ইসপিয়াক আহমেদ শিমুল
হাসপাতালের আইসিইউ রুমের বাহিরে বসে আছি। পাশে মা আর ছোট্ট ভাই , দু’জনের চোখেই পানি। শুধু আমি কাঁদতে পারছি না।
আমি যে পরিবারের বড় মেয়ে,আমি কাঁদলে মা আর ভাই’কে কে সামলাবে?
আইসিইউ তে বাবা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
নিজের বাবা না,সৎ বাবা।
আমি যখন তিন বছরের ছোট্ট মেয়ে , তখন আমার বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান।আমাকে আর মা’কে দেখার কেউ ছিল না।
মায়ের কলেজের এক বন্ধু মা’কে খুব ভালবাসতো,কিন্তু মা’কে কখনো তা বলে উঠতে পারেন নি।
যখন জানতে পারলেন বাবা মারা গেছেন,তখন তিনি মা’কে বিয়ের প্রস্তাব দেন।তিনি তখনো বিয়ে করেন নি।
মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না,অবশেষে আমার মুখের দিকে চেয়ে রাজি হলেন।আমাকে তো মানুষ করতে হবে।
ছোট্ট বেলায় মা আমাকে তাবাস্সুম বলে ডাকতো,বড় হওয়ার সাথে সাথে আরো একটা নাম পাই।আমার বাবা আমার নাম দেন জান্নাত।
ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি,বাবা আর মায়ের ভালবাসায়।
আমার যখন সাত বছর বয়স,তখন কে জেনো বলে উঠলো আমি যাকে বাবা বলে ডাকি তিনি আমার নিজের বাবা না।আমার সৎ বাবা।সৎ বাবা মানে কী?তখন সেটা বুঝতাম না।অনেকেই বলতো সৎ মা আর সৎ বাবা কখনোই ভালো হয় না।
আমার বাবা আমাকে খুব ভালবাসতেন,কখনো আমার সাথে রাগি ভাবে কথা বলেন নি,আমাকে সব সময় আদর করতেন।
তখন ভাবতাম আমার বাবা আমাকে খুব ভালবাসে,আমার বাবা আমার নিজেরই বাবা।তাই সৎ বাবা কী?তখন সেটা ভাবতাম না।
আমি ছোট্ট মানুষ,বাবা মায়ের ভালবাসা পাচ্ছি এটাই যথেষ্ট।
.
আমার যখন ১২ বছর বয়স,তখন একদিন বাবা মা’কে কিছু একটা নিয়ে কথা বলতে শুনলাম।
কৌতুহল নিয়ে লুকিয়ে আমি তাদের কথা গুলো শুনতেছিলাম।
— আমি চাই না,আমাদের আরও কোনো সন্তান হোক।
বাবা মা’কে বলতেছিলেন।
— কেন?তুমি কী বাবা হতে চাও না?
— আমি তো বাবাই।জান্নাত যখন আমায় বাবা বলে ডাকে তখন আমার মন জুড়িয়ে যায়।ধরো,আমাদের আরও এক সন্তান হলো।ওরা যদি সৎ ভাই বোন নিয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া করে তখন কী হবে?আমি এটা সহ্য করতে পারবো না।তাই আমি চাই না,আমাদের আরও কোনো সন্তান হোক।
এ কথা শুনে মা আর কিছুই বলেননি।
বিকালে আমি মায়ের কাছে গেলাম।
— মা,সৎ বাবা মানে কী?
— তোকে এসব কে বলেছে?
— লোকে বলে আমার বাবা নাকি আমার নিজের বাবা না?আমার সৎ বাবা।
— বড় হ মা,সব বুঝবি তখন।
আমি মা’কে আর কিছুই জিজ্ঞাস করিনি।
শুধু বলেছিলাম ‘ মা,আমার একটা ভাই চাই।’
.
এখন আমি চব্বিশ বছরের যুবতি।যখন আমার পনের বছর বয়স , তখন আমাদের জীবনে আসে আমার ছোট্ট ভাই আয়ান।তখন আমি জীবনের অনেক কিছুই বুঝি।
সৎ বাবা মানে কী?সেটাও ততদিনে আমি বুঝে গেছি।
আমার বাবা আমাকে সবসময় নিজের মেয়ের মতই ভালবেসে গেছেন,কখনো আমাকে সৎ মেয়ে মনে করেন নি।
আমার কাছে তিনি আমার নিজেরই বাবা।
— আপু,ডাক্তার ভিতরে গেছে।
ছোট্ট ভাই আয়ানের ডাকে ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরলাম।
ডাক্তার বাবার অবস্থা দেখার জন্য ভিতরে গেলেন।আমি,মা,আর ভাই বাহিরে বসে আছি।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে এলেন।
— ডাক্তার,আমার বাবার কী অবস্থা?
ডাক্তার কিছুই বলছেন না,চুপ করে আছেন।উনার চেহারায় ফ্যাকাসে একটা ভাব দেখা যায়।
— চুপ করে আছেন কেন?বলুন আমার বাবার কী অবস্থা?
— আমরা দূঃখিত,আপনার বাবা আর এই পৃথিবীতে নেই।
কথাটা শুনে আমি সেখানেই বসে পড়লাম।আয়ান আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।বাবার মৃত্যুর কথা শুনে মা সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন।আমার চোখও আজ বাধা মানছে না।মানবেই কেন?আজ যে জীবন থেকে অমূল্য কিছু একটা চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি।বাবা’কে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম।বাবার অনেক বন্ধুরা এসেছেন বাবার মৃত্যির সংবাদ শুনে। পাড়া-প্রতিবেশীরাও দেখতে এসেছেন।
.
রাত ন’টা,
আজ আমাদের বাড়িতে কোনো আঁলো নেই।কোনো শব্দ নেই,একবারে নিস্তব্ধতা।সন্ধ
্যায় বাবা’কে অন্ধকার কবরে শুইয়ে দিয়ে সবাই চলে গেছে।
বাবার মৃত্যুর পর মা অনেকবারই জ্ঞান হারালেন।মা’কে কোনো ভাবে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি।ছোট্ট ভাইটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি বাবার ছবিটা হাতে নিয়ে আমার ঘরে বসে আছি।আজ ছোট্ট বেলার সময় গুলো খুব মনে পড়ছে।
বাবার কাঁধে চড়ে মেলায় যাওয়া,হাতে হাত রেখে স্কুলে যাওয়া,আরো কত কী!মা আমাকে মারলে বাবা বলতো, ‘ আমার মেয়েকে একদম মারবে না।’
আজ সব শেষ হয়ে গেল। আর কখনো বাবা’কে ফিরে পাবো না।
একটু পর বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দায় দাড়িয়ে বাবার কবরটার দিকে তাকিয়ে আছি।কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম বাবার কবরটার দিকে।একটু পর আমার পা গুলো বাবার কবরটার দিকে এগুতে লাগলো।ধীরে ধীরে গিয়ে বাবার কবরটার পাশে বসলাম। কবরের মাটি গুলোর উপর হাত রেখে বাবাকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম।আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেড়োচ্ছে না।নিশ্চুপ হয়ে বাবার কবরের পাশে বসে আছি।রাত যে গভীর হয়ে গেছে সেদিকে আমার খেয়ালই নেই।হঠাৎ কাঁধে কারো হাত রাখা অনুভব করলাম।পিছু ফিরে দেখলাম আমার ছোট্ট ভাই আয়ান।
— আপু,চল ঘুমাবি।
আয়ানের চোখ দিয়ে এখন আর পানি পড়ছে না,কাঁদতে কাঁদতে হয়তো চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে।যাকে আমার আগলে রাখার কথা,সে আমায় আগলে রাখছে।
আমি কিছু না বলে আয়ান কে নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।
দুজনেই শুয়ে পড়লাম,আয়ানের শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।একটু পর আয়ান ঘুমিয়ে পড়লো। আমার চোখে আজ ঘুম নেই।বাবার সাথে সাথে চোখের ঘুমও আজ হারিয়ে গেছে।
যেই মানুষটা কখনো আমাকে সৎ মেয়ে মনে করেননি,নিজের মেয়ের মতই ভালবেসে গেছেন,সেই মানুষটা আজ না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন।আজ আরও একটা বুঝতে পারলাম। বাবা আর মা কখনোই সৎ হয় না,সৎ হয়ে যায় আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ।
আজ এই সমাজকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে ‘ বাবা কখনো সৎ হয় না। বাবা, বাবাই হয়।’
…সমাপ্ত…
‘ বাবা কখনো সৎ হয় না। বাবা, বাবাই হয়।’
খুব সুন্দরভাবে গল্পটি উপস্থাপন করা হয়েছে। অনেক ভালো লাগলো।
বাহিরে — বাইরে
মা’কে — মাকে
ভাই’কে — ভাইকে
করেন নি — করেননি (নি সবসময় শব্দের সাথে যুক্ত হয়)।
“বাবা আর মা কখনোই সৎ হয় না,সৎ হয়ে যায় আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ।” ভালো লেগেছে কথাটি।গল্পটাও অসাধারণ হয়েছে।
শুভকামনা