পুরুষ
প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 1,852 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

গল্প লেখকঃ
#আয়শা_সুলতানা_তিথি
আপসারা নূর তিথি
(মার্চ – ২০১৮)
………………

আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমি তখন সবে স্পষ্টভাবে কথা বলতে শিখেছি। সারাদিন মা যতবার না ডাকতাম তার চেয়ে বেশি বাবা ডাকতাম। তখন বুঝতাম না বাবা আমার ডাকে কতটা বিরক্ত হয়। এটাও বুঝতাম না মায়ের সাথে প্রতিনিয়ত ঝগড়ার কি কারণ ছিলো। এখন বুঝি, হ্যাঁ কারণটা আমি। যতদূর মনে পড়ে বাবা উচ্চশিক্ষিত ছিলো। সে কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়া নিয়ে এরকম করতে পারে ভাবলে আমার গা শিউরে উঠে। বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন মা গলায় দড়ি দিলো। কি অদ্ভুত না? একটাবারও মনে হলো না? আমার কি হবে? মা মারা যাওয়ার সপ্তাহ না ঘুরতেই বাবা নতুন মা ঘরে আনে আর তারপর দিনেই আমাকে রেখে যায় এই এতিমখানায়। সেদিন থেকে পুরুষ মানুষের প্রতি আমার প্রচন্ড ঘৃণা আর ক্ষোভ জন্ম নেয়। ঠিক করি জীবনের কোনো অংশেই পুরুষ মানুষের কোনো অস্তিত্বের চিহ্ন রাখবো না।
.
আমাদের এতিমখানায় যে প্রধান দায়িত্বে আছে তাঁকে আমরা সবাই নতুন মা ডাকি। যদিও তিনি এখন পুরাতন। কারণ গত চৌদ্দ বসন্ত ধরে আমি তার কাছেই আছি। কোনো এক কারণবশত নতুন মা আমাকে খুব ভালোবাসতো। তিনি চেষ্টা করেছেন সকল এতিমদের অন্তত মাধ্যমিক পাশ করাতে। কিন্তু আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখেন অনেকটা। মাধ্যমিক পাশ করার পর যে যার গন্তব্য খুঁজে এখান থেকে চলে যায়। কারণ পুরাতনরা জায়গা না ছেড়ে দিলে নতুনদের কি হবে? আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরও যাই নি। এখন স্নাতক পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার ইচ্ছে পরবর্তীতে এখানের নতুন মা হবো আমি। পুরুষের সাহায্য ছাড়াও মাতৃত্বের সাধ পাওয়া যায়। এই সত্য আমি খুঁজে পেয়েছি নতুন মা এর কাছে। আজ ছাপ্পান্ন বছর বয়সেও তিনি বিয়ে করেন নি। হঠাৎ করে এতিমখানায় সাহায্য দেওয়া সংস্থাগুলো ঘুরে দাঁড়ায়। অভাবের একটা ছায়া নেমে আসে পুরো এতিমখানা জুড়ে। নতুন মা চিন্তায় বিছানায় শয্যাশায়ী হয়।

একদিন সকালে নতুন মা আমাকে তার ঘরে ডাকে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে বিয়ের কথা। আমার কানের কাছে যেনো সহস্র বজ্রপাত হচ্ছে। নতুন মা সব জেনেও কিভাবে এমন কথা বলতে পারে? আমার অবাক দৃষ্টি দেখে নতুন মা আমার দুটো হাত নিজের দু’হাতে চেপে ধরে বললো, “জানি রে মা তুই বিয়ে করতে চাস না। শেষ মুহূর্তে আমারও এমন নিষ্ঠুর আবদার করতে মন সায় দিচ্ছিলো নারে। এক বিরাট ব্যবসায়ী লোক তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে। বলেছে তোকে বিয়ে করলে এই এতিমখানায় দায়িত্ব নিবে। আমি কি করবো বল? যদিও তার বয়স তোর তুলনায় একটু বেশিই হবে। কিন্তু তুই অমত করিস নারে। আমাকে ভুল বুঝিস না। ঐ দুধের শিশুদের দিকে তাকালে আমার বড্ড কষ্ট হয় রে”।
আমি কিছু না বলে বেড়িয়ে আসলাম। হায়রে পুরুষ! আর কত রূপ দেখবো তোমার? এতিমদের সাহায্য করবে তাও নিজের স্বার্থ হাসিল করে। বাহ! বাহ!
মাঠে শিশুদের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে হলো না ঐ হাসিকে মলিন করতে। তাই নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাজি হয়ে গেলাম।

যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে আমার চেয়ে বছর দশকের বড়। তার সাথে আমার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমেই। না শারীরিক আর না মানসিক। অবশ্য বিয়ের ছয়মাস পেরিয়ে গেলেও তার ভিতর এমনকিছু দেখিনি যা দেখে তাঁকে খারাপ ভাবা যায়। তবুও মনের ভিতর একটা পোষ্য প্রাণী আছে। যার নাম ঘৃণা। নতুন মা মারা যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলো মানুষটাকে কষ্ট দিস না। বড় ভালো মানুষ সে।

এতো ঘৃণার মাঝেও একটা দিক ভালো লাগতো সে আমার যত্ন করলেও কখনো স্বামীর অধিকার খাটাতে আসে নি। এতোবড় বাড়িতে আমরা দুইজন একা মানুষ। আমি সারাদিন এতিমখানায় থাকি আর সে অফিসে। রাত হলেও দুজন দুই কক্ষে থাকি। একবার ব্যবসার জন্য সে ঢাকার বাইরে গেলো। আমি লক্ষ করলাম তার কথা আমার ভীষণভাবে মনে পড়ছে। তার অনুপস্থিতি আমার মনে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। তাঁকে একটাবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই অনুভূতির সাথে আমি নতুন পরিচিত। এর নাম কি জানি না। মনের অজান্তেই তার ঘরে চলে গেলাম। সব নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ একটা ডায়েরি পেলাম। খুলে কিছুদূর পড়তেই বুঝতে পারলাম ডায়েরি আমাকে নিয়ে লেখা। আমি বিয়ে করতে চাই না জেনেও সে আমাকে বিয়ে করেছিলো শুধুমাত্র বখাটেদের নজর থেকে আমাকে রক্ষা করতে? আর সব সম্পত্তি আমার নামে লিখে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আমার চোখ থেকে গাল গড়িয়ে পানি পড়ছে। অনেক বছর পর চোখ থেকে পানি পড়ছে। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে না। একটা তীব্র আনন্দ হচ্ছে। একটা লাইন পড়ে থমকে গেলাম, “যদিও আমার ইচ্ছে ছিলো মেয়েটার কাছে কখনো স্ত্রীর অধিকার চাইবো না। তবুও কিভাবে যেনো তাঁকে খুব ভালোবেসে ফেলছি। সে আমাকে প্রতি মুহূর্তে টানে। তার কাছে থাকলে বোধহয় আমি পুরুষত্ব দেখাতে গিয়ে মানুষ থেকে পশুর রূপে রূপান্তরিত হবো। তাই দূরে চলে যাচ্ছি”।
আমি ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কান্না করলাম। এ কোন শাস্তি! সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুজলাম তার কোনো কার্ড পাওয়া যায় কি না! কারণ তার নাম্বার আমার কাছে ছিলো না। আমার নাম্বার টা খুব প্রয়োজন যে। অনেক খোঁজার পর পেলাম। ফোন করতেই সে সাথে সাথে রিসিভ করলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “আপনি এক্ষুনি বাসায় আসবেন। এক্ষুনি আসবেন” আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আমার কাছে সব ঘোরের মতো লাগলো। কি করলাম আমি? আমি কি তাঁকে ভালোবেসে ফেললাম?
সে আসার পর আমার আবার ঘোর লাগলো। তাঁকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, “এমন কষ্ট কেনো দিচ্ছেন? আমাকে একা রেখে কেনো চলে গিয়েছিলেন?”
তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখের কোণে জল। সে কি যেনো বলতে চাচ্ছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। ঘোর কাটতেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম। ঠিক করলাম যা হয়েছে ভুলে যাবো। পুরুষ ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। তার থেকে দূরে থাকার বৃথা চেষ্টা করলাম। পারলাম না। তাই মনের কাছেই হার মেনে তার পায়ে আমার ভালোবাসা সোপর্দ করলাম। পৃথিবীটা স্বর্গস্বরূপ লাগছিলো আমার কাছে।

একদিন সকালে হুট করে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমার মাথার কাছে তিনি বসে আছেন। আর ডাক্তার হাসি হাসি মুখ করে বলছে, “মিষ্টি খাওয়ান। বাবা হতে চললেন তো”
তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখমুখে আনন্দের রশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমার মনে অজানা একটা শঙ্কা দেখা দিলো। মেয়ে সন্তান হলে যদি সেও পাল্টে যায়? তার এতো ভালোবাসা আমি হারাতে পারবো না। কিছুতেই পারবো না। বড্ড লোভ সৃষ্টি হয়েছে যে।
ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে এসে সে আমার পাশে এসে বসলো। আমি উঠে আধশোয়া অবস্থায় বসলাম। সে আমার হাত দুটো ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার কিন্তু মেয়ে বাবু চাই”
আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো। তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব পুরুষ খারাপ না। যে আমায় জন্ম দিয়েছিলো সে ভিন্ন রকমের হলেও যার জন্য আমার জন্ম হয়েছে সে ঠিকই পুরুষ। আমার ভালোবাসার পুরুষ।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

৭ Comments

  1. Salman

    ভালো লাগলো খুব ৷

    Reply
  2. Hussen

    ????????

    Reply
  3. Maruf Hossain

    ভালো ছিলো। বিশেষ করে সব পুরুষ এক না এটা ফুটিয়ে তুলার জন্য।

    Reply
    • Aysha Sultana Tithi

      শুকরিয়া❤

      Reply
  4. Aysha Sultana Tithi

    ধন্যবাদ 🙂

    Reply
  5. সাইফুল ইসলাম

    খুব সুন্দর লিখেছো আপু

    Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *