তাসফি আহমেদ
রহমান সাহেব গম্ভীর দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। মিতু তখন নিচের দিকে তাকিয়ে এক মনে নাস্তা করে যাচ্ছিল। রহমান সাহেব ওর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকের চেয়েও বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তা কী সিদ্ধান্ত নিলি? ও বাড়িতে কবে যাচ্ছিস?”
মিতু এমন একটা ভাব করল যেন সে কথাটা শুনতেই পায় নি। বেশ স্বাভাবিক ভাবে নাস্তা করতে থাকল। রহমান সাহেব খানিকটা অপমান বোধ করলেন। অল্পতেই রেগে যাওয়ার মতো একটা বাজে অভ্যাস আছে উনার। তাই মিতুর দেওয়া এই ক্ষুদ্র অপমানে উনার রাগটা খানিকটা উৎসাহ নিয়ে বাড়তে থাকল। উনি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেন। বললেন,
“মিতু,আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”
মিতু বেশ স্বাভাবিক থাকল। শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এর উত্তর তোমার জানা আছে বাবা। খামখা বারবার জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“মানে কি? তুই কি সত্যিই ওই বাড়িতে যাবি না?”
“এক কথা কতবার বলব বলতো? আর তুমিওবা কেন বারবার জিজ্ঞেস করছো?”
“জিজ্ঞেস করব না? আমার মান সম্মানের ব্যাপার। তুই না গেলে যে আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।”
“তোমার সমাজে মুখ দেখানোটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর আমার উপর যে তারা রীতিমত অত্যাচার করে সেটা কিছুই না?”
“না,কিছুই না। শোন, এক হাতে তালি বাজে না।তোর দোষ না থাকলে কি তারা তোকে বিনা কারণেই বকাঝকা করে? তুই যে ধোয়া তুলসীপাতা সেটা আমি বুঝব কিভাবে?”
মিতুর অবাক হওয়ার সীমা থাকল না। সে অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো। হায়! কি বলছে এই মানুষটা? ইনি কি সত্যিই ওর বাবা? মিতু ভেবে পায় না। ওর চোখে জল জমতে থাকে। বুক কেঁপে উঠে। গলাটা ধরে আসে। কোনো মতে বলে,
“বাবা আমার উপর তোমার একটুও বিশ্বাস নেই? আমাকে তোমার বিশ্বাস হয় না?”
“বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছুই না। শশুড় বাড়িতে এমন ছোটখাটো সমস্যা হয়ই। তাই বলে যে একেবারে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হবে তা কিন্তু না। প্রব্লেম থাকবেই। সেটা মানিয়ে নিতে হবে। বুঝলি?”
মিতুর ভ্রু জোড়া কুচকে এলো।তার বাবার প্রতি এখন ঘৃণা হচ্ছে। রাগ হচ্ছে। অসহ্য লাগছে ওর। ও বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বুঝি নি। আর বুঝতেও চাই না। আমি অনেক মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আর না। এভাবে মানিয়ে নিয়ে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
“কোনো বাড়াবাড়ি হচ্ছে না। আমি যাচ্ছি না মানে যাচ্ছি না।”
“চুপ! চুপ থাক। তুই যাবি না বললেই কি হবে। আমার কথার কি দাম নেই? আমি কি আর তোকে এখানে রেখে দিবো? এতটা বোকা না আমি। কাল সকালেই তোকে দিয়ে আসব। দেখি তুই না যাস কিভাবে?”
“কাল দিয়ে আসবে কিভবে? আমিই তো থাকবো না।”
“মানে?”
” মানে কাল দিয়ে আসার জন্যে তুমি আমাকে পাবা না। আমি আজই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
“খবরদার বেশি বাড়াবাড়ি করবি না। এসব আমার একদমই পছন্দ না।”
মাঝ থেকে মিতুর মা রেহানা বেগম বলে উঠলেন,
“আহা! করছো কি? সকাল সকাল এই নিয়ে আলোচনা না করলে কি হতো না? নাস্তাটাও ঠিক মতো করতে পারছি না।”
রহমান সাহেব রাগত চেহারা নিয়ে বললেন,
“রেহানা,তোমার মেয়েকে বোঝাও। সে এখনো বাচ্চা না। বুঝার বয়স ওর হয়েছে। ”
মিতু কিছু বলতে যাবে ঠিক তার আগেই রেহানা বললেন,
“তা ও মন্দ কি বলছে? ওকে ও বাড়িতে পাঠাতে আমারও ইচ্ছে হচ্ছে না। শাশুড়িটা হয়েছে একটা।”
রহমান সাহেবের রাগটা একটু বাড়ল। উনি বেশ রাগি গলায় বললেন,
“ওও! তাহলে এই সব তোমার যুক্তি পরামর্শে হচ্ছে। তাই তো বলি,আমার এই মেয়ে এত সাহস পায় কই।তা তোমার কি আক্কেল জ্ঞান কিছুই নেই? মেয়েকে কি শেখাচ্ছো এসব?”
“কি আশ্চর্য, আমি আবার কি শেখালাম। না জেনে কথা বলবা না। আচ্ছা তোমার হয়েছেটা কি বলত? দিনদিন এত রুক্ষ হয়ে যাচ্ছো কেন?”
“বাবা তো তুমি হও নি। আমি হয়েছি। এই বড় দোষ আমার। বাইরের মানুষের মুখের কথা তো শুননি আজোও। শুনলে বুঝতে গায়ে কেমন লাগে।”
“তাই বলে কি মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দিবো নাকি?”
“আমি অতশত বুঝি না। ওকে যেতে বলছি ও যাবে। ব্যস!”
“না, ও যাবে না।”
কথাটা বলেই রেহানা খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন। আজ পর্যন্ত স্বামীর কথার পরে এক শব্দও করেন নি।অথচ আজ তর্ক করছেন? রহমান সাহেব চোখ গরম করে রেহানার দিকে তাকালেন। রেহানার কেন জানি একটু ভয়ও হলো না। মনের কোথা থেকে জানি অদম্য শক্তি পাচ্ছেন উনি। মেয়ের এমন প্রতিবাদ দেখে উনারও প্রতিবাদ করার ইচ্ছে জাগল। আর কতকাল এভাবে এমন অন্যায় সহ্য করা যায়। দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“মিতু ওই বাড়িতে যাবে না। এটা আমি বলেছি,ও যাবে না।”
এই বলে উনি মেয়ের দিকে তাকালেন। মিতু তখন অবাক নয়নে মাকে দেখছে। রহমান সাহেবের গলা ধারালো হয়ে এলো। বললেন,
“তুমি বললেই হবে নাকি? আর তুমি বলার কে? ”
“আমি ওর মা।”
“রাখো তোমার মা। মা-ই হয়েছে। আর তো কিছু করতে পারো নি। দু’বেলা রান্না করে এমন ভাব কর যেন রাজ কার্য সম্পাদন করেছো। এই রান্না ছাড়া আর কিইবা পারো।”
রেহানাও তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,
“তা কিছু করতে দিয়েছো কি তুমি? তোমার মা দিয়েছে? আমি চাই না আমার মতো আমার মেয়েটাও ভুল করে বসুক।নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলুক। আমি চাই আমার মেয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। আমার মতো দাসী হয়ে থাকবে এটা আমি চাই না।”
রহমান সাহেবের গলা ক্রমশ ধারালো হতে থাকল। উনি চোখ-মুখ আগুন করে রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“”আমি তোকে দাসীর মতো রাখছি?”
‘তা নয়ত কি? এই যে এখন, এখন আমার কথার দাম দিলে। আর কোনো দিন দাম দিয়েছ? পারো তো কেবল তুই তুকারি করতে।এছাড়া আর পারো কি? ভালো ব্যবহার তো শেখায় নি তোমার মা।”
“রেহানা,বেশি বাড় বেড়ে যাচ্ছিস কিন্তু। আমাকে চিনিস না। এই বয়সে তোকে ডিবোর্স দিতে হাত কাঁপবে না আমার।”
“এর অপেক্ষায় তো আমি ছিলাম। দাও ডিবোর্স। তোমার মতো নরপিশাচ থেকে মুক্তি পেতে চাই আমি। একে তো আমার জীবন নরক বানালে। এখন আমার মেয়ের জীবন নিয়ে খেলছো? এত সহজ না। মেয়ের বেলায় আমি সহজ থাকব না।”
“আমি নরপিশাচ? আমি নরপিশাচ? ”
“তা নয়তো কি? ধোয়া তুলসী পাতা? ”
রেহানার কথা বলার ভঙ্গি একদমই ভালো লাগে নিই রহমান সাহেবের। এমন ভাবে বলে যেন গায়ে লেগে যায়। গা যেন জ্বলে যায়। উনার রাগ বাড়ল এতে। তা সীমা অতিক্রম করল দ্রুত। উনার সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেল। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলেন না আর। উঠে দাঁড়িয়ে রেহানাকে মারার জন্যে হাত এগিয়ে নেন। কিন্তু মাঝ পথেই মিতু বাবার হাত ধরে ফেলে। বলে,
“মেয়েদের মারার দিন শেষ। এখন আর আগের সেই যুগ নেই যে পড়ে পড়ে পুরুষের হাতে মার খাবে। এখন প্রতিবাদ করার যুগ।মার খাওয়ার না। খবরদার যদি আর হাত উঠাবে মায়ের উপর। এর ফল ভালো হবে না কিন্তু। ”
“তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস। কি করবি তুই? আমার নামে মামলা করবি?”
মিতু মায়ের কাছে আসল। রেহানা বেগম তখন কান্না করছিলেন। ও মাকে ধরে উঠাতে উঠাতে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রয়োজনে তাই করবো। নারী মামলা কিন্তু বাজে জিনিস। খেয়াল রেখো।”
রহমান সাহেব কিছুই বলতে পারলেন। রাগে তার সমস্ত শরীর যেন ফেটে যাচ্ছিল। উনি চোখ-মুখ লাল করে, ভ্রু কুচকে মেয়ে আর মায়ের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কিছুদূর গিয়ে মিতু ফিরে তাকিয়ে বলে,
“আমার না মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। তুমি কি আসলেই আমার বাবা? এত নিষ্ঠুর হও কিভাবে? ”
“চুপ কর। চুপচাপ রুমে যা। তোদের চেহারা দেখে রাগ হয় আমার। আমাকে রাগাবি না আর। তা না হলে তোদের দুটোকে এখানেই খুন করে ফেলব।”
মিতু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসল। বলল,
“খুন করতে হবে না। আমাদের চেহারাও দেখতে হবে না। আমরা আর থাকছি না এখানে।”
এই বলে মিতু রুমে চলে গেল। পিছন থেকে কিছু একটা ভেঙ্গে যাওয়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। রহমান সাহেব গ্লাসটা নিয়ে সজোরে ফ্লোর আছাড় দিলেন। নাস্তার প্লেট ছুড়ে মারলে দেয়ালে। তার রাগ হচ্ছে ভীষণ। রাগের চোটে গায়ের চামড়া ছিড়ে আসতে চায়।
চায়।
.
শেষপর্যন্ত মিতু এবং তার মা রহমান সাহেবের বাসা ত্যাগ করলেন। রহমান সাহেব কিছু বললেন না। উনি এটা নিয়ে খুব একটা ভাবলেনও না। কোনো গুরুত্বই দেন নিই। খুব সাধারন ভাবে নিলেন। গেছে যাক। আবার তো ফিরে আসবেই। কই যাবে আর। মোল্লার দৌড় মসজিদে পর্যন্তই। কিন্তু তিনি তখনও জানতে না যে তিনি কত বড় একটা ভুল ভাবনা নিয়ে থাকছেন। মিতুরা আর আসল না। এক মাস পেরিয়ে গেলেও আসল না। রহমান সাহেবের চিন্তার শেষ থাকল না। তার দিনকাল কাটে প্রচণ্ড একাকিত্বে। দাম্ভিকতার কারণে নিজের ভুলের জন্যে ক্ষমাও চাইতে পারছেন না। তবে নিজের ভুল তিনি বেশ ধরতে পেরেছেন।এমন ব্যবহার তার একদমই উচিত হয় নি। অন্ধকার ঘরের কোণে পড়ে থাকেন আজকাল। উনার দিনকাল আসলেই ভালো যাচ্ছে না।
.
মিতু আজকাল মাথা উঁচু করে, বেশ স্বাধীন ভাবে চলা ফেরা করছে। বেশ ক’টা টিউশনি করায়। কাল একটা চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসেছে সে। পরিক্ষা ভালোই হয়েছে। এবার আল্লাহ যদি কপালে রাখে। মিতু বেশ শিক্ষিত মেয়ে। মাস্টার্স কম্পলিট করেছে। রেজাল্ট ভালো। চাকরি করার প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল ওর। বাবা দেয় নি। জোর করে বিয়ে দিয়েছে। জামাই ভালো জব করে। ব্যস! এই হলো। বাবাকে রোখায় কে? কিন্তু বাবা জানত না যে তাদের পরিবারের মানুষ গুলো একদমই ভালো হয়। খোঁচা মেরে কথা বলে বেশি। যেটা একদমই সহ্য হয় না ওর। অহেতুক খোঁচা কার ভালো লাগে? ঘরের বাকি বউদের থেকে মিতু একটু বেশি শিক্ষিত। এই হিংসায় তারা বাঁচে না। মেয়েদের এই একটা সমস্যা। এক মেয়ে আরেক মেয়ের ভালো একদমই সহ্য করতে পারে না।তাই তারা মিতুকে হেরাজ করার চেষ্টায় লেগে থাকে। কাজ করায় বেশি। ওর শাশুড়ি ওকে একটু বেশি বকাঝকা করত। মাঝে মাঝে তার রাগ উঠলে মিতুর চুল টেনে দিতো। মিতু অবশ্য রান্নাটা খুব একটা পারে না। মিতুর এই দূর্বলতার সুযোগ নিতো ঘরের বাকি দুই বউ। আর সামান্য খুঁত পেলেই শাশুড়ি রেগেমেগে একাকার। এসব একদমই ভালো লাগত না ওর। ওর স্বামী সোহেলকে বললে সে উল্টো মিতুর দোষ দিতো। মিতু অবাক হয়,এই যুগে এমন ছেলে এখনো আছে? এসব কারণে মিতুর সংসার বেশি দিন টেকে নি। ও চলে এসেছে। এখন কেবল ডিবোর্স বাকি। এর মাঝে সোহেল ফোন তো দূরে থাক একটা মেসেজও দেয় নিই। এটা দেখে রেগে গিয়ে সোহেলকে
সকল যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ব্লক দেয় মিতু। আর কিছুদিন যাক। তারপর উকিল ডেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ডিবোর্স নিবে ও।
.
মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। রেহানা বেগম দু’কাপ চা হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন ওর দিকে।
“নে। চা নে।”
মিতু চা নিল। কিছু বলল না। রেহানা মনে হয় বুঝতে পারলেন। বললেন,
“কিরে? বাবার জন্যে মন খারাপ লাগছে?”
মিতু ফ্যাকাশে হাসি দিল। বলল,
“মনটা কি অদ্ভুত তাই না। মানুষটা এত খারাপ ব্যবহার করার পরেও তার জন্যে খারাপ লাগা ছড়াচ্ছে মনে। বারবার তার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আচ্ছা মা, বাবা এমন কেন বলত?”
“তোর বাবার রাগটা একটু বেশি। তবে ইদানীং কি জানি হয়েছে। কে কি বলেছে হয়তো। সে আবার কান কথায় বিশ্বাসি। তাই… ”
কলিংবেল বেজে উঠল। মিতুর মা আর বলতে পারলেন না। তিনি চায়ের মগ রেখে দেখতে গেলেন কে এসেছে। মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুসময় বাদে মিতুর মা আবার ফিরে এলেন। তার মুখটা ফ্যাকাশে। কেমন জানি। মিতু মায়ের দিকে তাকাল। সে দেখল তার মা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। ও ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কি হয়েছে? কে এসেছে?”
উনি আমতা আমতা করতে করতে বললেন,
“ইয়ে মানে সোহেল এসেছে। তোর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে ও।”
মিতুর ভ্রু জোড়া কুচকে এল এবার। মুখে বিরক্তি এসে লেপ্টা যেতে থাকল। বলল,
“তাকে চা নাস্তা দিয়ে বিদায় কর। আর বলবে যে আমি ডিবোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো।”
রেহানা গেলেন না। দাঁড়িয়ে থাকলেন সেই অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে। তা দেখে মিতু বলল,
“কি হলো? যাও?”
“বলছিলাম কি…”
“মা!”
মিতু চোখ গরম করল। রেহানা আর দাঁড়ালেন না।উনি যেতেই মিতুর মাঝে একটা ভাবনা এসে জড়ো হলো। এই বাসার খবর সোহেল পেল কিভাবে? এটার খবর তো কেউ খুব একটা জানে না। তাহলে? ও হ্যাঁ ওর মামার কাছ থেকে জানতে পারে। উনিই এই বাসাটা খুঁজে দিয়েছেন ওদের। তা সোহেল মামার কাছে গিয়ে খবর নিলো? মিতুর বিশ্বাস হচ্ছিল না ব্যাপারটা। কারো বোজা হওয়ার ইচ্ছে মিতুর কোনো কালেই ছিল না। তাই প্রথম গিয়ে মামার বাড়ি উঠতেই বড় মামাকে বলে দিয়েছে বাসা খুঁজতে। বড় মামা নিষেধ করলেও মিতুর জেদের কাছে হার মানতে হয়। তবে ওদের ক’মাস থাকতে হয় ওখানে। সব কিছু বললেই তো আর হয়ে যায় না!
মিতুর মা আবার ফিরে এলেন। জানালেন,
“সোহেল তোর সাথে কথা না বলে কোনো মতেই যাবে না। আমি বুঝিয়েছি অনেক। তারপরেও না।কি করি বলতো?”
মিতুর রাগ হলো। বলল,
“তুমি যাও। গিয়ে বল যে ও না গেলে আমি সুইসাইড করবো।”
“মানে কি?”
“মা যাও তো। কথা প্যাঁচিও না।”
উনি চলে গেলেন। যাওয়ার পরই মিতু ঠাশ করে নিজের রুমের দরজাটা লাগিয়ে দেয়। রেহানার বুকটা কেঁপে উঠল। সত্যি কি কিছু করে বসবে ও? সোহেলকে দেখে মায়া হলো রেহানার। বেচারার চেহারার কি বাজে অবস্থা। চোখ যেন খাদে ঢুকে গেছে। চোখের নিচে জমে থাকা কষ্ট স্পষ্ট জানান দিচ্ছে যে সে ভালো নেই। কারো শোকে সে অধিক কাতর। সোহেল যাওয়ার সময় বলল,
“মা,প্লিজ আপনি একটু ওকে বুঝিয়েন। আমি আসলে ভুল করে ফেলেছি। ওকে বুঝতে একটু সময় লেগে যায় আমার। আর মাও ঠিক বুঝে যায় যে উনি অন্যায় করেছেন। আমাদেরকে প্লিজ একবার নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিন। কেবল একবার।”
রেহানা কিছু বললেন না। চুপ করে থাকলেন। সোহেল হতাশ হয়ে বিদায় নিল।
.
মিতু জানালার পর্দা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করল। সোহেলকে দেখার চেষ্টা। নিজের মনকে কোনো ভাবেই মানাতে পারছে না। এই অবাধ্য মন বারবার সেই অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসটার দিকে আকর্ষিত হয়। কি এক অদ্ভুত টান কাজ করে। যে টান মিতু কোনো ভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না। সোহেলকে দেখার কোনো মানেই নেই। তবুও এই মন বারবার দেখতে চাচ্ছে। এই তো দেখা যাচ্ছে ওকে। মিতু জানালার পর্দা আরেকটু সরিয়ে দিল।ব্লু শার্টটা পরেছে আজ। সাথে জিন্সের প্যান্ট। সোহেল কিছুদূর গিয়ে থামল। মিতুর রুমের বারান্দার দিকে তাকালো। সোহেলের করুন মুখটা দেখতেই বুক কেঁপে উঠল ও। গা সিরসির করতে থাকল। বুকের ভেতর চাপা একটা ব্যাথা অনুভব হলো ওর। হায়! এ কি অবস্থা ছেলেটার? এমন ফুটফুটে ছেলেটা এত রোগা হয়ে গেল কিভাবে? মিতু বুঝে উঠতে পারল না। তার চোখে জল জমতে থাকল দ্রুও।অদ্ভুত এক কারণে জল আসছে ওর চোখে। অথচ এই জল আসাটা একেবারেই অযৌক্তিক। মিতু দেখল সোহেলের চোখটাও চিকচিক করছে। তিন তলার এই জানালাটা থেকে তা স্পষ্ট দেখতে পেল মিতু। দ্রুত জানালার পাশ থেকে সরে দাঁড়াল সে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কি অদ্ভুত বেদনা হচ্ছিল ওর ভেতরে। কিসের সেই বেদনা,কিসের সেই টান কিছুই বুঝে উঠল না মিতু। অনেক দিন পর মানুষটাকে এভাবে দেখে ও মিতুর কেন জানি কষ্ট হচ্ছিল। অসহনীয় কষ্ট। সে বসে বসে কান্নার মাধ্যমে সেই কষ্ট নিবারণ করার চেষ্টা করল। রেহানা বেগম দরজার ওপাশ থেকেই টের পেলেন মেয়ে কান্না করছে। তাই তিনি আর তাকে ডাকলেন না। কাদুক মেয়েটা। কিছু কষ্ট ঝরুক।
.
মিতু আবারও পিছর ফিরে তাকালো। কিন্তু কোথাও সোহেলের দেখা পেল না ও। আশ্চর্য! ছেলেটা কি আজ আসবে না? কয়েক সপ্তাহ হলো মিতু নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে।
চাকরিটা হবে বলে ওর আশা ছিল না। বেশ কিছু দিন হলো কোনো রেসপন্স পায় নি। তারপর একদিন হঠাৎ করেই একটা চিঠি আসে। সাদা খামে মোড়ানো একটা সোনার হরিন ছিল সেই চিঠির সাথে। এপয়েন্টম্যান্ট লেটার হাতে পাওয়ার পর মিতু এবং তার মা দুজনেই কেঁদে দিলো। কি অদ্ভুত সুখের কান্না ছিল সেটা। এর মাঝে সোহেলের জ্বলানো বেড়ে গিয়েছিল। সে দিন কিংবা রাতে এসে এই বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। মিতুর রুমের বারান্দার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মিতুর ব্যাপারটা ভালো লাগলেও সে চায় না এই ব্যাপারটা চূড়ান্ত ভাবে ওর ভালো লেগে যাক। ওর ওই ঘরে ফিরে যেতে একদমই ইচ্ছে হয় না। মাঝে মাঝে কি একটা অস্বস্তি শুরু হয় ওর মাঝে। দোটানায় পড়ে যায়। একবার মন গলে তো পরেরবার সেটা শক্ত পাথর হয়ে যায়। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যে কি করবে। সোহেলর জ্বালানোটা তীব্র আকার ধারণ করে তখন যখন মিতু অফিসের জন্যে বাসা থেকে বের হয়। পিছু পিছু হাঁটে ওর। আর কথা বলার বাহান খোঁজে। মিতু তাকে সুযোগ দেয় না। তবুও পিছন পিছন আসে। আজও আসত। তবে না আসার পিছনে মূল কারণ হলো মিতু নিজেই। কাল একগাদা লোকের সামনে ছেলেটাকে বড্ড বেশি বকে ফেলেছে ও। চড় দেওয়ার জন্যে হাত উঠিয়েছে।সোহেলের করুন মুখটা দেখে মায়া হলো ওর। তাই চড় দেয় নি। তবে অনেক বকেছে । সোহেল তা মাথা নিচু করে শুনে গেলো।একটু প্রতিবাদও করল না। কালকের কথা মনে পড়তেই মিতুর বুক কেঁপে উঠল। নাহ! একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে এটা। কাজটা মোটেও ঠিক হয় নি। নিশ্চয়ই ও খুব কষ্ট পেয়েছে। তাই আজ আর আসছে না। কিন্তু ও না এলে মিতুর কি হবে? যদি আর না-ই আসে তাহলে? কথাটা মনে হতেই মিতুর দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। তার মনে হলো সোহেলকে না দেখে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া আরো সহস্র গুনে ভালো। সারাটা দিন গেল ভীষণ টেনশনে। কাজে একদমই মন বসে নিই। কোনো মতে বিকেল হতেই বাড়ির পথ ধরল ও। সোহেলের সাথে কথা বলার দরকার খুব। খুব দরকার। ডিবোর্সের না ভালোবাসার কথা বলা দরকার। কিন্তু বাসায় আসতেই ওকে অন্য কিছু দেখতে হলো। দেখল, সোহেলের আম্মু মলিন মুখে ড্রইংরুমের একটা চেয়ারে বসে আছে। প্লাস্টিকের চেয়ার। সোফার ব্যবস্থা এখনো হয় নিই। উনার এমন চাহনি দেখে মিতুর মনটা অস্থির হয়ে উঠল। সে কোনো মতে সালাম দিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেই ওর শাশুড়ি বললেন,
“মা,তোমার সাথে দুটো কথা বলা যাবে?”
মিতু ফ্যাকাশে হাসি দিল। বলল,
“জ্বী বলুন।”
“প্রথম থেকেই বলি। শোনো,আসলে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনে আসছি যে আজকালকার বউরা নাকি বাসার কাজ করে না। এরা বিয়ে করে আলাদা থাকার চেষ্টা।এই বিকৃত ধারণটা ওদের কাছ থেকেই পাই। তারা এও বলে যে বউকে ধমকের উপর রাখতে হয়। যেন ভয় পায়। আমিও তাই করা শুরু করি। মোটামুটি বড় বউ এবং মেজো বউ হাতের মুঠোয় চলে আসে। কিন্তু তোমাকে বসে আনতে পারি নি আমি। এই একটা রাগ আমার ছিল তোমার উপর। এদিকে তোমাকে পেয়ে যে বড় বউ আর মেজো বউ তোমার সাথে এমন মারাত্মক ব্যবহার করবে সেটা আমার জানা ছিল না। তারা তোমার সাথে কি করেছে সেটাও আমি জানি না। অল্প শুনেছি পারবিনের কাছ থেকে যে আমাদের ঘর মোছার কাজ করে। সেদিন সে বলল যে,” আপনাগো ছুডু বউডা আসলেই ভালো ছিল। খালা, আপনে যে কেমনে হেরে যাইতে দিলেন! হের মতো মানুষ হয়? হে যদি একবার মুখ খুলত তাইলে আপনের ঘরে আগুন লাইগা যাইত।” এসব বলে সে খানিকক্ষণ আমাকে বোঝাল। আমাকে বোঝাল যে কিভাবে আমার বড় বউ আর মেজো বউ তোমার হাতে কাজ করিয়ে আবার তোমাকেই বকা খাইয়েছে। লএসব ওই টিভি দেইখা শিখে এরা। খেয়ে পরে আর কোনো কাজ নাই তো তাই এসব করে। তবে শোনো, তুমি যাওয়ার পর আমার ছোট ছেলেটা কেমন জানি হয়ে যায়। কেমন উদাসীন ভাব। আমি আগে বুঝতে পারি নিই। কাল রাতে যখন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল তখন কেবল তোমার নাম নিয়েছে সে। কেবল তোমাকে ডেকেছে। বিশ্বাস করবে না আমি যা অবাক হয়েছি! আমি ভেবেছি ও তোমাকে ভুলেই গিয়েছে। কি চাপা স্বভাবের ছেলে দেখছো! তা সে জ্বর আর কমে নিই। সকালেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।”
মিতুর ভ্রু জোড়া কুচকে আসে এবার। খানিকটা চিৎকার দিয়ে বলে,
“কিহ?”
“হ্যাঁ রে মা। তাই। ওর অবস্থা খারাপ দেখে তোমার কাছে আসছি। আসছি দুটো কারণে। প্রথম, তোমার কাছ থেকে ক্ষমা চাইব,আর দ্বিতীয় ছিল তোমাকে খবরটা দিতে। আমার মনে হয় তুমি গেলে ছেলেটা সুস্থা হয়ে উঠবে।”
শাশুড়ি কি বলছে সেটা কানে যাচ্ছে না মিতুর। সে খানিকটা ঘোরের মাঝে চলে গেছে। নিজেকে বারবার দোষি মনে হচ্ছে ওর। বারবার মনে হচ্ছে এমন ব্যবহার না করলেও হতো।
.
সোহেলের কেবিনে ঢুকতেই দেখল ছেলেটা কেমন মায়া মায়া চেহারা নিয়ে,বাচ্চা শিশুর মতো শুয়ে আছে। দেখতে কেমন জানি সুন্দর দেখাচ্ছে। মিতু কাছে যেতেই সোহেল চোখ মেলল। তারপর মৃদু হাসল। কি অমায়িক সেই হাসি! মিতুর বুকে কাঁপন ধরে। এত সুন্দর করে কেন হাসে ছেলেটা। মিতু বসতে বসতে বলল,
“কেমন আছো?”
সোহেল একটা প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। বলল,
“উফফ!যাক! এতদিন পর তোমার কোমল কন্ঠ শুনতে পেলাম।”
মিতুর কেন জানি খারাপ লাগতে
থাকল। কালকের ব্যাপারটা নিয়ে সে আসলেই অনেক দুঃখবোধ করছে। এটা সোহেলকে জানাতে হবে। মিতু আমতা আমতা করতে করতে বলল,
“আসলে,মানে…”
সোহেল চট করেই বলল,
“বুঝছি বুঝছি। বলতে হবে না। আমি তোমার জায়গায় থাকলে সেই একই কাজ করতাম। এটাই স্বাভাবিক। ”
এই বলে থামল ও। মিতু তখন এক দৃষ্টিততে সোহেলকে দেখছিল। সোহেল দুষ্টুমি ভরা দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তা আজ কি আমায় খুব মিস করছিলে?”
মিতুর লজ্জা পেলো ভীষণ। সে লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। তারপর মাথা উপর নিচ করে সায় দিল। সোহেল তা দেখে হাসতে থাকল। তারপর আলতো করে মিতুর হাত ধরল। নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
“একটা কথা বলি, রাখবে?”
মিতুর লজ্জা তখনো কাটে নিই। তাই ছোট্ট একটি শব্দ করে সায় দিল। বলল,
“হ্যাঁ।”
“তোমার বাবাকে ক্ষমা করে দাও। মানুষটা খুব কষ্ট পাচ্ছে।”
মিতু চট করেই মাথা তুলে তাকালো তার স্বামীর দিকে। তার বুকটা যেন খুব দ্রুত কাঁপতে থাকল। অদ্ভুত একটা কষ্ট অবুভূত হলো ওর। যে কষ্ট কেবল বাবার বুকে মাথা রেখেই নিবারণ করা যায়।সোহেল বলল,
“প্লিজ। ”
মিতু দ্রুত বলল,
“বাবা কই?”
“ওই তো।”
মিতু তাকালো সেদিকে। দেখল তার বাবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে মা। মা কাঁদছেন। বাবার চেহারা আগের মতো নেই। একদম পাল্টে গেছে। চোখের নিচে কষ্ট জমাট বেঁধে আছে। মিতু অপেক্ষা করল না। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। রহমান সাহেব তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন।মিতুও। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মা-ও। রহমান সাহেব কোনো মতে বললেন,
“মারে, তুই দেখিয়ে দিয়েছিস মেয়েরা কি না করতে পারে। কারো সামনে মাথা নত করিস না। মাথা উঁচু করে চলেছিস। এখানেই তো একজন বাবার গর্ব। তোকে দেখে শেখার আছে রে মা, অনেক শেখার আছে।”
মিতু কিছু বলল না। সে বাবার বুকে লুকিয়ে থাকল। তার ভালো লাগছে এখন। মনের এক কোণে যে লুকায়িত কষ্ট ছিল সেটা এখন অনুভব হয়। এখন কেবল আনন্দ অনুভব হয়। কেবল আনন্দ।
কিভবে — কীভাবে
শাশুড়ি — শ্বাশুড়ি
পরিক্ষা — পরীক্ষা
— নি সবসময় শব্দের সাথে যুক্ত থাকে। যেমন- যায়নি, করেননি, খাননি ইত্যাদি।
মিতুর জীবনের ঘটনাগুলোকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। এর ফলেই আপনার গল্পের সার্থকতা ফুটে উঠেছে।
শুভ কামনা।