শেষ আলিঙ্গন
প্রকাশিত: মে ২০, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 2,421 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

গল্প লেখিকা- আফরোজা আক্তার ইতি
(মে – ২০১৮)
……………

-“ওস্তাদ, পোলাপাইনগুলা বিরক্ত করতাছে অনেক। সকাল থেকা কানতাছে।” চটে গিয়ে মুখ খিঁচড়ে বলল রতন।
-“আরেহ ধুর মিয়া এত পেরেশান হও কেন? ঘুমের শরবত বানায়া সবগুলারে খাওয়ায়ে দাও। ঘুমাইলেই সব ঠান্ডা।” নিশ্চিন্ত মুখে বলল মোদাব্বের উদ্দিন। রতন তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “ওস্তাদ, কালকে সারাদিন এদের ইনজেকশন দিয়া ঘুম পাড়ায়ে রাখছি, তার উপর এরা সারাদিন না খাওয়া। আজকেও তাই করলে তো দুর্বল হয়া যাবে।” রেগে কটমট করে তাকালো মোদাব্বের উদ্দিন। রতন তার এ চোখের ভাষা খুব ভালো করেই বুঝে, তাই আর কথা না বাড়িয়ে শরবত বানাতে বসে গেল।
-“মোট কতজন আনছো রতন মিয়া?”
-“গুনে গুনে পুরা দশজন ওস্তাদ। আজকে সকালে একটা বাচ্চারে পাইছি, সেটারেও ধরে আনছি।”
-“কেউ টের পায় নাই তো?”
-“আপনি আমারে এই ভাবলেন ওস্তাদ? পুরা তিন বছর ধইরা আপনার কাজ করতেছি।” মুচকি হেসে শরবতে চিনি দিয়ে চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল রতন। “রতন মিয়া কাঁচা কাম করে না। মানুষ তো দূরের কথা, একটা পক্ষী পর্যন্ত টের পায় নাই, এতো সাবধানে ভুলায়ে নিয়া আসছি।
আশ্বস্ত হল মোদাব্বের উদ্দিন। না, এই ছেলের উপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। তিন বছর এই ছেলের সাহায্য না পেলে এ পেশায় যে আর এগুতে পারতো না তা খুব ভালো করেই জানে সে। মনে মনে চোখ বুলিয়ে গুনে নিল, হ্যাঁ মোট দশটা বাচ্চাই আছে। ছোট খুপড়ি ঘরটাতে জায়গা নচ্ছে না, গাদাগাদি করে নিস্তেজ হয়ে একজন আরেকজনের গায়ের উপর পড়ে আছে বাচ্চাগুলো। গন্ধে ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না। তিনদিন ধরে নাওয়া খাওয়া ছাড়া, কতগুলো তো অসুস্থ হয়ে বমিই করে ফেলেছে। ঘৃণায় রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরল মোদাব্বের উদ্দিন। বাচ্চাগুলোর কেউ ক্ষুধায়, কেউ বা ভয়ে কান্নাকাটি করছে আবার কারো নড়বার শক্তিটুকুও নেই। এর মধ্যে কিছু বাচ্চার হাত পা কিডনী কেটে নিয়ে তাদের ভিক্ষাবৃত্তি শেখানো হবে, কারো বা রক্ত নয়ত অঙ্গাণু বিক্রি করা হবে। আবার কাউকে কাজের লোক হিসেবে চড়া দামে কেউ কিনে নিবে। একটু উঠতি বয়সের মেয়েগুলোকে টাকার বিনিময়ে তুলে দেওয়া হবে কোন নিষিদ্ধ পল্লীতে। মোদাব্বের উদ্দিনের পায়ের কাছে বসে থাকা বাচ্চাটি তার লুঙ্গি টানতে টানতে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমারে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যান।” “লুঙ্গী ছাড় ফকিন্নির বাচ্চা, দিলি তো ময়লা কইরা।” দাঁত খিঁচিয়ে বাচ্চাটির হাত থেকে লুঙ্গী ছাড়িয়ে নিয়ে বলল সে। “শোন রতন মিয়া, তুমি এগুলারে ঘুম পাড়ায়া বস্তায় ভইরা আমের ট্রাকে উঠাও। আমের কাটন দিয়া ঢাইকা দিবা তারপর শাটার লাগায়া দিবা, কেউ বুঝা পারবো না। আর বেশি দেরি করা যাইব না। বস বারবার কল দিতাছে আমারে। আমি গুদামে গেলাম তুমি ব্যবস্থা কর।” মোদাব্বের উদ্দিন হনহন করে তার আমের গুদামের জন্য রওনা দিল। এখানে সে রতনদের মত কিছু চ্যালাপ্যালাদের কাছে ছেলেধরার ওস্তাদ, আর ওখানে তার আমের গুদামে সহজ সরল মুর্খ-সূর্খ মানুষদের কাছে একজন মহাজন। তার বাগানের আম বিক্রির জন্য দিন আনা দিন নেওয়া গরীব লোকদের খাটায়। গত তিন বছর ধরেই খুব দক্ষতার সাথে এ বহুরূপী মুখোশের আড়ালে আছে সে। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধল গতবার। তারই এক পেশাদার লোকের বোকামির কারণে আরেকটু হলেও ধরা পড়তে গিয়েও বেঁচে যায় সে। তাই এবার বসের কাছে মাল হ্যান্ডওভার করার সময় খুব সাবধান হতে হবে। এজন্য নতুন কোন লোককে দরকার, যাকে কেও চিনে না আর ধরা পড়ারও কোন সম্ভাবনা নেই।

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মোদাব্বের উদ্দিন মুখে সিগারেট ধরালেন, এমন সময় তার সামনে দবির মিয়া এসে করুণ চোখে হাতজোড় করে দাঁড়াল। দবির মিয়া তার বাগানের আম বিক্রি করে। খুবই সহজ সরল মানুষ, সাত চড়েও রা করে না।
-“কি দবির মিয়া কিছু কইবা?”
বলব না বলব না ভেবেও ইতস্তত করতে করতে সে বলেই ফেলল, “মহাজন, এবারের মত আমারে কয়টা ট্যাকা দেন। মাইয়ার জ্বর, কিছুতেই ভালা হয় না। কবিরাজ দেখানের ট্যাকাও নাই। একটামাত্র মাইয়া মহাজন, কত মানতের পর ওরে পাইছি, ওর কিছু হইলে আমরা বাঁচুম না।” বলতে বলতে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ল দবির মিয়া।
-“আরেহ থামো মিয়া, তুমি না কয়দিন আগেও ট্যাকা নিলা? এত ট্যাকা শোধ করা পারবা মিয়া?”
-“লাগলে ভিটা বেইচা দিমু। মাইয়া না থাকলে ভিটা মাটি দিয়া কি হইব?”
সিগারেটে আস্তে করে টান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল মোদাব্বের উদ্দিন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করার এটাই সময়। “একমাত্র সম্বল বেইচা কি করবা? বউ-মাইয়ারে নিয়া থাকবা কই? খাইবা কি?”? মনে হল কথায় কাজ দিয়েছে। দবির মিয়া মাথা নিচু করে কথাগুলো ভাবছে। “শোন মিয়া, তোমারে একটা কাজ দেই। এটা যদি করতে পারো তাইলে নগদ একহাজার ট্যাকা পাইবা। কাজটা খুব সহজ। আমার এক লোক তোমারে আমার আমের ট্রাকে কইরা একটা জায়গায় নিয়া যাবে। সেখানে আমার কিছু পরিচিত লোক থাকবে। তুমি খালি তাদের কাছে আমের কাটনগুলা সাবধানে ডেলিভারি দিবা। ব্যাস এটাই তোমার কাম। আমার পরিচিত লোক আছে, কিন্তু তোমারে আমি দিলের খাস হিসেবে দেখি বইলা কাজ টা তোমারে দিলাম। বুঝলা মিয়া?”
এত সহজ একটা কাজের বিনিময়ে হাজার টাকা পাবে আর তা দিয়ে তার মেয়ের খুব ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে ভেবে নিরবে মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হয়ে গেল দবির মিয়া। মাথার ঘামের সাথে খুশিতে চোখের কোণে চলে আসা পানিটা যত্ন করে মুছতে গিয়ে সে আর খেয়াল করল না যে, এবার বসের থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বউয়ের কানের স্বর্ণের দুলের আবদার পুরণ করতে পারবে ভেবে মোদাব্বের উদ্দিনের চোখ কেমন চকচক করে উঠেছে।

ট্রাক থেকে নেমে এরকম সুনসান জায়গা দেখে অবাক হয়ে গেল দবির মিয়া। এরকম নিরব জায়গায় তাকে একাজে আসতে হবে ভাবতেও পারে নি সে। দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে মাল নেওয়ার জন্য। তাকে নামতে দেকে ইশারায় দু’জন ট্রাক থেকে সব বের করতে বলল তাকে। দবির মিয়া শাটার উঠিয়ে আমের কাটনগুলো নামিয়ে তাদের হাতে দিতে লাগলো। বস্তাগুলো নামানোর সময় টের পেল এগুলো কাটনগুলোর থেকে ওজনে বেশ ভারি। আমের বস্তা যে এত ভারি হয় তা আগে জানা ছিল না তার। সবশেষে শেষ বস্তাটা ট্রাক থেকে নামানোর সময় এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল দবির মিয়া। এ অনুভুতি তার খুব চেনা, খুব আপন মনে হচ্ছে। কি যেন ভাবতে ভাবতে বস্তাটা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। পরক্ষণেই লোকগুলোর ধমকে সতবিত ফিরল
তার, তাদের হাতে তুলে দিল।
খুব খুশি মনে বাড়ি ফিরছে দবির মিয়া। তার হাতে পুরো কচকচে এক হাজার টাকার নোট। মহাজন তাকে এক হাজার টাকা তো দিয়েছেই, সাথে খুশি হয়ে আরো দু’শো টাকাও দিয়েছে। বলেছে এভাবে কাজ করে দিলে আরো টাকা দিবে তাকে। সত্যিই মানুষটা খুব বড় মনের। এতগুলো টাকা একসাথে সে কখনোও দেখে নি। এটাকা দিয়ে তার মেয়ের চিকিৎসা করালে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে, আর চিন্তা নেই। চোখের কোণে খুশিতে জমে ওঠা পানি গামছা দিয়ে সযত্নে মুছে নিল সে। কিন্তু এ খুশি বেশিক্ষণ আর ধরে রাখতে পারলো না। উঠানে পা রাখতেই “আমগো আলেয়া কই গো” এক গগণবিদারী চিৎকারে সে থমকে দাঁড়ালো। আলেয়ার মা বুক চাপড়ে কাঁদছে। কিছু মহিলা তাকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করছে। পাশের বাড়ির জমিলার মা দবির মিয়াকে স্তব্ধ হয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে এল। মুখে ঘোমটা টেনে কান্না চেপে বলল, “আজকে সকালে আলেয়া জ্বরের শরীরটা নিয়া খেলতে গেল বাইরে। সেই যে মাইয়াটা গেল আর আইল না। এত খুঁইজাও তারে আর পাইলাম না।” কথাগুলো যেন দবির মিয়ার কানে নয়, হৃদয়ে গিয়ে বাঁধল। ধপাস করে বসে পড়ল সে। হাতের টাকাগুলো হাত থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। স্থির চোখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে সে ভাবলো, আমের বস্তা বের করার সময় সেই অনুভুতি ছিল তার মেয়েকে কোলে নেওয়ার অনুভুতি, শেষবারের মত।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

১ Comment

  1. tahsina

    লিখা লিখির অভ্যাস ভালো। লিখতে থাক আর নতুন নতুন গল্প দিয়ে যা আমাদের ????

    Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *