মিতুর খোঁজে
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 2,943 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

পারভেজ মোশাররফ

ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে জাফর সাহেব আঁৎকে উঠেন। কয়েকজন সদস্যের ইউপি মিটিং এর নিরব পরিবেশে হঠাৎ কল সবার দৃষ্টি আকর্ষণ এর মত। বুক পকেট থেকে কল কেটে দিয়ে বক্তব্য শুনতে লাগলেন চেয়ারম্যান সাহেবের। জাফর সাহেব গ্রামের মেম্বার। চেয়ারম্যানের এবং গ্রামের সকল ডাকে তাকে সাড়া দিতে হয়। মিনিট খানেক পরেই আবার রিং বেজে উঠলো। বুক পকেট থেকে ফোন নিতেই দেখে তার স্ত্রী নাদিয়ার কল। চুপিসারে বলবে মিটিং এ আছি একটু পরে কল দিতে, এই ভেবে কল রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে আতংকে বলে উঠে ” আপনি কোথায়? বাড়ি আসেন তাড়াতাড়ি, সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
জাফর সাহেব বলে উঠলেন, কি হয়েছে?
জাফর সাহেবের পাশেই দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন চেয়ারম্যান সাহেব। তার কথা শুনে বললেন, কোন সমস্যা?
চেয়ারম্যান সাহেবের থেকে অনুমতি নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে বাহিরে বের হয়ে এলেন।
ভাবতে লাগলেন, কি সর্বনাশ হতে পারে?
পাজামার পকেট থেকে মটরসাইকেলের চাবি নিয়ে রওয়ানা দিলে বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর ভাবতে লাগলেন, সর্বনাশ হওয়ার মত কিছু তো মাথায় আসছেনা। বাড়িতে নাদিয়ার কিছু হলো নাতো! নাহ, তার কি হবে। তার কিছু হলে কল দিতে পারতো নাকি। তাহলে তার আদুরী মেয়েটার কিছু হলো? তারই বা কি হবে? স্কুল থেকে ফিরে চারটায়। এখন দুপুর সাড়ে বারোটা। আগামী বৎসর কলেজে পা দিবে। কত কষ্টই না করছে মেয়েটা। এবার মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে শহরে বড় কলেজে ভর্তি করাতে হবে। ওখানে কি খাবে না খাবে, অসুস্থ হয়ে পড়বে দুদিনে। ওকে একদিন না দেখলে বুকটা যে চিৎকার করে উঠে। ও কি সেটা বুঝে?
নিজের সাথে কথা বলতে বলতে বাড়িরর কাছাকাছি পৌঁছে এসেছেন জাফর সাহেব। প্রচন্ড রোদে ঘেমে একাকার আরো একটা চিন্তা মাথায় চেপে বসে আছে।
বাসার সামনাসামনি এসে দেখে বারান্দায় বেশকিছু মহিলা বসে আছে আর গুজার করছে। নিশ্চয় কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তাকে দেখে মহিলারা মাথায় কাপড় দিয়ে বারান্দা থেকে সরে পড়ে।
জাফর সাহেব মোটরসাইকেল স্ট্যান্ডিং করে বারান্দায় পা দিতেই তার স্ত্রী ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে সামনে দাঁড়ায় আর বলতে থাকে শেষ, আমার সব শেষ। মিতুর কোন কাপড় চোপড় নেই। সব নিয়ে পালিয়ে গেছে। আমার সোনা আর জমানো টাকাও নিয়ে মিতু চলে গেছে। সব চলে যাক, তবুও আমার মেয়েকে এনে দাও। আমার মেয়েকে এনে দাও তুমি, যেখান থেকে পারো। নাদিয়ার হাতে থাকা সাদা কাগজখানি বাড়িয়ে দেয় তার স্বামীর দিকে।
জাফর সাহেব নিরবে পড়তে থাকেন নাদিয়ার দেওয়া চিঠিখানি।
তাতে লিখা,
প্রিয় আব্বু আম্মু,
আমায় ক্ষমা করে দিও। সৃষ্টিকারীর পরে কেউ যদি আমার পাশে থাকে তাহলে তারা হচ্ছো তোমরাই। আর তোমাদের মতই আমি মেহেদিকে খুব ভালোবাসি। আমার জীবনের আশার আলো যুগিয়েছে মেহেদি। সে এবার অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। তার আব্বু আম্মু দুজনই মেডিকেল সার্জেন্ট। আমি তাকে সারাজীবনের জন্য পেতে চাই। সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমাদের সম্পর্ক হয়তো উভয় দিকে মেনে না নিতে পারে। আমি তাই একা তার কাছে তোমার জমানো বিশ হাজার টাকা এবং মায়ের গহনাখানি নিয়ে এসেছি। আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি কখনো তোমাদের কষ্ট দিতে চাইনি। আমাদের পরবর্তী জীবনের সুখের আশীর্বাদ দিও।
ইতি তোমার আদুরে মেয়ে মিতু।
চিঠিখানি পড়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন নি। পিচনে থাকা চেয়ারে ঠাস হয়ে বসে পড়লেন। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। হয়তো রাগে নয়তো বেদনায়। কিছু ভেবে উঠতে পারছেন না। চিঠিখানা চার ভাজ করে বুক পকেটে নিলেন। তারপর পকেটে চাবি হাতাতে লাগলেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। স্ত্রীকে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
মোটরসাইকেলের কাছে গিয়ে দেখেন চাবি গাড়িতে রেখে গেছেন। গাড়িতে বসতেই নাদিয়া পেছন থেকে ডাক দিলেন,
– কোথায় যাচ্ছেন?
– আসছি।
গাড়িতে চেপে বসলেন। চললেন স্কুল পথে।
স্কুলে পৌছে দেখেন ক্লাসে অনুপস্থিত মিতু। মিতুর দুজন ভালো বান্ধুবী আছে ক্লাসে। সবসময় একসাথে আসে। দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মিতু সবসময় তোমার সাথেই আসতো, আজ আসেনি?
-এসেছিলো। কিন্তু পথিমধ্যে বলে ক্লাস খাতা নাকি রেখে এসেছে। তাই আমায় স্কুলের দিকে পাঠিয়ে মিতু বাসায় ফিরে যায় খাতার জন্য।
হতভম্ভ হয়ে গেলেন জাফর সাহেব।
কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
চিঠিখানি হাতে নিয়ে আবারো পড়তে লাগলেন।
তিনি নিজেকে নিজে দোষারোপ করতে লাগলেন কারন তিনি জানেন মিতুর হাতে মোবাইল দেওয়ার জন্যই তাকে এই দিন দেখতে হচ্ছে। গ্রামে তার একটা ঐতিহ্য আছে, কি করে মুখ দেখাবে!
এতক্ষণে হয়তো এলাকাজুড়ে খবর চলে গেছে।
স্কুলের রাস্তা ধরে বাড়ি পর্যন্ত যত দোকানপাট রয়েছে সবার মালিক কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে মিতু কে কেউ দেখেছে কিনা। কিন্তু সবারই এক মত, তারা কেউ দেখেনি। জাফর সাহেব বুঝতে পারলেন, অনেকেই তার মেয়েকে দেখেছে বিপথে যেতে, কিন্তু কেউই সাঁই দেবেনা। চিঠিখানিতে লিখা যার জন্য মিতু বাড়ি থেকে পালালো সে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। কিন্তু গ্রামের এমন কোন পরিবার নেই যাদের পুরো পরিবার মেডিকেলে কাজ করে। তাহলে ছেলেটি সম্ভবত শহরের। এক সেকেন্ডেই ভেবে নিলো। শহরের একটাই পথ, সে নিশ্চয় সেই পথ দিয়েই যাবে। কিন্তু কোথায় খুঁজবে তাকে। দিশেহারা হয়ে পড়ে জাফর সাহেব।
মিতু শহরের দিকে গেলে, তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। নিজেকে সান্ত্বনা দিলো, সে তো নিজ থেকেই চলে গেছে, নিজ থেকে কিছু করলে তাদের ফিরানো যায়না, আর নিজের ভালো নিজে না ভাবলে আমি কি করবো। এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় । দুপুরের খাবার খেয়ে খাটে একটু হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েন। স্ত্রী নাদিয়া তাকে পান বানিয়ে দেয়। তারপর পান খেতে খেতে মাথা থেকে তার মেয়ের কথা ঝেড়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েন জাফর সাহেব। তার স্ত্রী নাদিয়ার চোখেমুখে গম্ভীর ভাব। মেয়ে কোথায় গেলো তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। মেয়ের কথা ভাবতেই চোখে জ্বল চলে এলো। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, কত কষ্ট করে লালন পালন করেছি তোকে, আর মায়ের অমতেই চলে গেলি, এতো নিষ্ঠুর তুই। যেদিন মা হবি সেদিন বুঝবি, সন্তানের মর্মটা কেমন। তোকে কত আদরে রেখেছি, একমাত্র মেয়ে বলে, আর আজ চলে গেলি আমাদের ছেড়ে। এভাবে কাঁদতে কাঁদতে নিজ কক্ষে শুয়ে পড়ে নাদিয়া। কিন্তু তার ঘুম আসছে না।
এর কিছুক্ষণ পর একটা কল আসে। নাদিয়ার তখন ঘুম ঘুম ভাব। জাফর সাহেব তখন নাক ঢেকে ঘুমাচ্ছেন। ফোনের আওয়াজে জেগে উঠে গেলেন কল ধরতে। টেবিলে রাখা ফোনটি হাতে নিলেন। ফোনে বড় করে লিখা “আম্মু”, এটাতো তার মেয়ের’ই নাম্বার। কাঁপা হাতে কল রিসিভ করে বলে উঠে, “হ্যালো”
অপরপাশ থেকে কাঁদো কন্ঠে তার মেয়ে বলে উঠে, “আম্মু, আমি ফিরে আসতে চাই, আব্বুকে শহরে পাঠাও প্লীজ, আমি লেকের পাশে আটকা পরে আছি,, আব্বুকে এক্ষুণী……..” কথাটা শেষ না হতেই তার মেয়ে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে, যেনো কাউকে থামতে বলছে। তারপর প্রবল বেগে বাতাসের শব্দ। নাদিয়ার উৎকন্ঠা যেনো দ্বিগুণ বেড়ে উঠে। জাফর সাহেবের বেশ ঘুম পেয়েছে, নাক ডেকে ঘুৃমাচ্ছেন। নাদিয়া কয়েক ডাক দিয়ে জেগে তুলে বললেন, ” মিতু কল দিয়েছিলো” ঘুম থেকে উঠে বসে পড়েন জাফর সাহেব। জিজ্ঞেস করলেন, কি বললো? কোথায় এখন? সে নাকি কোন লেকের পাশে আছে, মিতু খুব বিপদে আছে। এখনি যান ওখানে, বললো নাদিয়া। জাফর সাহেব বসে চিন্তা করতে লাগলেন, শহর থেকে কিছু দূরে একটি ছোট লেক আছে, আরে একটি লেক আছে তা বেশ দূরে। মিতুর পক্ষে অতটুকু যাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে নিশ্চয় শহরের পাশের লেকটিতেই আছে মিতু। কিন্তু তার হাত ও খালি, জমানো যে, বিশ হাজার টাকা ছিলো তাও নিয়ে গেলো। এতদূর গেলে নিশ্চয় হাতে বেশকিছু টাকা রেখে যেতে হবে, কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। জাফর সাহেব এমন লোক নয় যে কারো থেকে হাত পাতবে। আর এখন তার দিন ও খারাপ যাচ্ছে। নাদিয়া গায়ে ঠেলে দিয়ে বললেন কি হলো, কি ভাবছো? জাফর সাহেবের ভ্রম ভাংলো। তারপর বলে উঠলো, তোমার জমানো কিছু সোনা ছিলোনা? ওটা কোথায় রেখেছো? হঠাৎ, সেগুলো কেনো? বললো নাদিয়া,
জাফর সাহেব সোনা গুলো বাজারে বিক্রি করে রওয়ানা দিলেন শহরের উদ্দেশ্যে। শহর থেকে বেশ কিছু দূরে রয়েছে ছোট একটি লেক। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। শুরুতে সি এন জি তারপর অটো তারপর বাস এভাবে গাড়ি বদল করতে করতে প্রায় অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছেন জাফর সাহেব। তখন প্রায় এশার সময় হয়ে এসেছে। একটু ঝিমুনি ও আসলো। তৎক্ষণাৎ তার ফোনে একটা কল আসে, তার মেয়ের ফোন। কল রিসিভ করে কানে ধরলেন। অপরপাশ হতে একজন পুরুষের কন্ঠে বললো, যেনো সে খুব দ্রুত হাসপাতালে দেখা করে। হাসপাতালের নাম বললো ডাক্তার, কিন্তু এখান থেকে বেশকিছু দুরে। রোগীর অবস্থা খুব আশংকাজনক এই বলে ডাক্তার কল কেটে দিলো। মিতুর বাবার তখন হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে। চোখেও ঝাপসা দেখছেন। এক মুহূর্ত না ভেবে সি এন জি নিয়ে চললেন সেই হাসপাতালের দিকে। পথে ভাবতে লাগলেন, কি হলো তার মেয়ের। নিজেকে বহুকষ্টে আয়ত্তে এনেছেন। মিতুর কিছু হলে তিনি সইতে পারবেন না। অল্পক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছালেন সে হাসপাতালে। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই তার কষ্ট হচ্ছে। হাঁটু ব্যথা করছে। তবুও প্রাণপণে উপরে এসে খুঁজে পেলেন ডাক্তারকে। ডাক্তারের মুখের অবস্থা মলিন। ডাক্তার রোগীর বিছানায় যেতে যেতে গম্ভীর মুখে বলতে লাগলেন, আসলে ফোনটা পেয়েছিলাম রোগীর কাছেই। কয়েকজন ধরাধরি করে নিয়ে আসলো এখানে। কিন্তু রোগীর পরিচিত কেউ আসেনি। আর ফোন পেয়েছি বিধায় একে একে কল দিবো ভাবছিলাম, ভাগ্যিস শুরুতেই আপনাকে পেয়ে গেলাম। তাই মনটা নিশ্চিন্ত হলো। রোগী ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙতে আরো দু ঘন্টা লাগতে পারে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাম পায়ের উপর ট্রাক যাওয়ায় বাম পা কেটে ফেলতে হয়েছে। জাফর সাহেবের কাছে সব দুঃস্বপ্ন মনে হলো। এ কি সব শুনছেন তিনি। তার একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিলো পূর্বক্ষণেই। দু পা হিল হয়ে আছে, যেনো আর এক কদম ও সামনে ফেলতে পারবেন না। গলা শুকিয়ে আসছে।
অবশেষে এসে পৌঁছালেন রোগীর কক্ষে। প্রায় ডজন খানেক রোগী সারি ভাবে শুয়ে আছে বেডে। ডাক্তার সর্বশেষ বেডের কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। জাফর সাহেব বেডের দিকে তাকিয়ে বললেন,, ” ও কে?” আপনার ছেলে, ডাক্তার জবাব দিলো। “আমার তো কোন ছেলে নাই” জাফর সাহেবের এই বাক্য শুনে ডাক্তার তখন মাথা তুললেন। ” আপনার ছেলের কাছ থেকেই তো ফোনটা পেলাম, আর আপানর ছেলে না হলে ফোন এর কাছে আসলো কি করে? ডাক্তারের প্রশ্নের জবাবে জাফর সাহেব একটু চিন্তিত সুরে ভ্রু কুঁচকে বললেন, ” আমারও তো সেইটাই কথা” রোগীকে ঘুমের ঔষুধ দেওয়া হয়েছে, দুই ঘন্টা পর রোগীর ঘুম ভাঙবে আশা করি। আপনি ততক্ষণ বাহিরে অপেক্ষা করুন, ডাক্তার এই বলে চলে গেলো।
বাহিরে বসে জাফর সাহেব ভাবতে লাগলেন। বিকেলে কল দিয়েছে মিতু কিন্তু এখন ফোন তার হাতে। মিতু এখন কোথায় আছে কে জানে। হ্যা, মেয়ে চিঠিতে লিখেছিলো যে একটা ছেলের কাছে যাবে, নিশ্চয় এই সে ছেলে। মিতুকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। আর কোনভাবে গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়েছে। যেভাবে হোক মিতুকে খুঁজে বের করতে হবে। আর মিতুর খোঁজ শুধুমাত্র এই ছেলেই দিতে পারবে। আর তার জন্য দু ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু, এই ছেলেকে দেখে মনে হয়না কোন ডাক্তারের ছেলে। চিঠিতে তো ডাক্তার’ই লেখা ছিলো। সব জানা যাবে যখন এই ছেলেটার জ্ঞান ফিরবে।
ভাবতে ভাবতে বাড়ি থেকে কল এলো নাদিয়ার। রিসিভ করে বলতে লাগলেন এতক্ষণ যা ঘটলো। খুব চিন্তা হচ্ছে নাদিয়ার। কথা শেষ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন জ্ঞান ফিরে এই আশায়। তার হঠাৎ মনে হলো, মিতুর ফোন তো তার কাছেই। তাহলে কার কাছে কল দিয়েছে সহজেই বুঝা যাবে। লোকটার পাশ থেকে তো আর কোন ফোন পাওয়া গেলোনা তাই নাম্বারে কল দিয়ে দেখি। এই ভেবেই পকেট থেকে ফোন নিয়ে কল লিষ্ট দেখতে লাগলেন। একটা নাম্বারে সকাল থেকে বেশ কয়েকবার কল দেওয়া হয়েছে। দেরি না করে সেই নাম্বারে কল চাপলেন। একজন মেয়ে সুমধুর কন্ঠস্বরে বলতে লাগলো ” আপনার একাউন্টে যথেষ্ট পরিমান ব্যালেন্স নেই, অনুগ্রহ করে রিচার্জ করুন” দূরর, এই মুহূর্তে ব্যালেন্স শেষ হতে হলো। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো, মনে মনে বললেন জাফর সাহেব। তারপর নাম্বার নিয়ে নিজের ফোন দিয়ে কল দিয়ে দেখেন নাম্বার বন্ধ।
মিতুর বাবা জাফর সাহেব দেখেন একটা অচেনা নাম্বারেও এই ফোন থেকে কল দেওয়া হয়েছিলো, মিতু যখন কল দিয়েছিলো তার আধঘন্টা আগে। সে নাম্বার নিয়েও নিজের ফোন থেকে কল দিলেন। একজন মহিলা কল রিসিভ করলো। জাফর সাহেব সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে বলছেন? তখন মহিলাটি খুব ভদ্র ভাষায় উত্তর জানালো, “আফনে কে মিয়া, কল দিয়া প্যারাইতাসেন! বাসায় পাঠামু নাকি? বাসায় কি পাঠাবেন তার উত্তর না নিয়েই কল শেষ করেন। তারপর ভাবতে লাগলেন, মিতু আবার কার কাছে কল দিলো। ঐ ছেলেটার মা নয়তো। যদি মা ও হয়, তাহলে একজন ভদ্রমহিলা এমন আচরণ করতে পারে।
কিছুক্ষণ পর নার্স এসে বলে গেলো, রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। চাইলে দেখা করতে পারেন। ডাক্তার সহ জাফর সাহেব গেলেন রোগীর বেডে। জ্ঞান ফিরলেও অত স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারবেনা এই অবস্থায়। তবুও জাফর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ে কোথায়? কো ও ওন মেয়ে? জবাব দিলো শুয়ে থাকা লোকটি। আমার মেয়েকে চিনিস না? তোরে জেলে দিমু, যদি আমার মেয়েকে না পাই, তখন চিনবি। তাড়াতাড়ি বল কোথায় আটকে রেখেছিস? জাফর সাহেবের এমন রাগান্বিত অবস্থা দেখে ডাক্তার বললো, “আহা, শান্ত হন; ওনি অসুস্থ, আপনার এমন ব্যবহার রোগীর জন্য বিপদজনক, আমাদের এখানে থাকা অবস্থায় আপনি এমন আচরণ করতে পারেন না। ডাক্তারের কথা শেষ না হতেই জাফর সাহেব বলে উঠলেন, ও আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে, আর আপনি বলছেন চুপ থাকতে? তারপর মুখ ফিরিয়ে বেডে শুয়ে থাকা লোককে বললো, “তোর নাম কি?” বা.. আ… আ… বু। বেডে শুয়ে থাকা লোকটি বললো, তার নাম বাবু। পকেট থেকে মিতুর ফোনটা বের করে জাফর সাহেব বললেন, এই ফোন তোর কাছে আসলো কি করে? তখন বেডে শুয়ে থাকা বাবু বললো, আমি আপনার মেয়েকে কিডন্যাপ করিনি, ঘটনা আসলে অন্য কিছু। অন্য ঘটনা? সব সত্যি বলবি, নাহয় বুঝবি কারাগারের খাটুনি কাকে বলে, জাফর সাহেব বলে উঠলেন। তারপর বাবু বললো, আমি সত্যি বলবো, আমি আসলে একজন চোর। আজ সকালে মোটেও টাকা ছিলনা, খাওয়ার মতও ছিলনা কিছু। খালি পকেটে সারাদিন চলার পর বিকেল বেলায় গ্রীন লেকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি একটা সুন্দর মেয়ে ফোনে কার সাথে কেঁদে কেঁদে কথা বলছে, আর আমার ও সারাদিনে কোন রুজি হয়নি। কাঁদছে দেখেও আমার মায়া হয়নি, কারন চোরদের মায়া থাকতে নেই। চিলেরছোঁ মেরে ফোন নিয়ে দিলাম দৌড়। পিচন পিচন মেয়েটাও দু কদম দৌঁড়েছিল, আরো দুজন লোক ধাওয়া করছিলো। প্রাণপণে দৌঁড়াতে রাস্তার মোড় নিতেই একটা সিএনজির সাথে ধাক্কা খাই আমি, তারপর আর কিছুই মনে নেই। বাবুর কথা শুনে জাফর সাহেব চুপ হয়ে রইলেন। তার মাথায় যেনো বাজ পড়লো। মুখ ঘুরিয়ে ভাবতে লাগলেন, তার মেয়ে নিশ্চয় এখনো গ্রীন লেকেই আছে। কিন্তু এই ফোন যদি মেয়ের কাছে থাকতো নিশ্চয় পেয়ে যেতো, সব শেষ হলো এই চোরের কারনে। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অতঃপর রাগী কন্ঠে চোরকে বললেন, তুই ফোন কেন চুরি করলি, শুধু ফোনটা না আমার মেয়েটাকেও চুরি করলি। ফোনটা এখন ওর হাতে থাকলে নিশ্চয় খুঁজে পেতাম। এখন কোথায় খুঁজবো? এই বিকেল থেকে রাত অব্দি কি ঐ গ্রীনলেকেই বসে থাকবে? কেন চুরি করলি ফোন? বাবু, নরম সুরে বললো, পেটের দায়ে স্যার। কাজ করতে পারস না?, কথাটার জবাব দিলো ” কে কাজ দেবে স্যার?” জাফর সাহেব বললেন, এখন তো এক’পা হারিয়েছো, কি করে কাটবে জীবন? বেডে শুয়ে থাকা বাবু অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদোস্বরে বললো, ভিক্ষে ছাড়া আর কি’ই বা করার আছে।
রোগীর স্থান ত্যাগ করতে করতে নিজেকে বকতে লাগলেন, ফোন হচ্ছে বিপদআপদের সবথেকে কাছের বন্ধু। অনেক অনেক জরুরি কাগজ পত্রও থাকতে পারে। আপনজনের ছবি, সবার নাম্বার সমূহ। এমনকি ফোন হারালে মানুষ মৃত্যু সমান কষ্টও পেতে পারে। আর মানুষ এতো জরুরি ফোন চুরি করে। ফোনের সিমকার্ড আর মেমোরি কার্ড সবথেকে দরকার। তবুও মানুষ এসব চুরি করে ফেলে দেয়।
জাফর সাহেব হসপিটাল থেকে ফিরে এসে রওয়ানা দিলেন গ্রীন লেকের উদ্দেশ্যে। তখন প্রায় অনেক রাত। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করছেন আর ভাবছেন মিতুর কথা। এত রাতে একা একটা মেয়ে কোথায় আছে, কি করছে তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। অবশেষে একটা সিএনজি আসলো, ভিতরে দুজন লোক বসা। তাদের পাশে বসে চললেন মেয়ের খোঁজে সেই গ্রীনলেকের গন্তব্যপথে। প্রায় আধঘণ্টা পর পৌঁছালেন সেই স্থানে। তখন প্রায় মধ্যরাত। আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেছে পুরো লেক। ঝোঁপগুলো যেনো ভৌতিক রূপ নিয়েছে। চারিদিক জনমানবশূন্য। একজন দুজন লোক দেখা যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। দিনের আলোতে এই লেক লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে, অথচ ঘনরাত্রিতে কারো দেখা পাওয়া দুষ্কর। কিছু লোক রাস্তার ফুটপাতে শুয়ে আছে, কারো মাথার নিচে ইট আবার কারো মাথার নিচে অন্য কিছু, কারো কিছুই নেই। তারা সবাই গভীর ঘুমে নিস্তব্ধ, ফুটপাতে থেকেও তারা শান্তির নিশ্বাসে ঘুমাচ্ছে। কাপড়ের অবস্থা দেখে বুঝা যায় তারা সবাই ভিক্ষুক। দিনভর ভিক্ষা করে আর রাতে শান্তির নিশ্বাসে ঘুমায়।
জাফর সাহেব শুয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে একে একে তাকিয়ে পথ চলতে লাগলেন। এদের মাঝেও মিতু শুয়ে থাকতে পারে অসহায়ের মত। রাস্তায় মাঝে মাঝে দু একটা বড় গাড়িও যাচ্ছে হুম হুম শব্দ করে। রাস্তার মাঝে একাকী হাঁটতে হাঁটতে তার পায়ে ব্যথা করছে। এই মধ্যরাতে তিনি কোথায় গিয়ে উঠবেন সেটা ভাবনায় আঘাত করছে। শহরে আসার পর থেকে নাদিয়া কতবার কল দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য এখন আর কল দিচ্ছেনা, ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। জানিয়ে দিয়েছে সকালে আসবে, কিন্তু এই রাত্রি কোথায় কাটাবে যদিও সময় বেশীক্ষণ নেই সকাল হওয়ার। জাফর সাহেব হাঁটতে হাঁটতে লেকটা পেরিয়ে এসেছেন। রাস্তায় এভাবে হাঁটা নিরাপদ নয়। যেকোন সময় চোর বাটপার এসে তার সবকিছু নিয়ে নিতে পারে, যদিও দুইটা ফোন আর কয়েক হাজার টাকা ছাড়া কিছুই পাবেনা তবুও জীবনের মায়া তো সবারই থাকে। লেক থেকে মোড় নিয়ে শহরের রাস্তা ধরেন জাফর সাহেব। এখান থেকে বিশ্বরোড প্রায় মাইখানেক দূরে। যদি হেঁটে যায় তাহলে ঘন্টা খানেক লাগবে। কিন্তু শহরে কি করবে, এত রাত্রিতে তো আর তার মেয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে না তার মতো। তাহলে অযথা না হেঁটে একটু বিশ্রাম নিলেই ভালো হয়। এই ভেবে রাস্তার মাঝে বিশ্রামের জায়গা খুঁজতে থাকে আর পথ চলতে থাকে। সামনে থেকে একটা পুলিশের গাড়ি আসছে। এত রাতে তারা পথে টহল দিচ্ছে। গাড়িটা তার সামনে এসে দাঁড়ালো, জাফর সাহেবও দাঁড়িয়ে যান। দুজন পুলিশ নেমে জিজ্ঞেস করছে এত রাত্রে রাস্তায় কি করে? সংক্ষেপে জবাব দিলো, কাউকে খুঁজছিলাম। মিথ্যা বলবেন না, কোথায় থেকে আসছেন বলুন, ভিতরে গিয়েছিলেন নাকি? পুলিশের এমন প্রতুত্তরে একটু ভড়কে গিয়েছিলেন জাফর জাহেব। ভিতরে মানে? কথাটা বলতেই মুখ বাড়িয়ে বললো, ভিতরে মানে বুঝেন না? দু’জন পুলিশের মাঝে অপরজন এতক্ষণ ঠাই দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু এখন বললো, ভদ্র মানুষেরা তো এতো রাতে রাস্তায় ঘুরাফিরা করে না। চলেন আমাদের সাথে। জাফর সাহেব একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন, আপনাদের সাথে কোথায় যাবো? আর কেন’ই বা যাবো? আমার মেয়ে নিখোঁজ। এরপর গাড়ি থেকে আরো দু’জন পুলিশ নেমে আসতে লাগলেন। দাঁড়িয়ে থাকা অপরজন পুলিশ বললেন, নিখোঁজ তো পুলিশ স্টেশনে ডায়েরি করবেন, এখানে কি? চলেন আমাদের সাথে।
জাফর সাহেব অনেক মিনতি করেও নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না। অবশেষে গাড়ি করে নিয়ে আসলো পুলিশ স্টেশনে। মেয়ে নিখোঁজ বলায় তারা মেয়ের ইতিবৃত্ত জানতে চাইলো। দারোগা তার সামনে বসিয়ে একে একে জিজ্ঞেস করলে লাগলেন মেয়েটির বর্ণনা। জাফর সাহেব ও বলতে লাগলেন, আরিফা জান্নাত মিতু, বয়স ষোল বৎসর, গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, পরনে সবুজ স্কুল ড্রেস, গ্রাম মায়াপুর। দারোগা মায়াপুর গ্রাম শুনে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, মায়াপুরেই থাকে? জাফর সাহেব উত্তর দিলেন। জ্বি স্যার। মায়াপুরেই থাকে। দারোগা কি যেনো ভাবতে লাগলেন, তারপর একজন কনস্টেবল কে বললেন, মেয়েটাকে নিয়ে আসো তো। কনস্টেবল মেয়েটাকে নিয়ে আসে। জাফর সাহেব দেখেন তার সামনে তার আদরের মেয়ে মিতু দাঁড়িয়ে আছে। যাকে খুঁজতে দিন রাত্রি করেছেন, জুতোর তলা ক্ষয়ে ফেলেছেন। মিতুর চোখে তখন পানি চলে আসে, এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে জাপটে ধরলো বাবাকে। তার বাবাও অশ্রু মুখে মেয়েকে জাপটে ধরে বলতে লাগলেন, “কোথায় ছিলি মা সারাদিন, তোর জন্য কত চিন্তা হচ্ছিল জানিস? কিভাবে পারলি আমাদের ছেড়ে আসতে” মিতুও তখন অনবরত কাঁদছিলো, “আমি কখনো তোমাদের ছেড়ে আসবো না বাবা, আমাকে ক্ষমা দাও, আমি আর কখনো আসবো না”
দারোগা সাহেব এমন অবস্থা দেখে হাসবেন কি কাঁদবেন বুঝতে পারলেন না। অতঃপর বলে উঠলেন, এবাব একটু থামেন। কাঁদার অনেক সময় পাবেন। সন্ধ্যাকালে এসেছিলো আপনার মেয়ে। ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিল আর কেউ নাকি তাকে খুঁজছে, নিজের মোবাইল টাও চুরি হয়ে গেছে। কালকে সকালেই গ্রামে পাঠিয়ে দিতাম কারো সাথে, ভাগ্য ভালো আপনি আসলেন। এখানে বসো মিতু আর বলো সারাদিন কি হয়েছে তোমার সাথে বলো, কেনো এসেছো এখানে? সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলো।
মিতু সব বলতে লাগলো,
প্রায় একমাস আগে মেহেদি নামে একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয় ফেসবুকে। তার সাথে নিয়মিত চ্যাট হতো। সপ্তাহ খানেক পর নাম্বার আদানপ্রদান হয়। এরপর প্রতিদিন কথা হতো ফোনে। মিতু তার প্রতি এতই দুর্বল হয়ে পড়ে যে তাকে ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করতে পারেনা। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সংসার বাধার। মিতুকে বলেছিল ছেলেটি মেডিকেলে পড়ে এবং তার মা, বাবাও মেডিকেলের ডাক্তার। প্রায় মাসখানেক পর মিতুকে বলে ঢাকায় ফিরে আসতে। সেখানে তারা বিয়ে করবে। মিতুর মেডিকেলে পড়ার শখ ছোটবেলা থেকেই। শহরে একই কলেজে ভর্তি হবে। তাই যা পারে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে। মিতুর একমাত্র ভালোবাসার মানুষ মেহেদিকে বিশ্বাস করে মায়ের জমানো সোমা এবং আলমিরাতে রাখা বিশ হাজার টাকা ব্যাগে লুকিয়ে রাখে। আরো কিছু নতুন কাপড়চোপড় ও ভরে রাখে। সকালে বান্ধবী কে খাতার অজুহাত দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। তারপর মনে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে রওয়ানা দেয় শহরের উদ্দেশ্যে। মেহেদি তাকে ঠিকানা দিয়েছিলো কিভাবে আসতে হবে। মেহেদি গ্রীণলেকেই অপেক্ষা করবে। কথামতো গাড়ি বদলে এসে পৌছায় গ্রীণলেকে। ছেলেটিকে যেমন ভেবেছিলো আর যেমন ছবি দিয়েছিলো ফেসবুকে তা থেকে সম্পূর্ণ অমিল। ছেলেটি দেখতে কালো, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। গায়ে একটা নোংরা শার্ট, পরনেও একটা পুরনো কালো প্যান্ট। একটু হতভম্ব হলেও কিছু জিজ্ঞেস করলোনা তাকে। অটো করে মিতুকে নিয়ে যায় একটা বস্তিতে। একটা ঘরে ঢুকে দরজা আটকিয়ে ভিতরে বসে। মিতুকে জিজ্ঞেস করলো কি কি এনেছে, মিতু শুধুমাত্র সোনার কথা স্বীকার করে। টাকার কথা গোপন রাখে। মিতুকে বললো, বিকেলে তারা বিকেলে যাবে কাজী অফিসে তাই কিছু টাকার প্রয়োজন। মিতুকে বলে সোনা বিক্রি করতে বের হবে কিছুক্ষণ পর। এরপর মিতুর কাছে একটা অবৈধ আবদার ছেয়ে বসে। মিতু রাজি হয়নি। তারপর একপ্রকার বাড়াবাড়ি হয়, তারপর ধস্তাধস্তি। কিন্তু মিতুকে কব্জা করতে পারেনি। মিতু একবারেই বলেছিলো, যা হবার সব বিয়ের পরেই হবে। অতঃপর মেহেদি মিতুর কাছে হেরে সোনাগুলি নিয়ে বের হয় ঘর থেকে এবং মিতুকে বলে যেনো ফিরে আসা পর্যন্ত কোথাও না বের হয়। মিতুকে চুপ করে বসে থাকে ঘরের ভিতর। মিতু নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো, যা আছে কপালে তাই হবে। কিছুক্ষণ পরেই তো স্বামী হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণ পর একটা কল আসে, কলটা মিতুর ফোনে নয়। মেহেদি তার ফোনটা ভুলে রেখে গিয়েছিল। মিতু কল রিসিভ করে, কিছুর বলার আগেই অপরপাশ থেকে এক মহিলা বলে উঠে, “মাইয়াটা কি আনচস? বিকেলের ভিতর অলিগঞ্জে নিয়া আয়, ভালো খদ্দের আইচে, মোটা অঙ্কের টাকা পাবি। মাইয়াডা কিন্তু ফ্রেশ চাই। কথা কস না ক্যা, হ্যালো, হ্যালো” মিতু নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। বুক ধুপ ধুপ করে উঠে।
দারোগা সাহেব মিতুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, অলিগঞ্জে পতিতালয় রয়েছে। নিশ্চয় তোমাকে ঐখানে বিক্রি করার জন্যই নিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা একজন পাচারকারী। আর নিশ্চিত যে সে সঠিক নাম বলেনি তোমাকে।
মিতুর কাছে সব পানির মত স্বচ্ছ পরিষ্কার হয়ে যায়। ছেলেটা ছিল বড় রকমের বাটপার। মিতুর কাছে এইমাত্র যে মহিলা কল দিয়েছিল তার নাম্বার নিজের ফোনে সেভ করে রাখে তারপর মেহেদির ফোনটা রাগে মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে। দেরি না করে বের হয়ে আসে ঘর থেকে। কারো না দেখার মত করে বের হয় বস্তি থেকে, কিন্তু অনেকেই তাকে দেখে ফেলে। মিতু কোন জায়গা চিনেনা, কোথায় যাবে সে একা। তার মনে পড়লো গ্রীণলেকের কথা, সেখানেই মিতুর সাথে মেহেদির দেখা হয়েছিল। একটা অটো ডেকে উপস্থিত হয় গ্রীণ লেকে। সেখানে এসে সে দিশা হারিয়ে ফেলে। কোনদিক দিয়ে এসেছিল ভুলেই গিয়েছে। তার মনে সংকোচ ও ছিল যে মেহেদি তাকে ধরে ফেলবে তাহলে সব শেষ। তারপর বাবার কথা মনে পড়ে, বাবাতো সবসময় আসতো শহরে। কল দিয়ে বললে নিশ্চয় এখানে আসবে। মিতু কল দেয় বাবাকে, কিন্তু কল রিসিভ করে তার মা। মাকে বলেছিল গ্রীণ লেকে আসতে। এই কথা বলতে না বলতেই একজন তার ফোন নিয়ে দৌড় দেয়। সবার নাম্বার ফোনে সেভ ছিলো, এখন চাইলেও বাবার সাথে যোগাযোগ করতে পারবেনা। মিতু অপেক্ষা করতে থাকে তার বাবার জন্য। কিন্তু এভাবে খোলামেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে মেহেদি তাকে খুঁজে বের করে ফেলবে আবার যদি লুকিয়ে থাকে তার বাবা তাকে খুঁজে পাবেনা। মিতু ভীষণ বিপদে পড়ে যায়। কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। অতঃপর মাথায় চিন্তা এলো, পুলিশ স্টেশনে গেলে নিশ্চয় তারা তাকে ঠিকানা মত পৌঁছে দিবে, আর বাবা খুঁজতে খুঁজতে না পেলে বাড়ি ফিরে আসবে তখন নিশ্চয় দেখা পাবে। অনেক্ষন অপেক্ষার পরও যখন বাবা আসছিলো না তখন সেখানের কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলো পুলিশের থানা কোথায়। তারপর থানায় হাজির হয়। কিন্তু ভাগ্যের বদৌলতে তার বাবাকেও পেয়ে যায়।
মিতুর বাবা জাফর সাহেব ও বললেন, শহরে আসার পর তার সাথে কি কি ঘটেছে। মিতুর ফোন থেকে মেহেদি নামের ছেলেটার নাম্বার দেওয়া হয় দারোগা সাহেব কে, যেনো দ্রুত ধরা হয় এই নারী পাচারকারীকে। পতিতালয় থেকে কল দেওয়া মহিলার নাম্বার ও দেয় যেন আঈন পতিতালয়ের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়।
সকাল বেলা মিতুর বাবা আবু জাফর সাহেব ও তার মেয়ে মিতু দুজনই গ্রামে ফিরে যান। মিতুকে এখন লজ্জা নিয়ে বাঁচতে হয়, পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে। জাফর সাহেবকেও লজ্জা নিয়ে থাকতে হয়, সমাজে তার একটা আধিপত্য ছিলো ; এখন আর নেই। তিনি বুঝতে পারলেন, মিতুকে এত অল্প বয়সে মোবাইল তুলে দেওয়া তার বড় রকমের ভুল ছিলো। মিতুর মা নাদিয়া ইসলাম সব লজ্জা ভুলে মেয়েকে অক্ষত অবস্থায় পেয়ে বেজায় খুশি। সর্বক্ষণ নজর রাখছেন, মেয়ের ব্যাপারে।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

১ Comment

  1. আফরোজা আক্তার ইতি

    আধুনিক প্রজন্মের বাস্তবতা নিয়ে একটি সুন্দরর গল্প লিখেছেন পড়ে খুব ভালো লাগলো। সোশিয়াল ওয়েবসাইটের ভালো ও খারাপ উভয়দিক থাকে। মিতুর ক্ষেত্রে খারাপটাই ঘটেছে। গল্পটি থেকে এখনকার প্রজন্ম অনেক কিছুই শিখতে পারবে।
    দুদিনে- দু’দিনে।
    গুজার- এমন কোন শব্দ আছে কিনা জানি না,থাকলে অর্থটা জানাবেন প্লিজ।
    সৃষ্টিকারী- সৃষ্টিকর্তা।
    জ্বল- জল।
    আন্তরিক শুভ কামনা রইল।

    Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *