লেখা-সোনিয়া আফরিন
“রেবেকা আপা”, “রেবেকা আপা,” তাসলিমার ডেলিভারির সময় হয়ে গেছে; মেয়েটা মনে হয় বাঁচবে না। হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ঢুকে বললো স্বাস্থ্যকর্মী সালেহা।
-কী বলছো তুমি? সেইদিনও তো মেয়েটা চেকআপ করিয়ে গেল। আজকেই ব্যাথা উঠেছে?
-হ্যাঁ আপা, মনে হচ্ছে খিচুনীর লক্ষণ
-সর্বনাশ!! কখন থেকে?
-গতকাল রাত থেকে। সময় হয়েছে মনে করে পাশের বাড়ির খালাকে খবর দিয়েছে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।
-গ্রামের এইসব গোঁড়ামি করা লোকদের নিয়ে আর পারি না। মেয়েটাকে মেরে ফেলবে তবুও ডাক্তারের কাছে আনবে না।
-খুব কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা, আপা।
-কোথায় আছে তাসলিমা?
-জলদি হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলে এসেছি। ওর স্বামী ভ্যানগাড়িতে করে নিয়ে আসছে।
-ভালো করেছো। না দেখে কিছু বলতে পারবো না।
আচ্ছা, ভালো কথা। হাশেম আলীর স্ত্রী আমেনার অবস্থা কেমন? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে তো?
-জ্বী আপা। হাশেম আলী পরহেজগার মানুষ। বউয়ের খুব যত্ন করে। আমেনা বেগম যাতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারে তাই তিনি স্ত্রীকে কাজে সাহায্য করেন। টিউবওয়েল চেপে পানি বের করে দেন, ভারী কলস নিজের হাতে উঠিয়ে দেন। তাছাড়া নিয়মিত সুষম খাবারের ব্যবস্থাও করেন।
-বাহ! খুব খুশি হলাম শুনে। এদের কাছ থেকে কিছু বর্বর লোকেদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। জানো তো সালেহা।
-ঠিক বলেছেন আপা।
তাসলিমা পূর্বপাড়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের মেয়ে। বাবা সলিম মিয়া অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করে সংসার চালায়। মাত্র তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় তাসলিমার। শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো ফলাফলই করতো। তবুও বিশ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে পাশের গাঁয়ের নায়েব আলীর ছেলে রহিমের সাথে বিয়ে দেওয়া হয় তাসলিমাকে। নতুন বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে মানিয়ে নিতে বেশ কিছু সমস্যা হয় তাসলিমার। শ্বাশুড়ি তাকে উঠতে-বসতে কথা শোনায়। কথায় কথায় যৌতুক আনতে বলে। অন্য বাড়ির বউয়েরা স্বামীকে ব্যবসায় করার অর্থ,মোটরসাইকেল সব দিয়েছে। কিন্তু তাসলিমার বাবা কেন মোটর সাইকেল দেয়নি তাই নিয়ে রোজ অশান্তি পোহাতে হয় মেয়েটাকে। স্বামী রহিমের বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মাঝামাঝি। বিয়ের আগ পর্যন্ত বাজারে পিতার সাথে সবজি বিক্রি রহিম। বিয়ের কয়েক মাস যেতে না যেতেই মায়ের উস্কানিতে শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক আনার বায়না ধরলো। দেখতে দেখতে রহিম এবং তাসলিমার বিবাহিত জীবনের এক বছর পূর্ণ হলো।
তাসলিমার ইচ্ছে ছিল সে অন্তত এসএসসি পরীক্ষা দেবে। মা-বাবার কষ্ট লাঘব করবে। কিন্তু পরিবারের কষ্ট তো দূরে থাক,নিজের দুঃখ-কষ্টই শেষ হয় না। বিয়ের সাথে সাথে যে পড়াশোনার পাটও চুকে গিয়েছে। মেয়েটার চেহারায় কেবল হতাশা আর হতাশা। এরই মাঝে তাসলিমা অন্তঃস্বত্তা হলো। বয়স অনুযায়ী মা হওয়ার মতো উপযুক্ত না হলেও ভিন্ন উপায় ছিল না। শ্বাশুড়ি বাচ্চা নেওয়ার জন্য রোজই ঘ্যানঘ্যান করতো। ভাগ্যের নির্মমতা মেনে নেওয়া ছাড়া কী-ইবা করতে পারতো মেয়েটা!
রেবেকা হক গ্রামের একটি জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর গাইনী চিকিৎসক। পনেরো দিন পরপর একজন স্বাস্থ্যকর্মী গ্রামের মহিলাদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করেন।
অবস্থা বেগতিক হলে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পরামর্শ দেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। স্বাস্থ্যকর্মী সালেহা এত কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিতে বারণ করেছিল তাসলিমার মাকে। তবুও বিয়েটা আটকানো গেল না।
স্বামী রহিমের তাসলিমার প্রতি কোনো খেয়াল ছিল না। গাঁয়ের ছেলেদের সাথে আড্ডা দেওয়া আর বাবার সাথে বাজারে সবজি বিক্রি ছিল মূল কাজ। এমনকি আড্ডা গিয়ে অনেক রাত অবধি বাইরে থাকতো। সেই সাথে শ্বাশুড়ির ছোট-বড় কথাতো বাড়তি পাওনা হিসেবে আছেই। তাসলিমার বাবার মতো একজন গরীব কৃষকের জামাইকে মোটর সাইকেল কিনে দেওয়া সহজ কথা নয়। তবুও মেয়ের সুখের জন্য বিয়ের পরেও মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দেন। তবুও যদি শেষ রক্ষা হতো! শেষে কিনা মোটর সাইকেলের বায়না ধরতে হলো! আসলেই কি মেয়ের জামাইকে খুশি রাখার জন্য,মেয়ের সুখের জন্য যৌতুক দিতে হয়?
সুখ জিনিসটা বড় আপেক্ষিক। হয়তো কালে-ভদ্রে এর দেখা মিলে। সুখ ছুঁয়ে দেখা যায় না। সুখ অর্জন করতে হলে কখনও কখনও কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতেও হয়। তাসলিমার সুখের জায়গা ছিল লেখাপড়া। শিক্ষিত হয়ে জীবনে বড় কিছু করা। বাল্যবিবাহের দরুণ সেটা আর হয়ে উঠলো না।
এদিকে তাসলিমার শ্বাশুড়ি তো মহাখুশি। পুত্রবধূর বয়স যতই হোক, নাতি-নাতনীর মুখ দেখাটা বড় ব্যাপার। একজন অন্তঃস্বত্তা নারীকে যে অন্য সময়ের চেয়ে শরীরের প্রতি একটু বেশি খেয়াল রাখতে হয় সেকথা কে বুঝাবে। একদিন গাঁয়ে স্বাস্থ্যকর্মী সালেহা এলো লোকেদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে। বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে নায়েব আলীর বাড়িতে প্রবেশ করলো। নায়েব আলীর স্ত্রী সালেহাকে সাদরে গ্রহণ করলো।
–আরে! স্বাস্থ্য আপা, আহেন আহেন। একটু জিরাইয়া লন।
–আপনার ছেলের বউকে দেখছি না। সে কোথায় গেছে?
–আছে, টিউবওয়েল চাপতাছে
–ওমা! এই সময়ে এইসব ভারী কাজ করা ঠিক না খালা।
কথাটি শোনার সাথে সাথে তাসলিমার শ্বাশুড়ির চোখে মুখে একটা বিরক্তির ভাব ফুটে উঠলো।
–আমাগো বুঝি বাপু ছেলেপুলে হয় নাই। কালে কালে কত কী যে আইবো, ধূর।
সালেহা তাসলিমার সাথে দেখা করে মা হওয়ার পূর্বে শরীরের যত্ন নিতে বিশেষভাবে বুঝালো। পথে রহিমের নাগাল পাওয়াতে হাসপাতালে জরুরী কিছু চেকআপ করানোর কথা বলে দিলো। সেই সুবাদে রহিম তাসলিমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। মেয়েটির অবস্থা ভালো ছিল না। একদিকে শরীর মা হওয়ার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। অন্যদিকে আবার পর্যাপ্ত খাবার ও বিশ্রামের অভাবে শরীর ছিল অপুষ্টির শিকার।ডেলিভারির তারিখের এক সপ্তাহ আগে ব্যাথা উঠেছে। কিন্তু শ্বাশুড়ি কিছুতেই ক্লিনিকে আনতে দিবে না। তাই পাশের বাড়ির দাইকে খবর পাঠিয়েছে। টানা দশ ঘণ্টা পরে ব্যর্থ হয়ে শেষে হাসপাতালে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই কথাই বলাবলি করছিল স্বাস্থ্যকর্মী সালেহা ও চিকিৎসক রেবেকা হক।
হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছে তাসলিমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। পাশে ভ্যানগাড়িতে শুয়ে আছে তাসলিমা। সাথে মেয়ের বাবা-মাকেও দেখা যাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হলো তাসলিমাকে। হাতে-পায়ে পানি এসে ফুলে গিয়েছে মেয়েটার। হাসপাতালে আসার পথেও কয়েকবার অজ্ঞান হয়েছে। সন্তান ও মা যেকোন একজনকে বাঁচানো যেতে পারে আবার উভয়ই মারা যেতে পারে। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষামান দুই পরিবারের সবাই। দুই ঘণ্টা পরে ডাক্তার বের হলেন। একটি নিথর দেহ পড়ে রইলো কেবল। সেই দেহের মাঝে লুকানো আর্তনাদ বহুদিন হয়তো কেউ শোনেনি।
গল্পটা আরো সুন্দর ভাবে তুলে ধরা যেত। অন্য কোন ব্যক্তির মাঝে ঘটনার উল্লেখ করা যেতো। আর কি বলবো,,,,, গ্রামের এসব ঘটনা নিত্য। একপ্রকার ব্যধির মত। এসব নির্মূল করা সহজে সম্ভব না, যতক্ষণ না গ্রামে শিক্ষার আলো বয়ে আসবে। যাই হোক, গল্পের উপস্থাপনা যেমন হোক, প্রেক্ষাপট চমৎকার।
শিক্ষা কুসংস্কার দূর করে। গল্পের ঘটনাটা খুবই কষ্টদায়ক।
কিন্তু শিক্ষার অভাবে অনেক মানুষের সাথেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তাছলিমা তো শুধু এ ধরনের ঘটনার শিকার হওয়া নারীদের প্রতিনিধি।
শুভ কামনা।