ইশরাত জাহান রোজী
চার বছরের ছোট্ট তুতুল। সারাক্ষণ বাসায় এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করে বেড়ায়। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল আটটাকে ছুঁয়ে ফেলেছে।
তাড়াহুড়ো করে বের হওয়া অফিসগামী বাবাকে বিদায় জানায় তুতুল। বিদায় জানিয়েই শেষ হয় না বিদায় পর্ব। জানালায় গিয়ে দাঁড়ায় আবারও, বাবাকে দেখবে বলে।
আকাশ থেকে তখন একটু একটু বৃষ্টি ঝরছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। রীশাদ যে জানালায় দাঁড়িয়ে আছে তার অর্ধেকটা পাশের আম গাছের ডাল-পাতায় ঢাকা থাকে সারাবছর। এক পাশটা খালি। খালি অংশটুকু দিয়ে দিয়েই পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়। মাঝেমাঝে জানালার কাছে চেয়ার দিয়ে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তিথিও দাঁড়ায়, বৃষ্টি দেখার আশায়, নীল আকাশ দেখার আশায়। মন ভরে, চোখ তৃপ্ত করে আকাশ দেখে।
অন্যদিনের মতো আজও দাঁড়ায় ছেলের পাশে। তুতুল হঠাৎ-ই বলে উঠে- “আম্মু , ঐ যে আম পড়ে আছে,নিব।”
বলেই কোন কথা না শুনেই চেয়ার থেকে নেমে দৌড় দেয় দরজার দিকে।দরজা খোলা থাকায় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে অসুবিধা হয় না তার।
আম,তুতুলের খুব প্রিয়।জানালার পাশেই আম গাছটায় আম ধরেছে বেশ। জানালায় লেগে থাকা ডালটাতেও বেশ কয়েকটা আম আছে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়,পাড়া যায় আম গুলো।
ওরা ভাড়া বাসায় থাকে। আম গাছটা বাড়িওয়ালার। কারো গাছ থেকে ‘না’ বলে কোন কিছু নেওয়া যায় না -এই শিক্ষায় ছোট্ট তুতুল বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। তাই কখনো গাছ থেকে আম পাড়ার বায়না করে না। কিন্তু যে আমটা মাটিতে পড়ে আছে, সেটা কুড়িয়ে নেওয়া অন্যায় নয় -এমনটা ভেবেই গাছ তলায় পড়ে থাকা আম নিতে ছুটে যায় তুতুল। তিথি জানে, ছেলে বাঁধা মানবে না। তাই আটকায়ও না। ছোট্ট মনটাকে খুশি দিতেও ইচ্ছে করে। চোখে দেখা আমটা না পেলে খুব কষ্ট পাবে -ভেবেই তিথি চুপ থাকে। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে, তুতুল কখন আমটা নিবে হাতে। হঠাৎ তিথি দেখতে পায়, প্রায় ছয়/সাত বছরের ফ্রক পরা বাচ্চা একটা মেয়ে, ময়লা পুরানো ও আধা ছেঁড়া একটা গামছা মাথায় দিয়ে আম কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ফ্রকের সামনের দিকটা বাম হাত দিয়ে উপরে তুলে ধরে রেখেছে। হয়ত ফ্রকের সেই ঝুলিটায় কয়েকটা কুড়ানো আম আছে।
তিথির বুকটা ধক্ করে উঠে। তুতুল যে আমের জন্য নিচে নেমেছে মেয়েটাও ওই আমটার দিকেই এগিয়ে আসছে। মেয়েটার সুক্ষ্ম সন্ধানী চোখ আমটা খুঁজে পাবে-এই আশংকায় ভীত হয়ে উঠে তিথি।
ভয়টা সত্যিই হয়ে উঠে। মেয়েটা আমটা দেখতে পায়।
জানালা থেকে সব কিছুই দেখতে পায় তিথি। কি করবে সে? মা হিসাবে ছেলের কষ্টের জন্য বুকের ভিতরটা চিন্চিন্ করে উঠল। আর কিছু ভাবতে পারল না। জানালা থেকেই ধমক দিয়ে বলে উঠল, -” এ্যাই ওই আমটা নিবি না। আমার ছেলে গেটে আছে, ও নিবে আম।” অপ্রত্যাশিত গভীর কন্ঠের ধমকে মেয়েটি কিংকর্তব্যবিমুখ হয়ে পড়ে। ততক্ষণে মেয়েটি হাতে তুলে নিয়েছে আমটা। লাল, সবুজ আর হলুদে মাখামাখি গাছ-পাকা আমটা। মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা তিথীর দিকে। চোখে-মুখে আতঙ্ক ও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তিথী আবারও ধমক দেয়- “দিয়ে দে আমটা।”
এবার আর দ্বিধা না করে মেয়েটি এগিয়ে যায় গেটের দিকে। তিথীর চোখ থেকে আড়াল হয়ে যায় মেয়েটি। কারণ, বিল্ডিংয়ের কালো কলাপসিবল গেটটা জানালা থেকে দেখা যায় না। আর ঐ গেটেই দাঁড়িয়ে আছে তুতুল। তিথী এবার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় সিঁড়িটায় পা দিতেই ছেলের খুশি ভরা কণ্ঠ শুনতে পায়-“আম্মু, আম্মু! ” ডাকতে ডাকতে অতি দ্রুততায় উপরে উঠে আসে তুতুল। মার হাতে আমটা দিয়েই বলে-” এক্ষুনি আম কেটে দাও, খাব।”
তিথী ছেলেকে সাথে নিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে আমটা ধুয়ে কেটে একটা প্লেটে দেয়। তুতুল প্লেট নিয়ে ঘরে গিয়ে টিভি দেখতে দেখতে আমটা তৃপ্তি করে খায়। তিথী চেয়ে চেয়ে দেখে ছেলের আম খাওয়া। মায়ের মন ভরে উঠে। চোখে খুশির ঝিলিক। কিন্তু বিবেকী মনটা খচখচ করতে থাকে।
মা হিসাবে খুশি হলেও, মানুষ হিসাবে স্বস্তি পায় না তিথী। গরীব, ছোট্ট ঐ বৃষ্টিতে ভেজা মেয়েটির করুণ আর ভীত মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠে।
হাতে পাওয়া আমটাও তিথীর ধমকের জন্য দিয়ে দিতে হয়েছে মেয়েটিকে- একথা ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠছে মন।
তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। অপরাধী মন কিছু না ভেবেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। আর এগিয়ে যায় পাশের বস্তিটার দিকে। তিথী কখনও ওদিকটায় যায় নি।
কিন্তু আজ যাবে। খুঁজবে মেয়েটাকে। অস্থির চোখ দুটো আশেপাশে মেয়েটাকে খুঁজে বেড়ায়। বস্তিতে পৌঁছে চেহারার বর্ণনা দিয়ে এঘর থেকে ওঘর খুঁজতে থাকে অস্থির হয়ে। কিন্তু পায় না!
অনুতাপে ক্লান্ত হয়ে বিষণ্ণ মনে বাসায় ফিরে তিথী। তুতুল তখন আম খাওয়া শেষ করে টিভি দেখছে। ডাইনিং টেবিলে খালি প্লেট। এক মুহূর্তের জন্যও তিথী মেয়েটিকে ভুলতে পারছে না। নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না সে। প্রচণ্ড রাগ হয় নিজের প্রতি। কি করল সে এইটা? কি এমন হতো নিজের ছেলেকে আমটা থেকে বঞ্চিত করলে? কিছুক্ষণ কাঁদত, তারপর ঠিক হয়ে যেত।
কিন্তু মেয়েটার হাত থেকে আমটা ছেলের জন্য কি করে নিল তিথী? বিবেকের এই জ্বালা থেকে তিথী নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। কোনদিন কি মেয়েটাকে আর খুঁজে পাবে না তিথী? ক্ষমা কি চাইতে পারবে না কোনদিন?
তিথী আর কিছু ভাবতে পারে না। চোখ বেয়ে অনুশোচনার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে বলে- “আল্লাহ আমায় ক্ষমা করে দিও
সুন্দর গল্প। কখনও কখনও কোন কাজ অাবেগের বসে করে ফেললেও মানবিকতাবোধ অামদের মনকে অশান্ত করে তোলে।
গল্পের শুরুতে রীশাদ নামক চরিত্রের কথা বলা হয় পরে তা তিথী নামে পাল্টে যায়। চরিত্রের নামের প্রতি খেয়াল রাখবেন।
দৌড় – দৌঁড়
চিন্চিন্- চিনচিন
খুবই ভিন্নধর্মী একটা গল্প। মানুষের অনেক কাজেই ভুল হয়। কিন্তু তার বিবেক থাকার কারণে সে পরে তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়। অনেকে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পায় আবার কেউবা পায় না।
গল্পটা অনেক ভালো লাগলো। লেখার ধরনও অনেক সুন্দর। তেমন কোনো বানান ভুল ছিল না।
ভিন্নধর্মী একটা গল্প। অনেক মানুষই আছে ভুল করে কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় না। আবার কেউবা প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেও তার আর সেই সুযোগ থাকে না। গল্পটার মধ্যে শিক্ষণীয় দিক রয়েছে।
লেখা ধরনও অনেক সুন্দর। তেমন কোনো বানান ভুল ছিল না।
এই গল্পটা একদিকে যেমন তুলে ধরেছে সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা আবার সেই মাই যে সন্তানের জন্য কঠোর হতে পারে তার উদাহরণ এবং সেই সাথে আছে আরও অনেক কঠিন বাস্তব, খুব ভালো