বুলায় অার বলে
-অনেক গাছ এমন অাছে, যেগুলো গাছের কাঠ পরিপক্ক হওয়ার পর বা গাছটি পরিপক্ক হওয়ার পর ফল ধরে। এতে একটু সময় বেশী লাগে। এই গাছে একদিন না একদিন ডালিম ধরবেই। সেদিন তোমরা অামার কথা মনে করবে।
অামার ভাইয়েরা গাছটির উপর বিরক্তি প্রকাশ করলে, বাবা হাসি মুখে বলে, অামার বয়স হয়েছে। অামি একদিন টুপ করে চলে যাব। এই গাছটি অনেক বছর বাঁচবে। এই গাছের প্রতিটি ইঞ্চিতে অামার হাতের ছোঁয়া অাছে। এই গাছটি যতদিন বেঁচে থাকবে, এই গাছের দিকে তাকালেই তোদের অামার কথা মনে পড়বে।
বাবার বিরোধিতার মুখে ভাইয়েরা গাছটি কাটতে পারেনা। কিন্তু ফল না দেয়া একটা ডালিম গাছ যে উঠোনের কতটা জায়গা দখল করে রেখেছে, সেটা নিয়ে ভাইদের বিরক্তির শেষ নেই। অামি গাছটিকে খুব ভালোবাসি। এর কারণ হচ্ছে, অামার বাবা গাছটিকে ভালোবাসেন। অামি খুব করে চাই, গাছটিতে একদিন হঠাৎ করেই ফুল ধরুক। সেই ফুলে অাস্তে অাস্তে পরাগায়ণ ঘটুক অার ফুল ভেঁদ করে ছোট এক ডালিম কড়া উঁকি দিক। সেই ডালিম কড়া দেখে অামার ভাইদের মন পরিবর্তন হোক। তারা কখনো বাবার ভালবাসা মাখানো গাছটির দিকে নেতিবাচক নজর না দিক। বাবার শরীরের যা অবস্থা, বাবা বেশীদিন বাঁচবে না। অামার বাবা না থাকা কালে এই গাছটির মধ্যে অামি অামার বাবাকে খোঁজে পাব।
দাদাভাই তো জমি লেখে না দেওয়াতে পৃথক হয়ে গিয়েছিল, অামি এস এস সি পাশ করার পর যখন কলেজে ভর্তি হব, সেই খরচের ভয়ে ছোট ভাইয়াও অালাদা হয়ে গেল। কোন মহিলা মানুষ ছাড়া অামার অার বাবার সংসারে দুর্ভোগ নেমে এলো। ঠিক মত রান্না বান্না করতে পারি না। কি রান্না করি, কি খাই জানি না। বাবা সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। বাবার অ্যাজমার সমস্যাটা বেড়েছে। রাতে শ্বাস নিতে বাবার বেশ কষ্ট হয়। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার কিন্তু টাকার সমস্যার জন্য নিয়ে যেতে পারি না। বাবার মাসিক অবসর ভাতার টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজী হল না। বাবা বলে
– এই টাকায় ডাক্তার দেখালে, সারা মাস দুই বাপ-ব্যাটা খাব কি? জমি বেঁচার কথা বললেও বেঁকে বসেন বাবা। বলেন, উনিতো এমনিতেও অার বেশীদিন বাঁচবেন না। শুধু শুধু জমি নষ্ট করার দরকার নেই। মরতেতো একদিন হবেই। বেঁচে ছেলেদের বঞ্চিত করতে চান না উনি।
বাবার কথা শুনে ব্যাথায় অামার বুকটা ভরে যায়। বাবাকে জমি বন্ধক দিতে বলি। বাবা তাতেও রাজী হয়না। বলে, অার কোন চিকিৎসায় নাকি তার কাজ হবে না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। নিজেকে খুব অকর্মণ্য মনে হয়। একদিন হুট করেই বাবা সিদ্ধান্ত নেয়, বাবার ছয় কাঠা জমি তিন ছেলের মধ্যে ভাগ করে লেখে দিবে। কথামত কাজ করেন বাবা। ভাইয়েরা দুই কাঠা করে জমি পেয়ে বেশ খুশি। সেদিন জমির দলিল করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। অামার দুই ভাইয়ের ঘর থেকেই অামাদের জন্য ভাল খাবার পাঠায়। অামার ওসব খাবারের দিকে চোখ যেতেই ঘৃনায় মন ভরে উঠলো। বিষের মত লাগতে লাগলো অামার কাছে খাবারগুলো। অামি সেগুলো ছুঁয়েও দেখলাম না। বাবাকে খুব জোরাজুরি করেও খাওয়াতে পারলাম না। বাবার সে রাতে শ্বাস কষ্টটা অারো বেড়ে গেলো। অামি কুপি জ্বালিয়ে বাবার শিঁয়রে বসে রইলাম সারা রাত। ইনহেলার দিলাম। তেল দিয়ে রসুন গরম করে বাবার বুকে অার পায়ের তলায় মালিশ করে দিলাম। রাত চারটার দিকে বাবার শ্বাস কষ্ট কিছুটা কমলো। বাবা অামাকে বললো
– সাদেক, খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ঐ দুই ঘরের খাবার অামার গলা দিয়ে নামবে না। তুই অামাকে অালু ভর্তা করে এক প্লেট ভাত খেতে দিবি বাবা? অামি দৌড়ে গিয়ে অামাদের ছনের রান্না ঘরের চুলোয় ভাত বসালাম অার ভাতের মধ্যে বড় বড় দুটো অালু সেদ্ধ দিলাম। ভাত হয়ে গেলে এক প্লেট ধোঁয়া উঠা গরম ভাত অার কাঁচা মরিচ দিয়ে করা অালু ভর্তা নিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে ডাকছি, কিন্তু বাবা সাড়া দিচ্ছে না। বোধ হয় ঘুমিয়ে গেছে ভেবে বাবার গায়ে ধরে
ডাকাডাকি করলাম। বাবা তাতেও সাড়া দিলেন না। অামি বাবার নাকের কাছে হাত ধরলাম, বুকে মাথা পাতলাম, পালস পরীক্ষা করলাম।
পালস পরীক্ষা করেই বুকটা অামার ধক করে উঠলো। অামার ভেতরে বিরাট বড় একটা দানবের মত পাখি ডানে ঝাপটালো। অার সেই ডানা ঝাপটানোর তীব্রতায় অামার ভেতরের সবকিছু কেমন চারপাশে ছিটকে পড়ে এলোমেলো হয়ে গেল। অামি কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। কখন যে চোখের পানি চিবুক বেয়ে বেয়ে গলার নীচে নেমে এসেছে সে খেয়াল নেই। বার বার অামার মগজের ভেতর চিৎকার করে কে যেন বলছিলো, ‘তুই এতিম, তুই এতিম”। অামি কাঁদছি কিন্তু শব্দ করতে পারছি না। শরীরেও তেমন জোড় পাচ্ছিনা । নড়াচড়া করার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছি। বাবার মাথার চুলে অাস্তে অাস্তে হাত বুলাতে বুলাতে মিহি স্বরে বললাম
-বাবা, ভাতগুলো খেয়ে গেলে কি এমন ক্ষতি হত? এত কিসের তাড়া ছিল তোমার? তুমি যখন পেটে ক্ষুধা নিয়েই চলে যাবে, তাহলে অামায় রাঁধতে কেন বলেছিলে?
বাবা কথা বলে না। অামি অাস্তে করে চৌকিতে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। অামার বাবার গায়ের গন্ধ কি সুন্দর! অামি বাবার গায়ের পবিত্র গন্ধ বেশী করে নিঃশ্বাসের সাথে নিয়ে অামার ভেতর ভরে ফেলতে চাইছি। বাবাতো অার নেই। বাবাকে যদি কবর দিয়ে দেয়, তাহলেতো অার কখনো মন খারাপের সময় বিড়ালের মত বাবার গা ঘেঁষে বসে বাবার গায়ের ঘ্রাণ নিতে পারব না। তাই বেশী করে এখন এই পবিত্র ঘ্রাণ নিয়ে নিচ্ছি, যাতে করে কলিজায় এই ঘ্রাণ অনেকদিন মজুদ থাকে।
রাত দশটার দিকে বাবার দাফনের কাজ শেষ করে এসে ঘুমিয়েছি। ভোর বেলা মানুষের চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙলো। দরজা খোলে দেখি, উঠোনের কোণের ডালিম গাছটাকে ঘিরে বাড়ির সবাই ভীড় করেছে। অামি সবার ভীড় ঠেলে ডালিম গাছটার দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, গাছটায় একটা ডালিমের ফুল ধরেছে। কি সুন্দর রংয়ের ফুল। অামি ফুলটার একদম কাছে নাক নিয়ে ফুলের ঘ্রাণটা বুক ভরে নিলাম। অাহ্! কি পবিত্র ঘ্রাণ! মুখ দিয়ে অাস্তে করে অবচেতন মনেই বলে ফেললাম, “বাবা”!
খুব সুন্দর লিখেছেন।
valo lagche. kintu sesh ta hut koree chole asche. arektu bistarito aslr val lagto