ঘুমের ট্যাবলেটের পাতাটা ওঠাতে গিয়ে মাথা থেকে ব্যান্ড পরে গেছে মারিয়ার। সেটাকে ওঠাতে গিয়ে আবার ট্যাবলেটটা পরে গেলো। হঠাৎ করে সব জিনিসগুলো হাত থেকে পরে যাচ্ছে। এটা কি আসলেই কোন কাকতালীয় ব্যাপার? নাকি অন্য কিছু।
ঘুমের ট্যাবেলটটা খেয়ে কেবল শুয়েছে এমন সময় সাইফ ফোন দিলো। মারিয়ার ইচ্ছে করছে মোবাইলটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে, কিন্তু সেটাও পারছে না। ফোন রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে সাইফ বলছে, “আজকেও সারাদিন ঘুরলাম। কিন্তু চাকরিটা তো শেষ পর্যন্ত হলো না। তোমার কি মনে হয়? বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে কি তোমার বাবা রাজি হবে? হ্যালো.. হ্যালো… কথা বলো।”
ততক্ষণে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে মারিয়া। ওর রুমটা বেশ গুছানো। বালিশের পাশেই একটা টেবিলক্লক রাখা। ওটাতে সাতটার সময় এলার্ম দেওয়া আছে। টেবিলের ওপরে একটা ডায়েরি রাখা, পাশে পাঁচটাকা দামের বলপেন কলম তার তীক্ষ্ণ দিকটাকে উন্মুক্ত করে পরে আছে। তৃষা একবার ভাবলো ডায়েরিটা উল্টে দেখি, পরে ভাবলো দরকার কি পরের জিনিস দেখার? আস্তে করে হেঁটে এসে বোনের পাশে শুয়ে পরলো তৃষা।
আজগর সাহেবের ঘুম আসছে না। সন্ধ্যা থেকে তিনি একটি ইংরেজী ম্যাগাজিন উল্টেপাল্টে দেখেছেন। কিসব আবোলতাবোল লেখা, ২০৪০ সালের মধ্যে নাকি মানুষ অমরত্ব লাভ করবে। এইরকম গাঁজাখুড়ি কথাবার্তা এরা ছাপে কিভাবে?
তিনি কিছুক্ষণ ডাইনিং রুমে হাঁটাচলা করলেন। মেয়েদের রুমে গিয়ে কয়েকবার উঁকি দিয়ে দেখলেন। নিষ্পাপ দুটি মেয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওদের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার খুব ইচ্ছা আছে তার। কিন্তু ওদের শৈশব থেকে নিজের ভেতর লালন করা এক ধরণের সংকীর্ণতা আজগর সাহেবকে এই কাজটা করতে দিলো না। এতো এতো কাছে থেকেও পিতার সাথে সন্তানের কতটা দুরত্ব রয়ে যায় সেটা আজগর সাহেব ভালো করেই জানেন।
সাইফ ঘুমের মধ্যে এপাশ ওপাশ করছে। তার ঘুম আসছে না। এই মধ্যরাতে কারেন্ট চলে গেলে জানালা দিয়ে জোছনার আলো আসে ঠিকই কিন্তু সাথে করে মশারাও আসে। কয়েল জ্বালানো হয়েছিলো কিন্তু সেটা শেষ হয়ে গেছে। আরেকটা জ্বালাতে গিয়ে দেখে কয়েলের প্যাকেট খালি। অগত্যা এভাবেই ঘুমাতে হবে, কি আর করা!
কাঁথাটাকে ভালো করে নিজের সাথে মুড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সাইফ। এবার কাঁথার ভেতরে মশা না ঢুকলেই হয়। কিন্তু তারপরও মশার ভনভন শব্দ শোনা যাচ্ছে। ছোটখাট একটা আজাবের মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছে সে। এই গরমের মাঝে কাঁথা মুড়ি দিয়ে মশার ভনভন শুনতে একটুও ভালো লাগছে না। উঠে গিয়ে টেবিল থেকে জগ নিয়ে পানি খেল সাইফ। আজ রাতটা নাহয় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চাঁদ দেখেই পার করে দেওয়া যাবে। তিন বোতামওয়ালা শার্টটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল সাইফ।
সকালে রুবিনার বাসায় এসে পুলিশ তাকে নিয়ে গেছে। পাশের বাসার ভাবির কাছে ছেলে রবিউলকে দিয়ে রুবিনা চলে গেল পুলিশের সাথে। প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো থানায়। ওসি সাহেব তাকে চা খেতে দিয়ে বললেন,
– নাম কি আপনার?
– রুবিনা
– স্বামীর নাম কি?
– শামছুল ইসলাম
– ও আচ্ছা গ্রামের বাড়ি কই?
– লন্ডন। বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টী লন্ডনে মানুষ। আমার দাদার একুশটা প্লেন আছে।
– কি করেন আপনি?
– কমু না। না কইলে কি করবেন?
তারপর তাকে নিয়ে আসা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মর্গের সামনে পাটিতে মোড়ানো একটা লাশ। রুবিনার সামনেই পাটি সরানো হলো। রুবিনা দেখলো তার স্বামীর বুকটাকে গুলি করে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। অ্যাপ্রন পরা এক ডাক্তার রুবিনার টিপসই নিয়ে বললো, বিকালে এসে লাশ নিয়ে যাবেন।
আজগর সাহেবের বাসায় আজ একটু উৎসব উৎসব ভাব। তার মেয়ে মারিয়ার বিয়ে আজ। ছেলেপক্ষ দেখতে এসেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ফেলতে চাইছে। মারিয়া বেশ শান্ত একটা মেয়ে। আজগর আলী বললেন, যাও নীল শাড়িটা পরে এসো। মারিয়া সুরসুর করে নিজের ঘরে ঢুকে পরলো। সকাল দশটার সময় মারিয়ার বিয়ে হয়ে গেলো। এক সপ্তাহ পর ওকে উঠিয়ে নেওয়া হবে।
আজগর সাহেবের সামনে দাঁড়ালো রুবিনা। বললো, আর কাজ করমু না চাচা। গ্রামে চইলা যামু। আমার টাহাডা দিয়া দ্যান।
আজগর সাহেব কেন, কি হয়েছে? কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। মানিব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে রুবিনাকে দিয়ে দিলেন। রুবিনা কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আজগর সাহেব দেখেও না দেখার ভান করলেন। আজকে শুভদিন। শুভদিনে কান্নাকাটি দেখা উচিত না। তিনি ইনহেলারটা পুশ করে মেয়ের রুমে চলে গেলেন।
তিনটার দিকে মেসে এসে দুপুরের খাবার খেলো সাইফ। মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। মারিয়াকেও আর ফোন করা হয়নি। একটু জিরিয়ে নিয়ে রিচার্জ করতে যাবে ভাবছিলো। রিচার্জ করতে বের হওয়ার সময় বুয়া এসে আচমকা পা জড়িয়ে ধরে বললো, ভাইজান। আমার স্বামী মইরা গেছে।
রুবিনা সাইফের একই এলাকার মানুষ। সাইফের মাধ্যমেই ঢাকায় এসেছিলো রুবিনা। ওর স্বামীর খবর জেনে সাইফ কিছু না বলে প্যান্ট শার্ট পরে রুবিনাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
মারিয়াদের বাসায় আত্মীয় স্বজনরা সবাই আসতে শুরু করেছে। পরিবারের বড় মেয়ে বলে কথা। অনেকে অনেক গিফট নিয়ে আসছেন। তৃষা হাসিমুখে সেগুলো গ্রহন করছে। আজগর সাহেব ডাইনিং রুমে বসে সবার সাথে গল্প করছেন। মারিয়া একবার পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। ওর লুবনা ফুফু খুব ভালো সাজতে পারে আর সাজাতেও পারে। সে ওকে মেহেদী পরিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে ওকে যন্ত্রণাগুলো সাথে নিয়েই ঘুরতে হচ্ছে।
মিনি ট্রাকের পেছনে করে স্বামীর লাশ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে রুবিনা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঢাকার আকাশে চাঁদ নেই তবে লাইটের ঝলকানিতে শহর ছেয়ে গেছে। অনেকগুলো তারা একটা চাঁদকে প্রহরা দিয়ে রাখে। আর অনেকগুলো লাইট ঢাকাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে। রবিউল এতক্ষণ জেগে ছিলো। একটু আগেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছে৷
রুবিনার কয়েক ফুট দূরে সাইফ হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তাকে ঘুমালে অদ্ভুতরকম নিষ্পাপ লাগে। রুবিনা সাইফের দিকে মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে। বাস্তবে সে কখনো সিনেমার নায়ক দেখেনি তবে সাইফ ভাইজানকে দেখেছে। ছোটবেলায় রুবিনা এম ইন লাইফ রচনায় লিখতো ডাক্তার হবো, ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু ওর পুরো বিশ্বাস রয়েছে এখন কেউ জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, আমি সাইফ ভাইজান হবো।
লেখাঃ তাহসিন আহমেদ
গল্পের ভুল গুলো তুলে ধরলে গল্পের ছেয়েও আমার কমেন্ট বড় হয়ে যাবে। কয়েকটা শব্দে বারবার ভুল করা হচ্ছে। আপনার প্রতি এই অধমের ছোট্ট অনুরোধ, বেশী বেশী বই পড়েন। বাংলা একাডেমীর বই পড়ুন, দেখুন প্রত্যেকটা সিন কিভাবে এন্ডিং হচ্ছে,,, কিভাবে শুরু হচ্ছে। কোনস্থানে কিভাবে উপস্থাপন করা হয় সবাইকে। একশটা উপন্যাস পড়ুন, একটা গল্প লিখুন। আর, ‘পরে’ নয়, ‘পড়ে’ হবে।