গল্প লেখিকাঃ
-অসূর্যস্পর্শা রহমান
(মার্চ – ২০১৮)
…………..
আমি মিন্টু হাজারি। এই যে দেখতেছেন কবরস্থান, আমি এইটার পাহারাদার।আপনাগো কি মনে হয়? শুধু জিন্দা মানুষেরই নিরাপত্তা দরকার? ভুল। মরা মানুষেরও নিরাপত্তা লাগে। এই কবরস্থানটাই আমার ঘর। আমার বাড়ি। আমার সব। গত চাইর বছর ধইরা কবরস্থানের মাঝে ওই কুড়ে ঘরটায় আমি থাকি।ভরাইত জাইগা পাহারা দেই, কবরে গাছ লাগাই, ফলকের মুইছা যাওয়া অক্ষরগুলা ঠিক করি, আগরবাতি জ্বালাই, কবর জিয়ারত করি, আরো অনেক কাম। জানেন এইখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নাই।নওই যে দেখতেছেন কালোপাথর বাধানো কবরটা, ওইটা ইসমাঈল হোসেনের। উনি এই এলাকার ছয় বারের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর তার গা ঘেষানো যেই কবরটা আছে না? সেইটা করিম শেখের। এলাকায় রিকশা চালাইতো। এইখানে প্রায়ই লাশ দাফন হয়। কারও লাশ দাফনে পিপড়ার মত মানুষের ভীড় হয়। আতর গোলাপজলের গন্ধে বাতাস মৌ মৌ করে। আর কারো কারো লাশ ঠিক দাফন হয় নাকি খাদানো হয় বোঝা মুশকিল। অবশ্য এইসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগই বেওয়ারিশ লাশ হয়। এনজিও-টেনজিও থেইক্কা আসে। আমার আবার একটা সমস্যা আছে বুঝলেন। আমি লাশের মুখ দেখতে পারি না। প্রথমদিকে এক লাশের মুখ দেখছিলাম। মাথা ঘুইরা পইরা গেছি।ফাসঁ দেওয়া লাশ আছিলো মনে হয়। মাথায় তিনডা সেলাই লাগছিলো। এরপর থেইক্কা আর মুখ দেহি না। এমনিতে সব লাশের উপর আমার খুব মায়া হয়। প্রতি কবরস্থানেই খারাপ লোকদের আনাগোনা থাকে। এদের নজর থাকে লাশের হাড্ডিতে। হাড্ডি বেচলে নাকি অনেক টেকা। আইচ্ছা হাড্ডি কারা কেনে? শুনছি মেডিকেলে যারা পড়ে। কি ভয়ংকর না? মরা মানুষ লইয়া সাওদা। এই খারাপ লোকগুলা আমারে লোভ দেখায়।
“মিন্টু মিয়া এতবড় কবরস্থান। চাইর/পাচটা লাশ এদিক সেদিক হইলে কেউ টের পাইবো না। লাশ প্রতি পাচঁ হাজার। আর একবার ভাইব্বা দেখো। ভোর হওনের আগে কাম শেষ। নগদ টেকা হাতে হাতে”।
কিন্তু আমি ওগোর কথায় কান দেই নাই। এইসব কাম আমারে দিয়া হইবো না।আমি জিন্দা মানুষ লইয়া সওদা করবার পারমু তয় মরা মানুষ লইয়া না। ওইদিন মসজিদে ফিরোজ ভাইয়ের সাথে দেখা হইলো। উনার কাছ থেইক্কা জানতে পারলাম আমার বাজান আমারে পাগলের মতো খুজঁতাছে। ও হ আপনাগো তো কওয়া হয় নাই। গেরামে আমার বাজান আর এক বইন আছে। চাইর বছর আগে আমার বইনের যৌতুক দেওয়ার জন্য বাজান সব সম্পত্তি মহাজনের কাছে বন্ধক দিছিলো।বিষয়টা আমার মনে ধরে নাই। ধরবই বা ক্যান? ওই সম্পত্তিতে আমার হক নাই?বাজান আমার কথা একবারও ভাববো না। এইডা নিয়া বাজানের সাথে গ্যাঞ্জাম কইরা ঢাকা-শহর চইলা আসছি। এতদিন বাজানের কোনো খোজঁ নেই নাই। ফিরোজ ভাই কইলো বাজান নাকি অনেক কষ্টে আছে। দিনে একবেলাও ঠিকমত খাইতেও পায় না। মহাজন সব জমি দখলে নিছে। বাকি আছে হুদা বসত-ভিটা।আগামী হপ্তায় সেইটাও দখল নিবো। তয় আটত্রিশ হাজার টেকা দিতে পারলে বসত-ভিটা ছাড়ানো যাইবো। এহন বুঝতাছি আমি অনেক বড় অন্যায় করছি।আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গেরামে যাওয়া লাগবো। কিন্তু খালি হাতে গিয়া কি লাভ? টেকা লাগবো। টেকা। মাসের উপরি টেকাগুলা ইমাম সাহেবের কাছে জমা রাখতাম। হের কাছে খোজঁ নিয়া দেখি ছাব্বিশ হাজার দুইশত উনপঞ্চাশ টাকা আছে। অনেকের কাছে ধারের জন্য গেলাম। মিছা বলবো না। সামর্থ্য মত সবাই কম-বেশি দিছে। তবুও মাত্র ছয় হাজার টাকার মত হইলো। কিন্তু বাকি টাকা? মাইসের হাতে-পায়ে পইড়াও জোগাড় হইলো না। সপ্তা শেষ হইতে দুই দিন বাকি। কি করবো বুঝতেছিলাম না। ঠান্ডা মাথায় ভাবলাম। বারবার ভাবলাম। লাশের সওদা ছাড়া উপায় নাই। প্রথম প্রথম কোনোভাবেই মনডারে বুঝ দিতে পারতেছিলাম না। নিজের অনেক বুঝাইলাম। এইডা ছাড়া কোনো পথ নাই।লাশ তো লাশই। পরান নাই। কোনো কামে লাগে না। একটা লাশ বেচলে টেকা পাব।বসত-ভিটা ছাড়াবো। বাজান নিশ্চয়ই অনেক খুশি হইবো। একটা লাশই তো। জানেন আমি সত্যি সত্যি একটা লাশ বেইচ্চা দিলাম। বেওয়ারিশ লাশ। ঝামেলা কম। দুই দিন আগে কড়াই গাছটার নিচে দাফন হইছিলো। লাশ কেনা দলটা ভালা। হাত চালায়া কাম করে। আলো ফুটার আগেই কাম শেষ। নগদ ছয় হাজার টেকাও দিলো। একটা প্রশ্ন জানার জন্য মনডা খছখছ করতেছিলো। আচ্ছা লাশটা ওরা নিবো কেমনে? মনে হয় বহুত ঝামেলার কাম।
আমার ধারণা পুরাই ভুল। ওগো কাছে এইডা কোনো ব্যাপারই না। সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাকে কইরা দিব্যি লাশটা লইয়া গেলো। নিজের মইধ্যে খুব অপরাধবোধ কাম করতাছে। যাইহোক টেকা তো পাইছি। গেরামের বাজার থেইক্কা বড় একখ্খান তরমুজ নিছি। বাজান আবার তরমুজ খুব পচ্ছন্দ করে। গিয়া দেহি ঘর তালা মারা। আশেপাশের সবাই কইলো বাজান নাকি ঢাকায় গেছে আমার খুজঁতে।কিহ আজব। বুড়া একটা মানুষ, কিচ্ছু চেনে না। ঢাকা-শহরের নামও ঠিকমত শোনে নাই। সে নাকি ঢাকায় চইলা গেছে। তাও তিন তিনদিন আগে। খুব চিন্তা হইতাসে।গেরামের মুরব্বিগো লইয়া মহাজনের কাছে গেলাম। টেকা দিয়া ভিটা ছাড়াইলাম।আবার রাইতের ট্রেনেই ঢাকায় ফেরত আসলাম। মসজিদে, আশেপাশের মুদির দোকানে, বাসা-বাড়িতে খোজঁ করলাম। কোনো বুড়া মানুষ কয়দিনের মইধ্যে আমার খোজ করছে কিনা। কিন্তু কেউ কিছু কইতে পারলো না। শরীরে আর বল পাইতেছি না। বিছানায় শুইতেই একটা গন্ধ পাইলাম। এই গন্ধটা আমি চিনি। শুধু চিনি কইলে ভুল হইবো। খুব ভালা কইরা চিনি। গন্ধটা মনে হয় খাদেম সাহেব শরীর থেইক্কা আসতেছে। গেরামে যাওয়ার সময় খাদেম সাবরে কবরস্থানের দায়িত্ব দিয়া গেছিলাম।
-খাদেম সাব উঠেন। ও খাদেম সাব। আরে মিয়া উঠেন।
-চেচাইতাছেন ক্যান? ফিরলেন কহন?
-সেইসব কথা পড়ে হইবো। আগে কন,আপনি গায়ে কি মাখছেন?
-আতর। ক্যান?
-এই আতর কই পাইলেন। এই আতর আমার বাজান মাখে। সে নিজে বানায় এই আতর।
-কি কন আবোল-তাবোল? তিনদিন আগে কড়ই গাছের নিচে একটা বেওয়ারিশ লাশ দাফন হইলো না? ওই লাশের লগে একখান থলি আছিলো। সেই থলিতে পাইছি।
-থলি বাইর করেন। আমি দেখবো।
থলিডা চিনতে আমার কষ্ট হয় নাই। এইডা আমার দাদাজানে থলি। বাজান কখনো এইডারে হাত ছাড়া করে নাই। থলির মইধ্যে বাজানে বাতের ব্যাথার ঔষধ, চশমা, পাথরের আংটি, আল্লার নিরানব্বই নামের বই, সব খুইজ্জা পাইছি। এইসব আমার কাছে আছে।
যেই মাডিতে আমার বাজানে রক্ত-মাংস মিইশ্শা আছে, তাও আছে। হুদা হাড্ডিগুলা নাই।
০ Comments