গল্প লেখকঃ তামান্না স্নিগ্ধা
(এপ্রিল – ২০১৮)
…………………
বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। ঘুমের ভিতরই নিতু আমার বুকের কাছে সরে এলো। আস্তে করে হাতটা ধরে ওকে সরিয়ে দিলাম। হালকা একটু কেঁপে উঠেই আবার ঘুমিয়ে গেলো।
বাইরে প্রবল বর্ষন। জানালার কাঁচে গাছের আবছায়া নাচানাচি দেখা যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে গায়ে কাঁথাটা টেনে নি, আবার উঠে পায়ের কাছ থেকে কাঁথা নিতে ইচ্ছে করছে না।
সারা গায়ে কেমন যেন আরামদায়ক এক শীতলতা সমানভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
নীতু মনে হয় পাশ ফিরে শুলো।
চুড়ির মৃদুশব্দ কানে অদ্ভুত এক মাদকতার জন্ম দিচ্ছে।
জোর করেই উঠে পড়লাম। জানালার গ্লাস ঠেলে দিতেই হুড়মুড় করে কালবৈশাখী ঝড় আমার মুখে ঝাপটা দিলো। বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে লাগছে দেখে জানালাটা আবার বন্ধ করে দিলাম।
ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
বিদ্যুৎ চমকের আলোতে নীতুর দিকে তাকাতেই দেখলাম ওর বাঁ পাশের গাল চিকচিক করছে।
নীতু কাঁদছিলো বোধহয়।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এক ছাদের নিচে পাশাপাশি বালিশে শুয়েও নীতু আর আমার ভিতর এখনো যোজন যোজন দূরত্ব। এক সময় জোর করে দূরে থাকতে থাকতে এখন আর নিজেই দূরত্ব ঘোচাতে পারি না। বাধো বাধো ঠেকে।
নীতুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় বৈশাখের এমনি এক আগুন ঝরা দিনে। ক্যাম্পাসে সাঁজ সাঁজ রব পড়ে গেছে কয়দিন আগ থেকেই। আমি ছিলাম আলপনা আঁকিয়ের দলে। বন্ধুরা রঙ বেরঙের প্লাকার্ড রেডি করছিলো আর আমি তুলি দিয়ে মুহূর্তেই সেটা রঙিন করে দিচ্ছিলাম। মূহুর্তের অন্যমনস্কতায় একটা প্লাকার্ডে অনেক খানি লাল রঙ ঢেলে পড়ছিলো। বন্ধুদের বকাবকিতে সেই লালের পিন্ডটাকে প্রজাপতিতে রুপান্তরিত করেছিলাম। র্যালিতে নীতুর হাতে ছিলো ওই প্লাকার্ডটা। মনে হচ্ছিলো লাল রঙা এক প্রজাপতি মাথা উঁচু করে তার সঙ্গী প্রজাপতিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বন্ধুরাও এটা নিয়ে হাসাহাসি করছিলো খুব।
নীতুর সাথে আবার দেখা হলো কয়দিন পর। বৈশাখী মেলাতেই।
নীতু কিনতে এসেছিলো রেশমি চুড়ি। বান্ধবীদের সাথে কলকল শব্দ করতে করতে যখন হেঁটে যাচ্ছিলো আমার মুগ্ধতা সীমা ছড়িয়েছিলো তখনি।
নীতু অবশ্য আমার এই এক তরফা ভালোবাসার কোন কিছুই জানতো না। জানাবো জানাবো করে যখন সময় খুঁজছিলাম তখনি ভাইয়া কানাডা থেকে পিএইচডি শেষ করে ফিরে আসলো বাসায়।
দুইভাইকে নিয়ে ছোট্ট আমাদের এই সংসারে এবার শুরু হলো আত্মীয় স্বজনের ভীড়। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছে। দীর্ঘ আট বছর পর ভাইয়া কানাডা থেকে আসছে লোকজন আসবে নাই বা কেন। এর ভিতর আবার আমার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হলো। ভাবলাম পরীক্ষার পরেই না হয় নীতুকে সরাসরি প্রপোজ করবো।
বাসায় এত গ্যাঞ্জাম যে ভাইয়া জোর করে আমাকে বড় খালার বাসায় রেখে এলো যাতে ঠিকমত পরীক্ষাগুলো দিতে পারি।
আমিও হাফ ছেড়ে বাচঁলাম। প্রথম তিনটা পরীক্ষা যাচ্ছেতাই রকম বাজে হয়েছে। এখন আল্লাহর রহমতে এগুলো ভালো হলেই হয়।
লাস্ট পরীক্ষার আগের দিন ভাইয়া ফোন দিলো এক্সাম শেষ করে তাড়াতাড়ি বাসায় যেন আসি সবাই নাকি তাকে ধরে বেধে মেয়ে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে।
আমিও বেজায় খুশি। ভাইয়ার বিয়ে হলেই আমার রাস্তা ক্লিয়ার।
পরীক্ষা দিয়ে এসেই কিছু না খেয়ে বড় খালার বকা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করতে করতেই রিক্সা করে আগে বাড়ি ফিরলাম। দেখি সবাই গোছগাছ করে রেডি হয়ে আমার জন্য বসে আছে। কোন রকমে হাতেমুখে পানি দিয়ে শার্টটা খুলে তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি গায়ে দিলাম।
ছোট ফুপি ইয়ার্কি শুরু করলো, “এবার তো নেক্সট সিরিয়াল নিলয়ের।” সবার সাথে ঠাট্টা করতে করতে গাড়িতে উঠলাম।
ভাইয়াকে একদম রাজপুত্রের মত দেখা যাচ্ছে। এমনিতে ভাইয়া আর আমার গায়ের রঙ সেম হলেও এতদিন কানাডায় থেকে ভাইয়ার গায়ের রঙ একদম বিদেশীদের মত হয়ে গেছে।
পনের মিনিট ধরে মেয়েদের বাসায় বসে আছি। ১৯ আইটেমের নাস্তা দিয়েছে। আব্বু আর আম্মু চা নিয়ে বসে আছে। ভাইয়া মাথা নিচু করে আছে আর আমি গোগ্রাসে নাস্তা খাচ্ছি। পেটে ভিষণ ক্ষুদা ছিলো, পরীক্ষা দিয়ে কিছু খাওয়া হয় নি আর এখন পেট আর চক্ষুলজ্জা মানছে না। ছোট ফুপি আমার খাওয়া দেখে মিচকি মিচকি হাসছে।
গলায় আমার প্রথম হেঁচকি বাধলো কনেকে ঘরে ঢুকতে দেখে।
ভাইয়ার কনে ছিলো আমার এত দিনের লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা নিতু!
বুকের ভেতরের কষ্টটা আটকাতে এত কষ্ট হচ্ছিলো যে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না।
আব্বু আম্মু আর ভাইয়ার চাপা উচ্ছ্বাসে খুব বুঝতে পারছিলাম মেয়ে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে।
নীতু যাওয়ার পর ভাইয়া লাজুক মুখে ফিসফিস করে যখন বললো, “নিলয় আম্মুকে বল আমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে।” আমার হৃদয়ের তন্ত্রীতে যেন তীক্ষণ একটা টান পড়লো।
আম্মু ব্যাগের ভিতর আংটি আগেই নিয়ে গেছিলো পছন্দ হলে পরিয়ে আসবে বলে। সবার সম্মতিক্রমে আংটি বদল তখনি হয়ে গেলো।
নিতুর মামা আবার আরেক কাঠি সরস। আব্বুকে বললো, “দুপক্ষেরই যখন একই মত তখন কাবিনটা করে ফেলায় ভালো, কি বলেন বেয়াইসাব?” পরে না হয় দিনক্ষণ ফেলে উঠায়ে নিয়েন।
ফোনে মোটামুটি কাছের আত্মীয়দের সবার সম্মতি নিয়ে ভাইয়ার সাথে নীতুর তখনি বিয়ে হয়ে গেলো।
সব হাংগামা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা। এত হুলস্থুল এর ভিতরে আমি যে এত নিশ্চুপ এটা কারো চোখে পড়ে নি। ছোট ফুপু গাড়ির ভিতর শুধু একবার বললো, “নিলয় এত চুপচাপ কেন, কিছু হইছে নাকি তোর?”
আমি উত্তর দেয়ার আগেই আম্মু বললো, “সারাদিন ছোটাছুটি করে পরীক্ষা দিয়ে ওর জানের উপর যা ধকল গেছে, তুই ওকে একটু ঘুমোতে দে।”
তারপরের কাহিনী গুলো খুব সংক্ষিপ্ত। ভাইয়া বড়সড় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী নিলো। নিতুকে খুব ধুমধাম করে বাসায় তুলে নিলো। আমি বাসায় পড়াশুনা হচ্ছে না এই খোঁড়া অজুহাতে হলে সিট নেয়ার ব্যাবস্থা করলাম। আব্বু আম্মু ছোট ফুপি ভাইয়া কারো অনুরোধ কর্ণপাত ই করলাম না।
নিতুকে বউ সেঁজে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখা সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিলো না আমার। বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকা ছাড়া আমার হাতে আর কোন অপশন ছিলো না। যত যাই হোক নীতু এখন আমার বড় ভাবি, তাকে আমি অন্য দৃষ্টিতে দেখতে পারি না।
যদিও নিতুকে আমি কখনই ভাবি বলে ডাকি নি। নিতু মনে হয় মনে করতো ওকে আমি ঘৃণা করি। কারন আমি কখনোই ও কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতাম না, সারাদিনে পারতপক্ষে ওর সামনে যেতাম ই না। ভাইয়ার সামনে কিছু বললে দায়সারা জবাব দিয়ে সরে যেতাম। আমার ঘর গুছালে চিল্লাফাল্লা করতাম। আব্বু আম্মু বুঝতো আমি ওকে পছন্দ করি না। কিন্তু এত ভালো একটা মেয়েকে আমি কেন অপছন্দ করি এটা নিয়ে আম্মুর সাথে আমার বেশ খিটিমিটি বাধতো। মাঝে মাঝে দেখতাম নিতু ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর সামনে থেকে পালিয়ে যেতাম। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যেত অথচ কিছু করতে পারতাম না।
তাই শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম হলে চলে আসার। ভার্সিটির এত কাছে বাসা হওয়ার পরেও হলে থাকার জন্য ফোনে নিয়মিত আত্মীয়স্বজন সবার তিনবেলা বকা খেতে লাগলাম। তবে এ সত্ত্বেও হল ছাড়লাম না।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। বাড়িতে আমাকে ফিরতে হলোই আর তা কিনা ভাইয়ার লাশ সংগে নিয়ে।
ভাইয়ার গাড়ি কাঁটাবনের কাছে এক্সিডেন্ট করেছিলো। এক রিক্সায়ালা গাড়ি থেকে ছিটকে পড়া ভাইয়ার ফোনের ডায়াল লিস্ট থেকে আমাকে ফোন দিয়েছে।
আব্বুকে যখন ফোনে এসব কথা জানায় তখন ভাইয়ার রক্তে রাস্তার পীচ ভেসে যাচ্ছে। মালবাহী ট্রাকের ধাক্কায় আমার ভাইয়া স্পট ডেড।
আম্মু পরপর কয়দিন অজ্ঞান হতে থাকলো। বাসায় কারো রান্না খাওয়া দাওয়ার কোন টাইমটেবল নেই। সব বিধস্ত অবস্থা। নিতু একদম ভেঙ্গে পড়েছে। বাসায় কে কাকে সামলায়। আব্বু হঠাৎ করেই যেন বুড়িয়ে গেছে। আমার বয়স কয়দিনেই মনে হচ্ছে ১০ বছর বেড়ে গেছে। নিতুকে ওর বাড়ির লোকজন এসে নিয়ে গেছে।
পরের ছয়মাস আমরা যেন ঘোরের মধ্যে থাকলাম। ভাইয়া নেই এই স্মৃতিটাই আমাকে বেশি পোড়াচ্ছিলো। আম্মু আমাকে এক দন্ড চোখের আড়াল করছিলো না। দশ মিনিটের জন্য বাইরে বের হলেও দুই তিনবার করে ফোন দিচ্ছিলো। এর ভিতর বড় খালা এসে বাসার অচল অবস্থা কিছুটা সচলের ব্যাবস্থা করলো। এবং আমার প্রবল অসম্মতির বিরুদ্ধেও আমার সাথে নিতুর বিয়ে ঠিক করলো। আমাদেরসহ নিতুদের বাসার সবাই রাজি হলেও আমি কেন যেন রাজি হতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো ভাইয়ার মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে আমি দায়ী। নীতুকে এত করে চাইতাম বলেই হয়ত আল্লাহ ভাইয়ার জীবনের বিনিময়ে নীতুকে আমার করার ব্যবস্থা করে দিলো।
নিজের ভিতর অজানা অপরাধের বোঝা বাড়ছিলো। সারাক্ষণ আত্মগ্লানিতে ভুগছিলাম।
এর ভিতরেই নীতুর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো।
আমাদের বিয়ের আজ দুইমাস পূরন হলো অথচ নীতুর সাথে আমার কথা হয়েছে হাতে গোণা কয়টি। যে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে আমি ওর দিকে তাকায় ও কি তাতে বুঝতে পারে ওর জন্য এই দৃষ্টির আড়ালে আমি এক সমুদ্র ভালোবাসার সরোবর নিয়ে ঘুরছি?
বুঝতে পারে না আমি জানি। ও এখনো ভাবে আমি ওকে আগের মতই কিংবা আগের থেকে বেশিই অপছন্দ করি।
আজ পহেলা বৈশাখ। এক বছর আগে আমি এইদিনে যেই মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলাম সে আজ আমার বউ। অথচ আমি তার দিকে তাকাতে পারি না, আমার ভাইয়াকে মনে পড়ে। তাকে আমি আলতো করে ছুঁয়ে দিতে পারি না, আমার ভাইয়াকে মনে পড়ে।
আমি হাজার দ্বীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রাখি তাকে ভালোবাসা প্রকাশ না করতে পারার কষ্টে।
এই জীবনে আর আমার এই কষ্ট থেকে বুঝি মুক্তি নেই।
বুদ্ধি হওয়ার পর আজ প্রথম বৈশাখে আমাদের বাসায় পান্তা ইলিশ হয় নি। ভাইয়ার খুব ইলিশ পছন্দ ছিলো। সকালে ফ্রিজ থেকে ইলিশ বের করতে যেয়ে আম্মু কান্না শুরু করছে। তারপর এতবেলা পর্যন্ত শুয়েই ছিলো। আব্বু তাই এখন মন ভালো করতে বড় খালার বাসায় নিয়ে গেলো।
আমি রোজকার মতই রুটি আর আলুভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা করছি। হঠাতই শুকনা রুটি গলায় আটকালো। তাকিয়ে দেখি টেবিলের উপর জগে কোন পানি নেই। উঠে ফিল্টার থেকে পানি নেয়ার জন্য ঘুরতেই দেখি নীতু পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ আমার বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠলো, আমি নীতুর হাতটা জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম, “নীতু আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
নীতু দীর্ঘক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বুকের ভিতর মাথা গুঁজে দিয়ে বললো, “আমি জানতাম।”
আমি দেখলাম, নীতুর চোখে অল্প অল্প জল। আর সেখানে এই হতভাগার জন্য ভালোবাসা অফুরান।
০ Comments