মাথার ভিতর আবার সেই যন্ত্রণাটা শুরু হলো। খুবই অসহ্য রকমের যন্ত্রণা। প্রথমে মাথার বা পাশ থেকে ব্যাথাটা শুরু হয়। তারপর আস্তে আস্তে ব্যাথাটা ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসে। তবে ব্যাথাটার একটা ভালো দিক আছে। ব্যাথাটা নিয়মিত হয় না। দু’তিন দিন পরপর শুরু হয়। প্রথম যখন রোগটা ধরা পরে তখন ডাক্তারাও খানিকটা অবাক হলেন। কারন এমন রোগ আগে কখনো দেখেন নি। অনেক পরিক্ষা-নিরিক্ষা করার পর বললেন এ5ঊখানে এ রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না। তারপর তারা এ রোগের চিকিৎসার জন্য আমেরিকা ট্রান্সফার করলেন। সেখানে বহুদিন পরিক্ষা-নিরিক্ষার পর ধরা পরলো রোগীর স্নায়ু ক্যানসার। যার চিকিৎসা পৃথিবীতে অনেকটাই দূর্লভ।
জনাব আজগর সাহেব চোখ দুটি বন্ধ করে হেলান দিয়ে তার ইজি চেয়ারটায় বসে আছেন। ব্যাথা উঠলে তিনি চুপচাপ এই চেয়ারটায় বসে থাকেন। তখন তাকে কেউ ডিস্টার্ব করে না। অবশ্য ডিস্টার্ব করার মত কেউ নেই বাড়িতে। ৪-৫ জন চাকর-বাকর বাদে আর কেউ থাকে না। আজ ২ দিন হলো তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন। তেমন কোনো রোগ ছিলো না মতিয়া বেগমের। সুস্থ-সবল স্বাভাবিক মানুষ। হঠাৎ একটা স্ট্রোকে মতিয়া বেগম নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি মারা গেলেন। মতিয়া বেগমের এভাবে চলে যাওয়া আজগর সাহেবকে আরো একা করে দিলেন। এখন শোকের ছায়া বিরাজ করছে এই বাড়িটিতে।
সাহেব, ‘উকিলবাবু এসেছেন।’
আজগর সাহেব হাতের ইশারায় তাকে ভিতরে আসতে বললেন। নিয়ামত হোসেন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকে একটি চেয়ারে বসে পরলেন। আজগর সাহেব চোখ বন্ধ অবস্থায়ই উকিলকে জিজ্ঞাসা করলেন,’কি অবস্থা উকিল? এবার জামিন হবে?’
‘আল্লাহ রহমতে হয়ে যাবে স্যার।’
‘সেটা ত অনেক আগে থেকেই বলে আসছো,কিন্তু জামিন ত হচ্ছে না। ‘
‘মার্ডার কেস ত স্যার,একটু সময় লাগবে। আগের বার হাতে তেমন এভিডেন্স ছিলো না। তবে এবার জোগার করেছি। অনেকগুলো মিথ্যা সাক্ষীর ব্যবস্থা করেছি। এবার হয়ে যাবে স্যার।’
‘হুম, তবে এবার আমি আমার ছেলের জামিন দেখতে চাই। তার জন্য যত টাকা খরচ করতে হয় করো।’
‘ইনশাআল্লাহ, এবার জামিন হয়ে যাবে স্যার।’
‘হুম। এখন যাও। আমি রেষ্ট নিবো। আর হ্যাঁ, সম্পত্তির উইলগুলো রেডি করেছেন?’
‘জ্বি, স্যার করেছি । দেখবেন ?’
‘নাহ, আজ দেখবো না। মাথায় আবার সেই ব্যাথাটা শুরু হয়েছে। আপনি এখন যান।’
নিয়ামত হোসেন অতি ভদ্রতার সহীত রুম থেকে বের হয়ে আসলেন।
আজ পত্রিকায় বড় করে হেডলাইন এসেছে ‘ টাকার কাছে কী আইন নত হবে!’আজগর সাহেব পত্রিকাটি হাতে নিয়ে হেডলাইনটি পড়লেন। তারপর আস্তে করে পত্রিকাটি টেবিলের উপর রেখে দিলেন।
‘করিম।’
‘জ্বি, সাহেব।’
‘নিয়ামত বাবু কি এসেছেন?’
‘জ্বি সাহেব। উনি অনেকক্ষণ ধরেই নিচে বসে আছেন। আপনি ঘুমুচ্ছিলেন তাই আর আপনাকে ডাক দেই নি।’
‘ঠিক আছে, তুমি যাও।’
আজ সকাল ৯টায় কোর্টের টাইম। আজই তাঁর ছেলের চূড়ান্ত রায় হবে। আজগর সাহেব রেডি হওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
ঘড়িতে সকাল ৯টা। কোর্টের ভিতর অসংখ্য মানুষের ভিড়। সবার ভিতরই এক ধরণের চাপা কৌতুহল কাজ করছে। কী হবে আজ! কী রায় আসবে! আজগর সাহেব উকিলের পিছনের চেয়ারটায়ই বসে আছেন। জজ ঢুকার সাথে সাথেই সবাই উঠে দাড়ালো। তারপর আস্তে আস্তে কোর্টের কার্যক্রম শুরু হলো। নিয়ামত সাহেব একের পর এক তাঁর মিথ্যা সাক্ষী পেশ করে যাচ্ছেন। মিথ্যাকে সত্য করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সরকারি পক্ষের উকিলও তার বিভিন্ন এভিডেন্স পেশ করে যাচ্ছে। নানা এভিডেন্স, নানা সাক্ষী বিচার-বিশ্লেষণ করার পর জজ আসামীকে দোষী সাব্বস্ত করে তাকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলো। আজগর সাহেব একদম চুপ হয়ে পড়লেন। নিয়ামত হোসেন তার ব্যর্থতার গ্লানী মুছার জন্য মুখখানি নিচু করে ফেললেন।
কোর্টের বাহিরে হাজারো লোকের ভিড়। অসংখ্য মানুষ ভিড় জমিয়েছে সেখানে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে রিপোর্টাররা
এসেছে। তারা অনবরত রিপোর্ট করে যাচ্ছে। আজগর সাহেব এবং তার উকিল কোর্ট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই রিপোর্টাররা তাদের ঘিরে ফেললো। নানান ধরনের প্রশ্ন করে যাচ্ছে তারা। নিয়ামত হোসেন রিপোর্টারদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার মক্কেল নির্দোষ। তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা হাই কোর্টে তার জন্য আপিল করবো।’ চারদিক থেকে বিক্ষুদ্ধ জনতার বিভিন্ন কথা তাদের কানে ভেসে আসতে লাগলো। কেউ কেউ বলছে,’সত্যের জয় হয়েছে।’ আবার কেউ কেউ বলছে,’টাকার কাছে আজ আইন নত হয় নি।’ আজগর সাহেব সমস্ত ভিড় উপেক্ষা করে তার নিজের দামী গাড়িটায় উঠে পড়লেন।
আজগর সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। আজ জীবন তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাঁর সেই পুরুনো স্মৃতিগুলো হঠাৎ মনে হতে লাগলো। কিভাবে তিনি বড় হয়েছেন! কিভাবে অসহায় মানুষের লাখ লাখ টাকা আত্মসাদ করে তাদের পথে বসিয়েছেন। আজগর সাহেব যে আজ বড়ই একা। এই পৃথিবীতে আপন বলতে তাঁর আর কেউই রইলো না। শেষ সম্বল ছেলেটাকেও তিনি হারালেন। তিনি সময়কে ব্যবহার করিছিলেন তাঁর নিজের প্রয়োজনে আজ সময় তার পূর্ণ প্রতিশোধ নিলো।
০ Comments