রাজীব সূত্রধর
কী হে ছোকড়া, এখানে কী?
কিছু না, স্যার।
কিছু না যখন তখন ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন গর্ধভের মতো?
এমনিতেই স্যার।
আমায় দেখে তোর শখ জেগেছে না? মশকরা হচ্ছে আমার সাথে?
না, স্যার।
আবার বলে না স্যার। বলি কিছুই যখন না, তখন এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন?
এমনিতেই স্যার।
ধর, গুনে গুনে ১০০ বার কান ধরে উঠবস কর।
হরিদাস বাবুকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটা সত্যি সত্যি কান ধরে উঠবোস শুরু করলো। গুনে গুনে ১০০ বার ধরা শেষ করলো। শেষ করেই বললো, স্যার শেষ।
এইবার হরিদাস ছেলেটাকে একটু খেয়াল করে দেখলেন। তার বয়স হওয়ার সাথে সাথে বিরক্ত হওয়ার বদগুণটা বেড়েই চলেছে। শিক্ষকতা থেকে পেনশন নিয়ে নিশ্চন্তে দিন কাটানো মানুষকে দুপুরবেলা ঘুমের সময় কলিং বেল বাজিয়ে ঘুম ভাঙালে বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ছেলেটা মোটামুটি ভদ্র মতোই। মাঝারি ধরনের স্বাস্থ্য, ডানদিকে কাত করে আচড়ানো চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, ফুলহাতা শার্ট, কালো রঙের প্যান্ট। সবই ঠিক ছিলো, সমস্যা শুধু এক জায়গায়, মাথায় তেলে চুলে মাখামাখি। দূর থেকেও তার চকচক করা মাথা স্পষ্ট দেখা যায়। মোটা করে আচড়ানো চুলের সিতি। হয়তো এজন্যেই ছেলেটাকে একটু বোকা বোকা লাগছে। বয়স বেশি না। বাইশ তেইশ হবে। কিন্তু মোটা ফ্রেমের চশমাটার কারণেই হয়তো তার বয়স মোটামুটি ত্রিশের কাছাকাছি মনে হচ্ছে।
হরিদাস বাবু বললেন, কে তুই ছেলে? নাম কী তোর?
স্যার, নবীন। নবীন মীর্জা।
এখানে কী চাই?
আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
আমার সঙ্গে কী?
কিছুই না স্যার। শুধু একটু কথা বলতে চাই। একটা ঘটনা শুনাতে চাই।
তুমি কে হে? আর ঘন ঘন এত স্যার স্যার করছো কেন?
স্যার,সবই বলবো আপনাকে।
তুই জানিস, দুপুরবেলা কারো বাড়িতে যাওয়া এক ধরনের বেয়াদবির মধ্যে পড়ে? কারো বাড়িতে যেতে হয়, সকালে,বিকালে বা রাতে। কিন্তু দুপুরে কখনোই নয়।
জানি স্যার।
এটা হলো প্রথম অপরাধ। আর দ্বিতীয় হলো আমি প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে কোন দরকারে এসেছিস। বললি এমনি এমনিই এসেছিস। মিথ্যে বলেছিস। এবার আগে ২০০ বার কান ধরে উঠবোস করবি তাও ওয়ান, টু, থ্রি এইভাবে গুনবি। তারপর বাকি কথা।
নবীন মির্জা এবারেও ২০০ বার কান ধরে উঠবোস করলো। হরিদাস বাবু তাকে নিয়ে ঘরে বসালেন। এক গ্লাস পানি আর দু’মুঠো মুড়ি আনতে গেলেন ছেলেটার জন্য। তার জন্য বড় মায়া হচ্ছে। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অবসর নেওয়ার পরেও বাদ দিতে পারেন নি। নবীন মির্জা এর ফাঁকেই ঘরটা একবার দেখে নিলো। ঘরটা আধাপাকা। ইটের ভাঙা দেয়াল, টিনের ছাদ। যথেষ্ট বয়স্ক একটা ফ্যান মাথার উপর ঘুরছে আপন মনে। সে বসে আছে একটা পুরনো কাঠের চেয়ারে। চেয়ারের হেলান দেওয়ার অংশে কাভার লাগানো। ছোট একটা ঘর, চেয়ার থেকে ৩ হাত সামনে মাঝারি আকারের একটা বিছানা। বিছানার সামনে দেয়ালে ইংরেজি ক্যালেন্ডার। সাধারণত বাঙালি ক্যালেন্ডার লাগায় ঘর সাজানোর জন্য। ক্যালেন্ডারে তারিখ তারা খুব কমই দেখে। অনেক সময় দেখা যায় মে মাস এসে গেলেও এপ্রিল মাসের পাতাটা ক্যালেন্ডারের সামনে আনা থাকে। কিন্তু এই ক্যালেন্ডার যথেষ্ট পরিষ্কার, প্রতিদিনই পরিষ্কার করেন মনে হচ্ছে। নবীনের চেয়ারের বাম পাশে ছোট একটা পড়ার টেবিল। টেবিলের উপর মস্ত বড় একটা ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধান। একটা র্যাকের মতো করে বানিয়ে টেবিলের পাশে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ সহ বেশ কয়েকটি সাহিত্যের আর ইতিহাসের বই আছে। তার মাঝে একটা শেখ মুজিবর রহমানের। এক ঝলকে এগুলোই নজর কাড়ে বেশি। উপরে মাঝখানে টিনের ছাদের সাথে একটা হাড়ি ঝুলানো। এই যা আসবাবপত্র।
হরিদাস বাবু ঘরে ঢুকলেন। হাতে এক গ্লাস পানি আর এক বাটি মুড়ি আর গুড়।
বললেন,কথা পরে হবে। আগে দু’মুঠো মুড়ি খাও বাছা। একা থাকি। এর বেশি কিছু করতে পারলাম না।
হরিদাস বাবুর হাত থেকে মুড়ির বাটি আর পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে নিঃশব্দে পানি খেল ছেলেটা। মুড়ির বাটি থেকে দু’মুঠো মুড়ি খেল খুব সাবধানে যেন আওয়াজ না হয়৷ ছেলেটার ভাবভঙ্গিতে বুঝা যাচ্ছে যে, ছেলেটা তাকে বেশ সম্মান করে। কিন্তু তাকে ঠিক চিনতে পারছেন না। আগে কখনও দেখেছেন বলেও মনে করতে পারলেন না অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
হরিদাস বাবু বললেন, এবার বলো কী বলতে চাইছিলে?
ছেলেটা মুড়ির বাটি পাশের টেবিলে রেখে বললো, স্যার, আমাদের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নারগানা গ্রামে। মোটামুটি সম্ভ্রান্ত পরিবার আমাদের। আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম আমি। আমার বড় এক বোন ছিলো। জন্মের ৩ বছরের মাথায় ম্যালেরিয়া রোগে সে মারা যায়। সেই জন্যই হয়তো একটু বেশিই আদর পেতাম সবার কাছ থেকে। তখন ছিলো ২০০২ সাল। বর্ষাকাল। আমার বাবার নামডাক শুনে আপনি এসেছিলেন কাজের জন্য। সঙ্গে আপনার মেয়ে অরি। বাবা আপনাকে আমাদের বাসায় থেকে কাজ করতে বললেন। আপনাকে তিনি একটা স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ দিলেন। শর্ত শুধু একটাই, আপনি যতদিন সেখানে থাকবেন ততদিন আমাকে পড়াতে হবে। আপনি ও রাজি হলেন। আপনারা থাকতেন নিচ তলায়। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। বাবা আপনাকে গ্রামের হাই স্কুলে চাকরি পাইয়ে দিলেন। আপনি স্কুল থেকে ফিরে আমাদের নিয়ে সন্ধ্যাবেলা পড়াতে বসতেন। আপনার কি কিছু মনে পড়ছে, স্যার?
হরিদাস বাবু বললেন, মনে পড়েছে। তুমি তাহলে আমার অন্নদাতার ছেলে? উনি কেমন আছেন? মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় আমি আর সেখানে থাকতে পারিনি। এখানে মেহেরপুরে চলে আসি। আর ওইদিকে যাওয়া হয়নি।
নবীন বললো, বাবা গত হয়েছেন ৪ বছর আগে। আপনার চলে আসার পর বাবা আমায় বিলেতে পড়ার জন্য পাঠিয়ে দিলেন ফুফুর কাছে। তাদের কাছেই আমি বড় হয়েছি। বাবা গত হওয়ার পর দেশে ফিরে আসি। এখানে এসে বাবার ব্যবসা সামলাতে শুরু করি। আর পড়া হয়নি। তারপর থেকে আপনাকে খুঁজছিলাম।
শুনে খুব খারাপ লাগলো। আমাকে কেন খুঁজছিলে, বাবা?
আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য।
এ কেমন ধারা কথা বাবা! তুমি কেন ক্ষমা চাইবে?
আপনার বর্তমান একাকিত্বের কারণ আমি। আমিই আপনার মেয়েকে পানিতে ফেলে মেরে ফেলেছিলাম।
কী বলছো এসব?
যা সত্যি, তাই বলছি। অরি পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো ছিলো। কিন্তু, আমার কেন জানি আপনাকে ভালো লাগতো না। আপনি আমায় পড়াতেন ভালো করেই। কিন্তু আমি ইচ্ছা করে বুঝতে চাইতাম না। প্রথম দিকে আপনি কিছু না বললেও শেষের দিকে একটু একটু কঠোর হতে শুরু করেন। পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণে বাবাও আমায় বকাঝকা করতেন মাঝে মাঝে। ছোট ছিলাম। তখন এতো কিছু বুঝতাম না যে আপনারা আমার কতটা খেয়াল রাখতেন। ছোট থেকে সবার আদর পেয়ে বড় হয়েছি। আপনি আসার পর থেকে আমার জন্য নতুন অবস্থা তৈরি হলো। আর আমি…
হরিদাসবাবু মাটিতে বসে পড়েছেন। তার মাথায় হাত। উদ্ভ্রান্ত চোখে একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। নবীন মীর্জা সেদিকে খেয়াল না করে একমনে বলে যেতে লাগলো। আজ না বললে হয়তো আর কোনদিনই বলা হবে না।
অরি তখনও সাঁতার শেখেনি। আমার তখনকার অবস্থার জন্য আমি অরিকেই দোষ দিতাম। ও ছিলো আমার সমবয়সী কিন্তু ও যেখানে সবার প্রশংসা পেত, আমি পেতাম ভর্ৎসনা। তাই খেলার ছলে একদিন ওকে আমাদের বাড়ির পেছনের বিলে নিয়ে যাই। অরির ডুবার জন্য যথেষ্ট গভীর ছিলো বিলটা। আপনারা চলে আসার পর আমার ধরাপড়ার ভয়টাও কেটে গেলো। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পর বুঝতে পারলাম দোষটা আমারই। নিজেকে যদি ঠিক করতে পারতাম তাহলে হয়তো বর্তমান একটা ভিন্ন ছবি দেখাতো আমাদের।
হরিদাসবাবু মাটির দিকে চোখ না সরিয়েই বললেন, তুমি এখানে কেন এসেছো?
নবীন মির্জা তার শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে বললো, ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা চাইতে এসেছি স্যার। আর আপনাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে এসেছি।
যার মৃত্যুর পর ঐ জায়গা ছেড়ে এসেছি, তার মৃত্যুর কারণ জানার পর সেখানে ফিরে যাবো ভাবলে কীভাবে? বাবা, আমার তোমার প্রতি কোন বিদ্বেষ নেই। তুমি তখন ছোট ছিলে। তুমি এখন আসতে পারো।
যাওয়ার আগে একটা সালাম করতে পারি, স্যার?
শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকের আশীর্বাদ সবসময় থাকে৷ সে শিক্ষার্থী ভালো হলেও আর খারাপ হলেও।
রাত হয়েছে। হরিদাসবাবু ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন চেয়ারে। আজ বহুদিন পরে তার চোখের কোণায় কয়েক ফোঁটা পানি জমেছে। মেয়ের মৃত্যুর পর আজ প্রথম তিনি অরিকে দেখলেন। বন্ধ দরজার হেলান দিয়ে মেয়েটা উসকো-খুসকো চুলে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আগের মতোই আছে। এতো বছরেও তার বয়স বাড়েনি বিন্দুমাত্র। বাবার সদ্য কিনে দেওয়া লাল জামা সে পরে আছে। চুলের বেনীতে নীল ফিতা। নিজের হাতে মেয়েকে সাজিয়ে সেদিন তিনি স্কুলে গিয়েছিলেন। আজ তার আর স্কুলে যেতে হয় না। সারাদিন তার ঘরে কাটে। টাকার জন্য কারো কাছে যেতেও হয় না। পেনশনের টাকায় তার মতো একলা মানুষ যথেষ্ট আরামেই মৃত্যুর স্বাদ পাওয়ার অপেক্ষা করতে পারে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ বর্ষা তার সময়ব্যাপ্তির মাঝপথে। ৫৬ বছর বয়েসী এক ব্যক্তিকে দেখা গেলো বৃষ্টির মধ্যে এলোপাথাড়ি ভাবে হাঁটতে। সে একবার ডানে গিয়ে আবার বামে ফেরে। হঠাৎ করে গর্জন করে তার বুক চাপড়ায়। আবার নিজের মনেই হাত সামনে এনে এমনভাবে হাত নাড়াচ্ছে যেন কাউকে আদর করছে। তার উন্মাদ ভঙ্গি দেখা গেলেও তার চিৎকার শোনা গেলো না। বৃষ্টি বেশ দক্ষতার সাথেই তাকে নিরব করে রেখেছে।
ঠায়-ঠাঁয়
চাই -চায়(যেহেতু অন্যজনের কথা বলা হয়েছে)
পারেন নি-পারেননি(নি শব্দের সাথে বসে)
বাবা মায়ের-বাবা-মায়ের
শুনে-শোনে
চাইবে-চায়বে
বাহ্ বেশ ভালো লিখেছেন। মানুষ যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন তাকে ক্ষমা করা দেওয়াই উচিত। যেমন গল্পের শিক্ষক নবীনকে ক্ষমা করে দিল। কিন্তু স্মৃতি যে শুধু কষ্ট দেয়। গল্পটা পড়ে কিছুটা কষ্ট লাগল। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে ফেলল এর থেকে কষ্ট আর কি আছে। শুভ কামনা রইল।
ভালো লাগলো গল্পটা অনেক। আপনার লেখনী সুন্দর।
সিতি- সিঁথি।
নিরব- নীরব।
শুভ কামনা এগিয়ে যান।
শিক্ষকের স্থান সর্বদাই উপরে। তাঁদের তুলনা হয় না। গল্পটা মন ছুঁয়ে গেল।