আক্কাস মিয়ার অপেক্ষা
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০১৮
লেখকঃ

 1,846 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ

গল্প: আক্কাস মিয়ার অপেক্ষা
সৌ র ভ হা সা ন
.
গোধূলীর সন্ধ্যা। মসজিদগুলো থেকে ভেসে ভেসে আসছে আজানের শব্দ। দূর থেকে দেখা যায় গায়ের বধূরা ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। চৌরাস্তায় বসে এই সবকিছু দেখছে আক্কাস মিয়া।
.
আক্কাস মিয়ার বয়সটা বেশিনা। পঞ্চাশেক হবে হয়তো। মুখে দাড়ি গোফ ও মাথায় লম্বা চুলের জটে কেমন অদ্ভুত দেখায় তাকে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা তাকে ভীষণ ভয় পায়। অথচ, কখনো সে কাউকে ভয় দেখায়নি। একটিবারের জন্যেও না।
.
মাঘ মাস চলছে বাংলা ক্যালেন্ডারে। প্রচন্ড শীত নেমে এসেছে গ্রামে। সবাই প্রস্তুতি নিয়েছে শীতের। শুধু আক্কাস মিয়া ছাড়া। এই শীতে তার থাকার একমাত্র জায়গা চৌরাস্তায় মন্ডল বাড়ির খড়ের মাচা। এখানেই সে সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে রাত কাটিয়ে দেয়।
.
বাজারে রুটির একটা টুকরা অথবা হোটেলে থাকা গতরাতের বাসি ভাত’ই আক্কাস মিয়ার খাবার। কোনোকোনো দিন না খেয়েই কাটিয়ে দিতে হয়। যদি কোন বধূর কোনদিন ইচ্ছে হয়, তবে আক্কাস মিয়াকে ডেকে দু’মুঠো খেতে দেয়।
.
প্রতিদিনের মতো সে খড়ের মাচার নিচে শুয়ে ছিলো। মক্তবে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা চৌরাস্তা ডিঙিয়েই মক্তবে যায়। একটা ছেলে রাস্তা থেকে ইটের একটা ছোট টুকরা ছুড়ে দিলো আক্কাস মিয়ার গায়ে। ইটের টুকরোটা গিয়ে লাগলো আক্কাস মিয়ার কপাল বরাবর। কলকল করে রক্ত বেরুতে লাগলো। আক্কাম মিয়া উঠে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তার সারাগায়ে রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। আক্কাস মিয়া নীরবে ব্যথা সইতে লাগলো। কারণ এখন তার এসব কষ্ট গায়ে লাগেনা। তার জীবনের ভয়ংকর অতীতের কাছে এই ব্যথা সামান্যই। আক্কাম মিয়ার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই অতীতের কথা মনে পড়লে সে এখনো শিহরিত হয়। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সে সহ্য করতে পারেনা।
.
আজকের আক্কাস মিয়া, আর বছর দশেক আগের আক্কাস মিয়ার মাঝে আমূল পার্থক্য। এক বৈশাখের কথা। তখন দেশে যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা জলপাই রঙের ট্যাংকে গ্রামে গ্রামে এসে বাড়ি-ঘড় পুড়িয়ে দিতো। সেদিন রাতে আক্কাস মিয়া একটু দূরে গিয়েছিলেন একটা কাজে। গ্রামে ফিরে শুনতে পেল তাদের বাড়ি-ঘড় সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে পাকিস্তানিরা। বাসায় ফিরে দেখতে পায় অর্ধ ঝলসানো স্ত্রীর মৃতদেহ আর বুকে গুলিবিদ্ধ তার ছেলে মাটিতে। সেদিনই তার স্ত্রী সন্তানকে কবর দিয়ে আক্কাস মিয়া গৃহত্যাগ করলেন। আর কখনো সেই গ্রামে ফিরে যায়নি।
.
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। আক্কাস মিয়ার জায়গা হলো মধুপুর গ্রামের চৌরাস্তা। কেন যেন সে এখানকার মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। আজ হতে দশ বছর আগে এখানে এসেছিলো, এখনো রয়েছে। অনেকেই জিজ্ঞেস করতো প্রথমের দিকে, সে কখনো কাউকে কিছু বলেনি। কথা না বলতে বলতে এখন মুখ দিয়ে কথা বের হতে চায়না। খুব কষ্টে দুই একটা কথা বের হয় হয়তো। তবুও সেই কথা অন্যকানে পৌঁছায়না।
.
গ্রামের লোকেরা এখন তাকে পাগল মনে করে। তানাহলে সে কেন সে এখানে থাকবে? আর আক্কাস মিয়ার চলাফেরা, আচরন ব্যবহারে তাকে যে কেউই পাগল বলবে এটাই স্বাভাবিক।
.
মাঘ মাসের এই তীব্র শীতে তার গায়ে কোন গরমের কাপড় নেই। শীতের কষ্টে এখন সে কাবু হয়ে গিয়েছে। আগের মতো রক্ত গরম নেই। এক সকালে কাঁপতে কাঁপতে সে এক বাড়িতে গেল শীতের কাপড় নিতে। কিন্তু সেখানে কেউ তার কথা বুঝতে পারলোনা। সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো তাকে। আক্কাস মিয়া আরেকটি ভয়াবহ রাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
.
রাত বাড়তে লাগলো। অভুক্ত আক্কাস মিয়া আরও কষ্ট পেতে লাগলো। পূর্বের মাঠে প্রচন্ড গতিতে বাতাস বইছে। সেই বাতাস হুহু করে ঢুকছে খড়ের মাচালির ভেতরে একদম আক্কাস মিয়ার বুকের ভেতর। এই রাত যেন শেষ হয়না। অনন্তকাল থাকবে এই রাত। কোনদিন সূর্যের দেখা মিলবেনা। রাত বাড়তেই থাকে। আক্কাস মিয়া আরও কাবু হতে থাকে।
.
রাতের পর রাত এভাবে ঠান্ডায় থাকতে থাকতে আক্কাস মিয়ার ঠান্ডা বসে গেল গেল বুকে। সাথে প্রচন্ড জ্বর ও কাশি। তার গায়ের জ্বর থার্মোমিটার দিয়ে মাপা তো দূরের কথা। কখনো তার আশেপাশেই কেউ আসেনা। দুপুরে গায়ে একটু জোর পেলেই বাজারে অথবা কারও বাড়িতে গিয়ে দু’মুঠো বাসি ভাত খেয়ে নেয় আক্কাস মিয়া।
.
জ্বর, ঠান্ডা, কাশি নিয়ে আক্কাস মিয়া এখন চৌরাস্তা থেকে বের হতে পারেনা। কাশির সাথে মাঝেমাঝে রক্ত বেরিয়ে আসে। আক্কাস মিয়ার মনে হয় বুক থেকে হয়তো কলিজাটা বেরিয়ে আসবে। এই অবস্থায় কেটে যায় আরও কয়েকটা ভয়ংকর কষ্টের দিন।
.
কোনভাবে এই শীতটা কাটিয়ে দেয় আক্কাস মিয়া। পেটের জ্বালা ও শরীরে বরফ শীতল কুয়াশার দিন চলে গেছে। এখন পেটে জ্বালা থাকলেও, অত্যন্ত গায়ে শীতটা লাগেনা। আক্কাস মিয়া ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ কয়ে ওঠেন।
.
এখন আক্কাস মিয়ার অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। একা একা কথা বলতে বলতে মুখের জড়তা কেটে গেছে। এখন সবসময়ই বকবক করতে থাকেন। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায় গ্রামের এপাশ থেকে ওপাশে। মাঝেমাঝে গ্রামের বাইরেও চলে যায়। কোনোকোনো দিন বাসায় ফিরে, আবার কোনকোনদিন ফিরেনা। রাতটা কাটিয়ে দেয় অন্য একটা গ্রামের কোন একটা নির্জন জায়গায়।
.
গ্রামের মানুষেরা সবাই প্রায় অবাক। যাকে তারা এতদিন আক্কাস পাগল বলে জানতো, তারা এখন আক্কাস মিয়ার এই আমূল পরিবর্তনে অবাক। সবাই ভেবেছিলো হয়তো কোন একদিন এই চৌরাস্তার মোড়েই আক্কাস মিয়ার মৃতদেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখবে তারা। কিন্তু, না। সবার ভাবনাটা ভুল প্রমাণিত করে আক্কাস মিয়া তার দীর্ঘ বসবাসের গ্রামটা ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গেল। কেউ আর তাকে খুঁজে পেল না।
.
আক্কাস মিয়া এক সকালে হাটতে হাটতে চলে গেলেন আরেকটা গ্রামে। বাজারের পাশেই একটা স্কুল। স্কুলের পাশে বিরাট মাঠ। সেই মাঠের এক কোণে বসে থাকেন আক্কাস মিয়া। রাতে স্কুলের পাকা বারান্দায় শুয়ে থাকেন।
.
এতো এতো স্কুলের ছাত্রদের দেখে আক্কাস মিয়ার মনে পড়ে দশ বছর আগের কথা। তারও এমন একটা ছেলে ছিলো। যাকে হত্যা করা হয়েছে। সেই ছেলেটা থাকলে এখন কত বড় হতো? নিশ্চই কলেজে পড়তো। এগুলো ভেবে আক্কাস মিয়ার চোখ ভাড়ি হয়ে ওঠে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। চোখের জল ঝরতে থাকে অনর্গল।
.
এই ছেলেদের দেখে আক্কাস মিয়ার তার নিজের ছেলের কথা মনে পড়েছে। তাই সে এই ছেলেগুলোর জন্য কিছু করতে চাইলেন। নিজের কাছে আনতে চাইলেন। কিন্তু কেউই তার আশেপাশে আসতো না কখনো। সবাই আগের মতোই ভয় পেত। আক্কাস মিয়া একটা বুদ্ধি বের করলো। যাতে ছেলে-মেয়েরা তার আশেপাশে আসতে পারে।
.
একদিন সে বাজার থেকে একটা ভাঙা থালা নিয়ে ভিক্ষা করা শুরু করলো। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা করতো সে। কেউ কেউ দু’মুঠো খেতেও দিতো। কেউ একটা টাকা অথবা দু’মুঠো চাউল দিতো তাকে। সে খুব যত্ন করে সেগুলো নিয়ে স্কুলে ফিরতো। চাউলগুলো বিক্রি করে দিয়ে টাকা নিতো। সেই টাকা দিয়ে সে বাচ্চাদের কিছু কিনে দিতে চাইলে কেউ নিতোনা। সবাই ভয়ে দৌড় দিতো।
.
আক্কাস মিয়া তখন স্কুলের পাশের দোকানদার মনিরের কাছে গেলো। সব কথা খুলে বললে মনিরকে। মনির হাই তুলতে তুলতে বললো,
– পাগল হইছেন মিয়া? নিজের এত কষ্টের ট্যাকা মাইনষের পোলাপানরে দিবেন ক্যা?
– ভাইসাব, আফনে বুজতেন না। আফনে যদি আমার এই উপকার টা করতেন, মনটা খুব শান্তি পাইতো ভাইসাব।
– আমারে কি করতে হইবো?
– আফনে আমি যেই ট্যাকাগুলো দিমু, হেডি দিয়া ওগোরে একটু খাওয়াইবেন। এইটুকু করতে পারলেই হইবো ভাইসাব।
– আইচ্ছা ঠিক আছে।
.
সময় গড়াতে থাকে তার নিজস্ব নিয়মেই। ধীরে ধীরে আক্কাস মিয়া বুড়ো হতে লাগলো। এখনও সে আগের মতোই গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে। সেই টাকাগুলো নিয়ে মনিরের কাছে দেয়। মনির সেগুলো দিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ায়। মনিরের তেমন কোন কষ্ট হয়না। মাঝেমাঝে দু’টো টাকা সাফাই করে দেয়।
.
এভাবে চলে যায় কয়েকটি বছর। আক্কাস মিয়ার গায়ের জোড় এখন শেষ পর্যায়ে। কোনরকম একটু হাঁটতে পারে। আক্কাম মিয়ার ইচ্ছে ছিলো এখানে, এই গ্রামে, স্কুলের পাশেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়ে দিবেন বাচ্চাদের কিছু খাইয়ে। কিন্তু, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে হয়তো ভিন্ন। তাই আক্কাস মিয়া এখানে থাকতে পারলো না। এক সকালে আবারও সে তার স্থান ত্যাগ করলো। হাঁটতো লাগলো অজানার পথে। যেই পথের কোন শেষ নেই। পথে তেষ্টা পেলে একটু বিশ্রাম নেয় কোন গাছতলায়।
.
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছে আবারও তার সেই ফেলে যাওয়া গ্রামে। খুঁজে খুঁজে বের করলো তার সেই চৌরাস্তার মোড়। জায়গাটা বদলে গেছে। চেনাই যায়না একদম। একটা বটগাছ জন্মেছে। এই কয়েক বছরে বেশ বড় হয়ে গেছে সেই বটগাছটা। আক্কাস মিয়া বটগাছের নিচেই বসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিলো বাতাসে।
.
মাস কয়েক গেলো। প্রকৃতিতে এলো শীতকাল। প্রকৃতি তো আর মানুষের কষ্ট বুঝেনা। সৃষ্টিকর্তা বুঝে। তবুও কেন তিনি অবিচার করেন, এইসব মানুষের উপরে? কোন পাপের শাস্তি? আক্কাস মিয়া শীতে কাঁপতে শুরু করে। হাঁড় কাপাতো শীত সহ্য করার বয়স নেই এখন। শুধু দক্ষিণ দিকের ধানের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নেই। অদ্ভুব এক কষ্টে তিনি অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর। যেন একমাত্র মৃত্যু’ই পারবে তাকে এই কঠিন কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে। কোন এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে এই হিমশীতল পৃথিবীর একটি হিমায়িত মৃতদেহ নিজের গর্ভে নেবে মাটি। এখন অপেক্ষা শুধু মৃত্যুর।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

০ Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *