আল্লাহ কখনো কাউকে নিরাশ করে না
প্রকাশিত: জানুয়ারী ৮, ২০১৯
লেখকঃ augustmault0163

 2,958 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

গল্প: আল্লাহ্ কখনো কাউকে নিরাশ করে না।
লিখেছে: মেহেরুন্নেছা মিষ্টি।

পোড়া হাত নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন জাহানারা বেগম। এতটা যন্ত্রণা করছে যে তিনি বসে বসে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলেন। পাশের বাড়ির চাচি এসেছে ভাতের মার নিতে। এসে দেখেন জাহানারা বেগম ডান হাতটা পানিতে ডুবিয়ে রেখেছেন। চাচিকে দেখে হাতটা আঁচলের নিচে লুকিয়ে রেখেছেন তিনি। তবুও চাচির চোখে ফাঁকি দিতে পারেনি সে। হাতটা ধরে চাচি বলল,
— আরে জাহানারা হাতটা পুড়লি ক্যাম্নে?
— ও কিছু না চাচি। নেন ভাতের মার লইয়া যান।
— হাঁচা কইরা কইস মা, মিছা কথা কইস না।
রফিকে মারছে তোরে না রে?
আর মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না জাহানারা। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে সে। চাচি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে থাকে।
— এত বাড়িতে যাই ভাতের মার আনতে, সব বাড়িতেই কম বেশি স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া দেইখা আহি। কিন্তু তুই মা এত সহ্য করোস? আল্লাহ্ তোরে ভালা রাখবো দেখিছ।
— চাচি গো কত্ত ভালা কইরা রান্ধনের চেষ্টা করি। তারপরেও খারাপ হইয়া যায়। আজগা ডাইলে লবণ বেশি হইয়া গেছে। হের লাইগা গরম ডাইলের পাতিলের ভেতর হাতটা দিয়া দিছে।
— রফিকটায় যে কবে মানুষ হইবো আল্লাহ্ জানে। আয় আলু ছেইচ্ছা রস দিয়া দেই। হাতটা ঠাণ্ডা লাগবনে।
— হেদিন জিহাদের দাদি আইছিল।
— আইয়া কী কইলো? তগো নিতে আইছিলোনি?
— চুলের মুঠি ধইরা কইয়া যায়, আমি বলে হের পোলারে মুখে কইরা লইয়া আইছি। হাঁচা কইতাছি চাচি ওই দিন আমি বাইর হইয়া আহি নাই। জিহাদের দাদা আমাগো বাইর কইরা দিছে।
— কস কী জাহানারা? বেবাক মাইনষে জানে, তুই রফিকরে লইয়া আইয়া পড়ছোস হের মায়ের বুক থেইক্কা। এ কথাই তো রফিকের মা বেবাক মাইনষের কাছে কইয়া গেছে।
— না গো চাচি। জিহাদের বাপে ঠিকমতো সংসারে ট্যাকা দিতো না দেইখা আমাগো ঘর থেইক্কা বাইর করছে। আমার কোন দোষ নাই। আমি জিহাদের দাদার পায়ে ধইরা কইছিলাম, আব্বা আমাগো বাইর কইরেন না আব্বা। আপনে আমাগো বাইর কইরা দিলে আমরা কই যামু? আমারে কয়, আমার সংসারে বইয়া খাওন চলবো না। আমি ট্যাকার খনি না।
— এ খবরনি? আর তোর হরি কয় তুই বলে হের পোলারে কাইড়া আনছোস। আমিও তো বউ পালি। আমার আগে পরে যাইয়া জিগাইস তো। কোনোদিন কিছু কইনি?
— সবই কপাল। আমি আমার হরির দোষ দেই না গো চাচি। একটা মাত্র পোলা হের। হেয় এমন কথা কইতেই পারে। আমি কিছু মনে করি নাই। খালি কষ্ট অয় স্বামী আমায় ভালোবাসে না। হেদিন ঘরে একটাও চাউল আছিল না। পোলাডায় খিদায় কান্তাছিল। চাউলের কথা কইছি দেইখা আমারে ইচ্ছা মতো মারছিল। আবার কয় মাইনষের বাইত থেইক্কা ভিক্ষা কইরা আনগা। আমি কাম করতে যাইতাম না।
— এ পোলাডায় কী জীবনেও ভাদাইম্মাগীরি ছাড়তো না? চাইর বছরের একটা পোলা থাকতে ক্যাম্নে যে কাম না কইরা থাকে কে জানে?
আইচ্ছা গো বউ আইজক্কা উডি। গরুগুলানরে খাওয়াইতে হইবো। তুমি নামাজ আদায় কইরা আল্লাহকে ডাইক্কো। তুমি ভালা ঘরের মাইয়া দেইখা ওর মতো ভাদাইম্মার ভাত খাইয়া গেলা।
পাশের বাড়ির চাচি চলে গেলে কোথা থেকে রফিক এসে বলে।
— ওই তুই ওই চাচির লগে এতো কিয়ের কথা কছ? তোরে না কইছি, বাইরের মাইনষের গলে বেশি মাখামাখি করবি না। কান দিয়া কী কথা ঢুকে না?
— আমি তো হেরে ডাইক্কা আনি নাই। তুমি আমারে কথায় কথায় এমন মারতাছো ক্যান? আমি কী মানুষ না? আমার কী শইল না?
— কিরে ভালাই তো মুখে মুখে কথা কওয়া হিগছোস। তয় পথটা হিগাইয়া দিয়া গেলো ক্যাডা? তোর মার টুকাইন্না ওই চাচি?
— গুরুজনগো সম্মান দিয়া কথা কও জিহাদের বাপ। আমারে মারতাছো ভালা কথা। মুরুব্বী মানুষটারে টাইন্না আনো ক্যান?
— ওই তুই আমারে হিগাইতে আবি ক্যাম্নে কথা কমু? তোর কী লজ্জা নাই? মাইনষের কাছে আমার নামে বদনাম কছ? তুই বলে আবার নামায আদায় করোছ?
— খবরদার আমার নামায কালাম নিয়া খুডা দিবা না।
সেদিন রফিক জাহানারাকে খুব মারধর করে। এতে করে জাহানারা কয়েক দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। ছোট ছেলেটাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল ওইদিনিই। বারবার বলে দিয়েছে নানা বাড়ির কারোর কাছে যেন এইসব না বলে। ছোট অবুঝ ছেলেটাও মায়ের আদেশে অটল। কখন কাউকে বাবা মায়ের কথা বলে বেড়ায়নি সে।
জাহনারা বেগম রাতের অন্ধকারে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে। নিজের স্বামীকে হেদায়েত পথে আনার জন্য। এতো অন্যায় অত্যাচার আজ তার কাছে অসহ্য লাগে। শরীরের প্রতিটা স্থানে রক্ত জমাট হয়ে আছে। দু’টাকা দিয়ে যে ব্যথার ঔষধ কিনে খাবে সে টাকাটা পর্যন্ত তার কাছে নেই। তবুও ব্যথা ভর্তি শরীরটা নিয়ে আল্লাহ্’র দরবারে হাত তুলে ফরিয়াত করে সে।
— ওগো আল্লাহ্! ওগো রাহমানুর রাহিম! তুমি আমার ডাকে সাড়া দেও আল্লাহ্। আমার স্বামীরে তুমি হেদায়েত পথ দান করো। আমার প্রতি আমার স্বামীর মনে মহাব্বাত তৈরি কইরা দেও। তোমার কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নাই গো আল্লাহ্। তুমি খালি আমার স্বামীরে বুঝ দান কইরা দেও। আমি যে আর পারতেছি না গো আল্লাহ্। আমার শইল দ্বারা সহ্য হইতাছে না আমার দেহ্ দ্বারা সহ্য হইতাছে না।
— আগুন…আগুন… কে আছো বাছাও, আমার শইলে আগুন লাগছে। আমার শইল পুইড়া যাইতাছে। আহ আর পারতাছি না, শইল জ্বইল্লা যাইতাছে।
স্বামীর বিকট চিৎকারে জাহানারা নামায আদায় করা শেষ করে তার কাছে যায়। গিয়ে দেখে স্বামী চোখ বন্ধ করে চিৎকার চেচামেচি করছে। তার শরীর দিয়ে ঘাম পড়তে শুরু করেছে। ঝাপটে গিয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো।
— ওগো জিহাদের বাপ। কী হইছে তোমার? তুমি এমন করতাছো ক্যান? কই আগুন পাইলা তুমি? এই যে আমি তোমার কাছে। চাইয়া দেহো কোনহানে কোন আগুন নাই। তুমি স্বপ্ন দেখতাছো গো।
— জাহানারা, জাহানারা! আমারে বাছা বউ, আমারে বাছা। আমার শইলে আগুন লাগছে। পানি আন। আমার শইলে ঢাইল্লা দে। দেখ ক্যাম্নে আমি জ্বলতাছি।
— কী কও তুমি? চোখ খোলও তো, চাইয়া দেহো কোনহানে কোন আগুন নাই। দয়া কইরা তুমি একটু চুপ করো। মাথাডা ঠাণ্ডা করো।
— কিহ্ কোনহানে কোন আগুন নাই? হতো এইতো আমি ভালা আছি। তাইলে কী এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছি?
— হুঁ তুমি স্বপ্ন দেখছ।
— নারে জাহানারা না। স্বপ্ন না বাস্তবই আছিল। দেখ এহনো আমার শইল জ্বলতাছে। আমি বুঝতে পারতাছি কিন্তু জাহানসরা। স্বপ্ন হইলেও বাস্তব আছিল।
— থাউক আর স্বপ্ন লইয়া ভাবতে হইবো না, ঘুমাও।
— নাহ্! না আমি আর একলা ঘুমাইতাম না। তুই আমার লগে ঘুমাবি।
জাহানারা খেয়াল করলো তার পালওয়ানের মতো স্বামীটা আজ একটা স্বপ্ন দেখে ভেঁজা বিড়াল হয়ে মিঞমিঞ করছে। উপায় না পেয়ে স্বামীর সাথে তখনি ঘুমাতে হয়। স্বামী তার গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইল তার দিক হয়ে। কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান হলে জাহান্নারা নামায আদায় করতে উঠে পরে। বাহিরে অযু করতে যায় সে। অযু করে ঘরে ফিরলে সে ভূত দেখার মতো হয়ে তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে।
— তুমি পাঞ্জাবী টুপি পইড়া কই যাইতাছো?
— মাইনষে পাঞ্জাবী টুপি পইড়া এ সময় কই যায় রে বউ?
— মসজিদে যায়। তয় তুমি কী মসজিদে যাইতাছো?
— হুঁ ঠিক ধরছোস বউ। আমি মসজিদে যাইতাছি। জ্ঞান হওনের বর্ষে দুই ঈদ ছাড়া কোনদিন নামায আদায় করছি কি না সন্দেহ। আইজগা যাই পাপ তো আর কম করি নাই।
— এক রাইতে তোমার কী হইলো গো?
— কথা বাড়াইছ না বউ। পথ ছাড় জামাতের সময় যাইতাছে গা। আমি জানি তোর অবাক হওনেরই কথা। বিয়ার পরে কোনোদিন তো আর মসজিদে পাঠাইতে পারোস নাই। যাওগ্গা শর, যাইতে দে।
জাহানারা হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠার আগেই গাল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়লো তার চোখ থেকে। তবে সে কান্নাটা ছিল সুখের কান্না। আল্লাহ্’র প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। ফজর নামায আদায় করে দু’রাকাত শুকরিয়া নামায আদায় করলো সে। জায়নামাযটা ভাঁজ করতে করতে দেখে স্বামী তার ফিরে এসেছে। এসেই জাহানারাকে বড় করে একটা সালাম দিল। জাহানারা আবারও একটা শক খেল। তবুও মুচকি হেসে সালামের উত্তর নিলো সে। তারপর স্বামী তাকে বলল,
— বউ। আমার জামাকাপড়গুলান গুছাইয়া দে তো।
— কিল্লেগা? কই যাইবা?
— মসজিদ থেইক্কা তিনদিনের লেইগা তাবলীগে যাইবো। আমার তো দ্বীনির সম্পর্কে কোন ধারণা নাই। হের লেইগা আমিও নাম লেখাইয়া দিয়া আইছি। কইয়া আইছি বিশ মিনিটের মাঝে তৈরি হইয়া যামু।
— তুমি আইজকা আমারে একটার পর একটা চমক দিতাছ ক্যান গো জিহাদের বাপ? আমি কী স্বপ্ন দেখতাছি না কী বাস্তবেই আছি?
— তুই জানোস না বউ। রাইতের স্বপ্নটা চোক্ষের সামনে ভাসলে এহনো আমার কলিজার পানি হুগাইয়া আহে। আমি অনুভব করতে পারছি বাস্তবে। যে স্বপ্নডার বর্ণনা কোনোদিনও আমি কাউরে দিয়া বুঝাইতে পারমু না।
জাহানারার বুঝতে আর বাকি থাকে না, মহান আল্লাহপাক রফিককে এই ভয়ংকর স্বপ্নটা দেখিয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। জাহান্নামের আগুন যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে এ সামান্যতম স্বপ্নের মধ্যেই রফিক কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছে বলেই আজ তার আচরণের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
জাহানারা আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে স্বামীর ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। যাওয়ার সময় রফিক তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলে যায়।
— বউ তুই কেউরে দিয়া বাজার আনাইছ। তুই কিন্তু যাইস না। আর পোলাডারে লইয়া আহিস। আল্লাহ্ বাঁচাইলে তিনদিন পর তো আইয়াই পরমু। দোয়া রাখিস।
— হুনো।
— হুঁ ক্।
— আমি যদি কোনোদিন তোমার লগে বেয়াদবি কইরা থাকি, তাইলে তুমি আমারে আল্লাহ্’র ওয়াস্তে মাফ কইরা দিও।
— বউ রে। তুই আমার ভিতরের আগুনডারে লাড়া দিয়া দিলি? তোর উপড়ে আমি যে পরিমাণ অন্যায় অত্যাচার করছি হের পরেও তুই আমারে হালাইয়া থুইয়া যাস নাই। বউ পারলে তুই আমারে মাফ কইরা দেইস।
— ধুরো। কী কও তুমি? আজাইরা প্যাঁছাল খালি কও। তুমি আমার স্বামী। তোমার পায়ের নিছে আমার জান্নাত। আর হেই তোমার উপড়ে আমার কোন অভিযোগ থাকবো? হেইডা তুমি ভাবলা ক্যাম্নে? আইচ্ছা তোমার অনেক দেরি হইয়া যাইতাছে। যাও তাইলে। আল্লাহ্ ভরসা।
প্রায় তিনদিন হয়ে এলো। রফিক আজ রাতের মধ্যেই ফিরে আসবে। জাহানারা আজ খুব ব্যাস্ত আছেন। স্বামীর জন্য আজ ভালোমন্দ রান্না করছেন তিনি। হ্যাঁ বাজার থেকে আধাকেজি গরুর গোস্ত কিনে আনিয়েছে পাশের বাড়ির চাচির বড় ছেলেকে দিয়ে।
–আহ! সুন্দর একটা গন্ধ বাইর হইছে। নাহ্ স্বামীর আগে খাওন ঠিক না। থাক লবণ দেখন লাগবো না। হে আল্লাহ্ আইজকা যেন আমার স্বামী আমার রান্ধার প্রতি অভিযোগ আনতে না পারে। তুমি দেইখো গো আল্লাহ্। শান্তি মতো যেন দুইটা দানা মুহে তুলতে পারে। আমিন।
— জিহাদ ওই জিহাদ। বাপ কই রে?
— আব্বু আব্বু তুমি আইছো?
— হুঁ বাপ আইছি। তোরে দেহনের লেইগা আমার মনডা ছুইটা গেছিলো।
— আস্সালামু আলাইকুম।
— ওলাইকুম আস্সালাম।
— জিহাদের মা কেমন আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ্। এই পইলা তোমার মুহে তুমি ডাক হুনলাম।
— হুঁ ওইহানে অনেক কিছু হিগাইছে। ক্যাম্নে স্ত্রীর লগে ভালা ব্যবহার করতে হইবো? কেম্নে স্ত্রীরে ভালা রাখতে হইবো। আরও অনেক কিছু হিগাইছে আমাগো।
— আহো হাত পাও ধুইয়া ঘরে আইয়া দুইডা খাইয়া লও দেহি।
— তুমিও আমাগো লগে বহো।
— নাহ্ তোমরা বাপ বেটায় খাও। আমি পাংখা দিয়া হাওয়া করি।
জাহানারা খেয়াল করলো স্বামী তার আজ কিছুই বলছে না। চুপচাপ তৃপ্তিসহকারে লোকমার পর লোকমা ভাত গিলেই যাচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে বাবা ছেলে উঠে যায়। এরপর সে খেতে বসে। এক লোকমা ভাত মুখে তুলে জাহানারা বেগম চুপ হয়ে যায়। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করে তার। দৌড়ে গিয়ে স্বামীর পায়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন তিনি।
— আইজকা তরকারিতে লবণ বেশি হইছে। মুখে লওন যাইতাছে না। তবুও তুমি আমারে কিছু কইলা না ক্যান?
— বউ রে ওইহানে আমারে একদিন রান্তে দিছিল। ওইদিন আমিও তরকারিতে লবণ বেশি দিয়া লাইছিলাম। তবুও কেউ আমারে কিছু কয় নাই। সবাই মুখ বুইজ্জা খাইয়া আল্লাহ্’র দরবারে শুকরিয়া জানাইছিল। আর তুমি ভালোবাইসা আমার লাইগা পোড়া হাত লইয়া রানছো। আর হেই খাওনডারে আমি খারাপ কমু?
— তুমি আমারে মাফ কইরা দিও। একটা দিনও আমি তোমারে শান্তিমতো রাইন্ধা খাওয়াতে পারি না।
— পারবা একদিন ঠিক পারবা। হুনো আমি একটা কাম পাইছি। কাউলকা থেইক্কা কামে লাইগা যামু। এ নেও এডা রাহো। প্রতিদিন আমি তোমারে দশ বিশ ট্যাহা কইরা দিমু। তুমি ওই ট্যাহা এডার ভিতরে জমাইবা।
— ট্যাহা জমাইলে এহেনে ক্যান? টুম্পা আপার কাছে সঞ্চয় করি। বছর শেষ হইলে অনেক ট্যাহা পামু।
— আরে ধুর ওই ট্যাহা সুদের হইয়া যায়। আর সুদ খাওন ভালা না। তাবলীগে কইছিলো হেরা। সুদের ট্যাহা দিয়া কি তুমি আমি হজ্জ্ব করতে যামুনি?
— কিহ্!
— চমক খাওনের কিছু নাই। আল্লাহ্ বাছাইলে তুমি আর আমি একদিন হজ্জ্ব পালন করতে যামু। আমির সাহেব কইছে নিয়তের নাম বরকত। হের লাইগা নিয়ত কইরা রাখলাম।
— তুমি অনেক ভালা গো। এতোদিন তোমারে একটা কথা কইতে সাহস পাইতাছিলাম না। ভাবতাছি এহন কমু।
— কী কথা?
— আল্লাহ্ তো আমাগো ঘরে আবার পোলাপাইন দিতাছে।
— হাঁচা কইতাছো বউ? আমি আবার বাপ হমু? আলহামদুলিল্লাহ্।
আস্তে আস্তে জাহানারা বেগমের সময় ঘনিয়ে এলো। এলাকার নামকরা দায়কে খবর দেওয়া হয়। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টার পর বাচ্চার কান্না শোনা গেলো। রফিক দৌড়ে দরজার সামনে ছুটে আসে।
— ও চাচি জাহানারা ভালা আছে তো?
— হরে বাজান। আল্লাহ্’র ইচ্ছায় তোর বউ ভালা আছে। তোর ঘরে তো চান্দের লাহান একটা মাইয়া হইছে রফিক। ওর জন্মের লগে লগে আতর ঘরটা আলো হইয়া গেছে। আয় দেখবি আয়।
— কি গো বউ। কেমন আছো এহোন?
— আলহামদুলিল্লাহ্। তয় আপনার তো অনেক দিনের শখ আছিলো একটা মাইয়ার। আপনে মুহে না কইলেও আমি ঠিক বুঝতে পাড়তাম। এহোন মাইয়ার নাম কী রাখবেন?
— হুঁ গো বউ মাইয়ার শখটা আমার আগের থেক্কাই। মাইয়ার নাম কী রাহোন যায়? আইচ্ছা আমাগো নবীজির আদরের ছোড কইন্যার নাম জানি কী?
— ফাতেমা ফাতেমা।
— হুঁ হুঁ ফাতেমা। মনে পড়ছে এহোন। আমার মাইয়ার নামও রাখমু ফাতেমা। আমির সাহেব মা ফাতেমারে নিয়া বয়ান করছিল। জান্নাতের সর্দান্নী থাকবো মা ফাতেমায়।
খাতুনে জান্নাত মাগো ফাতেমা আমার। এই জগৎ সংসার মাগো করিবেন আপনে উদ্ধার।
রফিক ভালো হয়ে গেছে শুনে তার বাবা মা তাদের ঘরে ফিরিয়ে নেয়। এরপর আল্লাহ্’র ইচ্ছায় এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার খুব ভালো কাটতে লাগলো। ছেলে মেয়েরা বড় হলে তাদের পাশের একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়। স্বপ্ন দেখে তাদের মাওলানা বানিয়ে গড়ে তুলবে। রফিকের স্বপ্নগুলো একদিন ঠিক পূরণ হবে। কারণ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কখনোই কাউকে নিরাশ করে না। যেমন করে সেদিন জাহানারাকে নিরাশ করেননি। সামান্য দুঃস্বপ্ন দ্বারা রফিককে হেদায়েত দান করিয়েছিল। আল্লাহ্ মহান। তাঁর কাছে অসম্ভবের কিছুই নেই।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৪ Comments

  1. Md Rahim Miah

    খনি না-খনি নাই
    কোন-কোনো (কোন দিয়ে প্রশ্ন বুঝায়)
    অযু- ওযু
    কী-কি(যেহেতু হ্যাঁ কিংবা না জানতে চেয়েছে)
    নিছে-নিচে
    কোন-কোনো
    ব্যাস্ত-ব্যস্ত
    দায়কে(বানানটা মনে হয় ঠিক নেই)
    যায়-যাই
    শুনে-শোনে
    বেশ ভালো লিখেছেন গল্পটা। তবে আঞ্চলিক ভাষা একটু কঠিন হয়ে গেছে মনে হয়, সেটা যদি সহজ হতো পাঠকের জন্য পড়তে সুবিধা হতো আর বুঝার। তবে গল্পটা পড়ে ভালোই লেগেছে। একটা স্বপ্নই স্বামীকে বদলে দিয়েছি। তবে গল্পের একটা অংশ তাবলীগে যাওয়া আর রান্নাতে লবণ দেওয়া এবং বউয়ের লবণযুক্ত রান্না খাওয়া কোথায় জানি পড়েছি আগে মনে হচ্ছে।যাইহোক বানানে ভুলের মান কমই।তবে আঞ্চলিক ভাষার বানান ভুল ধরতে পারলাম না । কারণ আঞ্চলিক ভাষা এক এক জায়গার এক এক রকমের হয়ে থাকে।অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।

    Reply
  2. Eti Akter Chandni

    আলহামদুলিল্লা, অনেক দিন পর আবারওএকটা সুন্দর গল্প পড়তে পারলাম।
    খুব ভালো লাগছে গল্পটা, তবে গল্পে আঞ্চলিকভাষার জন্য পড়তে অসুবিধাহলেও গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাফছে, আর গল্পে সব থেকে বেশি ভালো লাগছে হেদায়েতএর পথটা, সত্যি আল্লাহ কখন কা কে কী ভাবে হেদায়েতদান করে তা কেউ বলতে পারে না, আল্লাহ সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন।
    শুভ কামনা আপনার জন্য।

    Reply
  3. Halima tus Sadia

    ভালো লিখেছেন।
    শিক্ষনীয় গল্প।

    আমাদের প্রত্যেকেরেই উপলদ্ধি করা উচিৎ জাহান্নামের
    আগুন কেমন হবে।
    আল্লাহ সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুক।

    গলে–লগে
    ব্যাস্ত–ব্যস্ত
    জাহানসারা-জাহানারা

    শুভ কামনা।

    Reply
  4. আফরোজা আক্তার ইতি

    অসম্ভব সুন্দর। তৃপ্তি নিয়ে পড়ার মতো, মনটাকে ভালো করে দেয়ার মতো একটি গল্প। মন ছুঁয়ে গেল গল্পটি। খুবই চমৎকার হয়েছে।
    আল্লাহর পক্ষে কোনকিছুই অসম্ভব নয়। নেকনিয়তে কিছু চাইলে আল্লাহ অবশ্যই তা পূরণ করেন। জাহানারা তার স্বামীকে সৎপথে আনার জন্যই আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলেছিল, আল্লাহ তাই তার স্বামীকে এমন স্বপ্ন দেখান যাতে সে তার নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধন হয়ে যায় এবং আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল হয়ে যায়। অন্যদিকে তার সন্তানের আগমনেও তার ঘর আলোকিত হয়ে যায়। জাহানারাও সুখী হতে পারে।
    পুরো গল্পটিই যেমন চমৎকার ছিল তেমনি শিক্ষণীয়ও ছিল। গল্পটি পড়ে সবাই শিক্ষা নিতে পারবে।
    বানানে কিছু ভুল ছিল প্রিয়।
    মার- মাড়।
    ক্যাম্নে- ক্যামনে।
    ওইদিনিই- ওইদিনই।
    ঝাপটে- জাপটে।
    জাহানসরা- জাহানারা।
    আতর ঘরটা- আতুরঘরটা।
    পাড়তাম- পারতাম।
    শুভ কামনা অনেক।

    Reply

Leave a Reply to আফরোজা আক্তার ইতি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *