লেখা: মোহসিনা বেগম
,
প্রচণ্ড শীত পড়েছে আজ। চারদিক কুয়াশা যেন চাদর বিছিয়ে রেখেছে। সকাল এগারোটা বেজে গেছে এখনও সূর্যের দেখা নেই। ছুটিতে কয়েকটা দিন গ্রামে থেকে আনন্দ করব কিন্তু প্রচণ্ড শীতে জমে যাচ্ছি। লেপের নীচ থেকে বের হতেই ইচ্ছে করছে না। ওদিকে মা কতক্ষণ ধরে ডেকেই যাচ্ছে। উঠি উঠি করেও শীতের জন্য উঠতে ইচ্ছে করছে না। খাটের পাশ থেকে সোয়েটারটা গায়ে জড়িয়ে অবশেষে বাইরে এলাম। বাইরে এসে দেখি মা পিঠা বানাচ্ছেন, চিতই পিঠা। সাথে ধনেপাতা ভর্তা। দেখেই জিভে জল এসে গেল। কিন্তু চুলার খুব পাশ ঘেঁষে বসা শিরিন এর দিকে নজর যেতেই পিঠার কথা ভুলে গেলাম। আমাকে দেখে কান্না থামালেও, মেয়েটার চোখের কোনে জলের ফোটা এখনও চকচক করছে। মা তাড়া দিলেন,
-নে এখন খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। এত বেলা হলো এখনও কোন কিছু মুখে দেবার নাম নাই।
– যে শীত আম্মু, ক্ষুধা লাগে নাকি আবার?
-তা লাগবে কেন? খাবার তো সবসময় রেডি থাকে। অভাব থাকলে বুঝতে ক্ষুধা কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী? এই যে শিরিনকে দেখছিস , গতকাল দুপুরে খেয়েছে, এখন পর্যন্ত খাবার মত বাসী ভাতও জোটেনি। যা টেবিলের উপরে একটা প্লেটে ঠাণ্ডা ভাত আছে, একটু তরকারি নিয়ে, ওকে এনে দে।
ক্ষুধা যা ছিল, আম্মুর কথায় তা আর রইল না। ভাত এনে ওকে দিলাম। শিরিন খাওয়া শুরু করলো, হাত ধোয়ার তরটুকু সইলো না অথবা প্রয়োজন মনে করল না। এক নিমিষেই ভাতটুকু শেষ করে উঠে গিয়ে কল থেকে পানি খেয়ে আসলো। এসে আম্মুকে বলল, আমাকে খাবার দিতে। সত্যি বলতে, শিরিনকে দেখেই আমি খাবার কথা ভুলে গেছি। এই প্রচণ্ড শীতেও একটা ছেড়া কাপড় পরে আছে। শিরিনদের অবস্থা ভালোই, কিন্তু ওর মা মারা যাবার পর বাবা বিয়ে করলে আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলেও শিরিনের ভাগ্যের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। নিজের পেটের সন্তান বোবা কালা যাই হোক মা আদর যত্ন না করে পারে না। কিন্তু সৎ মায়ের কাছে প্রতিবন্ধী সন্তান মানেই একটা অভিশাপ। সারাদিন কাজ করে শিরিনের ভাগ্যে জুটতো একটু পান্তা ভাত আর বাসী তরকারী। বিয়ের বয়স হলে নানা জনে নানা কথা বলতে লাগল কিন্তু যে সমাজে ভালো মেয়ের পাত্র জোটাতে কষ্ট সেখানে বোবা মেয়ের জন্য বিশহাজার টাকা গুনতে হলো শিরিনের বাবাকে। তাও শিরিনের কপালে জুটল এক মাতাল স্বামী যে নাকি কারণে অকারণে মারধর করে। শ্বশুরবাড়িও বেশি দূরে না। টাকার লোভে শিরিনকে বিয়ে করে, রাতদিন ওকে দিয়ে সংসারের সব কাজ করাতো। গত ছয় মাস আমি গ্রামে আসি না বলতে গেলে। তাই শিরিনের বর্তমান কোন খবরই আমি জানতাম না। এর আগে ওকে যখন দেখেছিলাম তখন স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালোই ছিল। সৎ মা খারাপ হলেও শ্বাশুড়ি আর স্বামীর মতো এতটা পাষণ্ড ছিল না। তাই কম কিংবা বাসী হলেও নিয়মিত খেতে পারত । কিন্তু আজ দেখলাম শুকিয়ে একদম কঙ্কালসার। শিরিন আম্মুর কাছে কেঁদে কেঁদে কী যেন বলল অনেকক্ষণ ধরে তারপর চলে গেল। বোবা মানুষের ভাষা আমি বুঝি না। শুধু চোখের জল আর হাসির অনুভূতিটুকু বুঝতে পারি। শিরিন চলে যেতেই আম্মু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, নে খা, ঠাণ্ডা হলে খেতে ভালো লাগবে না।
আমি ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করলাম। আম্মু বলতে লাগল, ‘ মেয়েটা বোধহয় বেশিদিন বাঁচবে না, এত অত্যাচার আর কতদিন সহ্য করা যায়। প্রতিদিন রাতেই মদ খেয়ে এসে মেয়েটাকে মেরে আধমরা করে দেয় মাতাল স্বামী, তারপর দু’বেলা ভাতও খেতে দেয় না। দুপুরে একবেলা শুধু খেতে দেয়। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কীভাবে?’
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটু খেয়েই রুমে চলে এলাম। গ্রামের মধ্যে আমার বাবার আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো না হলেও, শিক্ষার দিক দিয়ে আমরাই সবচেয়ে এগিয়ে। আমার দুই ভাই ভালো কলেজে পড়ছে, আমিও ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি। ভার্সিটিতে মেয়েদের নিত্য নতুন পোষাক দেখে মাঝেমাঝে আক্ষেপ হতো। মনে হতো মধ্যবিত্ত হলেই বুঝি জীবনে সুখ থাকে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, খুব সুখী আমি, খুব সুখেই আছি। গ্রামের দরিদ্র আর নিপীড়িত মানুষের কষ্ট আসলে শহরের বিলাসবহুল স্থানে বসে অনুভব করা যায় না। অভিজাত এলাকায় ঘুরলে মনে হয় পৃথিবীটাই বুঝি উন্নত হয়ে গেছে। শিরিন জন্মের পর থেকেই নিপীড়িত , ওকে একটু সাপোর্ট দেয়া দরকার আমাদের । আম্মু চেয়েছিল শিরিনকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখতে কিন্তু ওর বাবা রাজি হয়নি। কিছু কিছু বাবারা জন্মসূত্রেই বাবা হয়। সন্তানের প্রতি তাদের যে একটা দায়িত্ব আছে সেটা তারা জানেই না। নিজেও মেয়েটার কষ্ট বুঝবে না আর কেউ যেচে সহযোগিতা করতে চাইলেও, না করে দেবে। আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। ঢাকাতে আমার পরিচিত একটা প্রতিবন্ধী আশ্রয়কেন্দ্র আছে সেখানে ওকে দিয়ে আসব।
,
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরী হয়ে গেল। উঠে গিয়ে দেখি আম্মু বারান্দায় বসে আছে, মন খারাপ করে। ‘কী হয়েছে আম্মু?’
আম্মু চুপ করেই আছে। আমি আবার বললাম, ‘কথা বলো আম্মু, কী হয়েছে তোমার? ‘
‘শিরিন আর নাই রে…’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘কী হয়েছে ওর? ‘
‘কাল রাতে ওর স্বামী আর শ্বাশুড়ি মিলে মারতে মারতে ওকে মেরে ফেলেছে। ওর বাবার থেকে দশহাজার টাকা চেয়েছিল, তা দেয়নি বলে’।
‘পুলিশকে খবর দিয়েছিল? ‘
‘পুলিশ এসেছিল, দশহাজার টাকা নিয়ে চলে গেছে’
‘শিরিনকে যে মারল, তার বিচার হবে না? ‘
‘আর বিচার! এরকম কত ঘটনা ঘটে, কোনটারই তো বিচার হয় না । মামলা করলে যে করে সেই হয়রানি হয়’
‘তাই বলে ওর বাবা এভাবে ছেড়ে দেবে? ‘
‘আপদ গেছে তার, অপয়া মেয়েটা মরেছে। মেয়েটা জন্মের পর কোনদিন একবিন্দু সুখও পেল না। ওদের মতো মেয়েদের জন্মই হয় কষ্ট পাবার জন্য।’
আসলেই তো , শিরিনদের জন্মই হয় কষ্ট পাবার জন্য!
পূনর্জন্ম
জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...
০ Comments