গল্প লেখকঃ
শামীম আহমেদ (ShaM)
(মার্চ – ২০১৮)
……………
-বাজান! বাজান, কাইল নাকি পইলা বৈশাখ? ছোট্ট অন্তু তার বাবা কবের মিয়াকে দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল।
-হ বাপ, কেন তুই পয়লা বৈশাখ দিয়া কি করবি? কবের মিয়া জবাব দিল।
-বাজান পান্তা-ইলিশ খামু।
-পান্তা-ইলিশ!
-হ বাজান ইস্কুলের আপায় কইছে পইলা বৈশাখে সবাই পান্তা-ইলিশ খায়। আমরাও খামু।
কবের মিয়া ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল-
-আইচ্ছা বাজান খাইবা, আমি আইজ ই বাজার থাইক্কা ইয়া বড় একটা ইলিশ আনমু আমার বাজানের লাইগা।
-সত্যি আনবা তো?
-হ বাজান সত্যি আনমু।
-তুমি তো অনেক কিছু আনতে কইয়াও আনো নাই।
-আইজ আর মিথ্যা কমু না বাজান, আইজ সত্যি আনমু।
-আইচ্ছা মনে কইরা আইন্নো, রাইত্তে তুমি না আসা পর্যন্ত কিন্তু আমি ঘুমামু না।
বলেই অন্তু খেলার জন্য দৌড় দিল । ছেলের এসব কান্ড-কারখানা দেখে উঠুন থেকে সাবেরা বানু কাথা সেলাই এর মধ্যে থেকে না হেসে পারলেন না।
কবের মিয়া গামছাটা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে সাবেরা বানুকে বলল-
-কি হইল, হাসতাছ কেন?
-হাসুম না ত কি করুম। বাপ বেটার এসব পাগলামি দেইখা না হাইসা উপায় আছে।
-আরে আমার ছোট্ট পোলাডায় একটু শখ করছে আমি কি সেইডাও পূরণ করুমনা নাকি।
-ওর কথায় কি কান দিলে হইব। ঘরে চাইল-ডাইল কিচ্ছু নাই হেইডা কি তোমার খেয়াল আছে। আছো পোলার শখ আহ্লাদ লইয়া।
-আরে এত চিন্তা করো কেন,আইজকা দিন ভালা আছে। আল্লাহ্ যদি মুখ তুইল্লা থাকান তাইলে মাছ বেইচ্ছা আইজ সব আনুম।
-কেমনে আনবা ইলিশের যা দাম, আর যেগুলা পাইবা ওগুলাতো মহাজনই লইয়া যাইবো।
-চিন্তায় ফালাইয়ো না দেখি। আমার বাপে ইলিশ খাইবার চাইছে যে করেই হোক আমি ইলিশ আনমু, আমার তামাকটা একটু দাও দেখি বেলা অনেক হইছে দু-
একটা টান মাইরা তাড়াতাড়ি নাওয়ে যাইতে হইব।
সাবেরা বানু হুক্কা দিতে দিতে রাগ দেখিয়ে বলল-
-পোলা পোলা কইরা সবই শেষ করবা। রাইত্তে তাড়াতাড়ি বাইত্তে আইসো।
-আইচ্ছা আমুনে। বলে কবের মিয়া হুক্কা টানতে লাগল।
*************
-ছালামুয়ালাইকুম মহাজন।
আড়তে ঢুকেই কবের মিয়া মহাজনকে সালাম দিল। পত্রিকাটা নামিয়ে মোটা চশমার ফ্রেমটা নাকের ডগায় এনে মহাজন কবেরে দিকে তাকালেন। আগে ভাল করে কবেরকে একনজর দেখলেন,তারপর সালামের জবাব দিলেন।
-কি কবের মিয়া আইজ এত দেরি কইরা আইলা যে? ফর্দ লিখতে লিখতে মহাজনের হিসাবরক্ষক সুরাব আলী কবেরকে জিজ্ঞেস করলেন।
-না চাচা ওই অন্তু একটু বায়না ধরছিলতো তাই একটু দেরি হইয়া গেছে।
-যাও মিয়া আল্লাহর নাম লইয়া বাইর হইয়া পরো,আইজ দিন ভালা আছে।
-হ চাচা যামু। মহাজন একটা কথা কইতে চাচ্ছিলাম।
মহাজন পত্রিকাটা চৌপায়ার উপর রেখে বললেন-
-কি কইবা কও।
-না মানে কইতে চাচ্ছিলাম যে আইজ আমারে একটু সকাল সকাল ছাড়তে হইব।
-কেন কি দরকার?
-আর বইলেন না ওইযে আমার পোলা অন্তু আছে নাহ, ও শখ করছে পান্তা-ইলিশ খাইবো।আমি আবার তাড়াতাড়ি না গেলে আমার বাজানে না খাইয়াই থাকবো।
মহাজন মুচকি হেসে বললেন-
-আইচ্ছা যাইবা,যাও
ওহন কামে লাইগা পড়ো। মধুরে কউ নাও লইয়া বাইর হইতে।
-জ্বী।
বলেই কবের মিয়া নৌকায় জাল নিয়ে পদ্মার বুকে নৌকা বাসাল। সঙ্গে আরো ৩ জন সাথী আছে।
একজনের নাম মধু। এখনো কিশোর, বয়স ১৬ থেকে ১৭ হবে,বাপ মারা যাওয়ায় কাজে লেগে গেছে। মধুর কাজ নৌকা চালানো। আরো দুজন হল রহিম চাচা
আর আবুল। রহিম চাচা মাঝ বয়সি লোক। বয়স খুব বেশি না হলেও কাজের চাপে শরীর একটু নুয়ে পড়ছে। তবে মাছ ধরায় রহিম চাচার হাত বেশ পাকা। এবার আবুলের কথায় আসা যাক। আবুল আগে অনেক বড় বাদাইম্মা ছিল, খালি এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করত। কয়দিন আগে নতুন বিয়ে করছে টাকা-পয়সার দরকার।
তাই কবেরের হাত ধরেই এখন মাছ ধরতে আসে। অবশ্য আবুলও অনেক ভাল। মাছ ধরতে পারে। আবুল অনেক সাহসীও বটে। যখন নদীতে পানি কম থাকে তখন মাঝ নদীতেই ডুব দিয়ে বোয়াল, কাতলা, ট্যাংরা, টুনা ছোট বড় সব ধরনের মাছই ধরে নিয়ে আসতে পারে।
**************
আজ নদীটা শান্ত লাগছে। আকাশটাও অনেক পরিষ্কার। ঝড়-ঝাপটার কোন আভাস নাই,যদিও বৈশাখের প্রথম দিনে সব সময় হালকা পাতলা ঝড়-বৃষ্টি হয়েই
থাকে।
মধু নৌকাটা মাঝ নদীতে ভাসিয়ে দিল। রহিম চাচা জালটা ঠিক করে দিতেই কবের আর আবুল জাল নদীতে ফেলা শুরু করল। মাছ ধরা শুরু হল, ধীরে ধীরে
একটা দুটা করে মাছ জালে আটকা পড়তে শুরু করল।
আজ বুঝা যাচ্ছে জালে ভালই মাছ পড়বে । মাছের আভাস দেখে সবাই খুশি হল। কিছুক্ষণ জাল তুলা হল। মাছগুলা নিয়ে আবার নদীতে জাল ফেলা হল, আবার
তুলা হল,আবার ফেলা হল। এভাবে ক্রমশ মাছ ধরা চলতে থাকল। মাঝে মাঝে রহিম চাচার হুক্কা থেকে কবের আর আবুলও দু এক টান দিল। মধু ছোট মানুষ
তাই তামাক খায় না।
হঠাৎ মধু চিৎকার করে উঠল-
-কবের ভাই এদিকে আহো।
-কেরে কি হইছে চিল্লাস কেন? কবের বলল
-আরে দেইখা যাও কত্ত বড় মাছ জালে আটকাইছে।
-কস কিরে সত্য নাহি??
-হ রে কবের হাছাই বড় একটা মাছ জালে পড়ছে। মাছটা দেখে রহিম চাচাও বলল।
কবেরের সাথে সাথে আবুলও সামনে একপা ফেলে মাছটা দেখল।
দুজনে মাছটা ধরার চেষ্টা করল। বাপরে মাছটা যেমন বড় তেমনি শক্তিও মেলা।
মাছটা তুলতে কবের আর আবুলকে অনেক বেগ পোহাতে হল। তাদেরকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হল মাছটার সাথে। অবশেষে মাছটা নৌকায় তুলা হল, কিন্তু একি
মাছটাকে কেউই চিনতে পারল না।
রহিম চাচা বলল-
-মনে হয় মাছটা সাগর থাইক্কা আইছে। এমন মাছতো নদীতে থাওনের কথা না।
আবুল বলল-
-যেহান থাইক্কা আহুক না কেন তাতে কি। এটা পাইলে মহাজন অনেক খুশি হইব।
-মহাজনের খুশি দিয়া কি হইবরে আবুল, মহাজনতো সবই লইয়া যাইবো। -কবের বলল
-হাছা কথা কইছো কবের ভাই, মহাজন এক লাম্বারের বদমাইশ।
-যাউকগা ওসব কথা বাদ দিয়া কামে মন দে।
আবুল আর কথা না বাড়িয়ে গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করল-
-আমায় এতো দুঃখ দিলিরে বিধি
হইলাম কুলমান হারা
তর লাইগা এতো কষ্টে
ভাঙ্গলাম নায়ের গোড়ারে বিধি
হইলাম কুলমান হারা……
আবুলের সাথে সাথে কবেরও গলা মিলাল।
***************
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল। চারদিক আবছা আবছা অন্ধকার হতে শুরু করল। কবের সবাইকে নিয়ে ঘাটে ফেরার কথা ভাবতে লাগল। মধুকে বলল নৌকা ঘুরাতে। রহিম চাচা মাছগুলো শামুক আর আগাছা থেকে আলাদা করতে লাগলেন। এদিকে কবের আর আবুল জাল ঠিক করতে লাগল।
মধু নৌকা ঘুরিয়ে ঘাটের দিকে নৌকা চালাতে লাগল। হঠাৎ করে আকাশে মেঘ গর্জন করতে লাগল, কালো মেঘ গুলা কোথা থেকে এসে সমস্ত আকাশটাকে ঢেকে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে দিল।
শান্ত-শিষ্ট দিনটি হঠাৎ করে কাল বৈশাখীর ভয়ংকর রূপ নিল। মাঝ নদীতে পানি ফুলে উঠেতে লাগল। প্রচণ্ড রকম শব্দ করে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। ঝড় শুরু হল। কবের সহ নৌকার সবাই ভয় পেয়ে গেল। বৈশাখের শুরুতে ঝড়-ঝাপটা হয় ঠিকই, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অনেক ভয়ংকর কিছু হবে, এমন ঝড় কবের আগে কখনো দেখেনি। তাই সবাই একটু বিচলিত হয়ে গেল। সবাই আল্লাহর নাম জপ নিতে থাকল। ধীরে ধীরে বুঝা যাচ্ছে আকাশের গর্জন বেড়ে বিকট আকার ধারণ করল।
মাঝ নদীতে তুফান শুরু হল। বড় বড় ঢেউ এসে নৌকাটাকে এদিক থেকে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই নৌকার মাঝখানে এসে জড়সড় হয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল। কবের নৌকাটাকে পাড়ে ভেড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু নাহ কিছুই করতে পারল না।
প্রচন্ড ঢেউয়ে নৌকায় পানি উঠতে শুরু করল,সবাই আরো বেশি ভয় পেয়ে
গেল। সবাই আল্লাহ আল্লাহ করছে কিন্তু হঠাৎ করে একটা বড় ঢেউ এসে পুরো নৌকাটাকেই উল্টিয়ে ফেলল। সবাই নৌকা থেকে পড়ে মাঝ নদীতে হাবুডুবে খেতে লাগল। একেই তো ঝড় তার উপর বড় বড় ঢেউ, কবের কি করবে কিছুই
বুঝতে পারছে না। কবের আবুলকে নিয়ে পানির নীচে ডুব দিল। নৌকাটা কাছাকাছিই আছে, দুজন নৌকাটা পানির উপরে তুলার চেষ্টা করল। পানির নীচ সমস্ত শক্তিই বৃথা যাচ্ছে। কোন কাজ হচ্ছে না, শেষে অনেক কষ্টে নৌকাটা ওরা পানির উপর তুলতে পারল। মধু আর রহিম চাচাকে নৌকায় তুলল, আবুলও উঠল। কিন্তু একি নৌকায় তো অনেক পানি, আর কেউ উঠলেই নৌকা আবার ডুবে যাবে। আবুল কবেরে হাতটা ধরল, কবের বুঝতে পারছিল ও নৌকায় উঠলে আর কেউই বাঁচবে না। তাই আবুলকে ওর হাতটা ছেড়ে দিতে বলল। কিন্তু আবুল হাত ছাড়ল না।
মধু কিছুই বলতে পারছিল না, ওর শরীর ঠান্ডা আর ভয়ে এখনো কাঁপছে। রহিম চাচা বললেন-
-কবের নাওয়ে উঠে আয়, তাড়াতাড়ি উঠ।
-না চাচা আমি নাওয়ে উঠতে পারুম না,আমি নাওয়ে উঠলে নাও আবার ঢুইব্বা যাইবো তাইলে আর আমরা কেউই বাঁচতে পারুম না।
-কবের ভাই নাওয়ে উইট্টা আহো আল্লাহর দোহাই লাগে, বাঁচলে এক লগে বাঁচুম মরলেও এক লগেই মরুম।
আবুল বলল
-না রে ভাই তোরা যা, আমি সাতরাইয়া আমুনে।
-না ভাই তোমারে এভাবে মাঝ নদীতে ছাইড়া আমরা যামু না তুমি নাওয়ে
উঠো।
-আবুল ভাই আমার তুই আমার হাতটা ছাড় নাইলে সবাই মারা পড়বি।
-আমি তোমার হাত ছাড়ুম না ভাই তোমারে একা ফালাইয়া আমরা কোথাও যামু না।
রহিম চাচা বললেন-
-কবের কেন পাগলামি করছিস, নাওয়ে উঠ। আল্লাহ চাইলে কিচ্ছু হইব না।
-না চাচা তা হয় না,আল্লায় যদি বাঁচাই রাখে তাইলে আবার দেখা হইব। আবুল তর ভাবি আর অন্তুরে দেইখা রাখিস। খোদা হাফেজ ভাই।
বলেই কবের আবুলের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িতে নিল। একটা ঢেউ এসে কবেরকে নৌকা থেকে দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ধীরে ধীরে কবের পানির নীচে তলিয়ে যেতে লাগল। আবুল “কবের ভাই” বলে চিৎকার করে উঠল।
মধু আর রহিম চাচা নির্বাক হয়ে গেল, তাদের গলা দিয়ে একটা আওয়াজও যেন বের হচ্ছিল না।
একসময় ঝড়ও থেমে গেল, উত্তাল নদীও শান্ত হয়ে গেল।
আবুল, মধু রহিম চাচা সবাই ঘরে ফিরল শুধু মাত্র কবের আর ফিরল না।
*************
পরদিন পদ্মার পাড় থেকে কবরের লাশ আনা হল।
উঠুনে চাটাইয়ে উপর কবেরকে শুইয়ে দেওয়া হল। আবুল, মধু রহিম চাচারা সবাই নির্বাকচিত্তে কান্না করতে থাকল। সারা গ্রামের লোকজন কবেরের বাড়িতে জড়ো হল। সাবেরা বানু যেন স্বামী হারার শোকে পাথর হয়ে গেলেন। কাঁদতেও পারছিল
না,পাগলের মতো বাড়িন্দায় পড়ে রইলেন। ছোট্ট অন্তু মায়ের এ অবস্থা দেখে মায়ের কোলে চুপটি করে বসে থাকল। সাবেরা বানু উঠুনে স্বামীর নিথর দেহের দিকে একবার তাকালেন। আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে স্বামীর লাশে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অনেক জোরে জোরে বিলাপ করে কান্না শুরু করলেন।
মায়ের কান্না দেখে অন্তুও বাবার লাশকে ধরে কাঁদতে লাগল। কান্নার আওয়াজে বাতাস ভারি হয়ে উঠল। অন্তু বাবার বুকে হাত দিল,অন্তুর হাতে কি যেনো একটা লাগছিল। অন্তু মাকে দেখিতে বলল
-“মা এই দেখো বাজানের হাতে ইলিশ।
অন্তুর মা ছেলের কথায় তাকিয়ে দেখলেন কবেরের দুই হাত বুকের সাথে বাধা। সেই হাতেই ছোট্ট একটা ইলিশ মাছ পরম যত্নে বুকের সাথে আগলে রেখেছেন।
অন্তু বাবার কাছ থেকে ইলিশ পেল ঠিকই,কিন্তু তার আর পান্তা-ইলিশ খাওয়া হল না।
০ Comments