গল্প লেখকঃ
সোমা দাশ
(এপ্রিল – ২০১৮)
……………
মা, ওমা, খুব খিদে পেয়েছে, মা খেতে দাও। চিৎকার করে মাকে ডাকতে ডাকতেই প্রাসাদসম বাড়িতে ঢুকলো অর্থি। মা নিচে নেমে আসলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, যেখানে গেছ সেখান থেকে খেয়ে আসতে পারলে না?
চুপ করে গেল অর্থি। বুঝলো মা বুঝতে পেরেছেন সব টা। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই মা ডাকলেন, শুনে যা, তুই যা করছিস তা কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি অর্থি। এইসব ভাল লাগছে না আমার আর, গত দশটি বছর তোর কোন কাজে কোন সিদ্ধান্তে আমি কিছু বলিনি। এখন তুই সফল ব্যবসায়ী, টাকা পয়সা, গাড়ি বাড়ি সব আছে তোর, তাহলে আর কিসের অপেক্ষা? কেন এবার নিজের জীবন টা সুন্দর করে গড়ে নিচ্ছিস না?
মা প্লিজ আমি টায়ার্ড, মাকে থামাতে চাইল অর্থি। কিন্তু মমতাদেবী আজ আর নিরস্ত হবেন না বলেই পণ করেছেন। একদম চুপ, কি ভেবেছিলি তুই, আমি কিছু বুঝতে পারব না? যারা তোর উপর এত অত্যাচার, বদনাম করল তুই কিনা এখন নিজের কষ্টে গড়া সম্পত্তি তাদের ভাগ করে দিবি? এত বড় মনের মানুষ হয়ে গেলি তুই? কেনরে খুকি, তুই সব ভুললেও আমি কিন্তু কিছুই ভুলিনি খুকি, তোর শাশুড়ি নিজের নপুংশক ছেলেকে বাঁচাতে তোকে বাজা বদনাম দিয়েছিল, তোর সামনে থেকে ভাতের থালা কেড়ে নিয়েছিল,পড়াশুনা করতি বলে হাতে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়েছিল যাতে পরীক্ষায় লিখতে না পারিস। এক নিঃশ্বাসে বলেই মমতা দেবী সোফায় বসে হাঁপাতে লাগলেন। অর্থি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মা মা,প্লিজ শান্ত হও, লক্ষ্মী মা আমার,শান্ত হও।
খুকি, তুই যে আমার সাত রাজার ধন, আমার নাড়িছেঁড়া ধন রে মা। মমতা দেবী কাঁদতে লাগলেন। শত কষ্টের মাঝেও তোকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলাম মা। তোর বাবা যখন মারা গেলেন, কত বয়স তখন তোর, মাত্র ষোল। দুচোখে অন্ধকার দেখছিলাম, কি করে সংসার চালাবো, তখন প্রদীপ বাবু আমাকে তার ছেলের জন্য তোর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। অভাবের সংসার তার উপর উঠতি বয়সী মেয়ে, তোর নিরাপত্তার কথা ভেবে রাজি হয়েছিলাম। নিজের অজান্তেই তোকে সঁপে দিয়েছিলাম অমানুষদের কাছে।
ব্যস, মা ব্যস, অনেক হয়েছে থাম এবার, উত্তেজিত হয়ে পরলো অর্থি। সবাই অমানুষ ছিল না, আমার শ্বশুর মশাই, আমার ননদ, নন্দাইরা কেউ অমানুষ ছিল না, শুধু ওরা মা ছেলে ছাড়া। ছেলের অপারগতার কথা আমি জেনে ফেলেছিলাম বলেই শাশুড়ি এত ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। আজ আমার যা কিছু হয়েছে সব কৃতিত্ব আমার শ্বশুর মশাইয়ের। উনি শুধু শ্বশুর নন, উনি আমার বাবা। উনি ধর্মত আমাকে মেয়ে মেনেছেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন আমার সব ভার নিয়েছেন। নিজের বউ, ছেলে মেয়েদের কথা না ভেবে, ডিভোর্স হবার পরেও তার আয়ের একমাত্র উৎস শ্রীমা বস্ত্রালয় আমার নামে করে দিয়ে গেছেন। ফ্যাশন ডিজাইনিং এর সম্পুর্ণ কোর্স আমি তার টাকা দিয়েই শেষ করেছি। আজ দেশের স্বনামধন্য বিখ্যাত শ্রীমা ফ্যাশন হাউজের ডিরেক্টর হতে পেরেছি, ব্যাংক ব্যালেন্স করেছি, কোটিপতি হয়েছি, সব ওই মানুষ টার কারণে। একথা ভুলি কী করে মা? আমি জানি তুমি বিশিষ্ট শিল্পপতি অনুরাগ সাহার সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছ। আমি বিয়ে করব মা, কিন্তু তার আগে বাকি কাজটুকু শেষ করার জন্য আমায় সময় দাও কিছুদিন, প্লিজ মা।
অর্থির হাত ছাড়িয়ে নিজেকে সরিয়ে নিলেন মমতা দেবী, শান্ত গম্ভীর স্বরে বললেন, কি করতে চাইছিস তুই?
তেমন কিছু না,অর্থিও উঠে দাঁড়ালো। হাতে খুন্তির ছ্যাঁকার দাগে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আমি একটা শ্রীমা বস্ত্রালয় থেকে তিনটি শ্রীমা ফ্যাশন হাউজ করেছি। তুমি ত জানো আমার প্রাক্তন শাশুড়ি মানুষের বাসায় কাজ করে খেতেন, তুমি ত ওনাকে এখানে এনে রাখতে দিবে না। তাই আজ তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসলাম, মাসিক কিছু টাকার ব্যবস্থাও করেছি। অভিরূপ, মানে আমার প্রাক্তন স্বামী, দিন রাত নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, তাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে রেখে এসেছি। এখন বাকি আছে তার নামে কিছু টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখা। ডাক্তার বলেছেন, ভাল হলেও কিছু করে খাওয়ার মত শারীরিক অবস্থা তার হবে না, তাই যাতে বাকি জীবন আরামেই থাকতে পারে তার একটা ব্যবস্থা ত করতে হবে। যেমনই হোক পাঁচ বছর ত স্বামী ছিল। বড় নন্দাই ভাল চাকরী করেন, কিন্তু তারপরো আমার শ্বশুরের বড় মেয়ে তার অধিকার আছে বাবার টাকায়। তাই কিছু টাকা তার নামেও ফিক্সড করে দিয়েছি। বাকি ছোট ননদ আর তার বর। তুমি ত জানো মা, অভিরূপের কাছ থেকে ডিভোর্স নেয়ার ব্যাপারে আমার ছোট নন্দাই কত সাহায্য করেছিল, ওরা আমার পাশে ছিল বলেই আমি সেই নরক থেকে মুক্তি পেয়েছি। ওর চাকরি নেই আজ প্রায় ছয় মাস। ঘর ভাড়া বাবদ যা পায়, তাই দিয়ে তিন জনের সংসার টেনেটুনে চলে যাচ্ছে। ভাবছি, তাকে শ্রীমা ফ্যাশন হাউজের একটি শাখার স্বত্তাধিকার দিয়ে দিব, যেটা অভিরূপের পাওয়ার কথা ছিল। আর তারপরও যদি টাকার দরকার হয় তাদের ছেলে বাবাইয়ের নামে কিছু টাকা ফিক্সড করে দিব। এতে আমার কিছুই কম পরবে না মা। দেখ মা, তুমি স্বীকার কর বা না কর, ডিভোর্স এখানে আমাকে আমার কর্তব্য থেকে এক চুলো নড়াতে পারবে না। কারণ তাদের সাথে আমার সম্পর্ক কোন না কোন প্রকারে রয়েই গেছে, তাই আমি মনে করি আমাকে এই ব্যাপারে তোমার সাপোর্ট করা উচিৎ। আর দাঁড়ালো না অর্থি, মমতা দেবীও আর ডাকেন নি, জানেন কোন লাভ হবেনা। মেয়ে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল।
পাঁচ বছর পরের কথা…..
মমতাদেবী বাগানে বসে আছেন তার চার বছরের নাতনী তোর্শা আর তিন মাসের নাতি তিতির কে নিয়ে। দোতলার ব্যালকনি থেকে অর্থি তাকিয়ে দেখছে মায়ের প্রসন্ন মুখ। আকাশের দিকে চোখ রেখে অর্থি বলে উঠল, বাবা, শুনতে পাচ্ছ তুমি? আমি আমার কথা রেখেছি, তোমার ছেলে মেয়েদের পথে বসাই নি আমি। তোমার সহধর্মিণীর সম্মান রেখেছি, তুমি যে আমায় কোনদিন ছেলের বউ নয় মেয়ে বলেছিলে। তুমি যে বলতে, জন্ম না দিলেও তোমার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক আছে। তুমি বলেছিলে তোমার নাতি হলে তিতির আর নাতনী হলে তোর্শা নাম রাখতে আমি তাই রেখেছি বাবা। যদিও তারা অনুরাগ সাহার সন্তান, কিন্তু জন্ম ত আমি দিয়েছি বাবা, তাই ওরাও ত তোমার। আমি যে তোমারই মেয়ে বাবা, আমি যে তোমারই আত্মজা।
০ Comments