লেখকঃ
তাহসিন আহমেদ ধ্রুব
(মার্চ – ২০১৮)
………………
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে ছিলাম। বিকেল বেলা এমনিতেই লোকজন অনেক বেশী থাকে। কেউ প্রেমিকা নিয়ে কেউ বা স্ত্রীকে নিয়ে। আমি আজীবনই একা মানুষ, তাই আমি একাই বসে আছি। যদিও আমার মতো একার সংখ্যাও খুব একটা কম নয়।
একটা ছোট্ট মেয়ে আমার হাত তিনেক দূরে এসে বসল। বয়স নয়-দশ বছরের বেশী হবেনা। মেয়েটার হাতে অনেকগুলো দুই টাকার নোট। সে নোটগুলো গোনা শুরু করেছে। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর মায়াকাড়া চোখ, আমি কখনো দেখিনি। দুধে আলতায় গায়ের রঙটার সাথে এতো সুন্দর দুটি চোখ, আমাকে ফেরাতে পারেনি। মনে হচ্ছিল যেন, জন্মগতভাবে কাজল মাখানো। গায়ে ময়লার কারণে রঙটা পরিস্কার নয় তবে আমি নিশ্চিত, এই মেয়েকে যদি সুন্দর করে গোসল করানো হয় তাহলে নির্দ্বিধায় রাজকন্যা বলে চালিয়ে নেয়া যাবে। মানুষ সবসময় সৌন্দর্যের অন্ধভক্ত। আমি কি করে ব্যতিক্রম হবো? আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ও আমাকে দেখে ভয় ভয় চাহনি দিয়ে টাকাগুলো লুকিয়ে ফেলল। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম,
— মামণি, তোমার নাম কি?
— রাণী।
এই নামগুলো সাধারণত এরকম নিম্নবিত্তরাই রাখে। আপনি রিকশাওয়ালা বাদশা মিয়া খুঁজে পাবেন, টোকাই রাজা মিয়া ও খুঁজে পাবেন। কিন্তু এই নামে ধনী লোক পাওয়া কঠিনই বটে।
— কি করো তুমি?
— “ভিক্ষা করি”, এমন ভাবে বলল যেন ভিক্ষা করা একটি মহৎ কাজ। এটা সবাই করে, সে ও করছে।
— আজ কত টাকা জমিয়েছ?
— আপনেরে কমু ক্যান?
— আচ্ছা, না বললে থাক। তুমি এই টাকা গুলো দিয়ে কি করবে?
— মার লেইগ্যা ওষুধ কিনুম।
— কি হয়েছে তোমার মায়ের?
— ক্যান্সার
— “ক্যান্সার? কর্কট রোগ বলে এটাকে বাংলায়”, আমি হাসলাম। কিন্তু মেয়েটি হাসলনা। সে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মনে হয় তার মায়ের রোগ নিয়ে এটা বলার জন্যই। কিন্তু সে জানেনা, আমার বাবাও এই কর্কট রোগেই মারা গিয়েছিলেন। শুধু সে জন্যই আজ আমি তার সামনে বসে আছি। অন্যথায়, আমি থাকতাম মাঠে, খেলাধুলায় ব্যস্ত। জীবিকা নির্বাহ তখন আমার কাজ হতো না, কাজ হতো পড়ালেখা।
নয়-দশ বছর বয়সী একটা মেয়ে তার মায়ের ক্যান্সারের(!) চিকিৎসার জন্য ভিক্ষা করছে। সামান্য কয়েকটা টাকা উপার্জনের মাধ্যমে একজন মায়ের জীবন বাঁচানোর ক্ষুদ্র চেষ্টা। এই চেষ্টা আদৌ সফল হবে কি? ভুল সময়ে ভুল জায়গায় জন্ম নেয়া এই রাজকন্যা মেয়েটির প্রতি সহানুভূতিতে আমার মন ভরে উঠলো। এমনিতে সে সময় সমস্যায় দিন কাটছে আমারও।
পকেট, মানিব্যাগ সবকিছু হাতড়িয়ে ১২১ টাকা পেলাম। সেগুলো মেয়েটির হাতে তুলে দিয়ে আমি চলে এলাম। একজন মায়ের বেঁচে থাকার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হিসেবে আমারও কিছু অবদান রয়ে গেল। যার মূল্য সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে আমার প্রাপ্য বলেই ধরে নিয়েছি। অধিকাংশ মানবসন্তান তো এ উদ্দেশ্যেই দান করে। তাই নয় কি?
জীবন জীবনের মতো চলে যায়। মধ্যবিত্ত জীবনের কষ্টগুলোকে মাড়িয়ে আমি পৃথিবীর পথে হেঁটে চলেছি। কারো কাছে চাইতেও পারছিনা, আবার ঠিকমতো আয়ও করতে পারছিনা। একদিন যন্ত্রণার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে পরদিন আবার ফিরে যেতে হচ্ছে পিষ্ট হওয়ার জন্যই। এটাই বাস্তবতা। এভাবেই চলে গেল পাঁচটি বছর। আমার হারানোর কিছু নেই। তাই আমি হারাইওনি। তবে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু, নতুন এসেছেও অনেক কিছু।
নাটকের অন্তিম দৃশ্য শুরুর স্থানে ঘটে কি না জানিনা! তবে এই নাটকের অন্তিম দৃশ্য শুরুর স্থানেই ঘটেছে।
সন্ধ্যা হয়েছে কেবল মাত্র। লোকজন সব চলে যেতে শুরু করেছে। মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য মুসল্লীরা ক্রমেই মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে আছি ঘাসের উপর। উদাস ভাবে সিগারেট টানছি। হলিউড ব্রান্ডের এই সিগারেটগুলোর দাম মাত্র তিন টাকা। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সিগারেট বলেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। আমি সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছি, আর সেগুলোই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। কিভাবে কুন্ডলী পাকিয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। এটাও একটা শিল্প। প্রতিটা জিনিসের মাঝে লুকিয়ে আছে শিল্প, যার সৌন্দর্যে আমরা বিমোহিত হয়ে যাই। শুধু দেখার জন্য একটা সুন্দর মনোভাব ও চোখ থাকা প্রয়োজন।
আমার সামনে এসে দাড়ালো দুইটি মেয়ে। অন্ধকার ভেদ করে যেন দুই দেবদূত এসে হাজির। সাজগোজ করা, শাড়ি পরিহিতা। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বলার মুড নেই এখন।
আমি জানি এরা কারা? কি চায় আমার কাছে? এরা হচ্ছে ভাসমান পতিতা। সন্ধ্যার পরে খদ্দের খুজতে এসেছে। লাল পাড়ের শাড়ি, পায়ে আলতা, ঠোটে লিপিস্টিক, কপালে টিপ দিয়ে এরা লোকেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করে যাতে সে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। এদের চাহিদা নিতান্তই কম। ২০০-৫০০ টাকা দিলেই এরা শরীর বিলাতে রাজি হয়ে যায়। কিছু উন্নত(!) দৃষ্টিভঙ্গির লোক এদেরকে জানোয়ারের বাচ্চা, পতিতা, মাগী, নষ্টা বলে। কিন্তু তারা জানেনা যে, একটা মেয়ে তার ইজ্জতটাকে শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে বিলিয়ে দেয়না। এর পিছনে লুকিয়ে থাকে হাজারো কষ্ট, কিছু প্রাণের দু’বেলা খাওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ আয় করার চেষ্টা। বিছানায় পরে থাকা বৃদ্ধ অক্ষম মানুষটির মুখে সামান্য খাবার তুলে দেওয়ার ইচ্ছা।
শুধু দিনশেষে নারী ভোগ করাই যাদের কাজ। তারা এটা কখনোই বুঝতে পারবে না। এমন কি আমিও না! একমাত্র ভুক্তভোগী ব্যতীত!
আমার দিকে ঝুকে এসে তাদের একজন বললো,
“আইজ কাস্টমার কম। ৩০০ দিলেই হইবো। এরম সুযোগ আর পাইবেন না।”, বলেই লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো মেয়েটি। চোখে বেদনা না কি কামনা, তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটা ঠিকই বুঝতে পারলাম যে, এই চাহনি আমার খুব চেনা। এই চোখ আমার অনেক পরিচিত। যে চোখের মায়ায় আমি একদা পরেছিলাম।
স্মৃতি আমাকে খুব একটা ধোঁকা দিল না। অতীত ফিরে আসলো দুচোখের মাঝে। পাঁচ বছর আগের সেই ঘটনা, মনে ফিরতে লাগলো বারবার। আমি শুধু বললাম,
“রাণী? রাণী না তুমি?”
চোখাচোখি হলো তাদের দুজনের মাঝে। পরক্ষনেই উধাও হয়ে গেল ছায়াদুটি। আমি তখনো অপলক চেয়ে আছি, যেখানে দাড়িয়ে ছিল দুই কামনাময়ী রমণী। যার একজন আমার বিস্তার হওয়া মনের অংশীদারত্বের অধিকার পাওয়া, রাণী। যাকে খুজেছি অনেক দিন। পাইনি কখনো। জীবন যুদ্ধের ২৩ বছর বয়সের একজন সৈনিক কি পারেনা একটি ১৫-১৬ বছরের পতিতাকে আপন করে নিতে? সুন্দর একটি জীবন উপহার দিতে? হয়তো পারে কিংবা পারে না। অথবা হতে পারে, সে চেষ্টাই করেনা।
আমি চারপাশে তাকালাম। কোথাও কেউ নেই। শুধুই অন্ধকার, সে তো বিদিশার নেশা। এভাবেই চলে যায় জীবন, কেউ যন্ত্রণায় ভোগে, কেউ হয়ে যায় পতিতা, কেউ হয়ে যায় ঐ দূর আকাশের তারা। মিল বলতে শুধু ঐ একটাই, “আমরা মানুষ।”
০ Comments