ঘুম পাচ্ছে, চারদিক থেকে রজনীগন্ধার সুবাস ভেসে আসছে। ঘুম পাচ্ছে, অনেক ঘুম পাচ্ছে। আজ শান্তিতেই ঘুমাতে পারবো মনে হচ্ছে, অনেক বছর পর। কিন্তু আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না, একদমই না। কেউ কি জীবনের শেষ ঘুম ঘুমাতে চায়?নেপথ্যে কাহিনী:
_______________- এই রিকশাওয়ালা যাবে?
– না মামা, এহন যামু না।
– মামা হাসপাতালে যাবো। খুব প্রয়োজন, ৫ মিনিটের রাস্তা।
– যামু তই ৩০ টেহা লাগবো। যাইবেন?
– আচ্ছা চলেন।বিপদে পড়লে সবাই কেমন অপ্রীতিকর আচরণ করে। কেউ পাত্তা দিতে চায় না। এমনকি এইসব রিকশাওয়ালারাও। বিপদে সাহায্য তো করবেই না বরং পারলে ভাড়া দশ গুণ বাড়িয়ে দেয়। সবাই ভয় পায়। বিপদে সাহায্য করে বিপদে পড়ার ভয়। রাস্তাঘাটে বিপদে পড়া মানুষদের নিয়ে আমরা মজা নিই। একবারও ফিরে তাকাইনা। এড়িয়ে যাই, পাত্তা দিই না। মানবতাও আজ ভয়ের ভয়ে ভীতু।
রিকশায় যেতে যেতে এসব চিন্তা করছিললো ফারহান। ছোটবোন টা প্রায় তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। সামান্য ঠান্ডা থেকে জ্বর, তারপর কাশি। আবার ছোট থেকেই আছে হাঁপানীর সমস্যা। ডাক্তার বলেছে হাঁপানীটা নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফারহানের পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল। মাস শেষে পরিবারের খরচ বাদেও ভালো একটা এমাউন্ট ব্যাংকে জমা রাখতে পারে ওর বাবা। মা একটি কলেজ এ শিক্ষকতা করে। আর ফারহান এবার অনার্স ফোর্থ ইয়ার, ঢাবিতে জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজে। এবং ফারহানের ছোট্ট বোন ফারহা এবার ভার্সিটি এডমিশন দিবে। মোটামুটি মানের ছাত্রী। কোনো একটা পাবলিকে টিকে যাবে।
___________
– মামা! , ও মামা! আইসা পড়ছি তো।
– ও আচ্ছা, আচ্ছা, এই নেন ভাড়া।
– আর পাঁচ টা টেহা বেশতি দিবেন, এই কাঠফাটা রোদে আইলাম।
– এমনিতেই ২০ টাকার ভাড়া ৩০ নিছেন, আবার ৫ টাকা বেশি চান!! খুশি থাকেন।
যে যত পায় ঠিক তত বেশিই চায়। রবি ঠাকুরের কবিতাটা খুব মনে পড়ছে ” এই জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুঁড়ি ভুঁড়ি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। ” বিরক্ত লাগে যখন এইসব রিকশাওয়ালারা একটু দয়া দেখাইলে মাথার উপর চড়ে বসে।
মনে মনে রাগ করতে করতে লিফটে গিয়ে ৬ষ্ঠ তলার বোতাম টিপলো ফারহান। ৬০৩ নম্বর রুমেই তার বোন শায়িত আছে গত তিনদিন ধরে। হালকা ঠান্ডা থেকে কেউ এতো অসুস্থ হতে পারে কল্পনারও বাইরে। ফারহানের খুব চিন্তা হয় একমাত্র বোনের এই অবস্থা দেখে।
বোনের রুমে ঢুকেই দেখে মা চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে। না ঘুমিয়েই বা থাকবে কিভাবে? গত দুইদিন সারাদিন হাসপাতালে পড়েছিলো মা। একমাত্র মেয়ের হঠাৎ অসুখ দেখে কোন মা’ই বা ঠিক থাকতে পারে!
ফারহান এসব চিন্তা করে আর মনে মনে হাসে। মা টা তাদের কত্তো ভালোবাসেন। তার দুই বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। টাইফয়েড হয়েছিলো ফারহানের। মা কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে সারাদিন ওর শিয়রে কাটিয়েছিলেন। যতদিন না ফারহান সুস্থ হয়েছিলো। অথচ মা ওদের কত বকতো ছোটবেলায়, কতো রাগ করতো, সব তো ওদের ভালোর জন্যই। মা যে ওদের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছে তা ফারহান নিজ চোখেই দেখেছে। গত বছর মার প্রমোশন হয়েছিলো গাজীপুরের মহিলা কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল পদে। মা ওইটা ইগনোর করেছেন শুধুমাত্র ও আর ওর বোনের জন্য। মার বেতনও অনেক বাড়তো।
ঘুমন্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে ফারহানের এমন অনেক কথা মনে পড়ে যায়। কঠোরতার আড়ালে মায়ের আসল রূপ ফারহান এখন বুঝে। মা যে তাদের অনেক ভালোবাসে, অনেক।
আবার ফারহার দিকে চোখ যায় ফারহানের। মেয়েটি এই কয়দিনে একেবারে শুকিয়ে গেছে। সেই প্রাণখোলা, হাসিখুশি মেয়েটি কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। মুখটা কেমন চিপসে গেছে সাথে চোখ গুলোও কোটরে ঢুকে গেছে। হাতগুলো কঙ্কালের মনে হচ্ছে। যাই হোক বোনটি ওর মায়ের মতোই সুন্দরী হয়েছে। ওর মা নাকি অত্যন্ত সুন্দরী ছিলো। বাবা মাঝেমাঝেই এসব নিয়ে গল্প করে, মা তখন মিটিমিটি হাসে।
ফারহান সামনে এগিয়ে গিয়ে মায়ের কপালে হাত রাখে। ঘুমন্ত মাকে ফারহানের স্বর্গের রাণীর মতো মনে হয়। স্বর্গ শাসন করতে গিয়ে যে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। মোলায়েম স্বরে মা মা বলে দুইবার ডাক দেয় ফারহান। মা যেনো ধড়ফড়িয়ে উঠে। ফারহান কে দেখে এক টুকরো হাসি দেয় মা।
– মুখ ধুয়ে এসো মা, খাবার নিয়ে আসছি।
ফারহানের কথা শুনে চোখ থেকে চশমা খুলে পাশের টেবিলে রাখেন রাশেদা বেগম। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখেন মেয়েটি এখনো ঘুমাচ্ছে। ওকেও ডাকতে হবে যোহরের আযান দিয়ে দিয়েছে।
ওয়াশরুম থেকে মুখ ধুয়ে এসে রাশেদা বেগম দেখেন ফারহান রুমে নেই। নামাজ পড়তে গেছে মনে মনে ভাবলেন। ফারহাকে ডাক দিয়ে তিনিও নামাজ শুরু করবেন চিন্তা করলেন।
– ফারহা, এই ফারহা। উঠ মা, উঠ। পড়ে পড়ে আর কতো ঘুমাবি? শরীর আরো খারাপ করবে রে মা, উঠ এবার।
ফারহার ঘুম এমনিতেই খুব হালকা। ইঁদুর দৌড়ে যাবার শব্দেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। মায়ের ডাক শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেললো সে। রোদের তীব্র আলোতে চোখমুখ ভরে গেলো ওর।
ঘুম থেকে উঠার পর অনেক সুস্থ বোধ হচ্ছে ফারহার। যদিও হাঁপানীর সমস্যাটা বেড়েছে। এখন থেকে নিয়মিত ইনহেলার নিতে হবে। ওর মনে হচ্ছে আজকেই ওকে রিলিজ দিবে হাসপাতাল থেকে।
বিছানা থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে ফ্রেশ হয়ে আসলো ফারহা। এসে দেখে মার ফরজ পড়া শেষ। বিছানার পাশেই দেখলো দুপুরের খাবার রাখা। বুঝলো ভাইয়া এসেছে। ভাইয়াটা একটা অলরাউন্ডার, সবই পারে। রান্না টা যা হয়না ভাইয়ার, একেবারে তুলনাহীন। মনে মনে ভাবে ফারহা আর মুচকি হাসে। ভাইয়াটা ওকে অনেক ভালোবাসে। ফারহাও নামাজ শুরু করলো।
নামাজ থেকে ফেরার সময় ডাক্তারের সাথে কথা হয়েছে। বলেছে আজই রিলিজ দিবে ফারহাকে। এক অদ্ভুত ভালো লাগা ফারহানকে স্পর্শ করলো। ছোট্ট বোনটি কতদিন পর বাড়ি যাবে, বাড়িটা একদমই খালি ছিলো।
বাবাকে ফোন করে ফারহান সুখবরটি জানালো। অপর পাশ থেকে আলহামদুলিল্লাহ শুনে ফারহানের চোখের সামনে ভেসে আসলো বাড়িতে তার বোনটির আবার ছুটাছুটির দৃশ্য, মার হাসিমুখে বাড়ি ফেরা আর বাবার সেই না বলা গল্প গুলো বলার উচ্ছাস। তারা আবার ফিরে পাবে সেই আনন্দময় দিনগুলো। হারিয়ে যেতে পারবে আবার আনন্দের মেলায়। সেই উচ্ছ্বসিত দিনগুলো আবার আসবে, আসবে আবার খুশির আমেজ। ফারহানের চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরতে লাগলো, বেশি খুশির কান্নায় চোখের পানি গুলো মুক্তোর মতো ঝরে পড়ে। তাই কিনা ফারহানের চোখ এখন চকচক করছে।
_______________
– এই উঠো, আর কতো পড়ে পড়ে ঘুমাবে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো যে। আসর পড়বে উঠো।
রাশেদা বেগমের মধুর ডাক শুনে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন জামিল সাহেব। কিন্তু পরক্ষণেই হাসির ফল্গুধারায় তার মুখ ভরে উঠলো। এমন স্বপ্ন দেখলে কে না খুশি হয়।
আসর পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন তার পরিবার যেনো এইরকম ভালোবাসায় সর্বদা আবৃত্ত থাকে। এ পবিত্র ভালোবাসায় যে কোনো খাদ নেই। জাকির সাহেবের কথা তাহলে মিথ্যা ছিলো, ছেলেটাকে শুধু শুধুই তিনি বকলেন ওইদিন। ফারহান আসলেই ভালো একটা ছেলে। অফিসের জমির সাহেবও ওইদিন এই কথাই বললো। দেখতে হবে তো ছেলেটা আমার।
জামিল সাহেব মাগরিব আদায় করে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য শুলেন। তার ঘুম আসছে, অনেক ঘুম। কিন্তু তিনি ঘুমাতে চান না। আরো বাঁচতে চান কয়েকদিন এই ভালোবাসার মাঝে, আরো কয়েকদিন অনুভব করতে চাই এই অমূল্য উপহার। তিনি এখন ঘুমাবেন না। জীবনের শেষ ঘুম কে ঘুমাতে চায়??
০ Comments