মাহবুবা শাওলিন স্বপ্নীল
রাতটা পার হলে নতুন দিন। বিশেষ দিন বলা যায়। ছোটবেলায় ‘আমার বিয়ে’ বলে চেঁচাতাম। মা শুনলে ধমকাতো। ভাবতাম বিয়ে বোধহয় শুধু মা’দের জন্য। ছেলেমেয়েরা বললে অপরাধ হয়।
বিয়ে সম্পর্কে মোটামুটি জানতে পারলাম পারু দি’র কাছে। লম্বা করে শ্যামলা, ছিপছিপে দেহ ছিল, বড় মামার মেয়ে। পারু দি’রও বিয়ে হয়ে যায়।
আজকের রাতটায় আমার ভীষণ খুশি হওয়ার কথা। আমি অখুশি নই। তবে ভীষণ খুশি তো সেদিন-ই প্রথম হয়েছিলাম। মুহূর্তটা ভুলবোনা।
আমি ভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। মেঘে মেঘে সম্ভবত ঝগড়া হয়েছিল সেদিন। নয়তো হেমন্তের ওই অবেলায় কেঁদে বৃষ্টি নামাবে কেন! বাইরে দেখছিলাম। একটা রিকশা স্কুল পড়ুয়া কোনো মেয়ের গায়ে কাদাপানি ছিটিয়ে চলে গেল। বোধহয় মেয়েটার চেয়ে রিকশাওয়ালার বাড়ি ফেরার তাড়া বেশি ছিল।
বাসের ভেতর চোখ ফেরালাম। কর্মব্যস্ততায় ডুবে থাকা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের দেখলেই বোঝা যায় বৃষ্টি কতটা অভিশাপ। একটা ছেলে অনেকটা কাকভেজা হয়ে বাসে উঠলো। সবার চোখ ছেলেটার দিকে। হাতে কিছু জরুরী কাগজের ফাইল ছিল। বারবার সেটা মুছছিল।
চোখে চশমা। ভিজে চুপসে যাওয়া চুল। শার্টের নিচটা দিয়ে ফাইল মোছার দৃশ্য! কেমন বোকা বোকা লাগছিল! আমি বলেই বসলাম,
“নিন, রুমালটা দিয়ে মুছতে পারেন
তাকালো ছেলেটা। বাসে উঠা সে অস্থির ছেলের সাথে এই তাকানোর মিল নেই। শান্ত, স্নিগ্ধ চাহনি। মনে হচ্ছিল পৃথিবী থেমে গেছে ছেলেটার স্থির চোখের সাথে।”
“বলছি রুমালটা নিতে পারেন। আপনার শার্টটাও ভেজা। দেখে মনে হচ্ছে ফাইলটা মোছা আপনার জন্য জরুরী।”
“হুঁ”
ব্যাস এইটুকুই! একটু তাড়াও দেখলাম না তার মাঝে!আমিই আবার বললাম,
“আপনি চশমা’র গ্লাসটা মুছুন, ভেজা গ্লাস, ঝাপসা লাগার কথা।”
“হুঁ”
“ইন্টারভিউ ছিল?”
“হুঁ”
“দিয়েছেন?”
“হুঁ”
“আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন।”
“হুঁ”
“মেয়েদের দিকে তাকাতে লজ্জা পান?”
“আপনার টিপ সরে গেছে।”
“জানি। একটু এদিক সেদিক করে টিপ পরার অভ্যাস আমার।”
“আচ্ছা”
“অবাক হলেন না?”
“হয়েছি।”
“আপনার এক্সপ্রেশন দেখে সেটা মনে হচ্ছেনা। ইচ্ছে করে অবাক না হওয়ার ভান করছেন? আমায় ইমপ্রেস করার জন্য?”
“সেটা তো আপনি আমায় করার চেষ্টা করছেন।”
“রুমাল দিয়েছি বলে?”
“আপনার আচরণে বোঝা যাচ্ছে।”
“আর কিছু বুঝতে পারছেন?”
“আমাকে আপনার ভালো লেগেছে।”
“ভালো বোঝেন। আপনি সবসময় এরকম গম্ভীরভাবে কথা বলেন? স্বলভাষী? কম কথা বলা লোকেরা ভীষণ রাগী হয়। আপনি রাগী?”
“না। আপনি রাগী।”
“কিভাবে বুঝলেন? সিক্সথ সেন্স?”
“না।”
“আমার মনে হচ্ছে আপনি ভাব নিচ্ছেন। ভাব আমার অপছন্দ।”
“আপনার দাঁত একটার উপর আরেকটা উঠে গেছে।”
“জানি সেটা। ছোটবেলায় ভয়ের কারণে ফেলিনি বলে। তো? সমস্যা?”
“এরকম মেয়েদের হাসি অসম্ভব সুন্দর হয়।”
“আমার নয়। আপনি আমার প্রশংসা করতে চাইছেন?”
“আপনি পৃথিবীর সেরা সুহাসিনী’র একজন।”
“এর আগে সুন্দর হাসি দেখেন নি হয়তো। নেমে যাবেন?”
“হুঁ, আপনি?”
“আমি সামনেই নামবো।”
“হুঁ”
“হুঁ হুঁ করছেন কেন? নামুন।”
“টিপটা ঠিক করুন। ঢের ভালো লাগবে।”
“ধন্যবাদ পাওনা থাকলেন প্রশংসার জন্য। আমি তিশা।”
“আসি।”
সেদিন ছেলেটার নাম জানা হয়নি। কিছু কিছু সময় আমরা গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা। কিছু করার সবচেয়ে সহজ উপায়টা ভুলে যাই, গড়মিল করে ফেলি। সেই মুহূর্তটা হয়তো কোনো বিপদের মুহূর্ত নয়তো প্রেমে পড়ার।
পরিচয়টা হয় পরেরবার যখন বাবার সাথে ওকে ড্রয়িং রুমে বসে দাবা খেলতে দেখি। বিস্ময়, শঙ্কা নাকি ঘোর, বুঝে উঠার আগেই বাবা সমাধান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বাবার ছাত্র ছিল। নাম শিমুল। সেই একজোড়া চোখে সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো চোখ রেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, এই ভদ্রলোককে আমার চাই। হয়তো তিনিও বুঝেছিলেন, হয়তো তারও ভেতরটা আষাঢ়ের আকাশের মতো বিজলী খেলে গিয়ে প্রেমবর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছিল।
সেদিনের পর কত হেমন্ত পার হয়েছে। ভালোলাগা, ভালোবাসা, প্রেম! সবকিছুই হচ্ছিল অঘোষিত নিয়মে। কেউ কাউকে কখনো মুখে বলার প্রয়োজন মনে করিনি। ছায়া হয়ে ছিল মানুষটা।
শিমুল ভাই বলেন, কোনো প্রেমিক প্রেমিকা’র সম্পর্ক সবচেয়ে সুন্দর হয় যখন তাদের মাঝে নিখুঁত বন্ধুত্ব থাকে। স্বলভাষী মানুষটা কথা খুব কম বললেও যে ক’টা বলতেন, আমার হৃদয়ে গেঁথে যেত।
আমার অতীত স্মৃতিচারণ থেকে সীমু এসে বর্তমানে ফিরালো। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, “আপু, ওই লোকটা, ওই যে শিমুল ভাইয়া এসেছিল আজ, চিঠিটা দিয়ে গেছে।” কিছু বুঝে উঠার আগেই ও দৌড়ে বের হয়ে গেল। বুঝেছিলাম চিঠিটা সীমু পড়েছে। কিছুটা ভয় আর প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে চিঠি খুললাম,
নীলিমা,
চমকাবেনা। নামটা তোমার বাবার কাছে শোনা। তিশা ছাড়া তোমার আরেকটা নাম আছে জানতাম না। নীলিমা নামটা সুন্দর। নীল রং এর আভার মতো তোমার চেহারায় স্নিগ্ধ ভাবটা আছে। চিঠিটা দেয়ার উদ্দেশ্য তোমার প্রশ্নের উত্তর দেয়া। দু’টো প্রশ্নের উত্তর পাওনা তুমি। না জেনেশুনে কাউকে বিয়ে করা যায় কিনা।
হ্যাঁ যায়। ছোঁয়া যায়, একঘরে থাকা যায় কিন্তু না জেনেশুনে ভালোবাসা যায়না। ভালোবাসতে সময় লাগে, কিছুটা জানা লাগে, বোঝা লাগে।
তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল আমি জেনেশুনে,বুঝে বিয়ে করবো নাকি অচেনা কাউকে জীবনসঙ্গিনী করবো।
নীশা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই এবং তোমাকেই।
তোমার উত্তরটা পেয়েছো।
চিঠিটা পড়ে তোমার কোনো প্রশ্ন জাগলে জিজ্ঞেস করবে।
ইতি
তোমার অপছন্দের ফুল
সেদিন কি তাড়াহুড়ো করে চিঠির উত্তর লিখেছিলাম। অনেকটা কাঁপা কাঁপা হাতে।
শিমুল ভাইয়া,
আপনি বলেছেন আমার কোনো প্রশ্ন জাগলে করতাম। আমি প্রশ্ন করছি, তবে উত্তরটাও আমি দেব।
প্রশ্ন-১ঃ কথাগুলো ফোনে কিংবা সামনাসামনি না বলে চিঠি কেন দিয়েছেন?
উঃ আমি চিঠি লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি। বলেছিলাম আপনাকে। আর আপনি সবসময় আমার পছন্দের জিনিসগুলো করে আমায় চমকাতেন।
প্রশ্ন-২ঃ আপনার প্রতি আমার প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিল জানতেন আপনি?
উঃ জানতেন। নাহলে সেদিন হঠাৎ আপনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতাম না। আপনি বুঝেছিলেন, মেয়েটা আপনার কাছে সর্বোচ্চ ভরসা পায়।
প্রশ্ন-৩ঃ নীশা নামটা আপনার দেওয়া?
উঃ হ্যাঁ। নীলিমার “নী” আর তিশার “শা”=নীশা। নামটা আমার পছন্দ হয়েছে।
শিমুল ভাইয়া, একটা জরুরী কথা, খুব জরুরী।
“ভালোবাসি”
ইতি
নীশা
পুনশ্চঃ আপনার দু’টা জিনিস অজানা। ১. আপনি একজন চমৎকার মানুষ এবং ২. শিমুল আমার সবচেয়ে পছন্দের ফুল।
আমাদের বিয়ের সূচনাটা দু’টা প্রেমপত্র দিয়ে। কাল শিমুল ভাইয়া বর সেজে আসবে। আচ্ছা তখন কি আমি সব মেয়ের মতো উনাকে লুকিয়ে দেখতে পারবো? বরের সাজে উনাকে কেমন লাগবে?
আমার বাসর ঘরটা শিমুল ফুল দিয়ে সাজাবো। মোম জ্বালানো থাকবে সারা ঘরময়। একটা মিষ্টি সুগন্ধীতে মাতাল লাগবে চারপাশ। আজকের রাতটা থেকে কালকের রাতটা সম্পূর্ন ভিন্ন হবে। কথা, আড্ডা, গানে কেটে যাওয়া সবচেয়ে সুন্দর রাত।
হঠাৎ খেয়াল হলো ফোন বাজছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে চমকে যাই, শিমুল ভাই। ৭বার কল। ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম ভুলে গেছি। বুকের বাঁ পাশে ধুক করে উঠলো। নিজেকে কোনোকিছু ভাবার সুযোগ না দিয়ে কলব্যাক করলাম। ওপাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠ।
“আপনি নীশা?”
“জ্বি, আপনি কে? এটা শিমুল ভাইয়ার নাম্বার না?”
“জ্বি। আমি হসপিটাল থেকে বলছি৷ এই ফোনের ভদ্রলোক একটু আগে রোড এক্সিডেন্ট করেছেন। ফুলের দোকান থেকে হাতভর্তি ফুল নিয়ে বের হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। উনার ডায়াল লিস্টে প্রথমে আপনার নাম পাই, আপনাকে ফোনে না পেয়ে উনার ফ্যামিলিকে জানানো হয়েছে। স্যরি টু সে, হি ইজ ডেড।”
শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। হিম হয়ে যাই৷ এরপর ভদ্রলোক কি কি যেন বলছিলেন। কানে কিছু শোনার অনুভূতি ছিলনা। খুব শক্ত করে জানলার গ্রিল চেপে ধরে রাখলাম। মাথা ঘুরছিল। অস্পষ্টভাবে দেখলাম দরজায় সীমু দাঁড়িয়ে, ‘বাবা মা’ বলে চিৎকার করছে। জ্ঞান হারানোর সময় একটা কথা-ই মনে হচ্ছিল, “কাল আমার বিয়ে!”
অসাধারণ একটা গল্প।
শেষে যে এমনটা হবে সেটা ভাবতেই পারিনি। খুব সুন্দরভাবে ঘটনাগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে।
সমাপ্তিটা অনেক বেদনাদায়ক হয়ে গেল। সত্যিই কখন কার সাথে কী হয় তা কখনও আন্দাজ করা যায় না।
গল্পের উপমা কি দিয়ে দিবো ভাষা পাচ্ছিনা। চমৎকার বললে কম হবে। আর শেষটা হ্যাপি এন্ডিং করলে ভালো হতো। অমিলের কোন প্রয়োজন ছিলনা। সাধারণত গল্পে সম্পর্ক অমিল করা হয় সবদিকে যায়না বলে। তবে এখানে সবদিকে যেহেতু দশে দশ, তাহলে হ্যাপি এন্ডিং ভালো হতো। যাই হোক, অনেক ভালো একটা গল্প লিখেছেন। সর্বোপরি, শুভকামনা।