Samayra Shikha
কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই বের হয়েছি। আজ রিক্সায় যেতে ইচ্ছে করছে না। আবহাওয়াটা বেশ
ভালো লাগছিল। অনুভব করছিলাম হালকা ভাবে আমাকে স্পর্শ করে যাওয়া বাতাসটাকে। ভালোই
লাগছিলো একা একা হাটতে। রাস্তায় লোকজনও স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা কম ছিলো। হয়তো আমি
আজ একা আসবো বলেই তারা আমার জন্য রাস্তাটা খালি রেখেছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি আর চোখে রাজকুমারী একটা ভাব নিয়েই হাঁটছিলাম। এমন সময়-ই মনে হলো যেন কেউ আমার হাতের আঙুল-টা ধরে মৃদু সুরে আমাকে ডাকছে “আন্টি,আন্টি”।
আমি স্বপ্নের জগৎ থেকে ২ সেকেন্ডের মধ্যেই বের হয়ে নিচের দিকে তাকালাম। তাকাতেই
দেখলাম একটা পুঁচকে মেয়ে আমার আঙুলটা ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
বাহ! কি নিষ্পাপ চাহনি!
আমি আর সময় না নিয়ে ওর ডাকে সাড়া দিয়ে বললাম, “কি হয়েছে আম্মু?”
তুমি আমাকে ওইইখানে পৌঁছে দিবা? হাত দিয়ে রাস্তার ওপাড়টা দেখিয়ে দিচ্ছে।
আমি বললাম, “তুমি কি একা এসেছো? তোমার সাথে কেউ নেই?”
নাহ,আমি একাই যাচ্ছি।
যাচ্ছি! কোথায় যাচ্ছো?
ওই যে আজ হাসপাতাল থেকে আমাকে একটা ছোট ভাই দিবে। তাই আব্বু আম্মু সেখানে গেছে আর আমাকে বাসায় সুফি আন্টির সাথে রেখে গেছে। সুফি আন্টি তার বাসায় গেছে তার ছেলেকে আনতে। এই সুযোগে আমি বুদ্ধি করে বের হয়ে গেছি।
ও মা! কত্ত বুদ্ধি তোমার! কিন্তু তোমার হাতে ওটা কি?
মিষ্টি। আজ আমার নতুন ভাইয়া আসবে তো তাই। আম্মু বলে যে বাড়িতে নতুন কেউ এলে মিষ্টি মুখ করাতে হয়। আমার ভাইয়া ত আজ নতুন আসবে তাই ওর জন্য নিয়ে যাচ্ছি।
ওওও।
এই পঁচা আন্টি, তুমি কি আমাকে ওখানে দিয়ে আসবা?
হ্যাঁ,চলো। ওর হাতটা ধরেই পার করে দিলাম রাস্তাটা। এর পর ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা তুমি কি হাসপাতাল টা চিনো?”
হুম,আম্মু যখন আগে একবার গিয়েছিলো তখন আমি আম্মুর সাথে ছিলাম।
ও। তা সেটা কোথায়?
ওইযে সামনের দুতলা বিল্ডিং এর পিছনের একটা বড় বিল্ডিং এর একটু দূরে ওই যে ১,২,৩,৪,৫ হ্যাঁ,৫ তলা বিল্ডিং এর দুতলায়।
ওলে বাবা! এত্ত দূর! তা আমি তোমার সাথে আসি একটু? তোমার ভাইকে মিষ্টি মুখ করাতে?
কেনো জানি পুঁচকেটার উপর মায়া লেগে গেলো। আর এতটা রাস্তা একা যাবে যদি কোনো বিপদ হয়! যদি কোনো বাজে লোকের হাতে পড়ে যায়! তাই ভাবলাম ওকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েই কলেজে চলে যাবো। এখন শুধু মহারানীর অনুমতি লাগবে।
অনেক ভেবে ওনি উত্তর দিলো “উমমম,চলো তাহলে”।
যাক,অনুমতি পাওয়া গেলো। আচ্ছা ওর নামটাই তো জানা হলো না! আচ্ছা আম্মু তোমার নাম কি?
আরফা আক্তার তাইফা তামান্না তুলি।
এত্ত ছোট নাম তোমার!।
দেখোনা আমার এই নামটা ধরে ও আম্মু ডাকতে পারে না। তাই শুধু তুলি বলে ডাকে।
আমিও কি তোমাকে শুধু তুলি বলে ডাকতে পারি?
তুমিও পারো না! তোমরা কত বড় তাও আমার নাম টা বলতে পারো না! আচ্ছা,পারোই না যখন তাহলে তুলি বলেই ডেকো।
ওর কথায় মনে হলো যে কত বড় ত্যাগ টা করতে হলো তার। যাই হোক, একটা অনুমতি তো পেলাম। একটা ধন্যবাদ তো দিতেই হয়!
থ্যাংক ইউ তুলি।
ওয়েলকাম।
বাব্বাহ! তুমি ইংরেজি ও বলতে পারো?
মুঁচকি হেসে বললো “আমার আম্মু শিখিয়েছে”।
মনে হয় হাসপাতালে এসে গেছি। তুলি,দেখো তো এই হাসপাতাল টা?
হুম, এটাই তো। তুমি কি করে চিনো? তোমার আম্মুও কি এখান থেকে তোমার ভাই নিয়ে গেয়েছিলো?
নাহ। আমার আম্মু এখান থেকে আমাকে নিয়ে গেয়েছিলো।
সত্যি!!
আমার উত্তর না দিতেই তুলি আমার হাতটা ছেড়ে এক দৌঁড়ে চলে যায় একটা ৩২-৩৪ বছরের লোকের কাছে। গিয়েই লোকটার হাতের দুটো আঙুল দুই হাত দিয়ে ধরে নাড়ছে আর বলছে “আব্বু,আব্বু” কিন্তু লোকটা কিছু বলছে না কেন! এতটুকু একটা ছোট মেয়ে একা একা বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে অথচ তার বাবার কোনো রিএকশন নেই!
কেন?
আর লোকটা এভাবে দেয়ালে মুখটা লুকিয়ে রেখেছে কেন? অনেকগুলি প্রশ্ন ভীড় করছে মনের ভেতর। দেখলাম পেছন থেকে একটা মধ্যবয়সী মহিলা এগিয়ে এসে তুলির হাতটা ধরে তার কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুলি এখানে কিভাবে এসেছে?”
তুলি খুব খুশি হয়ে বললো “বড় ফুঁপি, আমি না একাই আসছিলাম, তারপর এই আন্টি টা আমাকে রাস্তা
পার করে দিয়ে বললো আমার সাথে নাকি আমার ভাইকে দেখতে আসবে। তাই নিয়ে এসেছি।
আচ্ছা বড় ফুঁপি, আমার আম্মু কোথায়? আর ভাইয়াকে কি দিয়ে দিয়েছে? কোথায় ভাইয়া?
ওর ফুঁপি বললো “তোমার ছোট ফুঁপির কোলে তোমার ভাইয়া”।
আনন্দে তুলির মুখটা লাল হয়ে গেছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে দৌঁড় দিয়ে এলো কাছে। এসেই আমার হাতের বুঁড়ো আঙুল টা ধরে টেনে নিয়ে যায় ছোট ফুঁপির কাছে ওর ভাইকে দেখতে। আমি গেলাম তুলির নবাগত ভাইকে দেখলাম। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে সে। বাবুটাকে দেখে মনে হলো একেই হয়তো বলে পবিত্রতা।
তুলি তো ওর ভাইকে পেয়ে খুব খুশি। রাস্তা দিয়ে আসার সময় ওর কথায়-ই ওর আনন্দটা অনুমান করতে পারছিলাম।হঠাৎ করেই দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটায় নজর পড়তেই আমার মাথায় খুব বড়-সড় একটা বাজ পড়লো।
১০ টা ২২!!! আমার ক্লাস ১০ টায় শুরু হওয়ার কথা। তাড়াতাড়ি করে তুলিকে বিদায় দিয়ে মাত্র দুপা এগুতেই কানে এলো তুলি তার ফুঁপিকে জিজ্ঞেস করছে “আম্মু কোথায়?”
আমার পা আর এগোলো না। আমি আবার ঘুরে দাঁড়ালাম তুলির প্রশ্নের উত্তরটা শুনার জন্য। উত্তরের আশায় ওর ফুঁপির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখটা ভিজে যাচ্ছে। এবার যেন চোখের সীমানা অতিক্রম করে বেড়িয়ে এলো কয়েক ফোঁটা জল। আমি এই চোখের জলের অর্থটা বুঝতে পারলাম না। তুলির মুখের আরেকটি প্রশ্নের মাধ্যমে বের হয়ে এলো অর্থ। ফুঁপি তুমি কাঁদছো কেন? আমার আম্মু কোথায়?
ফুঁপি উত্তর দিলো “তুলি মা রে আল্লাহ তোর ভাইয়ার বদলে তোর আম্মুকে নিয়ে গেছে”।
কথাটা আমি বুঝতে পারলে ও তুলি হয়তো বুঝেনি।
তুলি এখনো ওর ফুঁপির দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তুলির বাবা হঠাৎ করে এসে তুলিকে জড়িয়ে ধরে
বলছে “তোমার আম্মু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আম্মু। আর আমাদেরকে তোমার ভাইকে উপহার দিয়ে গেছে”।
আম্মু কি রাগ করেছে আমার উপর আব্বু? চলো তুমি আর আমি আম্মুর রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে আসবো।
(ওর আব্বুর হাত টা ধরে) চলো আব্বু”।
তোমার আম্মু আর ফিরবে না মা।
আব্বু,আমার ভাইয়াকে চাই না। চলো ভাইয়াকে ফিরত দিয়ে আবার আম্মুকে
০ Comments