আঁধার শেষে
প্রকাশিত: অগাস্ট ২২, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 1,934 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

লেখা : ফারিয়া কাউছার

রাস্তার দু’ধারের দোকানপাট সারি-সারি লাইন বেঁধে আমার পেছনে চলে যাচ্ছে। সম্ভবত আমিই আনমনা হাঁটছি, এরা স্থির আছে। আজও এক বুড়ো দেখতে আসবে। মনটা খুব খারাপ। উল্টাপাল্টা কথা সব মস্তিষ্কে রেঁধে রাখছি তাঁকে শুনিয়ে দেবার জন্য। এখন সকাল সাতটা। তেমন কোনো দোকান খুলেনি, শুধু চায়ের দোকানটি ছাড়া। গণি আঙ্কেলের দোকানটিও বন্ধ। তার পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়িটির মুখের দরজাটি খোলা। তার মানে টিটু স্যার আজ তাড়াতাড়ি এসে পড়েছেন। যদিওবা এখন আমার প্রাইভেটে যাওয়া উচিত, আমি অগ্রসর হচ্ছি দোকানটি ডিঙিয়ে চায়ের দোকানের দিকে। কারণ সকালে পাত্র সম্বন্ধে চাচির কথা শুনে কিছুই খাইনি। খেয়েই প্রাইভেটে যাব।
যথারীতিতে পরোটা কিনতে চায়ের দোকানে যাই। গিয়ে দেখি ভেতরের বেঞ্চিতে এক ছেলে বসে আছে, চোখজোড়া তার নিমীলিত।
দোকানী গরম পরোটা দেয়ার সময় দেখলাম ভেতরে বসা ছেলেটি চোখ মেলেছে। সে এগিয়ে এসে আমার কাছে একটি পরোটা খুঁজল।
.
“আমাকে একটি পরোটা দিন? খুব খিদে পেয়েছে। কাল হতে কিছুই খাইনি।”
“আপনি তো দোকানেই আছেন। তার ওপর আপনার বুক পকেটেও সিগারেট দেখছি। নিজে কিনে খেতে পারেন না?”
“চায়ের দোকানে এমনিই বসেছিলাম।” ছেলেটি বলল, “সিগারেট বহু আগে কিনেছিলাম। তখন খাওয়া হয়নি। দোকানী সাঁঝ সকালে টাকা না পেলে বড় লস হবে তাঁর।”
“শুনুন ভাইয়া, এসব অখাদ্য খাওয়া মানুষ আমার বিন্দুমাত্র পছন্দ নয়। তাই আমি দিচ্ছি না।”
ছেলেটি অগত্যা বেরিয়ে গিয়ে হাঁটা ধরলো।
আমি বলে উঠলাম, “আপনাকে চেনা লাগছে। আপনি নিশ্চয় শুভ। সম্ভবত কালকে আপনার এইচ.এস.সি রেজাল্ট দেয়া হয়েছে। কেমন করলেন?”
শুভ ঘুরে তাকালেন। মেকি হেসে বললেন, “ফেল করেছি।”
“ফেল?” আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “আমি যতটুকু জানি, আপনি অনেক ভালো ছাত্র ছিলেন। দ্বিতীয় বর্ষে উঠার সময় এক স্যারের কাছে শুনেছিলাম।”
“যার কথা জেনেছ সে ব্যক্তিত্বকে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি আমি। এখন যাকে দেখছ, সে একই শরীরে আরেকটি মন বহন করেছে। শীঘ্রই মনটিসহ এই শরীরটিও নিখোঁজ হবে।”
পুনরায় সেই হাসিটি দিয়ে শুভ হাঁটা ধরলেন। আমি যদিওবা তাকে চিনতে দেরি করেছি, কিন্তু তিনিই যে আমার অনুপ্রেরণা! স্যারের কাছে তার গুণ প্রায় শুনতাম। নিজেকেও তার মতো মেধাবী করে গড়ে তোলার কথা ভাবি। আজ একি অবস্থা তাঁর! বড় কৌতূহল জাগছে তাঁর ব্যাপারে। তাই পরোটা রেখে তার পিছু পিছু গেলাম আমি।
.
“আমার এখন আর খাবারের প্রয়োজন নেই।” শুভ বললেন, “পরোটা দেখে মুহূর্তের জন্য খিদে পেয়েছিল।”
“আমার কাছে এমনিতেও পরোটা নেই। আপনার সম্বন্ধে জানতে চাই। হাসবেন না, তবে আপনি আমার অনুপ্রেরণা। আপনাকে খুব একটা না দেখলেও একসময় কলেজের টিটু স্যারের কাছে আপনার গুণগান শুনতাম।”
“সেই একসময়ের ছেলেটি আমি এখন নই।”
“আপনার ফেল করাটা আমি এখনও মেনে নিতে পারছি না। প্লিজ, আমাকে বলুন। নইলে এর অগোচরে থাকা কথাগুলো বারবার আমাকে উত্যক্ত করবে।”
অকস্মাৎ তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, “মরতে যাচ্ছি আমি। কীভাবে তা আমি জানি না। তবে মরবো। কিছুই জিজ্ঞেস করবে না প্লিজ। চলে যাও। আমার মতো অকর্মকের সংস্পর্শে এলে সম্ভবত তোমারও বদলানোর ইচ্ছে হবে। তোমার কিছু জানার দরকার নেই।”
“আমি সহজেই নিজেকে বদলাই না।” গম্ভীর গলায় বললাম, “আমাকে বলতে পারেন। আপনি সুইসাইড করতে যাচ্ছেন ঠিক আছে। যাওয়ার সময় অন্তত আমাকেই কথাগুলো বলে যান! জানার প্রবল ইচ্ছা জেগেছে। বলে গিয়ে নাহয় মরুন।”
শুভর বোজা চোখগুলোতে এখন বিস্ময় খেলছে। কেউ কাউকে মরতে এত সহজে বলে দেয়? শুভও আমার কথায় সম্ভবত আগ্রহ অনুভব করছেন। মরার আগে কারো সাথে দুঃখ শেয়ার করলে মনের বোঝা একটু হলেও প্রশমিত হবে, হয়ত তাই ভাবছেন।
.
“আপনার ভাবভঙ্গী দেখে লাগছে বলবেন। চলুন ওই চায়ের দোকানে। কিছু টাকা আছে, নাস্তাও করাবো আপনাকে।”
.
শুভর চোখে এখনও বিস্ময়। হয়ত একটিবার নিকাবের নিচের মুখটি দেখতে চেয়েছেন। আমরা পূর্বের চায়ের দোকানটিতে এসে বসলাম দু’জন। আমার শুরুতেই চোখ পড়ল নিচে পড়ে থাকা সিগারেটের দিকে।
“সিগারেট সম্ভবত প্রথম টেস্ট করলেন তাই না?”
“বুঝলে কীভাবে?”
“আমার জানামতে, সিগারেট প্রেমীরা এইভাবে অর্ধেকেই সিগারেট ফেলে দেয় না। আচ্ছা, আপনার কথা বলুন। ফেল কীভাবে করলেন? আর আত্মহত্যা কি ফেল করার কারণে করতে চান?”
শুভ মাথা ঝুঁকে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। আমার জোরাজুরিতে পরোটা একটু মুখে দিয়ে বলতে লাগলেন, “খুব মেধাবী স্টুডেন্ট ছিলাম আমি। খুব মেধাবী। আমার সাথে কেউ কম্পিটিশন করার কথা ভাবত না। এটা ছিল বহিরাবরণ। অন্দরমহলে আমি কীভাবে এই উপাধির জন্য সংগ্রাম করতাম তা বাহিরের কেউ জানতো না। পড়ার জন্য বই খুব কম পেতাম। মূল পাঠ্যবই কোনোভাবে সংগ্রহ করে পড়তাম। গাইড বই পর্যন্ত কখনো পৌঁছতে পারতাম না, সামর্থ্য থাকে না। আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে আমাদের সম্পত্তিগুলো একে একে ক্ষয়ে যাচ্ছে। চারজনের পরিবার আমাদের। যতসব টাকাকড়ি আমার পড়াশোনা আর আব্বার অসুখের পেছনে আম্মা খরচ করে দিচ্ছেন। আমি কোনোভাবে উচ্চ মাধ্যমিকে এসেছি। আমরা এখন আর্থিকভাবে একদম নিম্নবিত্ত পর্যায়ে আছি বললে চলে। এই যে বললাম, গাইড কিনতে পারতাম না। এরকম অভাবগুলোর ভরণ না করে কষ্ট করলে কিছু টাকা বাঁচত। শার্ট একটা নাহয় কম কিনতাম। টাকা কিছু বাঁচত। আম্মা বলেছিলেন, A+ আনলে উনি তৃপ্ত হয়ে আমাদের শেষ সম্বল জমিটুকু বেছে দেবেন। এখন আর ওইটাও সম্ভব নয়। আমার এক বছর পর পরীক্ষা দেয়া মানে আমাদের পরিবারের অনেক বড় এক অনটনে পড়া। যেটা আমি হতেই দিতে চাই না।”
“আপনার পড়াশোনার ঘাটতির কারণেই ফেল করলেন?”
“না, আমি যেটুকু পেতাম সেটুকুতে সবকিছু আয়ত্তে নিয়ে আসতাম। অথবা যেগুলোর অভাব থাকত, কিছু বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকার বিনিময়ে ধার নিয়ে পড়ে ফেলতাম। এইসব করেই প্রতিবার টপ করে আসি। কিন্তু এইবার…”
“এইবার?”
“এইবার আম্মার স্বপ্নগুলো খানখান করে ভেঙে ফেললাম আমি।” ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, “সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু যৌবনটা বড় খারাপ। একদিকে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবার সাহস জোগায়, তো অন্যদিকে নীচু হবার মতো কাজ করায়। সর্বদা বইয়ের সীমায় থাকা এই দু’চোখগুলো কখন যৌবনের ছোঁয়ায় এলো বুঝতেই পারিনি।”
“শান্ত হোন ভাইয়া। আমি আপনার কথা বুঝিনি। প্রেমে পড়েছিলেন বুঝি?”
চোখ মুছে শুভ মৃদুভাবে মাথা ঝাঁকালেন।
“প্রেমে পড়লে পড়ালেখার দিক থেকে পুরোপুরি ডাউন হয়ে যাওয়ার কথা তো নয়।”
“তুমি সম্ভবত আয়েশার ন্যায় কোনো ছলনাময়ীর ছলের স্বীকার হওনি বলে এমনটা বলছো।”
“আয়েশা!”
“তার নাম। আমি ভালো ছাত্র দেখে আমার সাথে আয়েশা বন্ধুত্ব করেছিল। পড়াশোনার দিক থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে যেসব ছাত্রছাত্রী থাকে, একদম তাদের কাতারে ছিল সে। কলেজে গেলেই সুযোগে পেড়ে দেখত, তার মতো গাধীকে প্রাইভেট পড়িয়ে আমি যাতে তাকে ঠিক করি। মেয়েদের সাথে মিশতে আম্মা কড়াভাবে নিষেধ করেছিলেন। তাই আমি ওকে কলেজেই সময় কিছু বের করে পড়াতে লাগলাম। তার চালচলন আমাকে খুব করে আকর্ষণ করত। মেয়েটিই এমন ছিল নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে করত তা আমার ধারণা নেই। স্বেচ্ছায় করলে ধরা যায়, সে আমার কাছ থেকে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশিকিছু আশা করেছিল। সময়ের তালে আমি কখন উন্মাদ হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। যেই সময়টুকু বের করে পড়াতাম, সেইটুকু সময়ে সে বারবার তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবার কথা বলত। আমি নিরুপায় হয়ে যেতাম। শুরুতে বিরক্তিকর লাগত। পরে যখন আমি তার প্রেমে পুরোপুরি মত্ত হয়েছিলাম, তখন শুধু কিছু সময়ের জন্যই নয়, কলেজ ফাঁকি দিয়েও ঘুরতে যেতাম। বুঝতেই পারছ, ধীরে ধীরে এগুলো আমাকে পড়ালেখা থেকে দূরে নিয়ে গেছে। এমনকি রাতের বেলায়ও আমি পড়তাম না। পকেটের যে খুচরা টাকাগুলো বাঁচাতাম, তা দিয়ে রিচার্জ করে আম্মার ফোন থেকে লুকিয়ে কথা বলতাম। বলতে পারো, এইভাবেই আমি বদলেছি, পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে গেছি। এক বন্ধু এইসব লক্ষ করায় আমাকে এসে আয়েশার সম্বন্ধে উল্টাপাল্টা নানান কথা জানালো। আমি ওসবে মোটেও বিশ্বাস করিনি।
কাল রেজাল্ট দিয়েছে। আমি ফেল করেছি। এই কথা কাউকে জানানোর আগেই বেরিয়ে গিয়েছি বাসা থেকে। কাল শেষবার দেখা হয়েছিল আয়েশার সাথে। সেও ফেল করেছিল। তবু তার ভাবভঙ্গীতে কিঞ্চিত চিন্তার ভাব দেখিনি। আমার ফেল করার কথা শুনেও তার কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। পরে সে নিজ মুখে স্বীকার করেছে, তার মনে এখন আমাকে নিয়ে বিন্দু পরিমাণ জায়গা নেই। ওই বন্ধুর কথাটিই ফলে গেছে। অগোচরে সে অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। তার জন্য হয়ত খুব সহজ জীবনের আরেকটি বছর অপেক্ষা করে একই পরীক্ষা পুনরায় দেয়া। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এটুকু পড়ে আসাও ছিল বহু কষ্টসাধ্য। তার ওপর আরেকটি বছর একই পরীক্ষার জন্য নিজের পড়াশোনার ভার নেয়া অসম্ভব লাগছে। জমি যেটি আছে, আম্মা ভেবেছেন, উচ্চ পর্যায়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিক্রি করবেন। তার পূর্বে তিনি আমার ফেল করার কথা জানলে আমার ওপর থেকে বিশ্বাসই হারাবেন। আমি এটা চাই না। এমনও হতে পারে, আমাকে দিয়ে পড়াশোনা করানোর চিন্তাটা মাথা থেকেই ঝেড়ে ফেলবেন। তখন আমাদের পরিবার চলবে কী করে? জমিটা বেছে বছর কয়েক চালিয়ে ফেলতে পারলেও বাকিটা জীবনের কী হবে? শিরিনের বিয়ে কী করে দেবেন আম্মা? আমাকে যদি ওই জমি বেছার টাকায় লেখাপড়া করান, তবেই সম্ভবত আমি বড় কিছু হয়ে পরিবারের ভার আজীবনের জন্য নিজ কাঁধে বইতে পারব। কিন্তু এমনটা হবে না। আম্মা সম্ভবত আমার ওপর থেকে বিশ্বাসটাই তুলে ফেলবেন। আমার আর কোনো পথ নেই। লেখাপড়া ছাড়া পরিবারকে চালাতে হিমশিম খেয়ে যাব, মরীচিকাকে সত্য মনে করার খোঁচাটা সারাজীবনই পেতে থাকব, বোনের বিয়েও সম্ভবত ভালো কোনো জায়গায় দিতে পারব না, আব্বার অসুখটাও বড় কোনো ডাক্তারকে দেখাতে পারব।”
শুভ আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি দীর্ঘক্ষণ যাবৎ সহসা কিছু বলতে পারলাম না। তবে গভীরভাবে ভাবছি। এই ছেলেটিই তার পরিবারের মেরুদণ্ড। মরীচিকাকে সত্য মনে করাতে তার ভুল যৎসামান্য ছিল। যৌবনের এই তৃষ্ণায় সবাই তো তৃষাতুর হয়! তার দোষ নেহায়েৎ নগণ্য। হতাশায় পতিত বলে এই সময় হয়ত তার দৃষ্টির চারিপাশটা অন্ধকার ঠেকছে। এজন্য দিশাহারা হওয়াটা স্বাভাবিক।
আমি শুভকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “এসব কিছু আপনার আম্মাকে খুলে বলতে পারেন। হয়ত তিনি আপনাকে কিছুটা ঝাড়বেন। একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় অনেকেরই খারাপ যায়। আপনার এখন তাই হচ্ছে। ভেঙে পড়ে এমন জঘন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলাটাও উচিত নয়।”
“তুমি বুঝছ না। আমার সামনে এখন আর কোনো পথ নেই। কাল থেকে এই যাবৎ আমি ঘরে যাইনি। টাকা না থাকায় কিছুই খাইনি। রাতভর ভেবেই আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আমি বেঁচে থেকে এই জায়গাটা দূষিত করার কোনো মানে হয় না। অনেকক্ষণ বসেছি, কথাও বলেছি। এখন আমায় যেতে দাও। তোমার সাথে এই আমার শেষ কথা।”
“আপনি তাহলে আপনার সিদ্ধান্তেই অটল থাকবেন।”
“হ্যাঁ, তাই।”
“বেশ, এটুকু যখন সময় দিয়েছেন, আরেকটু দিন।”
“মানে?”
“আপনার বাসার ঠিকানাটা দিন।”
“না, দেব না। আমি চাই না, আমার কুকৃর্তির কথা আম্মারা জানুক।”
“বিশ্বাস করুন, আপনি যতগুলো কথা বলেছেন তার একটি শব্দও বলব না আপনার আম্মাকে।”
সিক্ত চোখগুলো সবে শুকিয়েছে তার। শুভ একবার ভ্রূ কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকালেন। যাই হোক, তিনি নিজ সিদ্ধান্তেই অটল থাকবেন। বাকি এই মেয়েটির যাই ইচ্ছা হয়, তাই করুক। হয়ত এই ভেবে বাড়ির নামটি বলে দিলেন। তিনি এখানেই থাকেন, তা জ্ঞান ছিল না।
.
ঝিম ধরে শুভ বসে রয়েছেন। হঠাৎ কারো চেঁচামেচিতে যেন তাঁর চোখগুলো পিটপিট করে উঠল। সচেতন হয়ে দেখে তাঁর মা এসেছেন এবং কেমন কাঁদো কাঁদো হয়ে তাঁর সারা শরীর হাতরিয়ে দেখছেন। শুভ একবার রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাইলেন আমার দিকে। পরে মায়ের কথায় ফিরে তাকালেন।
“বাবা, তুই ঠিক আছিস তো?”
“হ্যাঁ, আম্মা।” অপরাধীর ভঙ্গিমায় বললেন, “আমার কিছু হয়নি।”
“আমি শুনলাম, তুই পরীক্ষায় ফেল করেছিস বলে বিভ্রান্তিতে পড়ে এক্সিডেন্ট করেছিস, এখন হাসপাতালে আছিস? আক্কেল কোথায় তোর? সামান্য এই কারণে কেউ এতো অসতর্ক হয়ে পড়ে? কই, দেখি।”
শুভ অপ্রস্তুতের মতো কথাগুলো শুনে বিস্ময়ের সাথে আমার দিকে তাকালেন। আমি এগিয়ে এসে শুভর মাকে সম্বোধন করে বললাম, “আন্টি, মিথ্যা বলেছি আমি। উনার কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি। হাসপাতালে নেয়ার বাহানায় এখানে এনেছি আপনাকে।” ফের এগিয়ে গিয়ে শুভকে বললাম, “দেখেছেন, সামান্য আপনার এক্সিডেন্ট হওয়ার কথা বলায় আপনার মা কেমন ছটফট করলেন! যদি জানতেন, আপনি এই পৃথিবীতেই নেই, তখন কেমন অবস্থা হতো উনার?”
মা তাঁর কেঁদে উঠলেন। সম্ভবত আমার কথার ধরন বুঝেছেন। কেঁদে কয়েকবার কষে শুভকে চড় দিয়ে বললেন, “মরার কথা ভেবেছিস? মরার কথা! তুই চলে গেলে আমি কী করে বাঁচব এটা ভাবিসনি? সামান্য রেজাল্টের কারণে তুই এমনটা করবি?”
মায়ের বেদনা দেখে সহসা কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে শুভ।
“আমাকে ক্ষমা করে দিন আম্মা। আমি দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম।”
মাকে কোনোভাবে সামলে নিয়ে আমার কাছে এলেন শুভ। সম্ভবত তিনি শুকরিয়া আদায়ের ভাষা খুঁজছেন।
পরিমিত হেসে আমি বললাম, “এখন থেকে আমিও আপনার স্টুডেন্ট। পড়াবেন তো আমায়?”
“শুধু তোমায় না,” জয়ের হাসি হেসে বললেন শুভ, “এখন থেকে আরো অনেক স্টুডেন্ট পড়াব। টিউশনির সেই টাকা দিয়ে কোনোভাবে আরেকবার পরীক্ষা দিয়ে জমিটা বেছে ভালো করে পড়াশোনা করব। অনেকটা দূর এগিয়ে যাব।”
আমার বুকটাও যেন ফুলে উঠল।
.
এরপর একসাথে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা দেয়ার পর আমাদের আর দেখা হয়নি। আমাকে বিয়ের জন্য প্রায়ই জোর করা হতো। আমার নিজ বাবা-মা নেই বলে কেউ আমার ব্যথা বুঝত না। চাচিরা শুধুই চাইতো ধনী কোনো ভুঁড়িওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে। কোনোভাবে আমিই উল্টাপাল্টা কিছু করে পাত্রদের দূর করতে সক্ষম হতাম।
.
আজ আমি তাদের সবার কাছ থেকে বহুদূরে, বিচ্ছিন্ন। কোনোভাবে এইচ.এস.সি দিতে পেরেছিলাম। পড়াশোনা তারা আর করাতে চাচ্ছিল না। কলেজের এক ম্যামের হাত ধরে এই অনাথাশ্রমে এসেছি। যদিও আমি এখানের মানুষের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, তবু আমার কাজ হচ্ছে তাদের দেখাশোনা করা। কিছু বাচ্চাদেরও পড়াই আমি।
এই বয়সেও স্বপ্নরা আমাকে ঘেরাও করে। একপাশ ফিরলে দেখি কোনো এক রাজকুমার আসছে। অন্যপাশ ফিরলে দেখি মা-বাবার মাঝখানে আমি বসে আছি।
এমন সুনজর হয়ত কারো নেই, যে আমাকে নিয়ে যাবে। আজ পনেরোটা বছর এখানেই পড়ে আছি। বিয়ের স্বাদ সেই কবেই মিটেছে।
পনেরো বছরে মিলে লেখা, ডায়েরিতে আবদ্ধ লেখাগুলো পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছু বাচ্চাদের পড়াতে যেতে হবে। মলাট বেঁধে উঠতে যাব, শুনলাম, কে যেন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। এতবছরে এই প্রথম! কোনো স্বপ্ন আলিঙ্গন করতে আসেনি তো? শুভ ভাই নয়তো? আমি ডায়েরি রেখে তাড়াতাড়ি গেলাম বাহিরে। বলিষ্ঠ এক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে, চোখে তাঁর চশমা, কোটের ওপরের লাল টাই’টা রোদের হলদে আলোয় চিকচিক করছে। তিনি বললেন, “আপনিই কি মেহেরুন নেছা?”
“জ্বী”
“হুঁ, তাহলে চোখগুলো চিনতে ভুল করিনি। তখন সবসময় তো তোমাকে নিকাবের উপর থেকে দেখেছি। চোখ অবশ্য চেনা ছিল।”
শুভ হাসছেন। বয়স হয়ত পঁয়ত্রিশ বছরের কোঠায়। লোকটাকে কেমন জোয়ান লাগছে! আর হাসিটাই যেন তার বয়সকে আরো কমিয়ে দিচ্ছে।
“এই হাসির কারণ?”
“ও কিছু না। শুনলাম, এখনও অবিবাহিতা তুমি?”
“জ্বী, আপনাদের মতো তো আর বড়লোক হতে পারলাম না! তাই বলে এই বয়সে কেউ ফিরেও তাকায় না।”
“তাকানোর জনটা তাকিয়েই আছে।” মৃদু হাসলেন। বললেন; “মনে আছে আমাদের প্রথম দেখার কথা! সেদিনের দেখাটা যদি না হতো, তবে আজ হয়ত আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। বহু খুঁজে ফের পেয়েছি তোমাকে। জানো, এখন মরীচিকাকে চিনতে শিখেছি। তাই বলে আজও বিয়ে করিনি। চলো না, গিয়ে পরোটা খাই!”
“আমিও যদি মরীচিকা হই?”
“সম্ভবই না। তুমি উপর হতে নিচ পর্যন্ত বাস্তবতা।
পরীক্ষার সামান্য একটা খারাপ রেজাল্টে কতশত ছেলেমেয়েরাই না আত্মহত্যা করে! আমিও যখন এমনটা চিন্তা করছিলাম তখন তুমি এলে। তুমি আমার প্রতি আম্মার ভালোবাসাটা না দেখালে হয়ত বুঝতামই না, আমি চলে গেলে মায়ের কত কষ্ট হতো।
তুমি মরীচিকা হলে আজ তোমার সামনে থাকতামই না। কারণ মরীচিকারা মানুষকে ভুল দেখায়।”
“কালচে মেঘ চারিদিকে আঁধার জুড়িয়ে আনে। তাই বলে আমাদের দুঃখ করার কিছু নেই। বরং মন জুড়ানো বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকা উচিত, তবেই জীবন উপভোগ্য হয়। আবার সোনালি রোদও আসে। সেদিন অতীত নামের আঁধার করা মেঘকে ভয় পেয়েছেন। বৃষ্টিতে ভিজেছেন। আজ দেখুন, রোদ হাসছে সফলতা হয়ে।”
“কষ্ট করলে সফলতাও আসে। শুধু নিজেকে শক্ত রাখতে হয়, তা বুঝতাম না।”
.
কথা শেষে তিনি গিয়ে তাঁর গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। মুচকি হেসে গিয়ে গাড়িতে বসলাম আর দু’জনই পাড়ি জমালাম নতুন এক জীবনের জন্য।
সবার কালো অতীত থাকলেও ভবিষ্যতে সুখের দেখা মিলে। কালো মেঘেরও শেষে মন জুড়ানো বৃষ্টি আসে। কে জানত মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো ব্যক্তিটা একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে জীবন পরিচালনা করবে! আর কে জানত, আমার মতো এক অভাগীর কালচে ভাগ্য রঙে টইটুম্বুর হয়ে যাবে!
(সমাপ্ত…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৩ Comments

  1. Mahbub Alom

    দারুণ।
    প্রতারণা এমন একটি জিনিস যা মানুষ নামক প্রাণিটি সইতে পারে না।তার জন্যই আসে হতাশা,বেছে নেয় মৃত্যুপথ।
    তবে প্রতারণার জীবনেও একজন মানুষ আসে জীবনে বাস্তবতা ফিরিয়ে আনতে।
    লেখিকা এমনি একটি চরিত্র উদ্ধাপন করেছেন।

    ধন্যবাদ

    Reply
  2. Halima tus sadia

    অসাধারণ গল্প।
    পড়ে ভালো লাগলো।
    গল্পে একটি মানুষের জীবনের কষ্টের পরে সফলতা আসে তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
    কিছু মেয়ের মিথ্যা প্ররোচনায় পড়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়।
    কারও জন্য কারও জীবন থেমে থাকে না।
    আয়েশার জন্যও শুভর জীবন থেমে থাকে নাই।
    জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।এতেই জীবনে বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
    মেহেরুন নেছা মেয়েটাই শুভকে নতুন জীবন দিল।
    তাই তো আজ শুভ এই দিনটা দেখতে পেলো।
    খিদে–ক্ষিধে
    ঘুরতে যাবার–ঘুরতে যাওয়ার
    আয়ত্তে–আয়ত্ত্বে
    মা তাঁর কেঁদে উঠলেন–মা তারঁ জন্য কেঁদে উঠলেন।
    শুভ কামনা রইলো।
    এগিয়ে যান।বড় লেখিকা হতে পারবেন।লেখার হাত ভালো।

    Reply
    • Faria Kawser

      ধন্যবাদ। মা আমার, নিষেধ করেছেন কাজটি করতে। শেষের বাক্যটা এই ধাঁচের।

      Reply

Leave a Reply to Halima tus sadia Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *