রোহেনা আক্তার
সম্পর্কটা শেষ হয়েছে আজ থেকে তিন বছর আগে।রঙিন মনে ফানুশ উড়িয়ে স্বপ্ন দেখার দিনগুলো ও শেষ হয়েছে সাথে সাথে।প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে সুখি হওয়ার,সুখে থাকার দিনগুলোতে এসে নতুন করে স্বপ্ন যোগ হয়নি বরং ফুরিয়েছে ভাগ্যে লিখা সব সুখের গল্পগাথা।জানিনা বিধাতা কেন এত অল্প সুখ লিখেছিলেন আমার ভাগ্যে।মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নির্জনে একাকি কোনো স্থানে চলে যাই।যেখানে দিনের পরদিন একাকি শুধু আমিই থাকবো।কেউ দেখবেনা,কেউ জানবেনা।সেখানে শুধু আমারি বসবাস হবে।
আজ থেকে তিনবছর পূর্বে অনামিকার সাথে আমার পরিচয় একটা ছোট লাইব্রেরিতে।হ্যা,আমার মতো অনামিকা
ও গল্প পাগল একটা মেয়ে ছিল।রোজ রোজ আমি সেই লাইব্রেরিতে যেতাম নতুন নতুন বইয়ের সন্ধানে।নতুন লেখকদের নতুন বই বাজারে আসতে দেরি হতো কিন্তু আমার কিনতে দেরি হতোনা,পড়তে দেরি হতোনা।সেই জন্য লাইব্রেরির প্রতিটা মানুষের সাথে আমার ছিল অনেক আন্তরিকতা।বইপাগল এই আমি এমন কোনো দিন নেই যেদিন লাইব্রেরিতে যাইনি।বই পড়লে আমার মতো ছন্নছাড়ার মনে ক্ষনিকের জন্য একটি ভালোলাগা কাজ করে।আমার যখন খুব বেশি মন খারাপ হয় তখন আমি বই পড়ি।মুহুর্তেই মন ভালো হয়ে যায়।এজন্য প্রিয় কিছু বইয়ের সমাহার আমার নিজ ঘরেই।
এমনই এক বই পাগলি অনামিকার সাথে আমার পরিচয় হয় এই বই পড়া নিয়েই।দিনটা ছিল লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।প্রিয় একজন লেখকের বই প্রকাশ হয়েছে।বরাবরের মতো লেখকের হাত থেকে আমার বইটা নেয়ার কথা।আর যত বই ই থাকুক লেখকের হাতে যে বই সেটাই আমি নিব।এবং প্রতিবার আমি এরকমই বই নেই।কিন্তু আজ সবকিছু উল্ঠো হয়ে গেলো।অনুষ্ঠানের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ।
বই নেওয়ার কথা লেখকের হাত থেকে।বরাবরের মতো আমি অনেক খুশি।কিন্তু আমার সে খুশি বেশিক্ষণ থাকলো না।
কারন লেখক হেসে হেসে বইটা অনামিকার হাতে তুলে দিলেন।খুর রাগ হলো আমার।তবু রাগ সংবরন করে চলে আসলাম।
মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছি।লাইব্রেরিতে যেতে ভালো লাগছেনা।আশ্চর্যের বিষয় এই প্রথম আমি লাইব্রেরিতে যাইনি।মনটা ছটফট করছে।
এমন সময় দরজায় কলিংবেলের শব্দ।
দড়জা খুলে কাউকে দেখতে পাইনি।বোকার মতো মনের অজান্তে হেঁসে উঠলাম।হয়তো হ্যালুসিনেসন।
সারাদিন ঘরে বসে থেকে ঘোর লেগে গেছে তাই হয়তো এমনটা হয়েছে।আমার জীবনে আমার ২বন্ধু ছাড়া আর কেউ নেই।এমন সময়ে কে আর আসবে?দরজা লাগিয়ে ফিরে আসতে যাবো তখন আবারো কলিংবেলের টুংটাং শব্দ।আবার দরজা খুললাম, নাহ কেউ নেই।এবার রাগই হলো।ধরাম করে দড়জা বন্ধ করে বেডরুমে চলে আসলাম।আবার কলিংবেলের আওয়াজ।এবার আর দরজা খুললাম না।শুয়ে থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার টুংটাং শব্দের আওয়াজে দরজা খুলতে বাধ্য হলাম।
দরজা খুলেই দেখি অনামিকা দাড়িয়ে আছে।
–একি আপনি?
–জ্বী। নিজে থেকেই আসতে হলো।ভেতরে আসতে বলবেননা?
–বাসাটা পুরো খালি ছিলো।তাই ইস্ততবোধ করছিলাম।
–দেখুন,আমি একটু গায়েপড়া স্বভাবের মেয়ে।কেউ বললেও যেখানে যাবার চলে যাই।কেউ না বললেও সেখানে যেতে ইচ্ছা হলে চলে যাই।বলতে পারেন একটু স্বাধীনচেতা মানুষী।
–আমি অনামিকার প্রতিটি কথায় মুগ্ধ হচ্ছিলাম।ওর কথা বলার স্টাইল,ওর সরলতা,ওর চোখের চাওয়া আমাকে মুগ্ধ করছিলো।
–আচ্ছা আপনার সবকথা বুঝলাম।কিন্তু মানুষী শব্দটার অর্থ বুঝলাম না।
–খলখল করে অনামিকা হাসতে লাগলো।আমার মনে হলো ক্ষণিকের জন্য আমার একাকী রাজ্যে কে যেন মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে।অনেকদিন পর আমার ঘরে যেন জোনাকির আলো জ্বলছে।মিটিমিটি তারা।আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি।
–হাসি থামিয়ে অনামিকা বলতে লাগলো।আচ্ছা পৃথিবীতে সবকিছু পুরুষের দখলে থাকবে কেনো?আমার কাছে মানুষ শব্দটা পুরুষবাচক শব্দ।তাই আমি এটাকে মানুষি বলি।বুঝছেন?
–এবার নিজেও খানিক হেসে দিলাম।
অনামিকার সাথে পরিচয়টা এভাবেই।খুব চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিল ও।আর ঠিক তার বিপরিত।সেদিনের পর থেকে অনামিকা যখন তখন আমার বাসায় চলে আসতো।হুটহাট ফোন দিয়ে দিতো।যখন তখন বায়না ধরতো মন যা চায়।কেমন যেনো মনের অজান্তেই আপন হয়ে গেছিল।যতটা আপন হয়ে গেলে কাউকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।ওর এই হুটহাট বায়না ধরার অভ্যাসটা ভীষণ দূর্বল করে দিয়েছিলো ওর প্রতি আমাকে।কখোনই ওর কোনো কথা ফেলতে পারিনি।ইচ্ছে হলেই ফোন করে বলতো আজ আমাকে নিয়ে যেতে হবে আমি যেখানে যেতে বলবো।মানা করতে পারতামনা।ভালোবাসার মানুষের কোনো কথা ফেলে দেয়া যায়না।কখন যে দুজন দুজনের মনের ভিতরে স্থান করে নিলাম দুজনের কেউই বুঝতে পারলামনা।হাসি,কান্না,আনন্দ,বেদনা আর একজন আরেকজনের সুখ দুঃখের গল্পগাথা শুনতে শুনতে কবে যে একজনের মনের গহীনে আরেকজনের বসবাস শুরু হয়েছিলো তা বুঝতেই পারিনি।বুঝতে পারি সেদিন দুপুরে।
প্রতিদিনের মতো লাইব্রেরিতে বসে শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস দেবদাস পড়ছিলাম।আচমকা অনামিকা এসে হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে গেলো।
–কি হয়েছে অনামিকা?লাইব্রেরি থেকে এভাবে টেনে বাহিরে নিয়ে আসলে কেনো?সবাই কি ভাববে বলোতো।
–অনামিকা কোনো কথা বলছেনা।একনাগাড়ে কান্না করছে।
–একি তুমি কাঁদছো কেনো?বাড়ির কারো কিছু হয়েছে?
–তবু ও অনামিকা নিচু হয়ে কাঁদছেই।চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুললাম।কি হয়েছে বলোতো।
–আচমকা অনামিকা আমাকে জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,এতো বড় হয়েছে শুধু ঘাস খেয়ে খেয়ে।মাথায় একটুও গিলু নাই। একটা মেয়ের সাথে প্রতিনিয়ত থেকেও বুঝতে পারোনা,সে তোমাকে কতটা ভালোবাসে।তুমিমি বলবে সে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আজকে আর থাকতে পারিনি।আবির বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।
–আমার মনে তখন আনন্দের বাতাস বইছে।কারণ অনামিকা আমায় ভালোবেসে সে আনন্দে আমি তখন আত্মহারা।অনামিকার পরের কথাটুকু শুনতে পাইনি।আমি বলছি ভালোবাসো তো ভালো কথা।অনু তুমি কাঁদছো কেনো?শুনো,আজ থেকে আমি তোমায় অনু বলে ডাকবো।
–অাবির বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন।সামনের সপ্তাহেই বিয়ে।
–এটা কি বলো তুমি।আমি কি তোমাকে পাবার আগেই হারিয়ে ফেলছি অনু?না,এ আমি মেনে নিতে পারবোনা।তুমিই বলো অনু আমরা এখন কি করবো।
–আবির চলো আমরা বিয়ে করে বাবার কাছে যাই।বাবা তখন মেনে নিতে বাধ্য হবেন।
–না,অনু।এ হয়না।আমি বরং তোমার বাবার সাথে কথা বলে দেখি।অনু জয়তো জানতো তার বাবা কিছুতেই রাজি হবেননা।তাই সে বারবার না করেছে।
–অাবির বাবা যদি মেনে না নেয়।অনামিকার কন্ঠে আমাকে হারানোর ভয়।তবু তাকে বুঝিয়ে রাজি করালাম।সেদিনের মতো দুজনই চলে গেলাম।মনের মাঝে একরাশ স্বপ্ন আর সে স্বপ্ন পূরনের জন্য বুক ভরা একরাশ আশা নিয়ে।
তার পরের দিন,
সময় সকাল এগারোটা…
আমি বসে আছি অনামিকাদের বাড়ির ড্রয়িংরুমে।প্রায় দশ মিনিট পেরিয়ে গেলে আসলেন অনামিকার বাবা,মা।
–মনের ভিতরের সব সাহস এক করে সেদিন আমি অনামিকার বাবার কাছে বিয়ের কথাটা বল ছিলাম।কিন্তু উত্তরে অনামিকার বাবা যতটুকু বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হলো অনামিকার বিয়ে যেখানে ঠিক করা হয়েছে,সে পাত্র সিটিজেনশিপ।বিয়ের পর অনুর দুই ভাইকে বিদেশে নিয়ে সেটেল করে দিবেন।তাহলে কেনো তারা তাদের মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন।আমি অনামিকাকে পাবার আশায় দৃঢ প্রতিঙ্গ ছিলাম।তাই অনেক অনিনয় বিনয় করে বললাম,অনুকে সুখে রাখির দ্বায়িত্ব আমার।আর ওর দুই ভাইকে বিদেশে পাঠানোর সব টাকা আমি দিবো।গল্পের এর পরের অংশটা বেশ দ্রুতই ঘটেছে।
এর ঠিক দুদিন পর আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো।শর্তানুযায়ী অামি অামার ভাগের সকল জমিজমা বিক্রি করে অনুর দুই ভাইয়ের বিদেশ যাবার ব্যবস্থা করলাম।তার ঠিক দুবছর পর…
অনু আজকাল প্রায়ই অামার সাথে ঝগড়া করে।সংসারের টানাপোড়ন নিয়ে।একেতো অার্থিক অবস্হা ভালো ননা থাকায় মনের অবস্হা ও ভালো যাচ্ছিলো না।তার উপর রাতদিন ওর ঝগড়াঝাঁটিতে আমিও কিছুটা তিক্ত হয়ে গেছিলাম।ঝগগার এক পযার্য়ে অনু তার বাবার বাড়ি চলে যায়।কে জানতো অনুর এ যাওয়াটাই তার শেষ যাওয়া আমার অনু আর আমার ঘরে ফিরে আসবেনা।
–আমি অনুকে ফিরিয়ে আনতে তাদের বাড়ি যাই।গিয়ে জানতে পারি অনু ও বিদেশে চলে গেছে।উপহার স্বরূপ আমার জন্য রেখে গেছে ডিভোর্স পেপার।
মানুষের জীবনে সব হারালেও শেষ পর্যন্ত কিছু না কিছু থেকে যায়।কিন্তু আমার জীবনে বুঝি কিছুই রইলো না।যখন সকল সম্পত্তির ভাগাভাগির শেষ হলো,তখন আমার জীবন থেকে অনুও নিজেকে ভাগ করে নিলো।ভাগ শেষটাই শেষ ঠিকানা হলো আমার।ছোট বেলায় ভাগ অংক করতাম।শত চেষ্টায় ও অনেক ভাগ অংকের সম্পূর্ণ সমাধান সম্ভব হতনা।কিছুটা ভাগশেষ তো থেকেই যেতো।
মন মানতে না চাইলেও মানতে হবে আজ ওর সাথে আমার জীবনের সব কিছুর ভাগ শেষ হয়ে গেছে।এটা আদৌ কোনো কিছুর ভাগশেষ ছিলোনা আমার ভাগ্যটাই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
খুব সুন্দর হয়েছে। প্রিয়তমাকে আজীবন না পাওয়ার অপূর্ণতা রয়ে গেছে গল্পে। হয়ত কিছু ভালোবাসা এমনই হয় যার কোন উপসংহার হয় না। তবুও সেই ভালোবাসা মনের গহীন অন্তরালে থেকে যায়।
সম্ভবত লেখিকা খুব দ্রুত টাইপ করেছেন, যার জন্য প্রচুর মিস্টেক হয়েছে।
সুখি- সুখী।
গল্পগাথা- গল্পগাঁথা।
একাকি- একাকী।
হ্যা- হ্যাঁ।
ক্ষনিকের- ক্ষণিকের।
উলঠো- উলটো।
সংবরন- সংবরণ।
হেঁসে- হেসে।
দাড়িয়ে- দাঁড়িয়ে।
ইস্ততবোধ- ইতস্ততবোধ।
বিপরিত- বিপরীত।
প্রতিঙ্গ- প্রতিজ্ঞ।
অনিনয়- অনুনয়।
রাখির- রাখার।
দ্বায়িত্ব- দায়িত্ব।
ধন্যবাদ আপু।সত্যিই খুব দ্রুত লিখেছি।সামনে চেষ্টা করবো ভুলগুলো শুধরাবার।
সত্যিই খুব দ্রুত লিখেছি আপু।সামনে বানানের দিকে খেয়াল রাখবো।ধন্যবাদ আপু।
ভালো লাগলো গল্পটা।
প্রিয়তমাকে পেয়ে হারানোর বেদনা + কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মানুষকে কতোটা নাড়া দেয়!
লেখিকা খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বানানে বেশ কিছু ভূল আছে, শোধরে নেবেন। শুভকামনা ।।