লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
জনরা: মুক্তিযুদ্ধ
.
.
ছোটখাটো একটা বাচ্চা ছেলেদের দল ষাটোর্ধ বুড়োটার পেছনে ছুটছে আর ভ্যাংচি কাটছে। জীর্ণ-শীর্ণ গেঞ্জি আর লুঙি পরা লোকটার মাথায় বাংলাদের পতাকা বাধানো। দাড়ি-গোঁফে মুখটা যেন পরিপূর্ণ। বৃদ্ধ লোকটা বটগাছের অাড়ালে লুকানোর আগে বেশ কয়েকটা ইটের বারি খেয়েছে। গাছের অাড়াল থেকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলছে, ‘যাহ, যাহ, ভাগ।’
ছোট ছোট ছেলেরা অনবরত আবারও ঢিল ছুঁড়তে থাকে। কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর গাছের অাড়াল থেকে বের হয়ে গাছের নিচে ধপাস বসে পড়ে। ততক্ষণে দুষ্টু ছেলেগুলো চলে গেছে। এ দৃশ্য দূর থেকে দেখে লোকটাকে পাগল ভেবে আব্দুর রহীমের সাথে ওর স্কুলে গেলাম। আজ বিজয় দিবস। ভার্সিটি বন্ধ থাকার সুবাদে আব্দুর রহীমের সাথে তার গ্রামে এসেছি কয়েকদিন কাটানোর জন্য। আব্দুর রহীম আমার ক্লাসমেট।
সত্যি বলতে এরকম গ্রাম আমার খুব ভালো লাগে। অনেকটা শিল্পীর তুলিতে অাঁকা ছবির মতো। সোনালী ক্ষেতের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নদী কিংবা অাঁকা-বাকা পথ। চারদিকে সবুজে ভরা গাছগাছালি। তার ফাঁকে সূর্যের কিরণের স্পষ্ট অালোতে মনটা ভরে যায়।
‘চুপ করে থাকলি যে? অাব্দুর রহীম বলে উঠলো।
‘না রে, ভালো লাগছে না।’
‘আমাদের গ্রাম কি তোর পছন্দ হয়নি?
আমার ওর হাত শক্ত করে ধরে বললাম,
‘তোদের গ্রামটা ছবির মতো সুন্দর। খুব ইচ্ছে করছে ছবির মধ্যে নিজেই ছবি হয়ে যাই।’
আমি মৃদু হাসলাম। অাব্দুর রহীম বলে উঠলো,
‘আচ্ছা ছোট ছোট ছেলেরা ওই বৃদ্ধ লোকটাকে এভাবে ভ্যাংচাচ্ছিলো কেন?’
মৃদু হাসলো আব্দুর রহীম। তারপর বললো,
‘লোকটা পাগল। ছোট থেকেই তাকে এরূপ দেখে আসছি। সবসময় গাছের নিচে বসে কী যেন বিড়বিড় করে বলে।’
‘তুই মনে হয় লক্ষ করিসনি, কপালের একটা অংশ তার ফেঁটে গিয়েছে। রক্ত ঝরছিল।’
আমার কথা শুনে আব্দুর রহীম মনে হয় একটু বিরক্তই হচ্ছিলো। তবুও বন্ধু বলে উত্তর দিয়েই যাচ্ছিলো।
‘আহা সাজ্জাদ, একটু চুপ কর না। সবাই তাকে এভাবে ক্ষ্যাপায়। আমরা তাকে মজিদ পাগলা বলেই ডাকি। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিষেধ করলেও ওরা শুনে না। আরও বেশি করে তাকে জ্বালায়।’
‘দোস্ত, এটা তো ঠিক হচ্ছে না। একটা মানুষকে এভাবে বিরক্ত করা তো ঠিক নয়।’
‘মানুষ জানে, তবুও না জানার ভান করে থাকে।’
একথা বলতে বলতে সে আমাকে পুকুরের দিকে ইশারা করলো। কী সুন্দর একটা বক!
বকটা দেখে খুব ভালো লাগলো। চারদিকে পানি তার মাঝে সাদা রঙের বক, সত্যি সত্যি চারপাশের অপরূপ দৃশ্যটা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। আমি আব্দুর রহীমকে বললাম,
‘এজন্যই গ্রাম আমার দারুণ পছন্দের।’
‘সবে তো অাসলি। আর কয়েকটা দিন থেকে তারপর নাহয় ভার্সিটিতে ফেরা যাবে। শহুরে কোলাহলের মাঝে আর কত!’
আমি আব্দুর রহীমের কথা শুনে খানিকটা হাসলাম। আমিও গ্রাম থেকে শহরে পড়তে এসেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের চাকা আমার জীবনটা বদলে দিয়েছে। মা মারা যাবার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে বেশ সুখেই আছে। আমার দিকে তার খেয়াল করার সময়টুকু নেই। বাড়িতেও ডাকে না, তাই আর যাওয়াও হয় না।
আব্দুর রহীমের সাথে নানান বিষয়ে কথা বলতে বলতে স্কুলের দিকে হাঁটছি। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রধান অতিথি আসবেন। বিজয় দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আরও কত কী!
আমি বললাম,
‘ওই গানটা ধর না?’
‘কোন গানটা?’
‘আরে ওইটা, যেইটা তুই প্রথম ভার্সিটিতে শুনিয়েছিলি।’
‘ওহ, ঠিক আছে।’
আব্দুর রহীম শুরু করলো,
‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাঠের পরে,
আমার মন ভুলায় রে।’
অাব্দুর রহীমের গান শুনছি আর পাগল মজিদের কথা ভাবছি। লোকটা কপাল ফেটে এখনে রক্ত পড়ছে নিশ্চয়ই? মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ‘তাকে সাহায্য করা উচিত ছিলো আমাদের।’
.
এখনি জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান জানানো হবে। প্রধান অতিথির জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করেও তিনি আসেননি। তার আসতে নাকি দেরি হবে। সেজন্য অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। সকল শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে। আমিও আব্দুর রহীমের সাথে দাঁড়িয়ে আছি।
সকলের সামনে পতপত করে পতাকা উড়ছে। আমার দেশের পতাকা। যে পতাকায় মিশ্রিত অাছে সবুজের মাঝে শহীদের লাল রক্ত। পতাকার মাঝে অবশ্য লাল রক্তগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে লাল রক্তগুলো হাতে নিয়ে গায়ে মেখে নেই। কিন্তু তা সম্ভব নয়। রক্তকণিকাগুলো যে শুকিয়ে গেছে!
জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান জানানোর পর শুরু হলো জাতীয় সঙ্গীত। সঙ্গীত শুরু হওয়ার মাঝখানে মজিদ পাগলা কোথা থেকে যেন দৌড়ে আসলো। তার হাতেও একটা বাংলাদেশের পতাকা। স্কুলের পতাকার পাশেই তার পতাকা গেঁড়ে সম্মান প্রদর্শন করলো। পুলিশের মতো স্যালুট জানিয়ে পা কয়েকবার উঁচিয়ে নামালো। এদিকে জাতীয় সঙ্গীত প্রায় শেষের দিকে।
মজিদ পাগলাও আমাদের সাথে গাইতে শুরু করলো। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হওয়ার এক পর্যায়ে তার চোখে স্পষ্ট পানি দেখতে পেলাম। চোখের এই পানি দেশের জন্য লাখো ভাইয়ের উৎসর্গের পানি। চোখের এ পানিই বলে দেয় তিনি দেশকে কতটা ভালোবাসেন।
একজন শিক্ষক বলে উঠলেন,
‘পাগলাটাকে বের করে দাও তো।’
বের করে দেয়ার কথা শুনে নিজের আনা পতাকাটা নিয়ে সকল শিক্ষার্থীর চারপাশে দৌড়াতে থাকলো আর চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো,
‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’
এমন সময় প্রধান অতিথি গাড়ি চলে অাসলেন। সকল শিক্ষার্থী দু’দিকে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে গেল। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম। কেরানী এসে সকলের হাতে ফুলের পাপড়ি দিয়ে গেল। অতিথি সাহেব গাড়ি থেকে নামতেই প্রধান শিক্ষক তার সাথে মুসাফা করে শিক্ষার্থীদের মাঝ দিয়ে হেঁটে আসতে লাগলো। ছাত্র-ছাত্রীরা তার গায়ে ফুল ছিটাচ্ছে। হঠাৎ মজিদ পাগলা এসে এক দলা থুথু প্রধান অতিথির গায়ে দিয়ে বলে উঠলো,
‘রাজাকারের বাচ্চা, আজ তোকে কে বাঁচাবে?’
একথা বলে পতাকার দণ্ডটাকে উঁচিয়ে ধরলো প্রধান অতিথির পেটে ঢুকানোর জন্য। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে কর্তৃপক্ষ এসে পাগলা মজিদকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। বাইরে যেতে যেতে সে বলতে লাগলো,
‘রাজাকারের বাচ্চা, এই দেশের মাটিতেই তোর বিচার হবে।’
কিছুক্ষণের মধ্যে স্কুলের পরিবেশ পাল্টে গেল। গোলযোগ সৃষ্টি হলো খানিকটা।
প্রধান শিক্ষক প্রধান অতিথির হাত ধরে মজিদ পাগলার হয়ে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলো। হয়তো প্রধান শিক্ষক চাকরি চলে যাবার ভয়ে বারবার কড়জোরে মিনতি করতে থাকলো।
‘দেখেছিস মজিদ পাগলার কাণ্ড?’
আব্দুর রহীমের কথা শুনে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আহ শব্দ করে অাব্দুর রহীমের দিকে তাকালাম। মেকি হেসে বললাম,
‘তার এমনটা করার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে বন্ধু। আমার মনে হয় না তিনি সম্পূর্ণভাবে পাগল। তার মস্তিস্ক এখনো অনেকটা ঠিক আছে। গ্রামের মানুষেরাই তাকে বদ্ধ পাগল বলে সম্মোধণ করে।’
‘তোর এমনটা মনে হবার কারণ কী?’
‘জাতীয় সঙ্গীত বলার সময় উনার চোখের যে পানি আমি দেখেছি তা দেখে মনে হয়নি উনি সম্পূর্ণরূপে পাগল।’
‘তোর কথা আমি কিছুই বুঝি না।’
‘তোর বুঝতে হবে না। তুই থাক, আমি আসতেছি।’
‘কোথায় যাস?’
‘পরে বলছি। এতটুকু ভরসা রাখ তোদের গ্রামে হারিয়ে যাব না।’
অাব্দুর রহীমের সাথে আমিও হেসে উঠলাম।
.
খুব দ্রুত বটগাছটার দিকে চলে আসলাম। চারদিকে তাকাচ্ছি, নাহ! কোথাও মজিদ পাগলা নেই। অারেকটু সামনে গেলাম। হ্যাঁ, জমির এককোণায় বসে দাঁতের উপর দাঁত রেখে কটকট করেই যাচ্ছে। দাঁত কটমট করতে দেখে খানিকটা ভয় পেলাম আমি। উনার পাশে গিয়ে খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু পাছে যদি আমাকে তাড়া করে সেই ভয়ে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখাচোখি হতেই বলে উঠলো,
‘কে তুমি? এখানে কী চাও?’
আমি উনার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম। কী বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। ফের জিজ্ঞেস করলো,
‘কী ব্যাপার? কে তুমি? তুমিও কি রাজাকারটার দলের লোক নাকি?’
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম,
‘না না, আমি তো উনাকে চিনিই না। আসলে আমি মকবুল চাচার বাড়িতে এসেছি। উনার ছেলে অাব্দুর রহীমের সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ি।’
‘ওহ, এখানে কী চাও? পাগল মানুষরে সাথে বেশি কথা বলা ঠিক নয়।’
‘সত্যি বলতে আপনাকে দেখে আমার ঠিক পাগল মনে হয় না। সেজন্যই তো আপনার কাছে এলাম।’
এবার জোরে একটা ধমক দিয়ে বললো,
‘তুমি বেশি বুঝো না? এত বুঝার দরকার নাই। আমি পাগল, মজিদ পাগলা। দেশের জন্য পাগল। যাও তুমি চলে যাও। অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজাকারের বাচ্চাকে অভ্যর্থনা জানাও।’
আমি একটু ভয়ে ভয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। ওনার পাশে বসতে দেখে খানিকটা সরে বসলো। আমি আরেকটু তার দিকে সরে গেলাম।
আবার একটা ধমক আমার কপালে জুটলো,
‘বললাম না চলে যাও। এখানে বসলে যে?’
‘আমি আপনার নিকট থেকে কিছু শুনতে চাই।’
‘না না না, আমি কিছু বলতে পারি না। আমার কাছে কিছু শোনার কাম নাই।’
আমি তাকে প্রথমবারের মতো প্রশ্ন করে বসলাম,
‘আপনি তাকে রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিয়ে থুথু দিলেন কেন? আবার মারতে গেলেন।’
এবার উনি উচ্চস্বরে বলতে লাগলো,
‘রাজাকারের কি তাহলে পা টিপে দেব? এই দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি কি তার হয়ে আমার কাছে জেরা করতে এসেছ?’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
‘একদম না।’
‘তুমি চলে যাও। নাহলে আমার সাথে তোমাকে কেউ দেখলে তোমাকেও পাগল ভাববে।’
‘কে কী ভাবে ভাবুক। আপনার প্রতি আমার খুব কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। আপনি না বললে আমি যাব না।’
‘তুমি তো আচ্ছা পাজি ছেলে। এত জেদ কেন তোমার?’
‘আপনি বললেই আমি চলে যাব।’
‘পাগলের কথা শুনতে তোমার ভালো লাগবে না।’
আমি মুচকে হেসে বললাম,
‘আপনি বলুন, আমার ভালো লাগবে।’
এমন সময় মকবুল চাচা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমাকে দেখে বলে উঠলো,
‘সর্বনাশ বাবা! তুমি ওই পাগলটার সাথে বসে কী করছ? অাব্দুর রহীমই বা কোথায়?’
আমি সশব্দে বলে উঠলাম,
‘চাচা চিন্তা করবেন না, আমার কিছুই হবে না। মজিদ চাচা খুব ভালো মানুষ। আর আব্দুর রহীম স্কুলে আছে। আপনি ওকে বলিয়েন না আমি এখানে আছি।’
চাচা আর কিছু না বলেই হনহন করে চলে গেল। মজিদ পাগলা বলে উঠলো,
‘দেখেছ তো? আমার সাথে তোমাকে দেখলেই পাগল ভাববে। তুমি চলে যাও।’
‘আপনি না বললে আমি যাব না।’
আমার এই কথাটুকু বলা যেন ঢের অন্যায় হয়ে গেল। আমি মজিদ পাগলের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না। শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
.
চারদিকে বাড়িতে বাড়ি অাগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকজনের অধিকাংশরাই বাঁশঝাড়ের মধ্যে গর্ত করে নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখেছে। কেউ বা পুকুরের মধ্যে কচুরিপানার ফাঁকে লুকিয়ে নিজেদের পুড়িয়ে দেয়া বাড়ির দিকে দেখছে আর চোখের পানি ফেলছে। নিজেদের কষ্টার্জিত ঘামের পয়সা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল এই বাড়ি। প্রতিটি স্তরে স্মৃতির ছায়া যেন লেপ্টে আছে।
১৭জন মানুষকে ধরা অানা হয়েছে। প্রত্যেকের চোখে-মুখে এখন বিষণ্ণতার ছাপ। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে সবাইকে মেরে ফেলা হবে।
পাকিস্তানী ক্যাম্পের চারদিকে অসংখ্য পাকিস্তানী সেনারা পাহারা দিচ্ছে। এত সিকিউরিটির মধ্যে কে আসবে তাদের বাঁচাতে? প্রাণটা বুঝি সত্যি এবার দিতে হবে।
১৭জনের কয়েকজন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তাদের মতে, তারা তো নিরীহ, কোনো দোষ করেনি তারা। কেন তাহলে এভাবে কষ্ট দিয়ে শেষে মেরে ফেলা হবে।
বাঙ্গালী রাজাকার একজন ঘরটার ভেতর ঢুকে পড়লো। একজন যুবকের চোয়াল ধরে বললো,
‘বল, সাত্তারদের ঘাঁটি কোথায়?’
ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
‘জানি নাহ স্যার।’
জানি নাহ বলাতে যুবকের গায়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলো রাজাকারটা। এগিয়ে গেল পরের জনের দিকে,
‘বল, মুক্তিবাহিনী কোথায় অাস্তানা গেড়েছে?’
কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘জানি নাহ স্যার।’
তারও গালে দু’টো চড় বসলো। লোকটা আবারো বললো,
‘সত্যি সত্যি স্যার, আমি জানি নাহ।’
অগত্যা তাকে অার প্রশ্ন না করে পরের জনের দিকে এগিয়ে গেল রাজাকারটা। রাজাকারের পিছনে দু’জন পাকসেনা।
মধ্যবয়সী লোকটাকে একই প্রশ্ন করলো সে,
‘মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কোথায়?’
মধ্যবয়সী লোকটা দাঁত কটমট কটমট করতে করতে বললো,
‘জানলেও বলবো না তোদের। আমাদের মেরে ফেললেও বলবো না।’
রাজাকারটা খানিকটা হেসে উঠলো, বিদঘুটে হাসি। সিগারেটের জ্বলন্ত মুখটা মধ্যবয়সী লোকটার হাতের উপর ঘষে দিয়ে বললো,
‘না বললে তো এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি না।’
হাতের জ্বলন্ত অাগুনের ছাপ পেয়ে খুব জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে মধ্যবয়সী লোকটা। রাজাকারটা আবার বলে উঠে,
‘দেখ, বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন হতে পারবে না। এই দেশ পশ্চিম পাকিস্তানই শাসন করবে। তোমরা বৃথা কষ্ট করছো। যা জানতে চাওয়া হচ্ছে বলে দাও। হয়তো তোমাদের জন্য স্যারের কাছে আসি সুপারিশ করতে পারব।’
মধ্যবয়সী লোকটা একদলা থুথু রাজাকারটার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
‘আমার দেশ বাংলাদেশ। খুব শীঘ্রই আমি স্বাধীন হতে পারব ইনশাআল্লাহ। তোরা যে অাশা মনে রেখেছিস তা বাইরে বের করিস না। আর আমার জীবন থাকতেও আমি বলবো না।’
মুখ থেকে থুথু মুছতে মুছতে বললো,
‘ভালো, চালিয়ে যাও। দেখি তোমাদের জন্য আমি কী অতিথি অাপ্যায়ন করতে পারি।’
এই কথা বলে মেয়ে দু’টোর দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। মেয়ে দু’টো ভয়ে চুপসে গেছে। বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেছে পুরো শরীর। ধীর পায়ে সেদিকে গেল রাজাকারটা।
পাকসেনা দুটোকে ইশারা করে বললো,
‘নিয়ে চলো। রাতে স্যারের কোনো অসুবিধাই হবে না আজ।’
মেয়ে দুটোর বাঁধন খুলে দিতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তারা। রাজাকারটার পায়ে ধরে বললো,
‘আমরা কিছুই জানি নাহ। আমাদের সর্বনাশ করবেন না, দয়া করুন।’
রাজাকারটা মৃদু হেসে মধ্যবয়সী লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘রাতটা ভেবে দেখার সময় দিলাম।’
রাত যতই বাড়তে থাকে ভোর ততই কাছে আসে। বন্দিশালার দুপাশের ঘরগুলো থেকে মেয়েদের চিৎকার ভেসে আসে। কখনো বা হাউমাউ করে কান্নার শব্দ শুনতে পায় বন্দিশালার গ্রেপ্তারকৃত বন্দিরা।
নিরবে দু’ফোঁটা অশ্রু ফেলা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকে না।
.
অনেক জোর করা সত্ত্বেও মধ্যবয়সী যুবকের মুখ থেকে কোনো কথা বের করা গেল না। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে কমান্ডার অাদেশ দিলো সে নিজ হাতে সবাইকে ফায়ার করবে। সবাইকে এক এক করে দাঁড় করানো হলো। সকলের চোখ, হাত বাধা।
এমন সময় রাজাকারটা বলে উঠলো,
‘স্যার, আমার মনে হয় এদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অাধমরা করে ফায়ার করা উচিত। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত একটা কথাও মুখ দিয়ে বের করতে পারলাম না।’
কমান্ডার সাহেব বলে উঠলো,
‘ঠিক হে।’
১৭জন নারী-পুরুষের মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করা হলো বড় একটা গর্ত খোড়ার জন্য। পাকসেনাদের ভয়ে খুব দ্রুত কাজটা সমাধা করতে হলো তাকে। তার উপর আরেকটা দায়িত্ব দেয়া হলো যে, সবাইকে মারার পর গর্তে সবাইকে পুঁতে দিতে হবে।
এ কাজের জন্য শুধু তাকেই জীবিত রাখা হবে। হালকা গড়নের লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখা হলো।
অাকাশ কালো মেঘে ছেঁয়ে গেছে। টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছে। ১৬জন বাঙ্গালীকে গাছের সাথে ঝুলানো হলো। শূন্যে পা দাপাতে দাপাতে একটা সময় সকলেই নিস্তেজ হয়ে পরে। প্রথম ধাপ শেষের পরে ফায়ার করে জীবনের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়া হয়।
পাকসেনারা তাদের কাজ শেষ করে চলে যায়। চলে যাওয়ার সময় রাজাকারটার মুখে ছিলো হাস্যোজ্বল। হ্যাবলা লোকটা লাশগুলো গাছ থেকে নামাচ্ছিলো আর হাউমাউ করে কাঁদছিলো। এরা তো তারাই যারা তার প্রতিবেশী কিংবা অাপনজন।
অনেক কষ্টে সারিবদ্ধভাবে লাশগুলোকে রেখে গামছাটা মাথায় বেঁধে দাঁড়িয়ে পরে। তৎক্ষণাৎ আরো কয়েকজন এসে তার সাথে দাঁড়িয়ে পরে। জানাযা পড়তে হবে যে!
জানাযা শেষ করে লাশগুলোকে গর্তের মধ্যে রেখে মাটি চাপা দিয়ে দেয় লোকটি।
কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সারাদিন হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে নিঃস্ব লোকটি।
.
এতক্ষণ সেই একটি দিনের কথাগুলো বলছিলো মজিদ পাগলা। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। পানির বেগে দাড়ি ভিজে গেছে। এমন ঘটনা শুনে নিজেকে স্থির রাখাটা আমার জন্য খুব কষ্টকর হয়ে পড়লো।
এত কষ্ট, বেদনা নিয়ে কোনো মানুষ বেঁচে থাকে?
মজিদ পাগলা শান্তস্বরে বললো, ‘তারপর যুদ্ধ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। কতকিছুই না হলো, কিন্তু আমার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কারো কাছেই বলতে পারিনি। যখনই বলতে গিয়েছি তখনই পাগল ভেবে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আজ সাতচল্লিশটা বছর আমি এই ১৬জনের বদ্ধভূমিটাকে পাহাড়া দিচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশ তো তারা দেখে যেতে পারল না, একটু নাহয় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাক। মানুষ জানে, এখানে কিছু মানুষকে মেরে ফেলার পর পুঁতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পিছনের গল্প কেউ জানে না। আমা জানি শুধু, আমিই। তুমি জানো সেই রাজাকারটা কে ছিলো?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘না তো।’
মজিত পাগলা হাহা করে হেসে বললো, ‘আজকের প্রধান অতিথিই সেই রাজাকার। মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করে এখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। সংসদে অাসনও নাকি পেয়েছে। তার কত সম্মান!’
উনার কথাশুনে আমার মাথাটা শুধু ঝিমঝিম করছে। চোখের কোণায় জমে থাকা পানিগুলো শুকিয়ে গেছে মনে হয়।
আমি একটু সংকোচের সাথে বলে উঠলাম, ‘তখন থেকেই কি গ্রামের নাম ফাঁসিতলা?’
মজিদ পাগলা মেকি হেসে বললো, ‘হ্যাঁ।’
হ্যাঁ শব্দটা উচ্চারণ করে বদ্ধভূমিটার দিকে অাস্তে অাস্তে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে গান গাইতে লাগলো,
‘এক সাগর এ রক্তের বিনিময়ে,
বাংলার স্বাধীনতা অানলে যারা,
আমরা তোমাদের ভুলব না।’
একটু পাগলা টাইপের হলেও তার গানের গলাটা খুব সুন্দর। পকেট থেকে রুমালটা বের করে মুখটা মুছে নিলাম।
.
অাব্দুর রহীমের পাশে বসতেই সে রাগী মনোভাব নিয়ে বলে উঠলো, ‘অাসল মজাটুকুই মিস করলি। এখন এসে আর কী দেখবি বল?’
আমি মৃদু হাসলাম। হয়তো সে আমার হাসির কারণ বুঝতে পারেনি। স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। কিন্তু আমার মন তো মজিদ পাগলের সেই কথাগুলোকেই টানছে। যে কথাগুলো বা দৃশ্যগুলো সাতচল্লিশটা বছর নিজের বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছে। এসব ভাবতেই ফের এক ফোঁটা অশ্রুকণা আমার চোখ বেয়ে গাল স্পর্শ করলো।
(সমাপ্ত)
পূনর্জন্ম
জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...
বাংলাদের পতাকা-বাংলাদেশের পতাকা
রহীমের-রহিমের
রহীম-রহিম
কী-কি
শুনে-শোনে
নাহয়-না হয়
শহুরে -শহরের
পাছে-পাশে
ওনার-উনার
গেড়েছে-গড়েছে
আসি সুপারিশ -আমি সুপারিশ
সমাধা-সমাধান
নাহয়-না হয়
আমা-আমারটা
অসাধারণ গল্প ছিল, একদম বাস্তব ঘটনা ফুটে উঠেছে গল্পের মাঝে। পড়ে অনেক অনেক ভালো
লেগেছে। কিন্তু বানান ভুলের মাত্রা বেশি। আর কি ও কী এর ব্যবহারেr নিয়ম হয়তো লেখকে জানে না। কী ব্যবহার হয় ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আর কি হ্যাঁ কিংবা না বলার ক্ষেত্রে। গল্পের মাঝে ব্যাখ্যা না করার উক্তিতেও কী ব্যবহার হয়েছে। তবে অনেক ভালো ছিল গল্পটা । হৃদয় ছুঁয়ে গেল, শুভ কামনা রইল।
মাত্রাতিরিক্ত ভালো লাগলো গল্পটি পড়ে। অসম্ভব সুন্দর। কিন্তু গল্প সময় নিয়ে এডিট করোনি মনে হচ্ছে। কিছু বানান ভুল আর টাইপিং মিস্টেক চোখে পড়লো
অসাধারণ লিখেছেন।
গল্পের থিমটা ভালো ছিলো।
চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন।
মনোমুগ্ধকর লেখা।
তবে প্রতিযোগিতার গল্প বানানের প্রতি খেয়াল রাখবেন।
শুভ কামনা রইলো।
আসসালামু আলাইকুম। গল্প প্রসঙ্গে কিছু কথা :
গল্পটা মোটামুটি লেগেছে। বেশ কিছু ভুল রয়েছে। সবচেয়ে বড় যেটা গড়মিল তা হলো দেশ স্বাধীনতা লাভের আগেই কীভাবে দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’ হলো।
দেখ বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন হবে না – কীভাবে বাংলাদেশ হলো স্বাধীনতার আগেই?
আমার দেশ বাংলাদেশ -?
অন্যান্য ভুলগুলো নিচে তুলে ধরা হলো :
ষাটোর্ধ – ষাটোর্ধ্ব
ধপাস বসে পড়ে – ধপাস করে বসে পড়ে
ততক্ষণে – ততোক্ষণে
আমার ওর হাত শক্ত করে ধরে বললাম – আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে বললাম
একথা – এই / এ কথা
এখনে – এখনো
এখনি – এখনই
মেখে নেই – মেখে নিই
এমন সময় প্রধান অতিথি গাড়ি চলে আসলেন – এমন সময় প্রধার অতিথির গাড়ি চলে আসলো / এমন সময় প্রাধান অথিতি গাড়ি করে চলে আসলেন
সম্মোধন – সম্বোধন
এককোনায় – এক কোণায়
উনার পাশে গিয়ে খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো। – উনার পাশে গিয়ে বসতে খু৷ ইচ্ছে হচ্ছিলো
এত – এতো
মুচকে – মুচকি
দেখ – দেখো
আসি – আমি
ততই – ততোই
নিস্তেজ হয়ে পরে – নিস্তেজ হয়ে পড়ে
আমা – আমি
কথাশুনে – কথা শুনে
দাঁড়িয়ে পরে – দাঁড়িয়ে পড়ে
মুখে ছিলো হাস্যোজ্জল – মুখ ছিলো হাস্যোজ্জ্বল
আগামীর জন্য শুভ কামনা।
মুচকে – মুচকি
দেখ – দেখো
আসি – আমি
ততই – ততোই
সম্মোধন – সম্বোধন
অনেক সুন্দর ছিল তবে তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন মনে হচ্ছে।
কয়েকদিন আগে, সম্ভবত রাজশাহীতে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকি একটা কথা বলেছিলেন অনেক আফসোস করে যে, যারা রাজাকার তাদেরকে বসানো হয়েছে মন্ত্রীর পদে, আর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাজাকারের পদক।
বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ মিল আছে গল্পটার।
বানানে কিছু ভুল থাকলেও লেখার মান সুন্দর আছে।