নীল পলিথিনের ছাউনি
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৫, ২০১৮
লেখকঃ vickycherry05

 2,982 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ vickycherry05

গল্প লেখিকাঃ
আফরোজা আক্তার ইতি
(এপ্রিল – ২০১৮)
………………

রাস্তায় জ্যামে বসে আছি দশ মিনিট ধরে। রিকশা এগুচ্ছে তো এগুচ্ছে না এমন অবস্থা। এদিকে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শীতের কনকনে বাতাস এসে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। গায়ের চাদরটা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে বসলাম। মাথা উঁচু করে দেখছি সামনের গাড়িগুলো কতদূর এগুলো, ঠিক এমন সময় আমার হাতে একটা কোমল স্পর্শ পেলাম। “আফা, দুইটা ট্যাকা দ্যান।” কাতর আবেদনী কন্ঠ শুনে আমি চমকে পাশে তাকালাম। ছ’বছরের একটা বাচ্চা ছেলে, সর্বাঙ্গে কালি-ঝুলি মাখানো, পরনে শুধু নোংরা একটা হাফপ্যান্ট, তাও যেন পুরোটাই তালি দিয়ে তৈরি। দেখে যথেষ্ট মায়া লাগলো বটে। আমি ব্যাগ থেকে দশ টাকা বের করে ছেলেটির হাতে দিলাম। কিন্তু এতে তার সন্তুষ্টি পাওয়া গেল না। সে তার চেহারায় যতটুকু সম্ভব মিথ্যে আকুলতা, করুণ কাতরতা আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, “আফা, আরো কিছু দ্যান। সারাদিন কিসসু খাই নাই। আমি এতিম, বাপ মা নাই।” আরো বিস্তর কিছু ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম সে একা নয়। আরো একটি চার বছরের বাচ্চাও তার এক হাত ধরে পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার নজর পরতেই সে বাচ্চাটিকে হ্যাঁচকা টান মেরে সামনে এনে বলল, “আফা, আমার ভাইয়ের প্যাটে বেরেইনের (ব্রেইনের) কেন্সার হইসে। ওর কথা শুনে মৃদু হাসলাম। বুঝলাম এখনো মিথ্যে বলাটা ভালোমতো রপ্ত করতে পারে নি। মাত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। নাছোড়বান্দা বাচ্চাটা আমাকে অনুনয় করতে করতে ব্যাগ হাতের থেকে প্রায় কেড়েই নিবে এমন অবস্থা। এদিকে আশেপাশের লোকগুলোও তাকিয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি আরো দশ টাকা বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। ছেলেটি এবার এক হাতে তার ভাই আর অন্য হাতে ভিক্ষার টাকাগুলো নিয়ে অন্য রিকশার সামনে গিয়ে পুনরায় তোতাপাখির মত মুখস্ত বুলি আওড়াতে লাগলো।

আমি আবারো সামনে তাকালাম। পরিস্থিতিরর যেন কোন পরিবর্তনন নেই। সব রিকশা, যানবাহনগুলো মূর্তির মত স্বস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ডানপাশের ফুটপাতের নীল পলিথিনে মোড়ানো ছাউনিগুলোর দিকে লক্ষ্য করলাম। সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। ২৬-৩০ বছরের এক মেয়ে,পড়নে মলিন একটা শাড়ি, সামনে মাটির উনুন জ্বেলে তাতে পিঠা ভাপ দিচ্ছে। তার পাশে একটা পাতলা চাদরে শুয়ে আছে বছর দু’য়ের একটা বাচ্চা। সম্ভবত গায়ে জ্বর, মেয়েটি চিন্তিত মুখে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার গায়ে হাত রেখে জ্বরের পরিমাণ দেখছে। খদ্দের তেমন নেই। কিছুক্ষণ পর সেই ছ’বছরের ছেলেটি তার ভাইকে নিয়ে মেয়েটির কাছে গেলো। মেয়েটি তার চার বছরের বাচ্চাটিকে নিজের কাছে টেনে এনে তার পিঠের উপরে ঘা’কতক বসিয়ে দিল রাস্তা পার হয়ে ভাইয়ের কাজে সঙ্গ দেয়ার অপরাধে। আকস্মিক মার সহ্য করতে না পেরে সে মা মা বলে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে ফুটপাতের অন্য প্রান্তে চলে গেলো। তার মা সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলো না মাত্র। শুধু উনুন থেকে পিঠা নামিয়ে আরেকবার পাশে শুয়ে থাকা বাচ্চাটির মাথারর পট্টিটটা পাল্টে দিল। তার পাশে ছ’বছরের বাচ্চাটি প্যান্টের পকেট থেকে সারাদিনের ভিক্ষা করে জমানো পয়সাগুলো বের করে ফুটপাতের উপর বিছিয়ে বসল। পয়সাগুলো আলাদা করে এক পকেটে রাখল আর নোটগুলো রাখলো আরেক পকেটে। তারপর তাদের পলিথিনের ছাউনির ভিতর থেকে একটা ভাঙা-কালো পাতিল থেকে দু’মুঠো পান্তাভাত একটি বাটিতে রেখে গোগ্রাসে খেতে লাগল।

এমন সময় রিকশা এগুতে শুরু করল। সৎবিত ফিরতেই সামনে তাকিয়ে দেখলাম, ট্রাফিক সিগনালে সবুজ বাতি জ্বলছে। শীতের কনকনে বাতাস যেন গায়ের চাদরের ভিতরেও হাড় কাঁপাতে চাইল। আরো ভালোমতো গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলাম। চাদরের গরম ও’মে মনে হল, একটা পলিথিনের ছাউনি কিভাবে ওদের ওম দেয়? আচ্ছা, এটাই কি আমাদের সুশীল সমাজ, যেখানে মানুষের জীবন, আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র ফুটপাতের একটা নাজুক নীল পলিথিনের ছাউনিতে সীমাবদ্ধ? যেখানে একটি প্রজন্ম মিথ্যার অন্তরালে ভিক্ষাবৃত্তি শিখছে, একটি বাচ্চা তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ভুগছে, আবার কোন ছোট্ট প্রাণ লড়ছে জীবন-মৃত্যুর আশংকায়, আর একজন অসহায় মা তার তিন সন্তানের মুখে একমুঠো খাবার জোগাতে ব্যস্ত? তাহলে কি এই আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ?

সম্পর্কিত পোস্ট

শয়তানকে পরাজিত করুন –

শয়তানকে পরাজিত করুন –

কোন এক দাওয়াতে এক ভাবী গল্প করছিলেন যে, এক মহিলা যখন তার Husband রাগ হয় তখন তিনি আয়াতুল কুরসি পড়েন আর তার স্বামী বিড়াল হয়ে যান । তখন আর এক ভাবী বললেন," ভাবী - আয়াতুল কুরসি পড়লে উনার স্বামী বিড়াল হন না বরং ঐ মহিলার সাথের শয়তানটা পালিয়ে যায়” । ভাবীদের এই...

একজন মানুষের গল্প

একজন মানুষের গল্প

দুই টাকার আইসক্রিম, বই সামনে নিয়ে চিৎকার করে পড়া, কলম দিয়ে এক অক্ষর বারবার লিখে হাত ব্যাথা সহ্য করতে করতেই ছোটবেলা কাটিয়ে দেওয়া। একটু বড় হওয়ার পর ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়া। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়া কোনো এক বট তলা। যেখানে বসে আড্ডা দিত কয়েকজন স্কুল পালানো...

অস্ফুট কান্না

অস্ফুট কান্না

লেখা: মোহসিনা বেগম , প্রচণ্ড শীত পড়েছে আজ। চারদিক কুয়াশা যেন চাদর বিছিয়ে রেখেছে। সকাল এগারোটা বেজে গেছে এখনও সূর্যের দেখা নেই। ছুটিতে কয়েকটা দিন গ্রামে থেকে আনন্দ করব কিন্তু প্রচণ্ড শীতে জমে যাচ্ছি। লেপের নীচ থেকে বের হতেই ইচ্ছে করছে না। ওদিকে মা কতক্ষণ ধরে ডেকেই...

০ Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *