লেখক: আরিফ আকবর
ক্রিং ক্রিং..! ক্রিং ক্রিং..!
বালিশ থেকে একটু মাথা তুলে ঘড়ির এলার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লো রিফাত। ঘুম ভেঙে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একরকম লাফিয়ে ওঠে সে।
‘একী! এতক্ষণ ঘুমালাম আমি!’
একথা বলে দ্রুত বাথরুমে গিয়ে তড়িঘড়ি অজু করে নামাজে দাঁড়ালো রিফাত। এখন ছয়টা বাজে। সাধারণত সে কখনো এতো দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে না। তার এলার্ম দেওয়া থাকে চারটায়।
নামাজ শেষ করে শেষ বারের মত ‘হোম ওয়ার্ক’ গুলো দেখে নিচ্ছে সব ঠিকঠাক আছে কি না।
ঠিক সাতটার সময় পড়ার টেবিল থেকে উঠে গোসলে যায়। গোসল, খাওয়া ও ক্লাসে বের হওয়ার জন্য সে সময় নেয় ৪৫ মিনিট। এসময়ের মধ্যে যেকোনো মূল্যে এই তিনটি কাজ সেরে সে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবে। স্কুলবাস আসলে তারপর সেটাতে করে সে স্কুল যাবে।
বলা যায়, তার জীবনটা নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর হ্যাঁ, এই নিয়মের প্রবর্তক সে নিজেই। ভোর চারটায় ঘুম থেকে ওঠা, নামাজ পড়া, পড়তে বসা, সাতটার সময় উঠে গোসল, খাওয়া ও ক্লাসের জন্য প্রস্তুত হওয়া। বিকেল তিনটায় ঘরে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ঠিক একঘণ্টা ঘুমানো। ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ খেলাধুলার পর মাগরিবের নামাজ পড়া। মাগরিবের পর থেকে ১২ টা পর্যন্ত পড়াশুনা। এর মাঝে ৪০ মিনিট সময়ে নামাজ ও রাতের খাবার খাওয়া।
এই নির্দিষ্ট নিয়মগুলোর বাইরে সে কখনো কিছু হতে দেয় না।
কিন্তু হঠাৎ করেই তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়! সম্প্রতি সে কিছু সময় তার ফোনের পিছনে ব্যয় করে। ফলশ্রুতি কোনো কোনো সময় কিছু নিয়মের ব্যতিক্রম হচ্ছে তার অজান্তেই। এমনকি নামাজেও অলসতা শুরু হয়েছে!
ক্রমশ এটা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। বিশৃঙ্খলা শুরু হলো তার শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে। অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার মাঝে ঢুবে যেতে থাকলো একটি বিশুদ্ধ-সুশৃঙ্খল আত্মা।
কিন্তু তার এই অবনতির মূল কারণটা কি? ফোনে রাত-দিন কী এমন করে সে!
রিফাতের সেই সুশৃঙ্খল জীবন বিশৃঙ্খল হওয়ার পিছনে একমাত্র কারণ হচ্ছে, নারী। নারী সঙ্গ তাকে তলিয়ে দিয়েছে বিশৃঙ্খলার অতল গহ্বরে।
কীভাবে যেন একটি মেয়ের সাথে তার পরিচয় অতঃপর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আমাদের সবারই একরকম মোহ কাজ করে। রিফাতও এর ব্যতিক্রম নয়।
কখন যে নিজের মনটা অন্যের নামে করে দিয়েছে, তা সে নিজেও টের পায়নি! বন্ধুত্ব থেকে সম্পর্কটা প্রেমে উন্নীত হয়েছে। সব নিয়ম ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে, তার ভালোলাগা-মন্দলাগার ব্যাপারগুলি তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র একজনকে ঘিরে। সে এখন ভিন্নরকম ভালোলাগা অনুভব করে। নির্দিষ্ট কোন শৃঙ্খলে এখন আর সে আবদ্ধ নয়; সে এখন মুক্ত। অবশ্য সরাসরি মুক্ত বলা হয়তো ঠিক হবে না। এখনো সে একটা শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এই শৃঙ্খলে নিয়ম করে খেতে হয় না, গোসল করতে হয় না, ঘুমোতে হয় না— সারাদিন শুধু তাকে সময় দিলেই হয়! আর যখন না খেলেই নয়, তখন একটু খাবার খাওয়া।
মেয়েটি যে তাকে এমন করতে বলে, তা কিন্তু নয়! মেয়েটি তাকে সময়মত খেতে বলে, গোসল করতে বলে, ঘুমোতে বলে; কিন্তু রিফাত কৌশলে এসব প্রসঙ্গ কাটিয়ে ওঠে। ‘একটু পরে খাবো’ বললেও একটু পর আর খাওয়া হয় না। সব কিছু ভুলে যায় দুজনেই। মেতে ওঠে প্রেমালাপে। প্রেমের স্বাদ আস্বাদন করতে করতে ঘুমের মধ্যে হারিয়ে যায় দুজনেই।
এখন আর ভোর চারটায় ঘুম থেকে ওঠা হয় না। সূর্যের তাপ গায়ে লাগলেই ঘুম ভাঙে তার। ঘুম থেকে উঠে অজু করে আর নামাজ পড়া হয়ে ওঠে না। এখন ফোনটা হাতে নিয়ে প্রেমিকাকে ‘সুপ্রভাত’ জানাতে হয়। নিজে না খেয়ে শুয়ে থেকে ওপারের জন সকালে কি নাস্তা করল, সেটা জানার জন্য উৎসুক হয়ে থাকে।
এখন আর ক্লাসের সেরা ছাত্রের পুরষ্কারটি তার হাতে ওঠে না। সারামাসে একদিনও অনুপস্থিত না থাকার জন্য যে পুরষ্কার দেওয়া হয়, সেটাও সে আর ছুঁতে পারে না। ক্লাসে স্যারের করা প্রশ্নের সবচে’ উপযুক্ত উত্তর দিয়ে সে আর বাহবা পায় না। সময়ের আবর্তনে সব পাল্টে গেছে।
ক্রমশ গভীর হতে থাকে তাদের সম্পর্ক। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে সে। হারিয়ে যায় অজানা ভুবনে। আহ্! এই ভুবনটা কত সুন্দর! কত মধুর! এই ভুবনে যা ইচ্ছে করা যায়। আচ্ছা, আসলেই কি করা যায়? এর বাস্তবতা কতটুকু?
স্বপ্নের মত দুনিয়াতেও কি তেমন ছোট্ট একটা ঘর বানানো যায়? যেখানে শুধু তারা দুজনই থাকবে। তৃতীয়জন যে হবে সে তাদের আদরের ছোট্ট ফুটফুটে একটি বাচ্চা। বাড়ির চারিদিকে থাকবে ফুলের বাগান। সেই বাগানে তিনজন মিলে খুব মজা করে খেলবে। বড় একটা গাছ থাকবে, যে গাছে থাকবে একটি দোলনা। আর সেখানে বসে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত করবে। আরও কত কী….!
কিন্তু বাস্তবতা ঠিক এমনটা নয়! বাস্তবতা বড় কঠিন। আর এই জিনিসটা বুঝতে রিফাত বেশ দেরি করে ফেলেছে। যখন বুঝলো তখন সেখান থেকে ফেরা বেশ কষ্টসাধ্য তার জন্য।
হ্যাঁ! রিফাত এখন তার ভুল বুঝতে পেরেছে। নিজে থেকেই যে বুঝেছে ঠিক তা নয়। তার বন্ধু অনিক চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সে ভুল পথে এগুচ্ছে।
রিফাত তার ভুল বুঝতে পেরে ছুটে আসে বাড়িতে। ঘরের দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে প্রায় দেড় ঘণ্টা। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
তার ঘুম ভাঙে প্রায় ৩ ঘণ্টা পর। দিনের বেলায় এমন দীর্ঘক্ষণ ঘুম আগে কোনোদিন ঘুমায়নি। ঘুম থেকে উঠে চিন্তা করছে কিভাবে সে প্রত্যাবর্তন করবে। কোন উপায় তার মাথায় আসছে না।
বালিশের কাছে পড়ে থাকা ফোনটা বাজছে সেই কখন থেকে! রিংটোন যেন তার কান পর্যন্ত যাচ্ছেই না! অবশেষে কী মনে করে ফোনটা রিসিভ করল।
‘কী হয়েছে তোমার! সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু তোমার ফোন তোলার তো কোন নাম কথাই নাই!’ রাগান্বিত কণ্ঠে বলে ওঠে মেয়েটি।
‘না, কিছু না। ঘুমাচ্ছিলাম তো তাই।’
‘যতবার রিং দিয়েছি তাতে আমার মনে হয় একজন মৃত মানুষও লাফিয়ে উঠে ফোন তুলবে। আর তুমি….’
‘মরেই তো গেছি!’
‘কী বললে তুমি! এসব আজেবাজে কথা মুখে নাও কেন, বলতো।’
‘এমনিই বললাম। আচ্ছা পরে কথা বলছি। বাই!’
তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খট করে ফোনটা কেটে দিল রিফাত।
সময় যত যাচ্ছে দুশ্চিন্তা তাকে ততই গ্রাস করছে। তাকে কিভাবে সব বলবে ভেবে পাচ্ছে না। যাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন দেখা, তাকে কী করে বলবে, ‘আমি আর তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই না! তোমাকে নিয়ে যা করেছি, যা ভেবেছি, যেসব স্বপ্ন দেখেছি, তা ছিল নিতান্তই ছেলেমানুষি। আমাদের এই স্বপ্ন দেখা ভুল ছিল। আমরা ভুল পথে এগুচ্ছি।’
সে কষ্ট পাবে বলে এসব আর বলতে পারে না রিফাত। মনের বিরুদ্ধে কথা চালিয়ে যায় তার সাথে।
রাতের অন্ধকারে বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা যখন মোমবাতি জ্বালাই। সেসময় কিছু পোকা তার চারপাশে উড়তে থাকে। তারা জানে এটা আগুন, এখানে পড়লে মারা যাবো। তবুও উড়তে উড়তে একসময় আগুনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে। নিজেকে রক্ষা করতে আর সক্ষম হয় না।
রিফাতের ব্যাপারটা ঠিক এমনই। সেই পোকা যেমন সব জেনেও আগুনের চারপাশে ঘোরে, লাফ দেয়, মারা যায়; মৃত্যু থেকে নিজেকে ফেরাতে পারে না। ঠিক তেমনিভাবে রিফাত সব জেনেও ফিরতে পারছে না।
মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এভাবে আরও কিছুদিন অতিবাহিত হলো। শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও। স্কুলের বারান্দায় আনমনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিল সে। হঠাৎ অনিক তার হাত ধরে টেনে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। রিফাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে তোর? কি নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা করছিস?”
রিফাত করুণ ভাবে বলল, ‘দোস্ত পারছি না রে…’
‘পাগল কোথাকার! ওটা নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা তোর! একদম ভাববি না ওসব। বুঝলি?’
‘আমি তাকে কী করে সব বলব! সে যে কষ্ট পাবে। কেউ আমার জন্য কষ্ট পাক, এটা আমি চাই না।’
‘শোন, তাকে তুই বুঝিয়ে বল যে, তোরা ভুল পথে এগুচ্ছিস। এই পথে থাকলে তোরা এপারওপার কোন পারেই সফল হতে পারবি না।’
‘আমি তো বুঝতে পারছি কিন্তু এটা কি সে বুঝবে?’
‘তোর আত্মা মুক্তির জন্য যে আর্তনাদ করছে সেটা মূল্যায়ন করতে হবে তোকে। সে না বুঝলেও তোকে ফিরতে হবে। কেন জানিস? কারণ, তুই এখন তাকে ছেড়ে দিলে হয়তো সে তোকে অভিশাপ দিবে। তোর উপর যে বিশ্বাস ছিল সেটা চূর্ণ হবে। কিন্তু এখন যদি তাকে না ছাড়িস, তাহলে সে তোকে আমৃত্যু অভিশাপ করবে। কেননা, তোর পিছনে তার যে মূল্যবান সময় নষ্ট করছে তাতে করে সে কখনো প্রকৃত সুখি হতে পারবে না। আর এর কারণ হিসেবে সে তোকেই দায়ী করবে!’
‘কী বলছিস এসব!’
‘হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি। এখন প্রত্যাবর্তন করলে হয়তো সাময়িক কষ্ট সে পাবে; কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারবে তুই ঠিক ছিলি। তখন সে তোর জন্য অন্তর থেকে দুয়া করবে।’
‘তুই ঠিকই বলেছিস রে দোস্ত।’
‘সবচে’ বড় কথা কী জানিস, আল্লাহকে খুশি করার জন্য কোন কাজ করতে চাইলে, কে কি ভাবল সেটার তোয়াক্কা করা যাবে না। আল্লাহ খুশি মানে, তুই ঠিক পথে আছিস, উত্তম কাজটাই করেছিস। আর এতেই তোর কল্যাণ রয়েছে। কেননা, মহান আল্লাহর খুশিতেই তো বান্দার কল্যাণ নিহিত!’
‘হুম..!’
আর কিছু না বলে বাসায় যাওয়ার জন্য হাটতে লাগলো রিফাত। তার ঠোঁটের কোণে হাসির আভা স্পষ্ট। অনিকের কথা তার অন্তরে গেঁথে গিয়েছে। বুঝতে পেরেছে অনিক যথার্থই বলেছে। তাই সে অনিকের সবগুলো কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
শুধু বিশৃঙ্খলার উপমা দিতে যদি অর্ধেক গল্প ব্যায় করেন তাহলে বাকিটা হবে কী? গল্পের ছেয়ে উপমা বেশী হয়ে গেলো। আর কিছু শব্দে ভুল আছে।
-ঢুবে – ডুবে
– ছুয়ে -ছুঁয়ে
-সবচে- সবচেয়ে
আরো বেশ কিছু ভুল।
আর গল্পের বিষয় নিয়ে বলতে গেলে এটা খুব কমন বিষয়। বয়ঃসন্ধিকাল কালে এসব সবার জীবনেই ঘটে। খুব কমন বিষয় নিয়ে গল্প পড়ার আগ্রহ খুব কম মানুষের-ই থাকে।