গল্প লেখকঃ
-আহমেদ সবুজ
(এপ্রিল – ২০১৮)
…………
– কইরে সাদ, আয় যাই…
– নারে তুই যা, তোদের সাথে দেখলে আব্বা রাগ করবেন।
দিপু মন খারাপ করে চলে গেল। চৈত্র সংক্রান্তির বিকেল। দিপুরা শিব তলা থেকে গাজনের মেলায় যাচ্ছে।
দিপু মুখোশ পরে ভূত সেজেছে। ওদের গাজনের মেলায় চরক ঘুরানো দেখানো হয়, বাবা বলেছেন এগুলো দেখাও আমাদের ধর্মে পাপ। তাই আমি ওদের সাথে যাইনা। কালকে পহেলা বৈশাখ। বৈশাখী মেলায় যেতে বাবা আমাকে কখনো বারণ করেন না। মেলা বসে গ্রামের শেষ প্রান্তে।
সন্ধ্যা হয়েছে এরকম সময়ে হঠাৎ চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। সবাই ছোটাছুটি করে যাচ্ছে হাতে লাঠি-সোটা। কি হয়েছে ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমিও ওদের পিছু পিছু দৌড়ে গিয়ে দেখি গাজনের মেলায় মারামারি লেগেছে।
একপক্ষ হিন্দু আরেকপক্ষ মুসলমান। তাই সংঘর্ষের কারণ বুঝতে দেরি হলোনা। দুপক্ষের হাতে লাঠিসোটা যে যাকে পারছে মারছে।
ফলসরূপ দুই পক্ষের কিছু কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলো। আমার বাবার মাথা ফাটলো, আলফাজ আলীর কোমর ভাঙলো, বিমল মিত্রের একটা চোখ নষ্ট হলো এবং সেদিন গভীর রাতে কারা যেনো হিন্দু পাড়ায় আগুন দিলো! তাতে দীপুদের ঘরবাড়ি, সারাবছরের খাবার ধান আর দুইটা গাভী পুড়ে ছাই হলো।
দীপুর বাবা আর আমার বাবা নাকি ছোটবেলায় খুব ভাল বন্ধু ছিলেন কিন্তু এখন শত্রু পক্ষ। কে যেনো আড়াল থেকে “আল্লাহ্ আকবার” বলে ইটের আধলা দিয়ে ভীড়ে ঢিল মেরেছিল। তার জন্য কয়েকজন হিন্দু যুবক মিলে নাকি দুইজন মুসলমান পিটিয়েছে এই নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে মারামারি। পরে অবশ্য সবাই জানতে পেরেছে যে কাজটা এক হিন্দু ছেলের।
বিকেলের দিকে দীপুর জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। দীপু আর এপাড়ায় খেলতে আসবে না! আজ সারাদিন হয়তো দীপুদের বাড়িতে কোন রান্নাবান্না হয়নি। ও হয়তো না খেয়ে আছে। বৈশাখের আমেজটাই নষ্ট হয়ে গেল। প্রতিবার দুই বন্ধুতে মিলে বৈশাখী মেলায় কত আনন্দ করতাম। মাটির পুতুল, বাহারী রং করা মাটির ব্যাংক, পাতিল, একতারা, বেলুন, টমটম গাড়ি, ঘুড়ি-নাটাই, হাওয়াই মিঠাই আরো কত কি! আর রাতে বটতলায় বাউলগানের আসর।
এবার বৈশাখী মেলা হবেনা। মসজিদের ইমাম সাহেব বলে দিয়েছেন বৈশাখী মেলা করা বেদায়াতি কাজ! এসব করা হারাম।
বাবার মাথায় পাঁচটা সেলাই দেয়া হয়েছে। বাবা চোখবুজে শুয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিলেন। কিছুই খেলেন না, আমিও কিছু খাইনি সারা দিন। দীপুর জন্য মনটা কেমন খারাপ হয়ে আছে, কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। বাবা এবং আমি না খাওয়ার জন্য মা অনেক বকাঝকা করে অবশেষে নিজেই কেঁদেকেটে চলে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, “আমারই যত ক্ষুধা, আমিই সব খাবো।”
গভীর রাত্রে আবার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙলো। বাবা নাকি গভীর রাতে বস্তায় করে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, মরিচ নিয়ে দীপুদের বাড়িতে গিয়েছিলেন দিতে। সেটা দেখে ফেলেছে এপাড়ার মাতব্বর তাই এখন বাবার বিচার হবে। বাবা কিন্তু নির্বিকার চিত্তে প্রশান্তি ভরা মুখ নিয়ে বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছেন। তাঁর মুখে অপরাধবোধের কোনো ছাপ নেই।
মাকে একবার ডাক দিয়ে বললেন, “কই গো, তোমার ছেলে আর আমার জন্য ভাত নিয়ে এসো খুব ক্ষুধা লেগেছে…”
মাতব্বর সাহেব খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমাদের সামনে রেখে মধ্যরাতে তুমি ভাত গিলবে? জবাব দাও, কেনো গিয়েছিলে বে-দ্বীনটাকে বিধর্মীটাকে চাল-ডাল দিতে?”
ইমাম সাহেব, ক্বারী সাহেব সহ পাড়ার বড় বড় মুরুব্বীরা এক হয়েছে কাল বাবার বিচার হবে।
রহিম শেখ বাবাকে বললেন, “যারা তোমার মাথা ফাটাইছে তাগোরে তুমি সাহায্য করতি যাবা? ঘোড়া ডিঙায়া ঘাস খাওয়া শুরু করিছো, তোমার আসলে একখান বিচার হওয়া উচিত!”
বাবা কিছু শুনছেন বলে মনে হলো না। তিনি গভীর মনযোগের সাথে আলু চটকে চটকে মসুরের ডাল সাথে পেঁয়াজ আর একটা কাঁচা মরিচ দিয়ে নির্বিকারচিত্তে পান্তা ভাত খেয়ে উঠে দুইটা ডেকুর তুলে বললেন, “আপনারা যে যার বাড়িতে চলে যান আমি ঘুমাবো।”
ThankYou 🙂