লেখা : তামান্না স্নিগ্ধা
(জুন – ২০১৮)
………………
লিয়াকত আলির ব্যবসার এখন বিশাল প্রসার। সবাই জানে বাজারের সবচেয়ে ভালো সবজি, তাজা মাছ মাংস তরকারি তার দোকানে পাওয়া যায়। অথচ এখনকার এই লিয়াকত আলি ছিলো এক দরিদ্র ভূমিহীন চাষা।
সে বেশিদিন আগের কথা না, ফসলের মৌসুম ছাড়া সারা বছরই লিয়াকত আলি আর জমিলা বেগমকে আধপেটা করে খেয়ে বেঁচে থাকতে হতো।
উত্তরবঙ্গের অভাব সম্পর্কে দেশের মানুষ টুকটাক কমবেশি সবাই জানে। এত দারিদ্র্যতা তারা দুজন সহ্য করতে পারলেও তাদের দুই ছেলেমেয়ে ময়না আর রফিক সহ্য করতে পারে নি। প্রতিদিন এক পোয়া চালের ভাত রান্না হতো। এক একদিন এক একজন ভাত খেতো। বাকিরা তিনদিন উপোস করতো। সে যে কী কষ্ট! জামিলা বেগম তো নিজের ভাগেরটুক ছেলেমেয়েদুটোকে ভাগ করে দিয়ে নিজে বেশীরভাগ সময় শুধু ফ্যান খেতো।
এর ভিতর একদিন ক্ষুধার জালা সহ্য করতে না পেরে রফিক চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো। লোকজনের সে কী মার! মারের চোটে রফিক দুইবার বমি করলো। তিনদিনের অনাহারী শরীর মানুষের এত নির্মমতা সহ্য করতে না পেরে ওখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
জামিলা বেগম কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে ফেললো কিন্তু নিজের ছেলের মৃত্যুর বিচার পেলো না।
ছেলের মৃত্যুশোক ভুলতে আর ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় লিয়াকত আলি বউ আর মেয়ের হাত ধরে পাড়ি জমালেন ঢাকা শহরে। কিন্তু ভাগ্য কি আর এত সহজে পরিবর্তন হয়! কমলাপুর রেলস্টেশন বস্তিতে অবর্ণনীয় কষ্টে দিন কাটতে লাগলো তাদের।
.
বস্তি থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই বিশাল বড় কাঁচাবাজার। লিয়াকত আলি তখন সারাদিন সেখানেই থাকতেন। বাজার করতে করতে ঘেমে নেয়ে যাওয়া শৌখিন বড়লোকদের বিশ, ত্রিশ টাকার বিনিময়ে বাজারের ব্যাগ টেনে দিতেন। সন্ধ্যার মুখে মুখে লিয়াকত আলি ঘরে ফিরতেন। পলিথিনের ব্যাগ ভর্তি থাকতো দোকানীদের ফেলে দেয়া তরিতরকারি। ব্যবহার ভালো দেখে অনেক দোকানী সামান্য পচে যাওয়া উচ্ছিষ্ট সবজি ডেকে ডেকে দিতেন লিয়াকত আলিকে। মজুরির টাকায় কেনা মোটা চাউলের দামও বাজারের একজন দোকানী রাখতো স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম। লিয়াকত আলি এতেই খুশি ছিলেন। দুমুঠো খেতে পেয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাতেন।
তার কাছে জামিলা বেগমের রান্নার হাতের তুলনা নেই। এই পঁচা আধপঁচা তরকারিই সে এত সুস্বাদু করে রান্না করতো যে লিয়াকত আলি দুই থাল ভাত চেটেপুটে খেয়ে নিতে পারতো।
.
লিয়াকত আলির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো বৃষ্টিভেজা এক প্যাচপেচে বাজারের দিনে। বরাবরই আমি দেখেশুনে টাটকা সবজী কেনার পক্ষপাতী। ড্রাইভারদের কাছে টাকা দিলে বাজার করে আনে ঠিকই কিন্তু মনমতো বাজার হয়না। তাই সময় পেলেই আমি একটু সবজি বাজারে ঢু মারি।
সেদিন গাড়ি থেকে নেমে বাজারের ভিতর ঢুকতেই শীর্ণ চেহারার এক মধ্যবয়সী লোক বললো, ‘স্যার আপনের ব্যাগ টানন লাগবো? আমারে দ্যান।’
‘ব্যাগ টানা সে আবার কী? বাজার সমিতির নতুন ব্যবসা নাকী?’ বেশ উচ্চস্বরেই বললাম কথাটা।
সে বেশ কুণ্ঠিত হয়ে মাথাটা নীচু করে বললো, “আপনেরা ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে দুকানে দুকানে ঘোরেন, আমারে দিলে আমি টাইনে দিতাম।”
‘আর কখন ব্যাগসহ চম্পট দিবা হদিস পাবো না তাই তো?’ বলে হেসে উঠতেই পাশের আলু পটলের দোকানদার বলে উঠলো, “স্যার সে মানুষ ভালো। দশ, বিশ টাকা যে যা দেয় তাই নেয়, কারো সাথে বচসা করে না।”
‘তাইলে চলো’ বলে তার হাতে বাজারের খালি ব্যাগটা দিয়ে হাটতে শুরু করলাম।
ঘণ্টা দুই বাজার সদাই করে হাপাতে হাপাতে গাড়ির কাছে ফিরলাম। যে গরম পড়ছে রে বাবা, এই গরমে বাজারে কেনাকাটা করাই দুষ্কর।
লিয়াকত আলি লোকটাকে ভালোই বলা চলে। বেশ সহজ সরল। গ্রামের মানুষ তো, কোনটা তাজা সবজি,কোনটা গতকালের বাসি, ভালোই চেনে। মাঝে মাঝে আমাকে বলে দিচ্ছিলো, “স্যার এইডা ন্যান, এইডা ভালো হবি না।”
ব্যাগগুলো ড্রাইভারের সাথে মিলে গাড়িতে তোলার সময় লিয়াকত আলির হাতে ১০০ টাকা দিলাম। সে বলছে, ‘স্যার ভাংতি নেই, আপনেই পেরথম।’
আমি ‘ভাংতি দেয়া লাগবে না, পুরোটাই তোমার’ বলার পরে অবাক বিস্ময়ে তার তাকিয়ে থাকা দেখে জানলাম অনেকেই ঘণ্টাদেড়েক তাকে নিয়ে বাজারে ঘোরাঘুরি করে ফেরার সময় হাতে দশটাকার একটা নোট ধরিয়ে দেয়। তাই আমার দেয়া টাকার পরিমাণ দেখে অত্যাধিক আনন্দে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।
কি মনে হলো, বাজারের ব্যাগের ভিতর থেকে মাঝারি সাইজের একটা রুই মাছ তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, “বাড়ির সবাই মিলে খেয়ো, লিয়াকত।”
গাড়িতে এসির ভিতর ঢুকে ঠাণ্ডা বাতাসে দম নেবার পর জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, “লিয়াকত তখনো একহাতে রুইমাছের কানকো আরেক হাতে একশো টাকার নোট নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখে মুখে একইসাথে আনন্দ আর বিস্ময় খেলা করছে।
.
এরপর মাঝেমধ্যে বাজারে এলেই লিয়াকতের সাথে দেখা হয়। সে অন্যদের বাজার করলেও আমাকে দেখামাত্র ছুটে আসে।
এতদিনে তার পরিবারের খুঁটিনাটি সবকিছুই আমি জেনে গেছি।
‘কী লিয়াকত কেমন আছো?’ বললে সে বিনয়ে বিগলিত হয়। প্রতিবারই তার উত্তর হয় ‘আল্লায় ভালো রাখছে।’
অফিসের কলিগদের কাছেও লিয়াকতের গল্প করেছি। তারা সবাই এখন লিয়াকতের দিয়ে বাজার করায়। ইদানীং তো আমি গাড়িতে বসে থাকি লিয়াকতই বাজার করে এনে দেয়।
.
গত বছর রমজান মাসে প্ল্যান করেছিলাম অফিসের দুই তিনজন মিলে যাকাতের পুরো টাকাটাই লিয়াকতের হাতে তুলে দেবো। যেন সে এই বাজারেই একটা দোকান দিতে পারে।
প্রথম কয়মাস ধরে দোকানের ভাড়াও আমরা সবাই পালাক্রমে দিয়েছিলাম। তারপর আর লিয়াকত আলিকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সৎ ও পরিশ্রমী বলে সে খুব দ্রুতই ব্যবসায়ে উন্নতি করেছে। মাল ওজনে কম দেয় না, আবার ভেজাল ছাড়া পন্য বিক্রি করে বলে বাজারে তার বেশ সুনাম।
আজ সকালে লিয়াকত ফোন দিয়ে জানালো, ‘এবার রোজায় সে যাকাত দিচ্ছে। আমি যেন তার জন্য দোয়া করি।’
মুহূর্তেই খুশিতে মনটা ভরে গেলো।
০ Comments