গল্প লেখকঃ
Fahmida Zaman Oishi
(এপ্রিল – ২০১৮)
……………………………
কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে স্মৃতি কিছুটা লজ্জিত হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করতে করতে পূর্ণিমাকে বলল, “পূর্ণিমা, তোমার আম্মুকে একটু বলবে এই মাসের বেতনটা একটু তাড়াতাড়ি দিতে?” পূর্ণিমা খাতার থেকে চোখ সরিয়ে সোজা স্মৃতির দিকে হা করে কতক্ষন তাকিয়ে রইলো। স্মৃতি পূর্ণিমার দিকে তাকানোর সাথে সাথে পূর্ণিমা মুখটা নিচে নামিয়ে বললো, “আচ্ছা বলবো টিচার” এই বলে আবার অস্ফুট ভাবে পূর্ণিমা বলতে লাগলো, “টিচার একটু বাইরে যাবো?” স্মৃতি মাথায় হাত দিয়ে কিছুটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো, “আচ্ছা যাও তাড়াতাড়ি আসবে।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই পূর্ণিমা হাওয়া হয়ে গেছে। স্মৃতির চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। অনেকগুলো টাকার প্রয়োজন স্মৃতির কিন্তু কিভাবে যোগাড় করবে। ৪টা টিউশন করে যা পায় তা দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে যায়। তার উপর ২ ভাই বোনের পড়ার খরচ, নিজের পড়ার খরচ চালাতে রিতিমতো হিমশিম খেতে হয় তাকে। বাবা আজ তাদের সাথে নেই প্রায় ৪ বছর। প্রথম প্রথম আত্মীয়-স্বজনরা সাহায্য করতো কিন্তু আজ ৩ বছর ধরে নিজেকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। চোখে মুখে শুধুই অন্ধকার স্মৃতির। চোখ দুটি অসাড় হয়ে বন্ধ হয়ে আসছে তার। আচমকা চোখ খুলে কিছুই বুঝতে পারে না স্মৃতি সে কোথায় আছে। অনেক্ষন পর চারপাশে তাকিয়ে দেখে পূর্ণিমা কলমের বিভিন্ন রংয়ের বাহার টেবিলে সাজিয়ে তার বড় ড্রইং খাতায় ঘুমন্ত স্মৃতির ছবি আঁকছে। এলোমেলো কালো কুঁকড়ানো চুল ঘাড় বেয়ে নিচে নেমে গেছে। চোখের মোটা ফ্রেমের চশমা বার বার ঠেলে উপরে দিচ্ছে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে পূর্ণিমা কিন্তু কি দারুণ তার হাতের চিত্র গুলো। একদম যেনো বাস্তব চিত্র।
স্মৃতির ঘুম থেকে উঠা মাত্র পূর্ণিমা আঁকা বন্ধ করে টেবিলে রাখা খাবারের ট্রে এগিয়ে দিয়ে বললো, “টিচার ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন।” স্মৃতি কিছুটা লজ্জা পেয়ে পূর্ণিমা কে বললো, “সরি পূর্ণিমা আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।” পূর্ণিমা বই খাতা ব্যাগে রাখতে রাখতে বলতে লাগলো, “আমিও টেবিলে ঘুমিয়ে যাই প্রায়শই। আম্মু অবশ্য দেখলে বকাবকি করে। তাই ঘুমানোর আগে দরজা লক করে ঘুমাই।” এই বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো পূর্ণিমা। কি অদ্ভুত রহস্যময় পূর্ণিমার হাসি। মেয়েটা সপ্তম শ্রেণিতে পড়লেও খুব মেধাবী আর ভাবুক। চেয়ার থেকে উঠার সময় স্মৃতি খেয়াল করলো পূর্ণিমা রুমের দরজা লক করে রেখেছে।
“আপু” ডাক টা শুনে পূর্ণিমাদের গেটের বাইরে থেকে খেয়াল করলো স্মৃতি। পূর্ণিমা ছাদের উপর থেকে আপু বলে ডাকছে। পূর্ণিমা শুধু পড়ানোর সময় স্মৃতিকে টিচার বলে ডাকে। ছাদের উপর থেকে পূর্ণিমা হাত নাড়িয়ে ইশাড়া দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে। অদ্ভুত লাগে মাঝে মাঝে ওর ব্যবহার। বাসায় যেতে যেতে প্রায় ৭.০০ টা বেজে গেলো। বাসার কিছু কাজ সেড়ে নিল সে। তারপর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর আগে ব্যাগ থেকে ডায়রি বের করলো স্মৃতি। স্মৃতির বদ অভ্যাস প্রতিদিন তাকে রাতে ডায়রি লিখে। যা তার বাবা শিখিয়েছে। সব কথা লিখে সেখানে। ডায়রির পাতা উল্টাতে উল্টাতে খেয়াল করলো স্মৃতি, একটা নীল খাম সাথে ডায়েরিতে গোটা গোটা হাতে লেখা, “সরি, আপনার বিনা অনুমতিতে আপনার ব্যাক্তিগত ডায়রি পড়েছি।” নীল খাম খোলার পর দেখতে পেলো ৫০০০ টাকা। সাথে আরেকটা চিরকুট যার ভিতর লেখা, “এটা আমার ব্যাক্তিগত টাকা। কয়েক বছরের ঈদের সেলামির টাকা। আমার আম্মু কেউ টাকা চাইলে তা পছন্দ করে না। আমার আম্মুর নিজের ইচ্ছাতে টাকা দিতে পছন্দ করে। আর এই মাসে আপনার বেতন পাওয়ার আশা খুবই কম। এটা ধার হিসেবে রাখেন পরে দিয়ে দিয়েন। ইতি আপনার পাগল স্টুডেন্ট”। হঠাৎ খেয়াল করলো স্মৃতি তার হাতের চিরকুট ভিজে গেছে চোখের পানিতে। আজও কিছু মহৎ মানুষের জন্য মধ্যবিত্ত ছেলে মেয়েরা হোম টিউশন করে নিজের সংসার চালাচ্ছে। হোক না সেটা পূর্ণিমার মতো ছোট বাচ্চার উদারতা।
০ Comments