লেখক- জিনিয়া জেনিস
‘ খা******,কেমনে প্যাট বাঁধায়লি ? ওমন কথা কওনের আগে বিষ খাইতে পারলি না ! ‘
ফযরের নামাজের পর আমার ঘুমোনোর অভ্যেস নেই।গতরাত অনেকটা নির্ঘুম কেটেছে বলেই সকালে বাকী ঘুমটুকু হয়ত চোখদুটোকে ছেঁকে ধরেছিলো।বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কখন যে চোখের পাতা দুটো এক হয়েছিলো জানি না।হঠাৎ পরিচিত কন্ঠের আভাসে আমি বিছানা থেকে যেন এক লাফে উঠে গেলাম।করিডোর পেরিয়ে যেতেই নীরা ধড়াম করে ঘরের দরজাটা আটকে দিলো।নীরার দরজা আটকানোর ধরনে বোঝা যাচ্ছে এই মুর্হূতে চিৎকার চেঁচামেচিতে সে যথেষ্ঠ বিরক্ত।নীরা- আমার বড় মেয়ে।ইংরেজিতে অর্নাস করছে।আমি অবশ্য চেয়েছিলাম মেয়েটা বি.বি.এ করুক।প্রতিবারের মত সেবারও নীরা আমার কথার বিরোধিতা করেছিলো।আজকাল বি.বি.এ, এম.বি.এ করে নাকি ছেলেপেলেরা সব রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে…আমি এত কিছু বুঝবো না…আরো কত কি ! যদিও আসল কথাটা বুঝতে আমার খুব একটা কষ্ট হয়নি।বন্ধুদের ফেলে নীরা কখনো কিছু ভাবতে পারে না।তবে ক্যারিয়ারের কথা ভেবে অনন্ত ওর আর একবার ভাবা উচিত ছিলো।কিন্ত সেটা কে বোঝাবে এই মেয়েটাকে।বন্ধুদের সাথে নিজের মত করে একটা পৃথিবী গড়ে নিয়েছে নীরা, যেখানে আমার কোন প্রবেশাধিকার নেই।
দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি – সময় এখন সকাল ন’টা বিশ।তাহলে কন্ঠটা নিশ্চয় তাসলিমার মায়ের ছিলো।তাসলিমার মা সাধারণত প্রতিদিন এই সময়ে আসে।সে আমার বাসায় রান্নার কাজ করে।তাকে সহযোগিতার জন্যে অবশ্য আরো দুজন আছে।তবে জেসমিন আর কুসুম এ বাড়িতেই থাকে।তাসলিমার মাকে সাহায্য করা ছাড়াও এবাড়ির ছোট বড় সব কাজ ওরা দুজন মিলে করে।
প্রথমদিকে তাসলিমার মা তার মেয়েকে নিয়ে কাজে আসতো।মেয়েটাকে আমার কাছেই রাখতে চেয়েছিলো।অতঃপর আমার দ্বিরুক্তি দেখে আর কিছু বলার সাহস পায়নি।সেদিন জেসমিন বলছিলো ওকে কোন একটা বাসায় কাজে দিয়েছে।তাসলিমার মায়ের মত ওকে এবাড়ি ওবাড়ি ছোটাছুটি করতে হয় না।মেয়েটা ওখানেই থাকে।
রান্নাঘরে পা রাখতেই দেখি তাসলিমার দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।আর ওর মা ঠায় দাঁড়িয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছে।
‘ আম্মাগো, কি বাড়িতে যে মাইয়াড়ারে কামে দিলাম….কপাল পোড়া মাইয়া লইয়া আমি কই যামু এহন ! ‘
এমনিতেই আগামীকাল আম্মার চল্লিশা নিয়ে মনের ভেতর কেমন যেন ছটফট করছিলো।কোন কিছুতে মন দিতে পারছি না।তার ওপর তাসলিয়ার মায়ের কথাগুলো শুনে মুখটা তেতো হয়ে গেল।
‘ শান্ত হও তাসলিমার মা।আমি একটা ঠিকানা লিখে দিচ্ছি।ডাঃ নাসিমা- আমার ভাগ্নি।তোমার কথা আমি ওকে বলে রাখবো।আর শোন, টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করো না।’
তাসলিমার মা চোখ মুছে রান্নার কাজে লেগে গেল।
আমার জীবনে মায়ের যে অভাবটা ছিলো মারুফের সাথে বিয়ের পর ওর মাকে পেয়ে তা পূরণ হয়েছিলো।হ্যা, আমার শাশুড়ির কথা বলছি।কাল উনার চল্লিশা।গতরাতে অনেকদিন আম্মাকে স্বপ্ন দেখলাম।স্বপের ভেতর আমি হণ্যে হয়ে একটি চাবি খুঁজছি।আম্মা আমাকে এতবার বলছেন আলমারির চাবিটা বালিশের নীচে আছে, অথচ আমি তা কিছুতেই মানতে রাজী নই।ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি আমার বালিশ আর বিছানার চাদরটা ঘামে ভিজে জবজব করছে।স্বপ্নের সত্যটা যেন এক পলকে আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে আসে।
বিয়ের পর আমাদের ছিলো ছোট্ট দুই কামরার সংসার।মারুফ ছোট্ট একটা চাকরি করতো।ওর স্যালারির সামান্য কটা টাকা দিয়ে আমাদের দিনগুলো কোন রকম কেটে যেত।মাঝে মাঝে আমার ভীষণ খারাপ লাগতো।মা আমাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখলে প্রায়ই একটা কথা বলতেন,
‘ স্মরণীকা, ছোট ছোট আনন্দগুলোকে জীবন থেকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিও না।একজীবনে সবকিছু পেলেও সময়ের কাছ থেকে কখনো এই দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।’
দিনশেষে বাড়ি ফিরে মারুফ আমার কোলে মাথা রেখে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যেত।জানি না কেন আজ সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ! বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর ফেরার অপেক্ষাতে অস্থির হতে ইচ্ছে করে ! অথচ তখন…..তখন কি যেন হয়েছিলো আমার ! নাহ্, আজ আর লুকাবো না।আমার একটা অসুখ হয়েছিলো- সুখ খুঁজে বেড়োনোর অসুখ…অন্ধ পাগোলের মতো খোঁজা।আমার কোল জুড়ে নীরা আসার পর অসুখটা যেন আরো বাড়লো।মারুফ তখন ঠিক-বেঠিকের হিসেবের খাতা ছুড়ে ফেলে আমাকে এক মুঠো সুখ এনে দেবার নেশায় মরিয়া হয়ে ছুটতে লাগলো।আমিও চোখ বুজে ওর মুঠো মুঠো ভরে আনা ধূসর সুখগুলোকে গোগ্রাসে গিলতে থাকি, ওষুধের মত করে।এরপর আমাদের জীবনে এলো নাদিম।শুনেছি সন্তানের জন্ম নাকি স্বামী – স্ত্রীর বন্ধন আরো মজবুত করে।আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছিলো তার উল্টো।কারণ, ততোদিনে দূরত্ব আমাদের দুজনের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।দেয়ালের পুরুত্ব কিংবা আমাদের দূরত্ব কমবে কখনো কিনা আমার জানা নেই।তবে নাদিমের কথায় সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম এ দেয়াল ভাঙ্গা হয়ত আমার দ্বারা হবে না।
নাদিম আমার আদরের ছেলে।যদিও মা-বাবার কাছে তার সব সন্তানই আদরের।তবে নাদিম বরাবরই নীরার চেয়ে একটু আলাদা।ওর সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছিলাম শুধুই আমি।বোকা ছেলেটা রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,
‘মা তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।’
নাদিম চলে যাওয়ার পর মনটাকে এই বলে বোঝালাম, দূরে থাকলেও আমার ছেলেটা ভাল থাকুক।মানুষের মত মানুষ হোক।যেদিন নাদিম মারুফকে ওর বিজনেস পার্টনার মণিকার সাথে ঘনিষ্ঠবস্থায় অবস্থায় প্রথম দেখে, সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম আমি।বাড়ি ফিরতেই নাদিম নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।টেনশনে আমি হাশফাশ করছিলাম….ছেলেটা আবার কি করতে কি করে ফেলে ! সারারাত ওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম।সকালে নাদিম দরজা খুলে আমার বুকে মাথা রেখে খুব কাঁদলো।
‘ চলো মা, আমরা এই বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাই।যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না।’
আমি নাদিমের চোখ মুছে মিথ্যে আশ্বাস দেয়ার পর, বুঝিয়ে সুঝিয়ে ক্যাডেট কলেজে পড়ার জন্য রাজী করালাম।
আজকাল মারুফ প্রতি রাতে বাড়ি ফেরে না।কখনো দেশের বাইরে কোন জায়গায় যাবার প্লান করলে, তাও আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করে না।যে রাতে মা মারা গেলেন, সে রাতেও মারুফ বাড়ি ফেরে নি।রাতে দুঃসংবাদটা পাওয়ার সাথে সাথেই ওর বোনেরা এসেই মায়ের ঘরে ঢুকে আলমারির চাবি খুঁজতে গিয়ে হট্টোগোল বাঁধিয়ে দিলো।একটু পর নীরা এসে জানালো তার দুই ফুপু মিলে মায়ের গহনা ভাগাভাগিতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।কিছু দলিলপত্র খুঁজে পাচ্ছে না বলে চিৎকার – চেঁচোমেচি করছে।আমি ওসবে কান না দিয়ে বারবার মারুফকে ফোন দিতে থাকলাম।অবশেষে জানাজার আগে মারুফ বাড়ি ফিরেছিলো।মারুফক
ে কাল মায়ের চল্লিশার কথাটা কি অফিসে যাওয়ার আগে একবার মনে করিয়ে দেয়া উচিত ছিলো ? থাক, রাতে ফিরলে বলা যাবে।রাতে বাড়ি ফিরবে তো ? একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলাম।আগামীকালের প্রস্তুতির জন্য এখনো অনেক কাজ পড়ে আছে।নাদিমটা পাশে থাকলে ভাল হতো।
দুপুরের খাবার টেবিলে সাজিয়ে কুসুম দরজা নক করে বলে গেল, ‘ আম্মা খাইতে আসেন।’
এখন আর কেউ হন্ত দন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে বলে না, ‘স্মরণীকা জলদি খাবার দাও ভীষণ খিদে পেয়েছে।’
নীরাটা বোধহয় আজ বাড়িতেই আছে।হয়ত কুসুমকে বলে নিজের ঘরেই খাওয়াটা সেরে নেবে।শেষ একসাথে কবে খেতে বসেছিলাম আমরা ?!
খাবারে হাত দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো।ভাগ্নির ফোন দেখে অবশ্য খুব একটা অবাক হলাম না।নিশ্চয় তাসলিমার ব্যাপারে কিছু বলতে ফোন করেছে।অথচ নীরা যে এমন অঘটন ঘটাবে তা স্বপ্নেও ভাবি নি।নাসিমার কাছ থেকে কথাগুলো শুনে আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছিলো।
‘ খালা, ভুল তো সব মানুষেরই হয়।আমি নীরাকে এ্যাবোরেশনের কথা বলেছি।কতবার আমার কাছে আসতে বললাম।এদিকে নীরা আমার কলটা পর্যন্ত রিসিভ করছে না।এখন কিন্ত আমার ভয় করছে ! নীরা আবার কিছু একটা করে বসলো না তো ! ‘
নীরার ঘরের কাছে যেতেই আমার চোখটা যেন ঝাপসা হয়ে এলো।দরজাতে দুমদাম আঘাতের আওয়াজ পেতেই পাশের ঘর থেকে কুসুম আর জেসমিন দৌড়ে এলো।কিন্ত….কই নীরার কন্ঠ তো শোনা যাচ্ছে না !
অনেকক্ষণ পর ভেতর থেকে চাপা গোঙানোর আওয়াজ পেয়ে আমি বললাম, ‘ মারে দরজাটা খোল। ‘
আর কিছু বলতে পারলাম না…আমার শ্বাসটা যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো।দুহাতে বুক চেয়ে ধরে মেঝেতে বসে পড়লাম।জেসমিন আমার পাশে বসে থরথর করে কাঁপছে।কুসুমটা দৌড়ে মনে হয় ইনহেলারটা আনতে গেছে।
‘ তাড়াতাড়ি আয় কুসুম…. আজ আমাকে যে করে হোক এই অদৃশ্য দেয়ালটা ভাঙ্গতেই হবে। ‘
সমাপ্ত।
‘ তাড়াতাড়ি আয় কুসুম…. আজ আমাকে যে করে হোক এই অদৃশ্য দেয়ালটা ভাঙ্গতেই হবে। ‘
সত্যিই, অসাধারণভাবে গল্পটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বস্তবতার সাথে অনেক মিল রয়েছে গল্পটির।
অনেক ভালো লাগলো।
‘তবে ক্যারিয়ারের কথা ভেবে অনন্ত ওর আর একবার ভাবা উচিত ছিলো।’
বাক্যটিতে ‘অনন্ত’ এর জায়গায় ‘অত্যন্ত’ হবে।
গল্পটা আরো বড় হতে পারতো। কেমন যেন, এক নিঃশ্বাসে পড়ার মত। যেনো এক নিঃশ্বাসে শুরু থেকে শেষ। লেখার গঠন মোটামোটি ভালোই ছিল, তবে একটু এলেমেলো ভাব আছে। গল্পও খারাপ না। সর্বোপরি, শুভকামনা।