সমুদ্র কে আমি ভালোবাসতাম। না,কথাটা বোধহয় ঠিক হয় নি।কেননা সমুদ্র কে আমি এখনো ভালোবাসি এবং আজীবন ভালোবেসে যাবো। একজন মানুষ কে এত বেশি ভালোবাসা যায় তা আমি কোনোদিন কল্পনা করতে পারিনি। পরিচয় টা বান্ধবীর মাধ্যমে। একদিন ক্লাশ শেষে ডিপার্ট্মেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় প্রথম সমুদ্র কে দেখি সাদা পাঞ্জাবী পড়ে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে একটা মেয়ে হেমন্তের সাজে সেজে আছে। অপূর্ব লাগছে সমুদ্র কে। আমি অবাক তাকিয়ে ছিলাম। কি যেন স্নিগ্ধতা লেগে আছে ওর চোখের সচ্ছলতায়। অথচ পাশে থাকা মেয়েটিকে তার সাথে একেবারে মানাচ্ছে না। বান্ধবি অরিন কে বিষয় টা সাথে সাথেই বললাম। ও মুচকি হেসে ঠাট্টায় মেতে উঠলো। অবাক করে দিয়ে অরিন সমুদ্র কে ডাক দিল। আমি ওকে নিষেধ করতে গিয়েও থামাতে পারলাম না। সমুদ্র সামনে এসে দাড়ালো। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। অরিন হেসে হেসে সমুদ্রের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। আমি জানতাম না সে (সমুদ্র) অরিনের ভাই আর আমাদের ক্যাম্পাসেই পড়াশোনা করে।
এর কিছুদিন পর সমুদ্রের এফ. বি আইডি থেকে অরিন আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠায়। আমি খুশি হয়ে ঝটপট তা গ্রহণ করি। ওহ,আমি তো আমার পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি! আমি অনিতা। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। সাহিত্যের প্রতি ভালোলাগা খুব ছোট থেকেই। টুকটাক কবিতা লিখি। সেগুলো বিভিন্ন ম্যাগাজিনে জমা দেই। আমার এফ.বি তে পোস্ট করা একটা কবিতার মন্তব্য জানাতে ইনবক্স করে সমুদ্র। সেখান থেকেই কথোপথনের শুরু। বান্ধবীর বড় ভাই হিসেবে তিনি আমার শ্রদ্ধেয় মানুষ। তাই ভালো লাগা টুকু গোপন করে একসাথে পথচলা চলতে থাকে। কবিতার প্রতি তিনি বেশ আগ্রহী। নিজেও লিখেন ভালো। এরপর বিভিন্ন ম্যাগাজিনে একসাথে গল্প জমা দিতাম। একে অন্যের কবিতার প্রথম পাঠক ছিলাম।
দু’জন দুজন কে আপনি সম্বোধনেই ডাকতাম। আমি ভাইয়া বলে ডাকতাম।সে মাঝে মাঝে তুমি করে ডাকতো। কবির সেই ‘তুমি’ শব্দটি কোনো কবিতা ছিল না। তবুও শব্দ টি উচ্চারিত হওয়ার পর নিজেকে অদ্ভুত ভাবে অনুভব করতাম, কত সহজেই নিজেকে সুখী ভাবা যায়!
সমুদ্রের সাথে কথা বলার ইচ্ছে, দেখা করার তীব্রতা, কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা সব ছিল; আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি কখনো ভালোবাসা ও প্রেম কে এক করে দেখি না। আর তাই সমুদ্র কে ভালোবাসলেও তার সাথে প্রচলিত প্রেম করতে আমি আগ্রহী না। আমাদের ভালোবাসা হবে অনন্য উদাহরণ। আমি চাইতাম সেও আমাকে ভালোবাসুক প্রচলিত প্রেমের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে, তারপর। কিন্তু সমুদ্র! সে কী চাইতো? সে যদি আমাকে ভালোবাসতোই, তবে কি এভাবে সস্তা প্রেমিক হওয়ার লোভে চলে যেত? এ প্রশ্ন গুলোর উত্তর সত্যিই আমি জানি না।
সময় বেশ ভালো কাটছিলো। একদিন এক কবিতা প্রদর্শনীর অনুষ্ঠানে দায়িত্ব নিয়ে দু’জনে কাজ করছি। সমুদ্রের সেই সাদা পাঞ্জাবী আর আমি সাদা-নীল শাড়ি পড়ে আছি। আমার কানের পাশে এসে ‘ ‘তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে” বলেই সে চলে গেল। শব্দটি কানে সুরতালে খুশির প্রতিধধনি বাজাতে লাগলো। অনুষ্ঠান শেষে আমি বিদায় নিতে গেলে সে যেতে নিষেধ করে বলে ‘ কথা আছে,একটু অপেক্ষা করো’। আবার সেই “তুমি” শব্দের সম্মোহিত ভাবনায় আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। অনুষ্ঠান শেষে প্রায় সবাই যখন চলে গেছে, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। আকাশে তারকার মুচকি হাসি আর চাঁদের লজ্জ্বা অবনত চাহনিতে আমি বেশ লজ্জা পাচ্ছি। সমুদ্র সহজভাবে কথা বলতে শুরু করলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো
– তোমার আঙুল আছে?
-হুম আছে তো। আমার সলজ্জ জবাব।
-গরম চায়ের কাপে ডুবাতে পারবে?
আমার চোখটা কেঁপে উঠলো। আমি বুঝতে পারছি সে কী বুঝাতে চাচ্ছে। এরপর সে কী বলবে তাও জানি। কিন্তু সে জানে না যে আমিও তাকে ভালোবাসি। তবে এত অল্পদিনে প্রেমে জড়াতে চাই না। আরো কিছুদিন তাকে সময় দিতে চাই যেন আমার প্রতি তার ভালোবাসা গভীর হয়। ভালোবাসার এই অপূর্ব অনুভূতি থাকুক আরো কিছুকাল,কিছুসময়।তারপর না হয় ভাবা যাবে।তাই সেদিন বিষয় টি হালকাভাবে এড়িয়ে আমি বিদায় নিলাম।
সমুদ্র কে আমি সত্যিই ভালোবাসি। আধুনিক সম্পর্ক গুলোর নিয়মাবলী আমার ভালো লাগে না। তাই আমি চাই সমুদ্রও আমাকে গভীরভাবে ভালোবাসুক,আমার কবিতার সবটা জুড়ে যেমন সে আছে,তেমনি তার কবিতা জুড়ে আমি থাকবো। প্রেম না করার দূরত্ব বজায় থাকুক আমাদের ভালোবাসায়। এসব চিন্তা করেই “আয়না বাজি” সিনেমাটি একসাথে সিনেমাহলে বসে দেখার জন্য সমুদ্র একদিন অনুরোধ করলেও আমি তাতে রাজি হয়নি।
সাহিত্যের আমার আমি আর বাস্তবের আমার আমি এক না। বাস্তবে আমি খুব চঞ্চল। মানুষ কে বিব্রতকর পরিস্তিতিতে ফেলতে আমার বেশ ভালো লাগে। সমুদ্র কে কয়েকবার অনেকের সামনে বিব্রত করেছি। কয়েকবার আমার সাথে একা দেখা করতে এসে দেখেছে, কখনো আমি অনেক মানুষ নিয়ে একসাথে বসে আছি আবার কখনো বা অরিন আমার সাথে আছে। আমি বুঝতে পারিনি সমুদ্র এতে করে আরো দূরে সরে যাবে। আমি কিছুটা দূরত্ব চেয়েছিলাম কিন্তু এতটা দুরত্বে কখন সে সরে গেছে তা আমি বুঝতে পারিনি। সে বার বার আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে এসেছে,আর আমি? অবোধ বালিকার মতো সব হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। রাতের একাকীত্বের সময়ে আমি বুঝতাম কোনো এক দ্বিধা আমায় আটকে রাখে। সমুদ্র কে ভালোবাসার পরও বলতে পারিনা ‘ভালোবাসি তোমাকে”।
প্রতি সপ্তাহেই ‘সাহিত্য অনুষ্ঠানে যাওয়া হতো। দুজনের কেউ সহজে মিস করতাম না। একদিন প্রোগ্রামে গিয়ে দেখি সমুদ্র আসেনি। বাহিরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলে ‘ সমুদ্র ভাইয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি”। মেয়েটি দেখতে আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। এমন সুন্দর মেয়ে পাওয়া যে কোনো ছেলের জন্য ভাগ্যের বিষয়। মেয়েটি দু’ঘন্টার অধিক সময় অপেক্ষা করে ফিরে গেছে। সেদিন প্রথম সমুদ্র কে হারানোর ভয় মনে আসলো।
মেয়েটির নাম লিয়ানা। তীব্র আশংকা আমার চোখ গিলে খাচ্ছে। পরের ২ সপ্তাহ আমি অনুষ্ঠানে যায়নি। বাড়িতে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম একটু রূপচর্চার মধ্য দিয়ে। ৩য় সপ্তাহে গিয়ে বুঝতে পারলাম অগোছালো আমি যতই গুছিয়ে আসিনা কেন,লিয়ানার সৌন্দর্যের কাছে তা একেবারে ম্রিয়মাণ। তারা দু’জন পাশাপাশি বসে আছে। কিছু সময় পর বুঝতে পারলাম তারা এক নব সম্পর্কের সূচনায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার চোখ দ্বিতীয় বারের মতো কেপে উঠলো। বাড়ি ফিরে এফ.বি তে তাকে জানালাম – ‘সুন্দর মানিয়েছে’। আমাকে সহজ সাবলীল ভাবে বললো-‘ যা ভাবছো তা কিন্তু না। খুব দ্রুত তোমার ভুল ভেঙে যাবে।“ সেদিন বোধহয় আমার চেয়ে বেশি সুখী পৃথিবীর কেউ ছিলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম এরপর সমুদ্র ভালোবাসি বলতে এলে আর ফিরিয়ে দিবো না। প্রচলিত প্রেম হলে হোক তবুও তাকে হারাতে চাই না।
ঘটনাটির পর সমুদ্রের প্রতি ভালোবাসা আরো অনেক বেড়ে গেছে । পরবর্তী অনুষ্ঠানে ভয় জাগা অনুভূতি নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। সে কিছু না বললেও আমি এবার তাকে কিছু বলতে চাই। সেদিনও গিয়ে দেখি লিয়ানা তার পাশে বসে আছে। সমুদ্র আশ্বস্থ করার পর বিষয়টি নিয়ে আর সন্দেহ জাগছে না। এখন তাকে আমার মনের কথা বলতে পারলেই হলো। কিন্তু তাদের দু’জন কে একসাথে যত দেখছি ততোবেশি যেন আমার চারপাশ কষ্টে লেপ্টে যাচ্ছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রের চেষ্টা করে অনুষ্ঠানে মনোযোগ দেই। আজকের একটা বিশেষত্ব আছে। সমুদ্রের লেখা “ভালবাসো যদি’-শিরোনামের গানটি একজন শিল্পী গেয়ে শোনাবে। গান শেষ হল কবির ভালোবাসার আমন্ত্রন দিয়ে, তারপর অনুষ্ঠান শেষ হলো। একপাশে লিয়ানা আর সমুদ্র দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আমি দূর থেকে তাদের দেখছি। একজন আমার পাশে এসে বসলো। তিনি জানালেন ওদের দু’জনের নতুন প্রণয়ের কথা। সৌন্দর্য পিপাসু সবাই। ক্রিয়েটিভ ব্যক্তিরা এ দিক থেকে এগিয়ে। তাই সমুদ্রের কোনো দোষ নেই। সব অপরাধ একান্ত প্রকৃতির। সমুদ্র লিয়ানার সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে সমর্পণ করেছে।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো।আমি ভেবে নিয়েছিলাম আর লিখতে হবে না। আজ অনেক দিন পর আবার লিখছি। কারণ সমুদ্র আমার কাছে ফিরে আসতে চাচ্ছে। আমি কি তাকে তার উপযুক্ত জবাব দিবো? নাকি সব ভুলে তাকে গ্রহণ করবো? আমি বুঝতে পারছি না।
সমুদ্র চলে গেছে আজ চার মাস তের দিন । সময়ের হিসেবে খুব বেশি দিন না হলেও মনে হচ্ছে যেন আমার জীবন থেকে কয়েক শ বছর চলে গেছে। আমি বদলে গেছি অনেকটা। বলতে গেলে সম্পূর্ণভাবেই বদলে গেছি।এরপর আর কখনো কোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানে যায়নি।
সমুদ্র চলে যাওয়ার পর একদিন কবিতার ডায়েরী থেকে তাকে নিয়ে লেখা সব কবিতা গুলো ছিঁড়তে লাগলাম। তারপর অবাক হয়ে দেখি আমার ডায়েরীতে আর কোনো পাতা নেই। শুধু কভার টা বিমর্ষ ভাবে পড়ে আছে। এরপর আর কোনদিন কবিতা লিখিনি বা লিখতে পারিনি। আমার অক্ষর রেখা কখন জানিনা,সংকীর্ণ হয়ে গেছে সমুদ্রের বৃত্তে। তাই আজ আমি ভিন্ন কেউ। তাকে আজ ভুলে গেছি। আমার কালো রূপের প্রতি আমার অদ্ভুত ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। সৌন্দর্য কে ঘৃণা করি। একা বাঁচতে জানি।
এমন সময় সমুদ্র ফিরে এলো যখন আমি আর আগের কেউ না,ভিন্ন অনিতা। আগের অনিতা তো মরে গেছে। ভেতরে যদি মৃত আত্মা থাকে তাহলে কি কাউকে ভালোবাসা যায়? যায় না। সমুদ্র আজ ফিরতে চাইছে কার কাছে তবে? অনিতা তো আর কবিতা লিখে না,অন্ধকারে একা একা বাঁচে।
লিয়ানার সাথে সমুদ্রের সম্পর্ক টা টিকেনি কারণ লিয়ানা সাহিত্য ভালোবাসে না,সে কবি সমুদ্র কে পছন্দ করে না। অথচ শুধু সমুদ্র কে ভালোবাসে।কয়েকদিন সমুদ্রের কবিতার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। ভেবেছিল কিছুদিন পর সমুদ্র কে এ পথ থেকে সরিয়ে আনবে। তাই একদিন সমুদ্রের সামনে ঝুলিয়ে দেয় দুটি অপশন। হয় কবিতা,ন হয় লিয়ানা- বেছে নিতে হবে একজন কে। সমুদ্র কবিতা কে পাথেয় করে ফিরে আসে অনিতার কাছে।
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি”- বলেই সমুদ্র অনিতার ঠোঁটের দিকে তাকালো। অনিতা চুপ করে আছে। সমুদ্র দ্বিতীয়বারের মতো ভালোবাসি বলে ফের ঠোঁটের দিকে তাকালো। এবার ঠোঁট হালকা কেঁপে উঠে কিন্তু কোনো শব্দ উচ্চারিত হয় না।অপেক্ষা শেষে প্রেম টুকু সাথে নিয়েই সমুদ্র ফিরে গেল আপন গতিতে। হয়তো একদিন সে বড় কবি হবে। সমুদ্র যদি অনিতার ঠোঁটে না তাকিয়ে চোখের দিকে তাকাতে পারতো,তবেই শুধু গল্পের শেষাংশ ভিন্ন হতো। অনিতা জানে, ‘চোখ কে যারা উপেক্ষা করে তারা কখনো ভালোবাসতে পারে না”।
আমি না হয় লিখে নিব ,আরেক টা ফিরিয়ে দেওয়ার কাব্য, আর আবার ভুলে যাবো তাকে। এই যুগল পৃথিবীর বুকে, যে একবার ভুলতে শিখেছে, সে বার বার ভুলতে জানে।।
——-(গল্প লেখকঃ নূর-এ-জাহান বিলকিছ)
—————————————-০——————————————–
‘অনিতার ডায়রী থেকে’ গল্পের ভাষাশৈলী অবাক করেছে। প্রতিটি শব্দ বুনট কবিতা হয়ে গল্পের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।মনে হচ্ছে মুগ্ধ হয়ে গল্পটা গিলে ফেললাম।