লেখকঃ মোঃ মাহমুদুল হক রনি
বাবা, মা, ছোটোভাই, আর আমি। এই আমাদের সুখী পরিবার। বাবার চাকরির সূত্রে ছোটোবেলা থেকে আমরা শহরেই থাকি। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুল ছুটি হলে তবেই গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়। আমার JSC পরীক্ষা শেষ। সামনে বিরাট ছুটি। ছোটোভাই সানি এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। তাই আর কোনো প্যারা নেই। মাকে আর ছোটোভাইকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাবা আসতে পারলেন না আমাদের সাথে। বাস, সিএনজি এসবে যাত্রা শেষ করে আমাদের নামতে হলো গাঁয়ের মেঠো পথে। রাস্তাটা হেঁটে যেতে হবে। দুপাশে সবুজ ফসলের ক্ষেত, ঠান্ডা বাতাস, হালকা রোদ, পাখির কিচিরমিচির বেশ ভালোই লাগছে। শহর থেকে এতদিন পর গ্রামে এলাম। সত্যিই খুব আনন্দ লাগছে। অবশেষে আমাদের বাড়ির সামনে গিয়ে পৌঁছালাম। আমাদের দেখেই সকলে হৈ হুল্লোর শুরু হয়ে গেলো। চাচা, ফুপি, ফুপাত ভাইবোন সবাই দৌড়ে এলেন।
ভালোমন্দ জিজ্ঞেসের পর্বটা শুরু হয়ে গেলো। তখনই লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেড়িয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহের উদ্দিন, উরূফে আমার দাদুভাই। দাদুর অনেক বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের প্রতি ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি। দাদুকে দেখে প্রথমেই মা, তারপর আমি দিয়ে সালাম করলাম। অনেক কথা হলো তখন, সেসব কথা আর আমার তেমন মনে নেই। রাতের বেলায় খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমি আর আমার ফুপাত ভাইবোনরা দাদুর ঘরে গিয়ে বসলাম। কুপি বাতি জ্বলছে, আর দাদু শুরু করলেন গল্প। মুক্তিযোদ্ধের গল্প। মিলিটারিদের আক্রমন, মানুষ হত্যা, গাঁয়ের মানুষের ভয়-আতঙ্ক, দাদুদের মুক্তিযোদ্ধে যোগদান, মিলিটারি ক্যাম্পে হামলা এসব শুনতে শুনতে চোখে ঘুম চলে এলো। প্রচুর আনন্দের মধ্য দিয়ে ছুটির দিনগুলি কাটালাম। সময় শেষ, এবার আমাদের ফিরতে হবে। যাওয়ার দিন সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম, সবার চোখেই জল।
আমার চোখের পানি কোনোমতে আটকালাম। কিন্তু দাদুর চাপা কান্না দেখে আর সহ্য হলোনা। কেঁদে উঠলাম আমিও। দাদু বললেন, “ছুটি হলে তাড়াতাড়ি চলে আসিস। জানিনা, আবার তোদের দেখতে পাবো কি না।” আমি বললাম, “এমন কথা বলতে নেই। নিজের শরীরের যত্ন নিও, আর ভালো থেকো। চলে আসার সময় দাদু রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি বারবার পিছু ফিরে দাদুর দিকে তাকাচ্ছিলাম। বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো আমার।
এখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের ২য় সাময়িক পরীক্ষা চলছে। একদিন বাড়ি থেকে ফোন এলো, দাদু খুবই অসুস্থ। আমাদের দেখতে চাইছেন। দাদুর অসুস্থতার খবর শুনে আমাদের মনের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলো। আমার পরীক্ষা আরও ৫টি বাকি। আম্মু আব্বু মারাত্নক দুশ্চিন্তায় ভোগছেন। আম্মুকে বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। আম্মু আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। পরের দিন সকালেই গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। পরীক্ষা আরও দুটো বাকি, আব্বু প্রায়ই কাঁদতেন দাদুর জন্য। তাই আব্বুকেও বাড়িতে চলে যাবার জন্য জোড় করলাম, কিন্তু আব্বু আমাকে একা রেখে যেতে রাজি হলেন না। অনেক বুঝানোর পর আব্বুও চলে গেলেন। কাজের বুয়াতো আছেনই, তাই আমার খাওয়া দাওয়ার তেমন কোনো সমস্যা হলোনা। পরীক্ষা শেষ করলাম। রাতে দাদুর সাথে কথা বলে আমার মনের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলো। পরেরদিন ভোরে রওনা দিলাম। আজ আর কেউ আমাকে নিতে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালোনা। বাড়ির সামনে মানুষের ভিড়। কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম, দেখলাম বাশের চাটির ওপর সাদা কাফনে জড়িয়ে শুয়ে আছেন আমার দাদুভাই। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। বুকটা ফেঁটে চৌচির হয়ে গেলো। দাদুর মাথার কাছে বসে পড়লাম। এরপর বোবার মত কাঁদতে লাগলাম। বারবার মনে হচ্ছিলো দাদুু যেন আমায় বলছেন বড্ড দেড়ি করে ফেললিরে দাদুভাই।।।
০ Comments