লেখক: ফরহাদ আকরাম
(মে – ২০১৮)
…………………
আজকাল রাতুল কে দেখলে বড্ড ঈর্ষা হয়। যদিও জানি ঈর্ষা খুব একটা ভালো জিনিস নয়, তবুও কেন জানি হয়ে যায়। রাতুল ইদানিং ব্লু কালারের একটা এপাচী বাইক কিনেছে। অবশ্য বয়সটাই তো বাইক নিয়ে দুরন্তপনা করার। ফুয়েল ভরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া। ওর বাবা শুনেছি দূনীতি কমিশনের বড় অফিসার। ওর মুখের গল্প ওদের নাকি বাজার করতে হয় না। আমি প্রথম তো বেশ অবাক হয়েছিলাম, কি ভালো ব্যবস্থা ওদের বাজার করতে হয় না। কোন কোন আংকেলরা নাকি বাজারের থলে পাঠিয়ে দিয়ে যায় গাড়ি করে। ওর মা কোন একটা স্কুল চালায় বাচ্চাদের ফ্রী পড়ায়। খুব শ্রদ্ধা হয় ওনার জন্য। পথ শিশুদের ফ্রি পড়াচ্ছে। ওরা অক্ষর জ্ঞান পাচ্ছে। কিন্তু আন্টি তো কিছুই করেন না, তাহলে টাকা পান কোথায়? প্রথম প্রথম ভাবতাম ওর বাবাই হয়তো ওনাকে স্কুর চালাতে টাকা দিয়ে থাকেন । বাহ কি সুখের ব্যাপার ।
রাতুল কে ঈর্ষা করার প্রথম কারণটা অবশ্য ভিন্ন। আমাদের কলেজের জুনিয়র তিতলীকে সে বাগিয়ে নিয়েছে। তিতলি তো আমার কাছে জীবন্ত প্রজাপতি। এত সুন্দর মেয়ে পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি যে নেই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। খুব ইচ্ছে ছিলো ওর সাথে বন্ধুত্ব করি। হয়তো এক ফাঁকে টুক করে মনের কথাটা বলে ফেলবো। কিন্তু সে কি আর ভাগ্যে সইলো। রাতুল বাইক নিয়ে ইদানিং কলেজে আসে, তার বন্ধুর সংখ্যাও বেশি। বেশি হবার পিছনে আরও একটা কারণ আছে। রাতুলের হাত খোলা খরচ, বিদেশী সিগারেট, ভালো ভালো রেষ্টুরেন্টগুলোর নিয়মিত খদ্দের। বন্ধুদের সব সময় খাওয়াতে পছন্দ করে। তাই হয়তো বন্ধুরা ওর জন্য প্রাণ বির্সজন করতেও দ্বিধাও করবে না। কলেজে যখন চিতা পড়া পুরাতন শার্ট পড়ে আসি, জুতো জোড়া যখন সাইনবোর্ড হয়ে দাড়ায় দরিদ্রতার, তখন দামী পারফিউম মেখে, ব্র্যান্ডের কাপড় পড়েই কলেজে আসে রাতুল। সত্যি আমার থাকলেও আসতাম। নেই তাই কলেজ ড্রেস পড়েই আসি, শরীর জুড়ে ঘামের নোনতা গন্ধে যে বিরক্তির উদ্রেগ হয় তা তো জানি। রাতুল এখন প্রায় চোখের সামনে দিয়ে তিতলীকে নিয়ে ছুটে যায়। তিতলীটাও কেমন বেহায়া কত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কোথায় যেন পালিয়ে যায়। ইচ্ছে করে তখন অনেক কিছুই ।
সন্ধ্যায় এ পথে অনেকেই হেঁটে যায়। এ পথেই আমি এক টুকরি কলা নিয়ে সন্ধ্যা থেকে বসে থাকি। কেউ কেনে।, কেউ দেখে দেখে হেঁটে যায়। কেউ কেউ ফ্রি খেয়ে চলে যায়। কিছুই বলার থাকে না। বলবো কি করে আমার তো ক্ষমতাধর পিতা নেই। নেই গায়ের জোর, আমার বাবা কোন কালেই ধনী বা শিক্ষিত ছিলো না। ট্রেনের বগিতে ঘুরে ঘুরে কান পঁচার মলম বিক্রি করতো। বিক্রি বাট্টা ভালো হলে বাজার করে বাড়ি ফিরতো। কখনও কখনও বিক্রি বাট্টা না হলে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়াতো খেয়ে না খেয়ে। বড় উদাসী লোক ছিলেন। ওনার এই ব্যবসা পরির্বতন করার জন্য মা কত তাগিদ দিয়েছিল, কিন্তু কে শোনে কার কথা তিনি এ ব্যবসা ছাড়বেন না। মাকে খুব রসিয়ে রসিয়ে বলতেন এটা নাকি তাঁর আবিষ্কার। স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ। আমি অবশ্য উনার ওষুধ লাগিয়ে কাউকে ভালো হতে দেখিনি। একবার বাবার বাসায় আসার খবর নেই, অনেক খোজ খবর নিয়ে জানলাম শান্তাহার জংশনে ট্রেনে কাটা পড়েছেন তিনি। কারা লাশও দাফন করে ফেলেছে। শেষবারের মত দেখা হলো না। আর দেখেই কি হবে। মা এ বাড়ি ওবাড়ি কাজ করেন। সরকারির অনুদানে সেলাই মেশিন পেয়েছিলেন, সেটা দিয়েই আমাকে আগলে এতটা পথ এসেছেন। ইদানিং মায়ের হাতে কাজ একদম কম, সবাই রেডিমেড কাপড়ের চাকচিক্যে আকৃষ্ট। কেউ আর এই মান্দাতার আমলের সেলাই করা জামা পড়তে চায় না। দিনের অধিকাংশ সময় দুঃশ্চিন্তা করতে করতে রোগ শোকে ভুগছেন। কত বছর ধরে আমাদের জন্য কোন আনন্দের সংবাদ আসে না। কোন সুখবর যা আমাদের মা ছেলের মুখে হাসি ফুটাবে ।
রাতুল নাকি নিয়মিত জিম করে। শুনেছি জিম করলে অনেক দুধ ডিম খেতে হয়। শরীরে ফিটনেস বলে কথা। দিন দিন ওর দিকে তাকানো যায় না। কি বডি, কি চেহারা, চকচকে সব। তিতলির তো ওর প্রেমে পড়াটাই স্বাভাবিক। আমার তো ঠিক মত ভাতই খেতেই কষ্ট হয়। কোরবানী ঈদে ধনীদের কল্যাণে খানিক গোশত খেতে পাই দুচারদিন। সারা বছর যা খাই তাতে স্বাস্থ্য হবে তো দুরের কথা, মাঝে মাঝে যে উপোস দিতে তখন তো পেটের ভিতরে গ্যাসট্রিক আলাসার হয়ে হয়তো নাড়িভুড়ি পচে যাবার জোগাড় তা কাকে বলি। গতকাল একজনের পায়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছি, বুদ্ধিটা অবশ্য দিয়েছিলেন আমার কলেজের এক স্যার। নির্বাচনী পরীক্ষার পর নোটিশ এলো, কোচিং অনির্বায। আমি এবং আমার মত গুটি কয়েক ছাত্রছাত্রী বলেছিল, এত টাকা দিয়ে কোচিং করবো না। আমাদের কোচিং না করে যা রেজাল্ট আসবে তাতেই খুশি, কিন্তু কলেজ এর গর্ভনিং কমিটির সিদ্ধান্ত কোচিং করো আর নাই করো সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু কোচিং ফি অনিবার্য। ভাবলাম পরীক্ষা বুঝি দেওয়া আরও কষ্টকর হলো। কলেজ কমিটির সভাপতির পায়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছি। তাঁর মন গলেনি। টাকা না দিলে পরীক্ষা দিতে দিবে না সাফ জানিয়েছেন। ওনার নাকি কমিটির সভাপতি নির্বাচন করতে অনেক খরচ হয়েছে । ফিরিয়ে দিলেন ।
আজকাল কলার ব্যবসায় মন নেই। ভাবছি কি করি, পরীক্ষা তো দিতে পারবো না, ড্রাগ বিক্রি করবো নাকি? রাতারাতি টাকা হবে। পরীক্ষা ফরীক্ষার গুষ্টি কিলাই। কিন্তু ড্রাগ ব্যবসা করবো কি করে, আমার তো সেই দাপট নেই। পুঁজি নেই। পুলিশ থেকে ছুটে আসার মত ক্ষমতা ধর পিতা নেই। তাহলে কি অস্ত্র হাতে তুলে নিবো, কন্ট্রাক কিলার হবো? এক হাজার টাকার পাইকারী ধরে মানুষ হত্যা করবো, কিন্তু এটা করতে গেলে শক্তিশালী হতে হবে। নতুবা খুন করতে গিয়ে নিজেই খুন হয়ে বসবো। তাহলে কি হবো জঙ্গী, আইএসআই, হরকাতুল বরাক বাঁশ, কিন্তু তারা আমাকে নিবে কেন? আমি তো ওদের তহবিলে অর্থ দিতে পারবো না, ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট না কি যেন চালায় তাও পারবো না, তাহলে কি করবো?
গত শেষ রাতে মা মারা গেছেন। উনি আমার কোচিং এর টাকার জন্য বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করেছেন। আমার মন খারাপ দেখে বলেছিলেন বাবা একটু সবুর কর নিশ্চয়ই টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তোর পড়াশোনা শেষ হলেই আমাদের সুখের দিন। আমরা খুব সুখে থাকবো বাবা, মা কে কি করে বলি এদেশে পিয়নের চাকুরীর জন্যও অনেক জায়গায় ঘুষ নেওয়া হয়। এদেশে অনেক জায়গায় এখনও ঘুষের টাকার জন্য ভিটেমাটি হারা হয় অনেকে। আমাদের তো তাও নেই মা। চাকুরী না হয় নাই করলাম, ব্যবসা করতে গেলেও ধনীদের টাকা তোড়ে ভেসে যেতে হয়। মায়ের লাশ নিয়ে বসে আছি। এলাকার কিছু লোক টাকা তুলতে গিয়েছে। টাকা তোলা শেষ হলে ওদের ভাগেরটা রেখে এরপর হয়তো মায়ের দাফন হবে। আমার মা ঘুমাবে, আমাকে একা রেখে যেমন একা করে গেছেন বাবা। যেমন একা করে দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। যেমন একা করে দিয়েছে তিতলী।
০ Comments