সজিব আহমেদ আরিয়ান
জন্মের সময়ই মারা যায় তামান্নার মা। কখনো মায়ের আদর পাইনি। মায়ের জন্য যে কত রাত কান্না করে ভিজেছে ওর মাথার বালিশ সেটা যদি বালিশ কথা বলতে পারতো তাহলে বোঝা যেতো, যা মুখে বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব না। তামান্নার বয়স যখন ২ বছর তখন ওর বাবা ভাবে মেয়েটার মায়ের অভাব একটু হলেও পূরণ করা দরকার। আসলে মা না থাকলেও ওর বাবা ছিলেন অনেক ভালো মানুষ। মেয়ের জন্য সব করতে পারেন। তামান্না যখন ২ বছরের তখন ওর বাবা তামান্নার জন্য একটা নতুন মা নিয়ে আসেন। তামান্না নতুন মায়ের কাছে কেমন যেতে চেতো না। আপন মাকে না দেখলেও মায়ের আসল মায়া তো আর অন্য নতুন মা দিয়ে পাওয়া সম্ভব না। নতুন মা এসে প্রথমদিকে খুব ভালো আচরণ করতো তামান্নার সাথে। যখন তামান্নার বয়স ৭ বছর তখন তামান্না ওর সৎ মাকেই আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো মানসিকভাবে। কিন্তু তখন সময় আর তামান্নার পক্ষে ছিলো না। ওর মা মানে সৎ মা ওকে একটু নির্যাতন করতো। প্রত্যেক কথায় অপমান করতো। কিন্তু তামান্না এইসবের কিছুই ওর বাবাকে বলতো না। ওর বাবা বাড়ি থাকলে তামান্নার সৎ মা ওকে কি যে আদর করতো তা দেখে কারো কখনো বোঝার উপায় নেই যে এটাই ওর সৎ মা। কিন্তু সৎ মা তো কখনো আপন হয় না। কিছুদিন পরে তামান্নার সৎ মার পেটে সন্তান আসে। তামান্না বেশ খুশি ছিলো ওর আরেকটা বোন আসবে। কিন্তু ওর খুশির মাঝেও ছিলো দুঃখ। তখন বাড়ির সব কাজ তামান্নাকেই করতে হতো। ছোট বলে এতো কাজ একলা ভালোভাবে করতে পারতো না। কিন্তু যা করতো তা খুব ভালোভাবেই করতো। কিন্তু তাও ওর সৎ মা ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতো। তামান্নার জীবনটা বিষাদময় হয়ে যায় কিন্তু তামান্না সবই মুখ বুজে সহ্য করে নেয়, কাউকে কিছু বলে না। ওর সৎ মার একটা মেয়ে হয়। এখন ওর সৎ মায়ের আচরণ দিনদিন আরো খারাপ হতে লাগলো। কিন্তু তামান্না তাও কাউকে কিছু বলে না ভাবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তামান্না কখনো কখনো সেই সকালে একবার খেতে পেতো আর সেই রাতে। মাঝখানে কিছু খেতে দিতো না সেই মহিলা। তামান্নার ঘরের কোণে বসে একলা একলা কান্না করতো। ছোট মেয়ে এছাড়া বা আর করতেও পারবে কি।
.
কিছুদিন গেলো। ও হ্যাঁ তামান্না কিন্তু স্কুলে পড়তো। খুবই ভালো ছাত্রী ছিলো। কিন্তু ছিলো একটু চঞ্চল স্বভাবের। সবার সাথে দুষ্টুমি করতো, কথা বলতো, রাস্তায় খেলতা সময় পেলেই। তামান্না ওই পরিস্থিতিতেও ক্লাস ফাইবের পিএসসি পরীক্ষা দেয়। আর আশানুরুপ ভালো রেজাল্ট করে। তামান্না যখন সিক্সে পড়ে তখন একদিন ওর সৎ মা ওকে একটা ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে। আসলে ছেলেটা ছিলো ওর ক্লাসমেট ব্যাস এতো টুকুই। কিন্তু ওর সৎ মা এটাকে অন্যভাবে নেয়। তাই তামান্না বাড়ি ফেরার পর ওকে অনেক মারে ওর সৎ মা। ওর সৎ মা ওর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়, বাহিরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ওর সৎ মায়ের মেয়েটাও ঠিক ওর মায়ের মতো হয়েছে। ছোট হলেও ওই মেয়েটি তামান্নার প্রতি হিংসুটে ছিলো।
.
তামান্নার সৎ মা তামান্নার জন্য বিয়ের কথা বলে ওর বাবার সাথে। কিন্তু ওর বাবা এতে রাজি ছিলো না। কিন্তু সৎ মা ওর বাবাকে বোঝায় যে, মেয়ে বড় হচ্ছে ছেলেদের সাথে কথা বলে এরকম করলে মানইজ্জত থাকবে না। এইরকম আরো যতো প্যাচ আছে সব বাধায়। ফলে তামান্নার বাবার মাথায় তামান্নার বিয়ের বিষয়টা ভালো ভাবে ঢুকিয়ে দেয়। এমনভাবে ঢুকায় যাতে ওর বাবার ভালো মন্দ বিবেচনা করার মানসিকতাও জাগ্রত ছিলো না। কিন্তু তামান্না বিয়ের কিছুই বুঝতো না। বিয়ে যে কি জিনিস তার আগাগোড়া কিছু জানতো না। ওর মা-বাবা মিলে পাত্র ঠিক করে। পাত্র দেখতে শুনতে ভালোই। কিন্তু বিয়েতে কিছু যৌতুক যায় পাত্র পক্ষ। তামান্নার বাবার পারিবারিক অবস্থা ভালো থাকাতে সে রাজি হয়ে যায় তার স্ত্রীর কুবুদ্ধিতে যে এইরকম ছেলে আর পাবে না। আর সেই ফাঁদে পা দেয় তামান্নার বাবা। বিয়ে দেওয়া শেষ এখন মেয়ে বিদায় দিতে হবে তখনই তামান্নার বাবার বিবেক নাড়া দেয়। সে বুঝতে পারে সে কি ভুল করেছে। তখন সে প্রচুর কান্না করে কিন্তু তখন আর সময় ছিলো না। তামান্নার বয়স তখন সাড়ে ১৫ ছুঁই ছঁই।
.
তামান্নাকে তার কিছু আত্মীয় স্বজন বিয়ে সম্পর্কে কিছু বোঝায়। স্বামী যা বলে তাই করবে, বাসর রাতে কোন কথা বা শব্দ করবে না, শশুর বাড়ির সবার সাথে ভালো ব্যবহার করবে, যে যা বলে তা শুনবে খারাপ কিছু বললে মনে নিবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। বাসর ছিলো সেদিন। বর ঘরে ঢুকে, আসলে দেখতে শুনতে ভালো হলেই যে মানুষটা ভালো হবে তা কখনই না। মানুষের কার্যকলাপেই পরিচয় পাওয়া যায় মানুষের ব্যক্তিত্বের ও তার মানসিকতার। তামান্নার জামাইয়ের নাম হলো জুয়েল। বাসর ঘরে ঢুকেই নিষ্ঠুর ও বিবেকহীন জানোয়ারের মতো ঝাপিয়ে পরে তামান্নার দেহের উপর। তামান্না চিৎকার করতে পারে নি কারণ তাকে বলা হয়েছিলো বাসর রাতে শব্দ না করতে। নিজের শান্তি আদায় করে নিয়ে জুয়েল তামান্নাকে ছাড়লো। আসলে আমাদের সমাজটাই এইরকম সবাই নারীর সতিত্ব নিয়ে খোঁজে কিন্তু কেউ নিজের সতিত্ব বা নিষ্ঠুরতা নিয়ে ভাবে না। অন্যের বিষয় নিয়েই যতো মাতামাতি। বাসর রাতে তামান্না বুঝতে পারে সব ছেলেরা স্বামীর মতো হয় না কেউ কেউ স্বামীর নামে হয় ধর্ষক। বাসর রাতের সেই ঘটনার পর জুয়েলকে ধর্ষক বলা ভুল হবে না। কারণ সত্যিকারের পুরুষ কখনো জোর খাটায় না। সেই রাতে তামান্না ব্যথায় ছটফট করে কিন্তু কেউই তার মূল্য দেওয়ার নেই। সেইদিন তামান্না এই নিষ্ঠুর পৃথিবী সম্পর্কে বোঝে।
.
তামান্নার জামাই মাঝেমাঝেই স্বামীর নামে ধর্ষকের রূপ ধারণ করতো এবং নির্যাতন করতো তামান্নার উপর। কিছুদিন পর তামান্নার উপর অন্যরকম নির্যাতন শুরু হয়। জুয়েল ও জুয়েলরা স্বপরিবারে তামান্নার উপর নির্যাতন শুরু করে। তামান্নার উপর জোর করা হয় তার স্বামী অর্থাৎ জুয়েল ব্যবসা করবে এখন তামান্নার বাপের বাড়ি থেকে ২ লাখ টাকা দিতে হবে। তামান্না প্রথম দিকে কিছুই বুঝতে ছিলো না। কারণ ওর বয়স তো তখন খুব কম। পারিবার সম্পর্কে ওর তেমন ধারণা ছিলো না। আস্তে আস্তে তামান্না বুঝতে শুরু করে তারপর একদিন ওর বাপের বাড়ি যায়। তামান্না সব খুলে বলে ওর বাবাকে। ওর বাবা ধার করে এনে মোট ২ লাখ টাকা দেয়। তামান্না সেই টাকা নিয়ে ওর শশুরবাড়ি যায়। ওর শশুরবাড়ির সবাই খুব খুশি। তাই কিছু দিন তামান্নার সাথে ভালো আচরণ করে। কিন্তু তা বেশি জোটে না তামান্নার কপালে। আবার শুরু হয় নির্যাতন। প্রতি রাতে জুয়েল মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো আর তামান্নাকে প্রচুর মারতো। তামান্নার সেই চিৎকার শোনার মতো কেউ নেই আর ছিলোও না কখনও। জন্মের পর সৎ মায়ের নির্যাতন আর তারপর শশুরবাড়ির নির্যাতন ওর জীবন এককথায় সম্পূর্ণ বিষাদময় হয়ে যায়। কিছুদিন পর ওর স্বামীর আবার একটা জিনিস চেয়ে বসে। যেটা তামান্নার বাবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। তা হলো একটা সুজুকি জিক্সার বাইক। যেটা অনেক দামী। তামান্না এইবার আর তার বাবার কাছে কিছু বলে না। কারণ ও বুঝতে পারে এইবার বললে হয়তো ওর বাবার জমি বিক্রি করতে হবে। ওর বাবার জন্য ভেবে ও প্রত্যেকদিন নির্যাতন সহ্য করে। একদিন রাতে তামান্না ঘরে শুয়ে ছিলো। ওর জামাই মদ খেয়ে আসে। সেদিন নির্যাতনটা অন্য মাত্রায় চলে যায়। তামান্নাকে সেদিন বাঁশ দিয়ে মারে। আজকে গলাও টিপে ধরে। তামান্না চিৎকার করে কান্না করছিলো আর বলছিলো, আমাকে মাফ করে দাও আর মাইরো না। কিন্তু কে শোনে ওর চিৎকার। সেদিন ওটা ওর স্বামী ছিলো না ছিলো এক পশু। জুয়েল রান্নাঘর থেকে কেরোসিন আনে। সেই কেরোসিন তামান্নার গায়ে দিচ্ছিলো। তামান্নার চিৎকার এতো বেরে গিয়েছিলো যা কোনো সাধরণ মানুষ শুনতে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়বেই। কিন্তু জুয়েলের মধ্যে মায়ার কোন প্রভাব ছিলো না। তামান্না বার বার তার জীবন ভিক্ষা যাচ্ছিলো। কিন্তু সেই নিষ্ঠুর পাশান মনের জানোয়ারের কানে সেই আওয়াজ মনে হয় যাচ্ছিলো না। অতঃপর জুয়েল তার পকেট থেকে একটা ম্যাচ বের করে আর সেটায় আগুন ধরিয়ে ছুড়ে দেয়। তামান্নার সেই কেরোসিনে ভেজে দেহের দিকে তামান্না ছুঁটে পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু কোন লাভ হয়না ততক্ষনে সেই আগুন তামান্নার ওড়না ও থ্রি পিসে লেগে যায়। জুয়েল ঘর থেকে বের হয়ে বাহির থেকে ঘরে খিল তুলে দেয়। ভিতর থেকে শুধু একটাই শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো সেটা ছিলো তামান্নার জীবন বাঁচানোর আত্মচিৎকার ও জীবন ভিক্ষার কান্না। জুয়েল বাহিরে দাঁড়িয়ে গালি দিচ্ছিলো আর বলছিলো, তুই আমার জীবনের সর্বনাশ করছোস তোরে আমি ছারুম না। কিন্তু ততক্ষনে তামান্নার চিৎকার থেকে গেলো। চারদিক নিশ্চুপ হয়ে গেলো। খালি মাঝেমাঝে আগুন শিখা ফোটার শব্দ হচ্ছিলো। এখন আর কেউই চিৎকার করছে না। চিৎকার শুধু একবার কিরেছিলো ওর বাবা। আর সেই চিৎকার ছিলো তার জীবনের শেষ চিৎকার। তামান্নার বাবাও চিৎকারের মাঝেই পেলো তার আসল ঠিকানা কবর। চিৎকার সেতো তামান্নার সৎ মাও করেছিলো কিন্তু সেটা তামান্নার জন্য না তার স্বামীর জন্য। কিন্তু সেই চিৎকার দিয়ে কোন লাভ নেই যেই চিৎকারে লুকায়িত থাকে অর্থের লোভ আর সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা চিৎকার। এখন আর কেউ চিৎকার করবে না। চিরশান্ত হয়ে গেলো তামান্না ও ওর বাবা।
ভালোই লিখেছেন। শিক্ষামূলক এবং বাস্তববাদী গল্প। এ গল্প থেকে সবাই বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা ও মেয়েদের শিক্ষার মূল্য বুঝতে পারবে। তামান্নার পিতামাতার বোকামির জন্য তাকে অকালে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হল। তার সুন্দর জীবন শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল।
বানানে বেশ কিছু ভুল আছে।
পাইনি- পায়নি।
চেতো না- চাইতো না।
খেলতা- খেলতো।
ফাইবের- ফাইভের।
আসলে ছেলেটা ছিলো ওর ক্লাসমেট ব্যস এতোটুকুই- আসলে ছেলেটা ছিলো ওর ক্লাসমেট। ব্যস! এতোটুকুই।
প্যাচ- প্যাঁচ।
বাধায়- বাঁধায়।
ঝাপিয়ে- ঝাঁপিয়ে।
পারিবার- পরিবার।
বেরে- বেড়ে।
সাধরণ- সাধারণ।
ভিক্ষা যাচ্ছিলো- ভিক্ষা চাচ্ছিল।