লিখাঃ Nusrat Jahan Eisha
মা, তুমি আমায় গল্প শোনাবে না? তুমি জানো না,আমার গল্প না শুনলে ঘুম হয় না?….
৮ বছরের মেয়ে রায়ীনার মুখে এমন আবদার শুনে নীলাশা তার মুখের উপর থেকে বইটা সরিয়ে বললো,
“হ্যাঁ মা অবশ্যই শোনাবো..তুমি তোমার ঘরে যাও, আমি আসছি..”
নীলাশা রায়ীনার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,,মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেলো! কিন্তু গল্প শোনার অভ্যাসটা ঠিক আগের মতোই রয়ে গেলো..রাফসান আর নীলাশার বিয়ের ১২ বছর পর রায়ীনা তাদের ছোট্ট সংসারে একজন সদস্য হয়ে জন্ম নিলো..নীলাশা আর রাফসান বেশ সময় কাটায় রায়ীনার সাথে..অনেক ভালোবাসে তাকে.. তারা তাদের সংসার জীবনের ব্যস্ততার মাঝে ভেবেই নিয়েছিল তাদের হয়তো আর কখনো মা-বাবা ডাকটা শোনা হবে না..তবে এ নিয়ে নীলাশা কিংবা রাফসান কারোরই আক্ষেপ দেখা যেতো না..! বরংচ নীলাশা যখন মাঝেমধ্যে মন খারাপ করে থাকতো, একজন সন্তানের অনুপস্থিতি অনুভব করে কষ্ট পেতো, রাফসান যেনো নিবিড়,শান্তশীতল ছায়ায় ঘেরা এক বট গাছের ন্যায় তার পাশে থাকতো..মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, “মন খারাপ করে আছো কেন? আরে তুমি না অঙ্কের প্রফেসর? এতো কঠিন কঠিন অঙ্ক সমাধান করতে পারো,আর জীবনের এই ক্ষুদ্রতম অঙ্কটাই মেলাতে পারছো না?” নীলাশাও অবুঝ শিশুর মতো তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতো,”মানে? কোন অঙ্কের কথা বলছো?”
_আরে,সৃষ্টিকর্তা হয়তো চান না, তোমার ভালোবাসায় অন্য কারো ভাগ থাকুক! তোমার ভালোবাসায় যেনো কোনো কমতি না হয়! তাই আমরা মা-বাবা হতে পারছি না..তবে মা-বাবা না হওয়ার একটা ভালো দিক আছে জানো? যেকোনো ছোট বাচ্চাকে দেখলে আপন করে ভালোবাসা যায়..সেটাই ভালো হয়!
ব্যাস নীলাশা আর কিছু বলতো না..কি সহজেই মানুষটা নিজের কষ্টগুলোকে চাপা দিয়ে তাকে শান্তনা দিচ্ছে! আর কি বলবে সে!
নীলাশা যখনই রায়ীনার চোখের দিকে তাকায় কেমন যেনো একটা মায়া খেলা করতে দেখা যায়..অদ্ভুত একটা মায়া..সেই মায়ায় যে কেউ হারিয়ে যাবে..মেয়েটা কি তবে রাফসানের মতো হলো? যেসব মেয়েরা দেখতে বাবার মতো তারা নাকি অনেক ভাগ্যবতী হয়..ভেবেই নীলাশার মনে একটা আশার আলো জ্বলে উঠে..তার মেয়েটা তবে ভাগ্যবতী..
পাশের ঘর থেকে রায়ীনার “মা, ও মা” ডাকে নীলাশার ভাবনায় মূর্ছা পড়লো..নাহ..মেয়েটাকে গল্প শোনাতেই হবে..
রায়ীনার ঘরে গিয়ে তার পাশে হেলান দিয়ে বসলো নীলাশা..রায়ীনা উৎসুক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”মা, প্রতিদিন তো রাজা-রাণী আর প্রিন্সেস এর গল্প বলো..আজ নতুন কোনো গল্প শুনবো..”
নীলাশা মুখে একটু হাসি ফুটলো..নীলাশা চরমভাবে অসুস্থ..বয়স তো কম হলো না..আজকাল মানুষ খুব অল্প বয়সেই মারাত্মক রোগ বাধিয়ে বসে! আর নীলাশার বয়স তো প্রায় ৫০+ হতে চললো..মেয়েটাকে কতদিনই বা আর পাশে পাবে কি জানি..সারাক্ষণই মৃত্যুর কথা মাথায় ঘুরঘুর করে!
আজকাল নীলাশা আবার মহান ব্যক্তিদের আদর্শ জীবন কাহিনী বেশি পড়ছে..কিছুক্ষণ আগেও সে হযরত মুহম্মদ (স) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (আ.) এর আদর্শ জীবনকাহিনী পড়ছিল..মানুষগুলো আসলেই কত্ত মহান! তারা নিজেদের কতো কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও বিপথগামী হননি..দুনিয়ার জীবনে তো কতো কষ্ট, অত্যাচার সহ্য করেছেন তারা..কিন্তু কখনো পথভ্রষ্ট হননি..
নীলাশা এসব চিন্তা করতে করতেই ঠিক করে নিলো রায়ীনাকে আজ সত্যিই নতুন গল্প শোনাবে..রায়ীনার দিকে তাকিয়ে নীলাশা বলতে লাগলো, হযরত ফাতেমা (আ.) এর জীবনকাহিনী.. তাঁর জীবনকাহিনী শুনে ছোট্ট মেয়ে রায়ীনার চোখ দিয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়লো..অন্যদিন সে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে..কিন্তু আজ সে পুরোটা শুনলো বেশ মনোযোগ দিয়ে..নীলাশা যখন বলা শেষ করলো রায়ীনা অবাক হয়ে বললো,”হযরত ফাতেমা (আ.) তো সারাজীবন কত ত্যাগ, কত কষ্ট করলেন! তার বিনিময়ে উনাকে কোনো প্যালেস দেওয়া হয়নি কেন মা? এটা তো ঠিক না..উনি তো কোনো পুরষ্কারই পেলেন না.. গল্পটা আমার পছন্দ হয়নি..”
নীলাশার মেজাজটা চট করে গরম হয়ে গেলো..আজকাল নীলাশার খুব অল্পেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়.. বয়স বাড়লে কি এমন হয় নাকি কি জানি! অবশ্য রায়ীনার ও কোনো দোষ নেই..এতোটুকু মেয়ে! সে আর কি-ই বা বুঝবে! নাহ! নীলাশার বুকে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে..রায়ীনার কথা শুনলে হয়তো আরো খারাপ লাগবে..নীলাশা উঠে চলে আসলো..
রায়ীনাও মুখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো..নীলাশা এপাশ ওপাশ করছে..তার ঘুম আসছে না..মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে..
কিন্তু কেন জানি তাও তার অনেক ঘাম হচ্ছে..বুকের ব্যথাটা আরো বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে..উফফফ অসহ্য লাগছে তার..প্রায় ধুম করেই উঠে বসলো নীলাশা.. রায়ীনার ঘরে গিয়ে দেখলো সে ঘুমাচ্ছে..এখন মধ্যরাত.. নীলাশা জানে না কাল সকালের সূর্যটা তার জন্য অপেক্ষা করছে কিনা! নাকি আজই তার শেষ রাত!
নীলাশা বইয়ে পড়েছে এই সময়টাতে আল্লাহ তাঁর বান্দার সকল চাওয়া পাওয়া কবুল করেন..যদি সেটা তার বান্দা মন থেকে চায়..নীলাশা ওজু করে তাহাজ্জুদ এর নামায পড়ে নিলো..তারপর রায়ীনার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তস্বরে ডাকলো,”রায়ীনা, মা আমার..ওঠো লক্ষ্মীটি..”
রায়ীনা ঘুমঘুম চোখে তাকালো..তার ঘুম এখনো কাটছে না..মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”আজ এতো তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে গেছে মা?”
_না,,মা..এখনো ভোর হয়নি..তুমি রাতে জানতে চেয়েছিলে না, হযরত ফাতেমা (আ.) দুনিয়াতে এতো কষ্ট, এতো ত্যাগ সাধনার পরও তাঁর কোনো প্যালেস হয়নি কেন? তাঁকে কোনো পুরষ্কার দেওয়া হয়নি কেন? আসলে তিনি পুরষ্কার পেয়েছেন..দুনিয়াতে নয়..আখিরাতে পেয়েছেন.. আর তাঁর প্যালেসটার নাম হলো “জান্নাত”
রায়ীনা বিস্মিত হয়ে উঠে বসলো..সে নীলাশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”মা,এতো কষ্ট করলেই কি জান্নাত পাওয়া যায়? আর জান্নাতে কি আছে এমন?”
_জান্নাত হলো চিরশান্তির স্থান..সেখানে কোনো অন্যায় অত্যাচার হয় না..খুনখারাবি, মারামারি, মিথ্যাচার কোনো কিছুই সেখানে থাকে না..শুধু শান্তিই বিরাজ করে.. আর কে বললো দুনিয়ায় শুধু কষ্ট পেলেই আখিরাতে জান্নাত পায়? তুমি যদি দুনিয়ায় সততা বজায় রেখে, আল্লাহর পথে চলো, কোনো অন্যায় কাজ না করো, তবে তুমি জান্নাত পাবে..আর যদি তার বিপরীত খারাপ কাজ করো, আল্লাহর পথে না চলে শয়তানের অনুসারী হও, তবে তোমার স্থান হবে “জাহান্নামে”.. সেখানে তোমাকে আগুনে জ্বলতে হবে, বিষধর সাপের দংশন সহ্য করতে হবে, কবরের আজাব সহ্য করতে হবে! ভীষণ কষ্ট সহ্য করতে হবে..
শুধু তোমাকেই নয়..তোমার পাশাপাশি আমাকে, তোমার বাবাকেও এই কষ্ট সহ্য করতে হবে.. (নীলাশা)
_এমা! আমার অপরাধের জন্য তোমাদেরও এতো কষ্ট সহ্য করতে হবে! না না..তোমাদের কিছু হোক আমি চাই না মা..আমি এখন থেকে আর কখনো মিথ্যা বলবো না.. আর প্রমিস করছি এখন থেকে আমিও তোমার সাথে নামায পড়বো.. আমিও জান্নাত প্যালেসে যাবো মা.. (রায়ীনা)
_মাশাল্লাহ..আল্লাহ তোমার নিষ্পাপ মনে যেনো এইভাবেই সবসময় রহমত করেন!! আর এখন থেকে আমরা কখনো প্রমিস বলবো না কেমন? এখন থেকে আমরা “ইনশাআল্লাহ” বলবো ঠিক আছে? (নীলাশা)
রায়ীনা মাথা নেড়ে জবাব দিলো,”হ্যাঁ, মা.. ইনশাআল্লাহ বলবো..”
এমন সময় কানে এক সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসলো, “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম..” এদিকে জানালে দিয়ে ভোরের আলো পর্দার আড়াল থেকে ঠিকরে ঘরে পড়ছে..একজন মা আর তার মেয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে আল্লাহকে ডাকছে..তাদের মধ্যে আজ কোনো নির্মমতা নেই..আছে শুধু নিষ্পাপ,কোমল একটি মন..
বাহ! খুবই চমৎকার একটি গল্প পড়লাম। মনটা শীতল আর শান্ত হয়ে গেল গল্প পড়ে। প্রতিটি বাবামায়েরই উচিৎ তাদের সন্তানদের সুশিক্ষা দেয়া, ইসলামের পথে পরিচালিত করা। তেমনি নীলাশাও তার মেয়েকে সুশিক্ষা দিয়েছে। এই ভালো কাজের বিনিময়েই তারা পাবে জান্নাত।
বানানে খুব বেশি ভুল নেই। তবে বিরামচিহ্নের অপপ্রয়োগ হয়েছে। দাঁড়ি এর জায়গায় ফুলস্টপ দিয়েছেন।
বরংচ- বরঞ্চ।
বুজে- বুঁজে
ভালো লিখেছেন। ইসলামিক শিক্ষনীয় লেখা।
প্রত্যেক মা এমনই হোক। আর প্রত্যেক সন্তানের মনে মায়ের থেকে শোনা প্যালেসের প্রতি লোভ জাগুক।