গল্প লেখকঃ
রেহেনা বেগম
(এপ্রিল – ২০১৮)
…………..
“তামান্না জানিস ঐ পাশের বাড়ির লায়লা মেয়েটা একদম ভালো না।” কথাটা বলল তানিয়া তার বান্ধবীকে।
উত্তরে তামান্না বলল,
আচ্ছা তোর কি কোন কাজ নেই। সারাদিন অন্যর কথা বলেই বেড়াস। এটা তো ভালো না।
তানিয়া বলল,আরে ধুর অন্যর কথা কোথায়? শোন না ঐ মেয়েটা একদম পড়াশুনায় কাচা। কিছুই পারে না। জানিস কালকে আমার কাছে এসেছিল গণিত বুঝতে।
– সে জানে না তাই এসেছে।
– আমি কি এমনি এমনি বলছি নাকি ও এসেছিল বিয়োগ বুঝতে। আমি তো হাসতে হাসতে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম।
– শোন তানিয়া, লায়লা অংকে কাচা সেটা আমিও জানি তার জন্য এত কথা বলতে হবে নাকি।
– মুখ ভেংচি দিয়ে তানিয়া বলল,যা বলব না।
– এভাবে কাউকে নিয়ে উপহাস করা ঠিক নয়। সবাইকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। কেউ কালো কেউ সাদা, জ্ঞানী, মুর্খ, ধনী,
গরিব সবাই আল্লাহর সৃষ্টি।
– তুই শুধু আছিস সবাইকে জ্ঞান দিতে। তোর কথা কী কেউ শুনে?
– সেটা জানিনা,তবে আমি তো আর ভুল কিছু বলিনা।
ব্যাগ হাতে নিয়ে তানিয়া বলল, ঠিক আছে আজ তাহলে উঠি। কাল কি কলেজ আসবি?
তামান্না বলল,হ্যাঁ আসবো। কিন্তু কেন?
-কালকে আসতে পারবো না। কালকে এক ভাইয়ের বৌ-ভাতে যাব।
-ওহ। নিশ্চয়ই নতুন ভাবির অনেক বদনাম বের করে পরশু আমাকে বলতে আসবি।
তানিয়া কিছু বলল না।
আচ্চা। ওকে,বাই,বলল তানিয়া।
“আসসালামু আলাইকুম”,বলল তামান্না।
লজ্জা পেয়ে তানিয়া আস্তে করে জবাব দিলো,ওয়ালাইকুম আসসালাম।
দুই বান্ধবী দুই পথ দিয়ে চলে গেল।এতক্ষণ ওরা কলেজের পুকুর পাড়ে বসে গল্প করছিল।
তামান্না একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সব সময় হিজাব করে চলে। নামাজ কালাম নিয়মিত পড়ে। মা আর দুই বোন নিয়ে ওদের পরিবার। বাবা দুই বছর আগে মারা যান। মাত্র কলেজ লাইফে পা দিল তামান্না আর তানিয়া।
তানিয়া বড় লোকের মেয়ে। নামাজ কালাম নাই। আছে শুধু একের কথা অন্যর কাছে বলার মতো বাজে অভ্যাস। মা বাবাকে নিয়েই তার পরিবার।
মায়ের সাথে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিল তামান্না। ওকে অন্য মনষ্ক দেখে তার মা বললেন,
কী রে তামান্না কী হয়েছে?
ঘোর কেটে তামান্না জবাব দিল,তানিয়ার কথা ভাবছি মা। ও শুধু পরনিন্দা করে বেড়ায়। এটা তো ভালো না। ওকে বুঝালেও বুঝেনা। কি করা যায় সেটাই বুঝতে পারছিনা।
– ওকে তুমি কুরআন, হাদীস দিয়ে বুঝাবে।
– মা ওকে অনেক বুঝিয়েছি।
– তাহলে তানিয়ার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া কর। আর বিশেষ এক বুদ্ধি বাতলে দিলেন।
দুদিন পরঃ
কলেজে ঢুকেই তানিয়া তার ক্লাসে ঢুকা মাত্রই শুনলো তার প্রিয় দুই বান্ধবী ইভা ও সিমা তার সম্পর্কে কি যেন কথা বলছে।তানিয়া দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকলো ওদের কথা শুনার জন্য।
ইভা সিমাকে বলছিল, জানিস তানিয়ার মত মেয়ে আমি একটাও বাংলাদেশে দেখিনি। আস্ত একটা হাড় কিপটে। আমি সেদিন ওকে বললাম, তুই আমাকে ২০টাকা ধার দে। আমার খুব প্রয়োজন। পরে দিয়ে দিব। ও কি বলল জানিস?
‘কী বলেছিল’,বলল সিমা।
ইভা বলল,
ও বলেছিল তুই অন্য একদিন ১০টাকা নিয়েছিলি ঐ টাকাটা এখনো দিস নি। তাই এখন ২০টাকা দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু সিমা, আমি ওর কাছ থেকে কোন দিনই টাকা নেই নি।
এভাবে ইভা ও সিমা অনেকক্ষণ গল্প করছিল তানিয়াকে নিয়ে। ওদের মিথ্যা গল্প শুনে চোখ লাল হয়ে যায় তানিয়ার। ক্লাসে না ঢুকেই আবার চলে যাচ্ছিল। এমন সময় তামান্না চলে এলো।
তানিয়াকে দেখেই তামান্না বলল, কী রে তোর মন খারাপ কেন? আর ক্লাসে না ঢুকেই দেখি আবার চলে যাচ্ছিস, ব্যাপার কী?
তানিয়া কিছুই বলছেনা। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে এই বুঝি পানি চলে আসল।
তানিয়ার কাধে হাত দিয়ে তামান্না বলল, কী হয়েছে তানিয়া। আমাকে সব খুলে বল।
ইভা আর সিমার কথাগুলো বলল তানিয়া। ওরা যে ওর সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছে এতে তার খুব খারাপ লাগছে।
তামান্না বলল,তাতে কী হয়েছে?
– তাতে কী হয়েছে মানে?
– তুই ওতো এভাবে অন্যর কথা বলে বেড়াস। তুই যেভাবে অন্যর কথা বলে বেড়াস। ওরাও তেমন তোর কথা বলে বেড়াচ্ছে।এতে মন খারাপের কি আছে।
-আমার খুব খারাপ লাগছে তামান্না।
-হ্যাঁ জানি। শুধু তোর কেন সবারই খারাপ লাগে।
-আমি এখন কী করব তামান্না।
-তুই অন্যর কথা বলে বেড়ানো এই বদ অভ্যাসটা বাদ দে। দেখবি তোর কথা কেউ বলবে না।
-তুই সত্যি বলছিস তো।
-হ্যাঁ। জানিস তো পরনিন্দা করা খুব খারাপ। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা বেশি বেশি ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই কতক ধারণা গুনাহ এবং গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান কর না। আর তোমাদের কেউ যেন কারও পেছনে গিবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? অথচ তোমরা তা ঘৃণাই কর। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী পরম দয়ালু।’ (সূরা আল হুজরাত :১২)
গিবত বা পরনিন্দা ব্যভিচার হতেও গুরুতর অপরাধ। সাহাবাগণ বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! গিবত কিভাবে ব্যভিচার অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ হতে পারে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ব্যভিচার করার পর মানুষ আল্লাহর নিকট তাওবা করলে আল্লাহ তাআলা তাওবা কবুল করেন। কিন্তু গিবতকারী ব্যক্তিকে যে পর্যন্ত ওই ব্যক্তি (যার গিবত করা হয়েছে) ক্ষমা না করে; ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। (মিশকাত)
হাদিসে এসেছে- ‘তোমরা গিবত বা পরনিন্দা করা থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ তাতে রয়েছে তিনটি ক্ষতি-
প্রথমত- গিবতকারীর দোয়া কবুল হয় না।
দ্বিতীয়ত- গিবতকারীর কোনো নেক আমল কবুল হয় না এবং
তৃতীয়ত- আমলনামায় তার পাপ বৃদ্ধি হতে থাকে। (বুখারি)
আর গিবত করার কারণে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়।
তানিয়া বলল,আমি তোর হাতে হাত রেখে ওয়াদা করলাম আর কখনো কারো গিবত করব না।
-সত্যি।
-হ্যাঁ। কথা দিলাম।
-মনে থাকবে তো।
-চিরদিন মনে থাকবে।
-তাহলে তো দেখছি মাকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়।
-কেন?
-আরে মা ই তো আমাদেরকে এই প্লান করতে বলেছিল।
-প্ল্যান। মানে কী?
এমন সময় ইভা আর সিমা এসে তানিয়াকে জড়িয়ে ধরল।
তামান্না বলল, ওরা এতক্ষণ নাটক করেছিল। ওটাই ছিল আমাদের প্লান। মা’ই আমাদেরকে এই প্লান বলেছিল। কারণ এই প্লান ছাড়া তুই বুঝতে পারতি না অন্যর কথা বলে বেড়ানো কতটা খারাপ।
তানিয়ার চোখ ছল ছল করছিল। ইভা,সিমা আর তামান্নার হাত ধরে বলল, সত্যি তোরা আমার চোখ খুলে দিলি। চল আমরা সবাই নতুন করে শপথ করি, কেউ যেন কোন দিন কারো গিবত না করি। তানিয়া হাত বাড়িয়ে দিল। আর একে একে সবাই হাতে হাত রেখে বলল, ইনশাআল্লাহ, আমরা আর কোন দিন কারো গিবত/পরনিন্দা করবো না।




০ Comments